যুদ্ধ শুধু জীবন আর ঘর-বাড়িই ধ্বংস করে না, একইসঙ্গে ধ্বংস করে বহু ভবিষ্যতের স্বপ্ন। রাজ্য, অর্থ, সম্পদ, লোভ, প্রতিশোধের বশবর্তী হয়ে পুরুষরাই অধিকাংশ যুদ্ধে জড়ায়। কিন্তু সব যুদ্ধেই সবচেয়ে বড় ক্ষতির শিকার হয় নারী ও শিশুরা। শুধু সম্ভ্রমহানি নয়, ঘর সংসার বাবা-মা-ভাই-বোন-স্বামী-সন্তান হারিয়ে বহু নারী হয়ে পড়েন সমাজচ্যুত। অথচ যে পরিস্থিতিতে তারা পড়েন, সেটা সৃষ্টিতে হয়তো নারীর কোনো দায়ই নেই। তবু্ও যুদ্ধের সবচেয়ে ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হয় নারীকেই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও তার ব্যতিক্রম না। নয় মাসের যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর ২ লাখ নারীর সম্ভ্রম, শত সহস্র বঞ্চনার বিনিময়ে এই পতাকা আমরা পেয়েছি। স্বাধীন দেশ সম্ভ্রম হারানো মা বোনদের বীরাঙ্গনা উপাধিতে ভূষিত করলেও, তা যে সমাজের সবাই মনে গেঁথে নেয়নি তার প্রামাণ্য দলিল ড. নীলিমা ইব্রাহিমের ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ বইটি। স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীদের চরম মূল্য চুকানোর কথা অনেকেই আমরা জানি, শুনেছি। কিন্তু যুদ্ধ শেষে তাদের কী হলো, কে কোথায় কীভাবে আছে, পরিবার-সমাজ তাদের কীভাবে গ্রহণ করেছে, তার একটি স্পস্ট চিত্র আমরা ৭ জন বীরাঙ্গনার বয়ানে এই বইতে পাই।
‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ বইটি এতটাই বহুল পঠিত যে, এর উপর ভিত্তি করে সময়ের অন্যতম গুণী নাট্যকার, নির্দেশক সৈয়দ জামিল আহমেদ মঞ্চে নাটক নিয়ে আসছেন শুনে চমকিত হয়েছিলাম। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বীরাঙ্গনাদের প্রতি নিজের দায়বদ্ধতা জামিল স্যার কিভাবে পূরণ করেন কৌতুহলী ছিলাম তা জানতেও। অবশেষে একদিন দেখেই ফেললাম স্পর্ধা ইনডিপেনডেন্ট থিয়েটার কালেকটিভের আলোচিত প্রযোজনাটি।
পাঠক একইসঙ্গে নাট্য দর্শক হিসেবে ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ আমার মধ্যে কী অনুভূতি তৈরি করলো সে আলোচনায় পরে আসছি। তার আগে জামিল আহমেদ এবং স্পর্ধাকে ধন্যবাদ দিতে চাই, টানা কিছু শো করে নাটকটির প্রদর্শনী বন্ধ করার সিদ্ধান্তের জন্য। গ্রুপ থিয়েটারের বর্তমান বাস্তবতায় বার বার মহড়ায় সবাইকে একত্রিত করার বহুবিধ হ্যাপা, প্রদর্শনী থেকে প্রদর্শনীতে একটি নাটকের মানের ক্রমাবনতি, হল না পাওয়ার যন্ত্রণা, দর্শকদের সময় স্বল্পতাসহ নানা সমস্যার মধ্যে খাবি খাওয়ার চেয়ে, নতুন নাটকের শো একটানা করে তা বন্ধ করাই আমার কাছেও যুক্তযুক্ত মনে হয়।
আসি নাটক প্রসঙ্গে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, বীরাঙ্গনা এবং যুদ্ধশিশুদের মর্মান্তিক জীবন বাস্তবতা ও তাদের বয়ান প্রায় ৫৩ বছর বয়সী এই দেশ এখনও নাটক-চলচ্চিত্রে সঠিকভাবে তুলে আনতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অধিকাংশ বাণিজ্যিক সিনেমায় এসব প্রসঙ্গ এসেছে স্থুলভাবে। কিছু কিছু সিনেমাকে তো নারী শিশুদের উপর পাকিস্তানি সেনার নৃশংসতা পাশবিকতা তুলে ধরা নয়; বরং কেবল ধর্ষণ দৃশ্য উপস্থাপনের দায়ে অভিযুক্ত করা যায়। তবে সিনেমার চেয়ে নাটকে খানিকটা হলেও পরিশুদ্ধভাবেই বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের প্রসঙ্গ এসেছে; কিন্তু সেটিকে পূর্ণাঙ্গ কিছু বলা যাবে না। সেদিক থেকে জামিল আহমেদের নাটক ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ বাংলাদেশের থিয়েটারে বেঞ্চমার্ক। কারণ ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, যুদ্ধকালীন নারীদের উপর বীভৎসতার কথা আমরা বহুভাবে শুনেছি। এখন প্রয়োজন যুদ্ধ-পরবর্তী তাদের জীবন সংগ্রাম, মনোযন্ত্রণা ও সমাজ বাস্তবতার নির্মম চিত্রগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরা। এতে যদি সমাজে খানিকটা হলেও প্রতিক্রিয়া হয়। আমি বীরাঙ্গনা বলছি বইটিতে আমরা সাত জন বীরাঙ্গনার তেমনই বয়ান পাই। নাটকে জামিল আহমেদ তেমনি দুই জনের বয়ান বেছে নিয়েছেন।
উপন্যাস, গল্প বা কোনো কবিতা থেকে কিংবা অবলম্বনে নাটক হলে দর্শক হিসেবে একটা বিপদ এসে উপস্থিত হয়। সেটা হলো তুলনার বিষয়টি চলে আসে। গল্প উপন্যাস পড়ে মাথার ভেতর কাহিনির যে চিত্রকল্প তৈরি হয়, নাটক তা মেটাতে পারলো কিনা অজান্তে তুলনা চলে আসে। সেদিক থেকে বলতে গেলে, আমি বীরাঙ্গনা বলছি নাটক সম্পর্কে আমার অনুভূতি মিশ্র। ড. নীলিমার বই পড়ে আমি এক ধরনের হতাশা, কষ্টে মুহ্যমান হয়েছিলাম বীরাঙ্গনাদের জন্যে। আতঙ্কিত হয়েছিলাম যুদ্ধকালীন তাদের অবস্থা পড়ে। পরে একবার ঘটনাচক্রে ইউটিউবে বইটির কিছু অংশের পাঠও শুনেছিলাম। সৎভাবে বললে, নাটক দেখে আমার এর চেয়ে ভিন্ন কোন অভিজ্ঞতা হয়নি। অথচ আমি নাটকে টেক্সটের অন্য কোনো উপস্থাপন আশা করছিলাম। আমি স্বীকার করছি, এই অতি আশার জায়গাটা আমার সীমাবদ্ধতাও। জামিল আহমেদ নির্দেশক হিসেবে কোরিওগ্রাফি, ইন্সটলেশন, লাইট, মিউজিকের মাধ্যমে নানাভাবে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন পাঠাভিনয়ের বিষয়টি থেকে বের হতে। কিন্তু খুব একটা সফল হয়েছেন বলে অন্তত আমার মনে হয়নি। তবে টেক্সট শক্তিশালী হওয়ায় এবং আবেগগত জায়গা থেকে অভিনয় শিল্পীদের কথাগুলো শুনতে ভালো লাগে।
নাটকের সংগীতে ঘাসফড়িং ক্যয়ার নামে আলাদা একটি দলকে যুক্ত করা দারুণ বিষয় ছিল। কিন্তু তাদের কতটুকু কাজে লাগানো গেল তা নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে। অভিনয় শিল্পীদের ডায়লগের মাঝে মাঝে এবং কোরিওগ্রাফির মধ্যে অপেরা ধাঁচে একই লয়ে তাদের গান, শুরুতে ইউনিক মনে হলেও, ধীরে ধীরে তা একঘেয়ে হয়ে যায়।
নাটকে ময়না চরিত্রে শারমিন আক্তার ভালো অভিনয় করেছেন। এক সময় ছাত্র রাজনীতি করা চঞ্চল উচ্চকিত একটি মেয়ে হিসেবে পরবর্তীতে জীবন সংগ্রামে স্রোতের বিপরীতে তার রুখে দাঁড়ানো ভালো ফুটিয়ে তুলেছেন শারমিন। মেহেরজান চরিত্রায়নে মহসিনা আক্তারও উজ্জ্বল। মফস্বল শহরের শান্ত শিষ্ট মেয়ে থেকে, যুদ্ধের ভয়াবহতা, পাকিস্তানি সেনার সঙ্গে বিয়ে, লাহোর চলে যাওয়া, সন্তান, বাঙালি হয়েও পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে জীবন সংগ্রাম, আত্মশ্লাঘা, দেশে আবেগময় ফেরা, আবার দেশ ত্যাগ দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। আমি বীরাঙ্গনা মেহেরজানকে দেখিনি। হয়তো তাকে অনুসরণ করেই মহসিনা রুমাল দিয়ে বার বার ঠোঁটের কোনা মোছা রপ্ত করেছেন। বিষয়টি দেখতে দারুণ লেগেছে। নাটকে তাদের সাহচর্য দেওয়া অন্য অভিনয় শিল্পীরাও ভালো করেছেন। কিন্তু যখন ময়নার স্বামী হারুন কিংবা বাবা-মা অথবা মানবাধিকার কর্মীদের চরিত্রে তারা এসেছেন, তখন অভিনয় ছিল দুর্বল। হয়তো ময়না আর মেহেরজানের বাইরে এই চরিত্রগুলো নির্দেশকের আলাদাভাবে মনোযোগ পায়নি। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা হারুনের চরিত্রটির অভিনয় আরও গভীরতা দাবি করে।
স্ক্রিপ্ট তৈরিতে জামিল আহমেদের ভুল ধরার ধৃষ্টতা আমার নেই। তবে মনে হয়, দুই বীরাঙ্গনার বয়ানে একই ধাঁচের কিছু সংলাপ বার বার চলে এসেছে। চাইলেই কিছু কেটে-ছেটে স্ক্রিপ্টটি আরও আঁটোসাট করা যেত। এতে নাটকের ডিউরেশনও কমে আসতো। শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলের প্রসেনিয়াম ফরম্যাটকে ভেঙে থ্রাস্টে রূপান্তর যথাপোযোগী হয়েছে। এর বাইরে নাটকের আলোক নির্দেশনা বেশ ভালো।
এতকিছুর পরও ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ নাটকটি বাংলাদেশের থিয়েটারে যে উল্লেখযোগ্য সংযোজন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেকদিন আগে ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ বইটি নিয়ে নাটক লিখেছিলেন গুণী অভিনেত্রী লাকী ইনাম। সে নাটক কোথাও মঞ্চায়িত হয়েছে কি না তা ঠিক জানি না। তবে সৈয়দ জামিল আহমেদ একই গল্প নিয়ে যেভাবে বীরাঙ্গনাদের আবার আলোচনার দৃশ্যপটে তুলে আনলেন তা সত্যি প্রশংসার যোগ্য। সময় এসেছে, নতুন প্রজন্ম নতুন ভাবনায় আবার বীরাঙ্গনাদের নিয়ে আলোচনা করুক। বীরাঙ্গনাদের ত্যাগ, তিতিক্ষা আর সংগ্রামের ইতিহাস জেনে তাদের নিয়ে গর্বিত হোক।
ছবি : সংগৃহীত