সম্পাদকীয় নোট : শুরুর আগে যৎকিঞ্চিত
নিজের উপন্যাসের প্রধান চরিত্রই গায়েব! হ্যাঁ, ঔপন্যাসিক সাদিক হোসেন মনে হয় এরকম এটা মতলব নিয়ে এই উপন্যাসটা লিখতে চাইছেন। তাঁর প্রধান চরিত্রের কোনো ছাপ যাতে উপন্যাসে না লাগে, সেই পথে তিনি এগুতে চেষ্টা করছেন। প্রধান চরিত্রকে প্রান্তিকতম চরিত্রের দিকে ঠেলে পাঠানোই যেন তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু এইটা করতে গিয়ে তিনি অদ্ভুত সব ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছেন। প্রথমেই একটা বিজ্ঞ বেড়ালের উপস্থিতি ঘটছে। এরপর একজন ফরাসি লেখক কোনো কারণ ছাড়াই চলে আসবেন কলকাতায়। কিন্তু কেন তিনি আসবেন? কলকাতায় এদিকে চলতে থাকবে নাটক – ফ্যাসিবিরোধিতার নাটক। এইসব ঘটনা আর নাটকই যেন জীবনের অনিঃশেষ গল্প এই উপন্যাসের : ‘সাজিদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই’। কিন্তু সত্যিই কি নেই? সেই রহস্য উন্মোচনের জন্যে শুরু করুন এই উপন্যাসটি পড়া।
তো সাদিক হোসেন কে, সেকথা বলি।
সাদিক হোসেন ১৯৮১ সালের ১১ই ডিসেম্বর দক্ষিণ ২৪ পরগণার মহেশতলায় জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ইনফর্মেশন টেকনলজি নিয়ে পড়াশোনার শুরু। কিন্তু এই পড়াশোনা ব্যবহারিক অর্থে বৃথা যায়। পরবর্তীকালে মাল্টিমিডিয়া চর্চা করে বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করছেন।
ইতিমধ্যে অনেকগুলো বই বেরিয়েছে সাদিক হোসেনের। প্রকাশিত গ্রন্থ : দেবতা ও পশুপাখি (কবিতা সংকলন, ২০০৭) সম্মোহন (গল্প সংকলন, ২০১১), মোমেন ও মোমেনা (উপন্যাস, ২০১৪), গিয়াস আলির প্রেম ও তার নিজস্ব সময় (গল্প সংকলন, ২০১৪), রিফিউজি ক্যাম্প (গল্প সংকলন, ২০১৭), মোন্দেলা (উপন্যাস, ২০১৯), হারুর মহাভারত(গল্প সংকলন, ২০১৯), আনন্দধারা (গল্প সংকলন, ২০২১)।
পুরস্কারও অর্জন করেছেন তিনি। ‘সম্মোহন’ বইটির জন্য পেয়েছেন সাহিত্য আকাদেমি যুবা পুরস্কার (২০১২) ও ডলি মিদ্যা স্মৃতি পুরস্কার। ‘গিয়াস আলির প্রেম ও তার নিজস্ব সময়’ বইটির জন্য পেয়েছেন নমিতা চট্টোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার (২০১৫)।
এবার উপন্যাসে প্রবেশ করুন। উপন্যাসটি তীরন্দাজ-এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে। আজ পড়ুন প্রথম পর্বটি। এখানে জনান্তিকে বলে রাখি, সাদিক হোসেন প্রায় দুই বছর আগে এই উপন্যাসটির কথা আমাকে প্রথম বলেন। এরপর লেখা শুরু করলেন মাত্র কিছুদিন আগে। শেষ অব্দি অনেকবার মনে করিয়ে দেয়ার পর উপন্যাসটির দুটি পর্ব দিয়েছেন। পরবর্তী পর্বগুলি আশা করছি নিয়মিতই পাওয়া যাবে। সাদিক উপন্যাসটি তীরন্দাজকে দেয়ার জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। শেষ কথা, উপন্যাসটি কেমন লাগছে জানাতে ভুলবেন না।
সাজিদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই
পর্ব ১
যাকে বলে ছায়াসুনিবিড়, ক্যাফেটা আসলে তাই। সাদার্ন এভিনিউ ধরে সোজা গোলপার্কের দিকে এগোতে থাকলে বামদিকে একটা ছোটো বাঁক। চারচাকা ঢুকবে না। ফলত, নাক বরাবর হাঁটা ছাড়া উপায় নেই। রাস্তাটাও তেমনি। অযত্নের পিচ কবেই উড়ে গেছে। একদিকে ভাঙা পাঁচিল। উঁকি না দিলেও বোঝা যায় ভেতরে একখানা পোড়ো বাড়ি রয়েছে। নিশ্চিত শরিকি ঝামেলা। মালিকানা নিয়ে বিবাদ চলছে। তা না হলে এইখানে পতিত জমি থাকাবার কথা না।
বাইরে কোথাও সাইনবোর্ড নেই। আমরা একটা লোহার গেটের সামনে এসে দাঁড়ালাম। এলা লোহার গেটটা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল।
সুড়কির রাস্তা। দু’পাশে সারি সারি নারকেল গাছ। তাদের ছায়ারা লাল সুড়কির উপর এঁকেবেঁকে বিলি কাটছে। শীত সবে পড়তে শুরু করেছে। তবে বিকেলের দিকে কলকাতায় তেমন আমেজ পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু এখানকার বাতাবরণ বেশ ঠাণ্ডা। ছায়ার জন্য। গা শিরশির করছিল।
আমি খেয়াল করিনি।
এলা ইশারা করল।
ততক্ষণে আমরা একতলা বাড়িটার সামনে। পেল্লাই কাঠের দরজাটা আধখোলা। তাতে ছোট্ট নেমপ্লেট। পেতলের উপর খোদাই করে লেখা – ব্রিয়াগনি ক্যাফে।
দু’বার নক করতেই একজন সুপুরুষ হাজির হলেন। এলা জানাল তার টেবিল বুক করা রয়েছে। সুপুরুষটি মুচকি হেসে তাঁকে অনুসরণ করতে বললেন।
আমরা একটা সরু লন পেরিয়ে বাড়িটার পেছনদিকে পৌঁছলাম। সেখানে ছাদনার তলায় চারটে টেবিল ফেলা। চারটের মধ্যে তিনটিই দখল হয়ে গেছে। হাল্কা আড্ডার মেজাজ চারদিকে গুনগুন করছিল।
এলাকে জিজ্ঞেস করলাম, এটার সন্ধান পেলি কোত্থেকে?
সে রহস্য মিশিয়ে বলল, আলেক্সা।
আলেক্সা?
আজ্ঞে। সে দু’ঢোক জল খেয়ে কফির অর্ডার দিল। বলল, প্রথমে কফি নিয়ে দেখি। পরে যা-কিছু খাওয়া যাবেখন।
সেতো বুঝলুম। কিন্তু আলেক্সা?
ওহ, তুই এখনো সেটার মধ্যেই আছিস? তাহলে শোন। এবার কলকাতা ফেরবার পর থেকেই যাচ্ছেতাই মন খারাপ। কারোর সঙ্গেই দু’মিনিট কথা বললেই ঝগড়া বেঁধে যাচ্ছে। কী যে বাকোয়াস অবস্থা। একদিন আলেক্সাকেই জিজ্ঞেস করলুম কলকাতায় হচ্ছেটা কী? সে বেটি এত কিছুর সন্ধান দিল যে আমি ঘাবড়ে গেলুম। একেবারে সবলা মেলা থেকে দাবা প্রতিযোগিতা। শোনবার পর মনে হল, দুনিয়াতে যা-কিছু হচ্ছে, সব শালা এই কলকাতাতেই হচ্ছে। তারপরেই টুইস্ট।
কেমন?
ভাবলাম এতকিছু যখন কলকাতায় হচ্ছে তখন বাইরে বেরিয়ে আর লাভ নেই। শুয়ে শুয়ে গল্প পড়ব। এদিকে প্রতিবার যা হয় – সেটাই ঘটল। বহুদিন মপাসাঁ পড়া হয়নি। ভাবলুম ঐ ব্যাটাকেই পড়ি। এদিকে বইটাই খুঁজে পাই না। আলমারি থেকে সবকটাকে নামালুম। খাটের তলা থেকে গুচ্ছের ম্যাগাজিন বের হল। কোথাও মপাসাঁ নেই। নেশাখোর বুড়ো গেল কই? কেঁদে ফেলবার অবস্থা তখন। একসময় চেঁচিয়ে উঠলাম – এক্ষুণি মপাসাঁর খোঁজ না পেলে কলকাতায় আর একঘণ্টাও থাকব না। ও বাবা, আলেক্সা কী ভাবল কে জানে – সে আমার বইটার সন্ধান দিতে পারল না বটে – কিন্তু এই ক্যাফেটার ঠিকানা বাতলে দিল।
আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। বললুম, ঢপবাজ।
ইতোমধ্যে কফি এসে গেছিল।
এলা বলল, হ্যাঁ, তোকে ঢপ দিয়ে আমি বড়োলোক হব।
শালা আর কতো বড়োলোক হবি?
ধুর, শোন না কথাটা।
আগে বল মপাসাঁর কী হল।
সেটাই বলছি। এলা কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, আসলে ব্যাপারটা বেশ জটিল। প্রথমে আমিও বিশেষ বুঝতে পারিনি। কিন্তু ঐ যে, ব্রিয়াগনি নামটা মাথায় গেঁথে গেছিল। এর পরের ঘটনা আরও চমকপ্রদ। মানে, পুরোপুরি রূপকথা টাইপ।
তাহলে রূপকথাটাই শুনি।
পাশের টেবিলে একজন সুন্দরী বসেছিলেন। ধবধবে সাদা পা। আমি সেই দিকে মুখ ঘোরালাম। এলা চামচ দিয়ে আমার মুখটা তার দিকে ফিরিয়ে বলল, এবার কলকাতায় ফিরে রাসেল এক্সচেঞ্জ থেকে পেল্লাই সাইজের একটা বাথটাব কিনেছিলুম।
ওকে বাধা দিয়ে বললুম, আচ্ছা, এটা কি সাহেবভূতের রূপকথা?
সে পাত্তা দিল না, একদিন হল কী, বাথটাবে শুয়ে আকাশপাতাল ভাবছি, হঠাৎ মনে হল – কে যেন ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে। না, ঠিক পায়চারি করছে মনে হল না। পায়ের শব্দ পাইনি। কিন্তু বুঝতে পারছিলুম ঘরের জিনিসপত্র নিয়ে কেউ নাড়াচাড়া করছে। মায়ের আমার ঘরে আসার কথা না। সে বেচারি এখন খাট থেকে একা উঠতেই পারে না। এদিকে ভেবে দেখলুম, আমি তো ঘরের দরজা বন্ধ করেছি। কারোর ঘরে ঢোকবার প্রশ্ন নেই। তাহলে এলো কীভাবে? কে এলো?
এটা রূপকথা, না ভৌতিক গল্প?
তা ভৌতিকরূপকথা বলেও তো কিছু হতে পারে। আগে পুরোটা শোন। ভয়ে ভয়ে কোনোরকমে গায়ে টাওয়েল জড়িয়ে উঠেছি, অমনি কী যেন ভারি জিনিসের মেঝেয় পরবার আওয়াজ পেলাম। হাতের কাছে একখানা বাথরুম পরিষ্কার করবার ব্রাশ ছিল। সেটা নিয়ে উঁকি দিতেই কী দেখলাম জানিস?
বেড়াল?
এক্স্যাক্টলি। বেড়াল। এখন তুই বলবি এসব তো হয়েই থাকে। নিশ্চয় হয়ে থাকে। আরে বাবা, যদি না এসব হত গল্প-উপন্যাসে এমন ভুরিভুরি সিচ্যুয়েশন থাকবেই বা কেন? কিন্তু মজার ব্যাপার হল বেড়ালটার সঙ্গে আমার দোস্তি হয়ে গেল।
মানে গল্পের বেড়াল গাছে উঠছে?
একদমই তাই। এলা হেসে ফেলল, মানে, একদম কথাবার্তা অব্দি শুরু হয়ে গেল। সেদিন ঢিপঢিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। প্ল্যান ছিল ওর সঙ্গে কফি খেতে খেতে আড্ডা দোবো। কিন্তু সে-ব্যাটার মতলব অন্য। গোঁসা করে ইজি চেয়ারে বসে বসে দুলছে। কফির গন্ধ তার নাকি নাপসন্দ। আমিও তেমনি। ঘরের মালিক আমি। আর তুমি হলে মানবেতর। তা তোমার কথা শোনা হবে কেন? হয় বশ্যতা স্বীকার করো, নয় তো দূর হটো। আর তখনি একবার বিদ্যুৎ চমকালো। মা ডাকল পাশের ঘর থেকে। বেড়ালটা ম্যাও করল ইজি চেয়ারে বসে। আর আমি সূত্রটা পেয়ে গেলাম। ঝরঝর করে মনে পড়ল মপাসাঁর গল্পটা।
বেড়ালটা কি হুলো?
এলা বিরক্তি দেখিয়ে বলল, তোর কী মনে হয়?
আমি অকপট, হুলো।
আ ভেরি পুওর হুলো। স্যাঙ্গুইজ খাবি?
সে উত্তর করতে দিল না। পাল্টা বলে বসল, আচ্ছা আমি কি ভাট বকছি?
নিশ্চয়।
কিন্তু ঘটনাটা জটিল আর চমকপ্রদ মনে হচ্ছে না? রহস্যাবৃত?
না।
এবার তুই কিছুক্ষণের জন্য মপাসাঁকে দূরে সরিয়ে রাখ।
রাখলাম।
কোথায় রাখলি?
তোর বাথটাবে।
আহ, রোমান্টিক। সে-যাই-হোক, মপাসাঁ তো এখন বাথরুমে। সুতরাং, মপাসাঁ এখানে নেই। এইবার তুই বল। এতো নাম থাকতে তোর বেশিরভাগ চরিত্রের নাম সাজিদ কেন? অবশ্য তুই না বললেও আমি খানিকটা অনুমান করতে পারি। আলরেডি একটা থিয়োরি নামিয়ে ফেলেছি।
একেবারে থিয়োরি!
আমি ঘাবড়ে গেছিলাম। প্রতিটা গল্পের পেছনে কতো যে মনোবাঞ্ছা থাকে তা তো গল্পকার ছাড়া আর অন্য কেউ জানে না – জানবার কথাও না। বরঞ্চ জানলে কেলেঙ্কারি ঘটে যেতে পারে।
এলা একখানা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল।
আমি উদগ্রীব। ওর থিয়োরিটা কী জানতেই হবে।
এলা বলল, তেমন কিছুই না। তোর নামের সঙ্গে সাজিদ নামটার মিল রয়েছে। লেখবার সময় নিশ্চয় নিজের মতো কারোকে কল্পনা করে লিখিস।
স্পষ্টতই বোঝা গেল, আসল থিয়োরিটা সে চেপে গিয়েছে। আমি তবু দমবার পাত্র নই। জিজ্ঞেস করলুম, মানে সাজিদের আড়ালে আসলে আমি নিজেই রয়েছি – এটাই বলতে চাইছিস? যেমন ক্যাফেটার সঙ্গে মপসাঁ? এটা একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না?
তা বটে। বাড়াবাড়ি আছে। কিন্তু মিল তো রয়েইছে। আমি চোখের সামনে দেখতে পাই।
দেখতে চাইলে যা-ইচ্ছা দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু প্রমাণ তো করতে পারবি না।
তোর বুঝি সবকিছুতেই প্রমাণ লাগে? এই প্রমাণ চাওয়ার ব্যাপারটা একধরণের পাওয়ার প্রাক্টিস।
কিন্তু প্রমাণ ছাড়া থিয়োরি নামাবি কী করে?
তা বটে। এলা বিল মিটিয়ে বলল, এখানে এসেছিলাম অন্য একটা কারণে। একটা কার্পেট কিনব। অদ্ভুত কার্পেট। সেটা নিয়ে তোর পরামর্শ চাইব ভেবেছিলাম।
প্রথমে মপাসাঁ, তারপর সাজিদ, আর এখন কার্পেট। আমার আর বিস্মিত হবার সুযোগ ছিল না। তা কোথা থেকে কিনবি? বড়বাজার?
বড়বাজার! এলা যেন আকাশ থেকে পড়ল, কী নভেলিস্টিক ইমাজিনেশন!
সে একখানা উবার বুক করে ফেলেছে। মোবাইলে দেখাচ্ছে সেটা তিন মিনিটের মধ্যেই বড়োরাস্তায় এসে পড়বে।
আমরা ক্যাফে থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম। সেই পিচ-ওঠা রাস্তা, ভাঙা পাঁচিল। পাঁচিলের ওপারের পোড়োবাড়ি যেন কোমরভাঙা বুড়োর মতো ঝিম মেরে বসে আছে। কথাটা আর চেপে রাখলাম না। বলে ফেললাম, তোর মপাসাঁ সমগ্রটা আমার কাছে রয়েছে।
তুই কবে নিয়েছিলি?
নিয়েছিলাম। আর ফেরত দিইনি। ভেবেছিলাম ঝেড়ে দোবো।
এলা ক্যাবে উঠে চলে গেল।
শেষ নভেম্বরের বিকেল। খানিক পর সন্ধে নামবে। তবে আর আগে একধরণের সোনালি আলো সাদার্ন এভিনিউয়ের গাছগুলোর মাথায় খেলা করে। বান্ধবী চলে যাবার ঠিক আগে যেমন তার বন্ধুর দিকে আড়চোখে তাকায় একবার – ঠিক তেমনি ক্ষণিক এই সোনালি আলো। এই আলো বেশিক্ষণ স্থায়ী থাকে না।
আমি একা হাঁটছিলাম। এলা সাজিদের সঙ্গে আমাকে গুলিয়ে ফেলছে কেন? তার মতো একজন শিক্ষিত মেয়ে, যে আবার সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছে, তার তো এমন ছেলেমানুষী করা উচিত নয়।
প্রধান চরিত্রের নাম ‘সাজিদ’ – এমন গল্প আমি আট-দশটা লিখেছি। প্রতিটা সাজিদই পরস্পরের থেকে আলাদা। কেউ স্কুলশিক্ষক, কেউ পুলিশ, কেউ আবার দর্জি। একটি গল্পে তো সাজিদ ছিল সোনাগাছিতে বেশ্যার দালাল। শেষপর্যন্ত সে লটারিতে পুরস্কার জিতেছিল। তা, এতোগুলো সাজিদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কোথায়? সজ্ঞানে কোনো সাজিদের ভেতরই আমি নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চাইনি। বরঞ্চ সবসময় আমার প্রচেষ্টা থাকত সাজিদের থেকে আলাদা থেকে যাবার। তবে কি সচেতনভাবে আড়াল হতে চেয়েছি বলেই আমি নিজেকে প্রকাশ করে ফেলেছি?
রাতে এলাকে ফোন করলাম।
এলা বলল, কার্পেট। ব’লেই ফোনটা কেটে দিল। আমি পাশ থেকে মিয়াঁও শব্দ শুনেছিলাম।
ঘুম আসছিল না। জানালা খুললে হাল্কা কুয়াশার ভেতর কালো আকাশ দেখা যাচ্ছে। কালো কালো গাছের পাতা। কালো কালো পাশের বাড়ি। কালো পুকুর।
বুঝতে পারছিলাম – সাজিদের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক এবার ত্যাগ করতে হবে। কীভাবে ত্যাগ করব? সে না হয় আমার প্রতিচ্ছবি হল না। কিন্তু সে যদি আমার বিপরীত প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে! ভয় লাগছিল। সাজিদকে দেখতে পাচ্ছিলাম। সে সাদিক আর না-সাদিকের পরিধির বাইরে যেতে চাইছে। তাকে সেখানে পাঠাতেই হবে।
(চলবে)