গদ্য

সুখ-দুঃখের কথা | চৈতালী চট্টোপাধ্যায় | জন্মদিন

সম্পাদকীয় নোট

গত প্রায় চার দশক ধরে কবিতা লিখছেন চৈতালী চট্টোপাধ্যায়। আমাদের বৈশ্বিক ও চারপাশের প্রতিদিনের দিনযাপনের, বিশেষ করে নারীজীবনের তীক্ষ্ণ-তীব্র বিষয়আশয় আর স্বতন্ত্র শৈলী ও স্বরের কারণে বাংলা কবিতায় তিনি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। একটি কাব্যগ্রন্থ থেকে আরেকটি কাব্যগ্রন্থে চৈতালী যেভাবে কবিতার জ্যোতির্ময় পরিভ্রমণে ব্যাপৃত রয়েছেন, তাতে তাঁকে এই সময়ের একজন উল্লেখযোগ্য কবি হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে সহজেই। সীমান্তের ওপারে কবিতাচর্চা করলেও বাংলা কবিতায় তাঁর অধিষ্ঠান।
আজ তাঁর জন্মদিন। এ উপলক্ষ্যে তীরন্দাজের পক্ষ থেকে তাঁর কবিতাচর্চার পথরেখা নিয়ে তাঁকে কিছু লিখবার জন্যে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। এই লেখাটি সেই আহ্বানেই রচিত। এতে তাঁর কবিতা-ভাবনার যেমন প্রকাশ ঘটেছে, তেমনি কবিতাভিযানেরও। চৈতালীর কবিতা বুঝবার জন্যে এটি প্রবেশক হিসেবে কাজ করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আমাদের অনুরোধে খুব স্বল্প সময়ে তিনি লেখাটি লিখে পাঠিয়েছেন বলে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
শুভ জন্মদিন, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়। আপনার পার্থিব ও সৃষ্টিশীল দীর্ঘায়ু কামনা করছি।

সুখ-দুঃখের কথা | চৈতালী চট্টোপাধ্যায়

…তার অনেক পরে, পড়া হবে রথী-মহারথীদের লেখা সেসব বই যার কোনোটা ব্যক্তিগত জার্নাল, কোনোটা-বা নোটবুক, চিঠিপত্র, মেময়ার্স কিংবা হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি, কবিতার মুহূর্তও বটে। আমার হাতের তেলোয় শুকনো জাফরিকাটা অশ্বত্থপাতার মধ্যে, আমার চিবুকে জমে ওঠা ঘাম কিংবা চোখে, অশ্রুবিন্দুর মধ্যে, গ্রীষ্মের খাঁ-খাঁ দুপুরে শরবতী লেবুর মতো চুম্বনের নোনতা স্বাদের মধ্যে পলকাটা পোখরাজ হয়ে ঝলসে উঠবে কবিতার অনুভব। কখনও অনুরাগে, কখনও-বা অপরাধবোধে।

আর অনেক পরে, আমার সদ্যোজাত শিশুকন্যার ঘুমন্ত ঠোঁটে দেয়ালা দেখতে দেখতে ঈশ্বর প্রত্যক্ষ করব আমি। আমার অনুভবে নেমে আসবে কবিতা।
তার অনেক পরে পতন ঘটবে কম্যুনিজমের। সিএনএন চ্যানেলে দেখতে পাব ওয়র্ল্ড ট্রেড সেন্টার তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল। গুলি ছুটবে,ধর্মঘট হবে, তাড়া খাওয়া পশুর মতো মারা পড়বে মানুষ ভিয়েতনামে, বাংলাদেশে, ইরাকে, ইরানে, আফগানিস্তানে, গোপীবল্লভপুরে, গুজরাতে, কিংবা নন্দীগ্রামে। ‘হ্যাঁ’ থেকে মুহূর্তে ‘না’ হয়ে যাওয়া অস্তিত্বগুলো দেখব আর লজ্জায়, ঘৃণায় জ্বলে উঠবে অনুভব, কবিতায়।

তার অনেক পরে, আয়নায় কনেচন্দন আঁকা আমার নিজেরই কপাল দেখতে দেখতে হিংস্র হয়ে উঠব আমি। পানপাতার আড়াল সরে গেলে জেগে উঠবে যে মুখ, যাকে নিঃসীম বৈধতায় রোজ রাতে শরীরের স্বাদ পেতে দিতে হবে অন্য পুরুষকে, সে এবার খোল থেকে থকথকে মাংসটাকেই শুধু আলাদাভাবে নিয়ে নেমে পড়েছে মাটিতে, কাদায়, বাজারে। ঘেঁটে যাচ্ছে। ছড়িয়ে যাচ্ছে। পুড়ে যাচ্ছে। মুছে যাচ্ছে। তখন, তখনও ভাইবোনের মতো তার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছে ছন্দ আর শব্দ।

গুগল ঘেঁটে প্রচুর মানুষের প্রচুর উক্তি পড়ছিলাম কবিতা প্রসঙ্গে। তারপরও, আমার কবিতাজীবন ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে লিখতে বসে শূন্যচোখে তাকিয়ে আছি। এখন, যেখানে থাকি, কান পাতলে ময়ূরের ডাক ভেসে আসে। জলফড়িং উড়ে বেড়ায় এদিক ওদিক। নাম না জানা ফুলের গন্ধ টের পাই। মনে হয় আবহজুড়ে এক মহাকবিতা লেখার আয়োজন চলেছে বুঝি, চাঁদোয়া খাটানো হচ্ছে, সুন্দরের। মন তখনই পরিপূর্ণভাবে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে দেখে নেয় একবার, মহামারি কীভাবে আছড়ে ফেলছে জীবন, কীভাবে সুর মুছে যাচ্ছে আফগানিস্তানে, কীভাবে ডুকরে কেঁদে ওঠে মৃতপ্রায় গণতন্ত্র আমাদের, আর অপমান সইতে না পেরে, মেয়েরা কীভাবে ধুঁকতে ধুঁকতে বেঁচে থাকে। না, আমি তখন আর ভেবে পাই না, কবিতার কোনো মহৎ উৎস কিংবা উদ্দেশ্য খুঁজব কি না। আবার, চকিতে আমার মন বলে, কবিতা আসলে মন্ত্রশক্তি। ভাবনা ঘন করতে করতে জলটুকু মেড়ে নিয়ে,যা পড়ে থাকবে, আলো বা কালো। আর তার সঙ্গে জুড়ে যায় নির্মাণকুশলতা। খুব ভাবছি, কোনো ঘটনা, কোনো দৃশ্য অথবা সুখদুঃখের অভিঘাত কি আমার মধ্যে কবিতার জন্ম দেয়? কোনো পুরাণের সাবটেক্সট, মহাকাব্যের নাটকীয় মুহূর্ত, রিকন্সট্রাক্ট করতে চাই আমি? সমসময়ের আদলে মেরামত করে নিতে চাই? সেই সম্ভাবনাটুকুই বুঝি লিখে-ফেলা কবিতা আমার! মগ্নচৈতন্য থেকে সে যখন গড়িয়ে নেমে প্রতিমা হয়, তখন আমি তাকে আয়ত্ত্বের মধ্যে পাই। এটাই মূল কথা। একই সঙ্গে সচেতন ও অসচেতন প্রয়াসের রসায়নে সে গড়ে ওঠে, এইমাত্র! আমার কবিজীবন যদি চোখ মেলে বোধবুদ্ধির উদয় হওয়া থেকেই লালন করি আমি, কবিতাজীবন কবে শুরু, সে বলতে পারব না। সবাই যা করে, সংসার, প্রথাসিদ্ধ চাকরি, সঞ্চয়, নিশ্চয়তা অর্জন, এসবের বাইরের কক্ষপথে ঘুরে মরব আমি, এটা শুরুতেই জানতাম। বেঁচে থাকব, মুহূর্তের ডানায় ভর করে, চরম নশ্বরতায়, জানতাম আমি। সে-যাপনে রং চড়িয়ে পরে কখনও বলব, কাঁচবসানো দেয়ালের ওপর দিয়ে হেঁটে গেছি…

কবিজীবনের কথা বলতে বসি যদি,তথ্যচিত্রের মতো একেকটা স্লাইড, পারিবারিক চরম যন্ত্রণার গ্লানি আর ইস্কুলের চ্যাপেলে সিস্টার একজন অর্গ্যান বাজাচ্ছেন, একটা ছোট মেয়ে বিভোর হয়ে শুনছে, এ দুটোকেই রাখতে পারি, সংলগ্ন। কবিজীবন হল এক বোয়াল মাছের হাঁ। ভেদাভেদ না করে সবটাই গিলে নিল টুপ্ করে। আমি আগুন খেলাম না বরফ চিবোলাম, সব সবটাই।

বিজ্ঞাপনের মেয়ে সিরিজটা লিখছি যখন, যেটুকু লেখার ক্ষমতা শুধু সেটুকু দিয়ে নয়, রীতিমতো গা-গতর দিয়ে। পাগলির মতো ঘুরে বেড়াতাম। ভাঙাচোরা কবরখানা। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। সন্ধের যাদুঘরের সামনে। আর্ট গ্যালারিগুলো। আর, বিজ্ঞাপনের মেয়ে শরীর পেত একটু একটু করে।

মা বলল, খুব ইচ্ছে করে, তোর একটা কবিতার বই দেখে যাব, ‘আমার বন্ধু পুণ্যব্রত পত্রী একদিন প্রেসিডেন্সীর সিঁড়িতে বসে পাণ্ডুলিপি পড়েটড়ে অপরূপ প্রচ্ছদ বানালো। তরুণ প্রিন্টার্স বই ছাপলো। তাপসদার প্রেসে নেশাধরানো ছাপাখানার গন্ধের মধ্যে বসে বসে প্রুফও দেখে দিলাম।
পয়লা বৈশাখের পরদিন, দশখানা বই হাতে, মাটিতে পা পড়ছে না এমন ভাবখানা নিয়ে বেরিয়েই দেখি মেডিক্যাল কলেজের সামনে একটা ঘোড়ার গাড়ি। থামিয়ে, জিগ্যেস করলাম ফ্রি স্কুল স্ট্রিট যাবে কি না। তারপর, আমার প্রথম কবিতাবই ঝোলাব্যাগে ভরে, এক্কাগাড়ি চেপে আপিসের দরজায় এসে নামলাম। ব্যাস্, তারপর আর কী, মার্কামারা কবি হয়ে গেলাম!

১৯৮৭ তে, বিজ্ঞাপনের মেয়ে সিরিজের একটা কবিতা এখানে তুলে ধরছি।

আঙুল উঁচিয়ে ডাকল সেই মেয়ে, ‘তীরে আছ? আমি যে এখনও ভাসছি জলে! ‘ওর হাতেপায়ে চিকচিক করছে জলবিন্দু, বুক পর্যন্ত ভীষণ স্রোত। এতক্ষণ ডাঙা ভেবে যেখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম, সেই মৃত চর আসলে এক ফেনা মাত্র, বুদ্বুদের মতো জলে মিলিয়ে গেল। আমার চারপাশে প্লাবনের শব্দ হইহই করে কেড়ে নিচ্ছে পায়ের তলার মাটি। মানুষজন তবু স্থির দাঁড়িয়ে হাসছে, গল্প করছে, শঠতায় ফুলে উঠছে চোয়াল। এত যে কলরব, ধ্বসে যাচ্ছে পার, টের পায় না কেউ। গৃহস্থবাড়িতে এখনও কেন শাঁখ বেজে উঠল না?
একা মেয়ে, তার গায়ে জ্বলছে রাশি রাশি টুনিবাল্ব, বুকজল ঠেলে বয়ে নিয়ে বেড়ায় অমঙ্গলের বার্তা। বেঁধে দেয় সংযোগের ছেঁড়া সুতো। ওপারে যে সালঙ্কারা বধূটি মাথা হেঁট করে বসেছিল, সে এবার একে-একে ভাসিয়ে দিল কনকচূড়, সিঁথি, সীতাহার। খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছে গহনা

এবার টাঙিয়ে দিই খুব সম্প্রতি লেখা কবিতা আমার।

সকাল আটটা আর রাত আটটার মধ্যে খুব একটা তফাৎ করি না এখন।
হিম-ধরা অপেক্ষা আমাকে দেখতে শিখিয়েছে
শুঁয়োপোকা কীভাবে প্রজাপতি-চেহারা নেয়,
তারপর ওর জন্য শালিকপাখি বসে থাকে!
আকাশ ক্রমশ সরু হয়ে আসছে,
রোদ ঝরে পড়ছে বাতাসের ওপর,
আমি যাকে নিষ্ক্রমণের পথ ভেবে ক্রমাগত ভুল করে এগোতে থাকি,
যতক্ষণ না মরা বাচ্চাকে হাওয়ার হাতে ছেড়ে দেয় তার ভূতে-পাওয়া-মা!
দাড়ি কামানোর ক্রিম ঘষছে যে,
মশারি টাঙায় যে,
জলের মতো, একরকম, মুখগুলোতে আজ
যে কোনও ভয়ই ভাসানো যাবে, জানি!

সবেমাত্র, মুক্তি বলতে তোমাকে চিনছিলাম।
অসুখ বলতেও, তুমি আমার মধ্যে ঢুকে পড়ছিলে।
তখনই মাঝখানের দরজাটা টেনে নামানো হল
এর মাঝখানে টুকে রাখা আছে, সাপ, পদ্মফুল, রক্ত ও মলমূত্রবীর্যের মধ্যে দিয়ে, আমার পুরো জার্নিপথ, ভ্রমণবৃত্তান্ত, দুরূহ এক লিপিতে। উৎসাহীজন, সংকেতমুক্ত করলে, দেখতে পাবেন কখনও।

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field
    X