তীরন্দাজ Blog শিল্পকলা চলচ্চিত্র আসিফ সৈকত | অস্কারজয়ী প্রথম এশীয় নারী পরিচালক ক্লোয়ে ঝাও-এর সিনেমাযাত্রা | শিল্পকলা
চলচ্চিত্র শিল্পকলা

আসিফ সৈকত | অস্কারজয়ী প্রথম এশীয় নারী পরিচালক ক্লোয়ে ঝাও-এর সিনেমাযাত্রা | শিল্পকলা

বলাই বাহুল্য, সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেয়া এরকম এক নারী কিভাবে আমেরিকাতে এলেন আর নোম্যডল্যন্ড-এর মতো সিনেমা বানালেন, জিতে নিলেন অস্কারের পুরস্কারের মতো পুরস্কার, তা শুধু কৌতুহল নয়, বিস্ময়েরও জন্ম দেয়।

মার্কিন মুভি, নাম নোমাডল্যান্ড। পরিচালক ক্লোয়ে ঝাও। ঝাওয়ের এই ছবিটিই এবার শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র আর শ্রেষ্ঠ পরিচালকের অস্কার পুরস্কার জিতে নিল। কিন্তু কে এই ঝাও? ইতিমধ্যে যারা বিশ্ব চলচ্চিত্র সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখেন তারা জানেন ঝাওয়ের জন্ম চীনে। চীনের মতো দেশের অতি ধনীর ঘরে জন্ম নিয়ে চীনের কঠোর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় বড়ো হওয়া, যেখানে তার বাবা ঝাও ইয়ুজি একটা ইস্পাত শিল্পকারখানার মালিক, রাষ্ট্রীয়ভাবে যার প্রভাব প্রতিপত্তি বিপুল এবং যার স্ত্রী নিজেও রাজনীতিতে জড়িত, চীনের একেবারে শীর্ষ পর্যায়ের এলিট সমাজের মানুষ তারা। এরকম একটা পরিবেশে বেড়ে ওঠা ক্লোয়ে ঝাও যে অস্কার পেতে পারেন, অনেকের ভাবনাতেই এটা ছিল না। বলাই বাহুল্য, সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেয়া এরকম এক নারী কিভাবে আমেরিকাতে এলেন আর নোম্যডল্যন্ড-এর মতো সিনেমা বানালেন, জিতে নিলেন অস্কারের পুরস্কারের মতো পুরস্কার, তা শুধু কৌতুহল নয়, বিস্ময়েরও জন্ম দেয়। সেই সঙ্গে একথা বলা দরকার যে তিনিই প্রথম এশীয় নারী যিনি সেরা পরিচালক হিসেবে অস্কার পুরস্কার পেলেন। এর আগে মাত্র‘ একজন নারী সেরা পরিচালকের পুরস্কার জিতেছিলেন আর তিনি হচ্ছেন ক্যাথারিন বিগলো। গতবছর প্রথম নারী পরিচালক হিসেবে তিনি‘হার্ট লকার’ সিনেমার জন্য এই পুরস্কারটি পান। সুতরাং বলাই যায়, এক বিরল সম্মানের অধিকারী হয়েছেন ক্লোয়ে ঝাও।
এখন ক্লোয়ে ঝাও নামে সবাই তাকে চিনলেও ১৯৮২ সালে বেজিংয়ে জন্মের সময় তার নাম রাখা হয় চাও থিং। তার বাবা ঝাও ইয়ুজি শোউগাং নামের চীনের সর্ববৃহৎ স্টিল কোম্পানির শীর্ষ এক্সিকিউটিভ। এই কোম্পানিটি চীনের শীর্ষ স্টিল কোম্পানিগুলোর একটি। চীনের অনেক কিছুর উপরেই কোম্পানিটির নিয়ন্ত্রণ আছে এবং এই শিল্পকারখানাটির ওপর সরকারেরও প্রভাব আছে। তার মা আবার সরকারিভাবে প্রভাবশালী পিপলস লিবারেশন আর্মির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। ‘ভোগ’ ম্যগাজিনের সঙ্গে ইন্টারভিউতে পরিচালক ক্লোয়ে ঝাও নিজেকে একজন ‘দ্রোহী টিনেজার আর অলস’ নারী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। তার প্যাশন ছিল মাঙ্গা আঁকা আর ফ্যান-ফিকশন লেখা। সিনেমাও তিনি সবসময়ই ভালোবাসতেন, বিশেষ করে ওংকার-ওয়াইয়ের ‘হ্যাপি টুগেদার’ সিনেমাটি তার মনে বিশেষভাবে দাগ কাটে। জীবনের শুরুর সময় থেকে ওয়েস্টার্ন পপ সংস্কৃতি তাকে আকৃষ্ট করতো। ঝাও কমেডিয়ান অভিনেত্রী সং দান্দানকে টিভিতে দেখে বড়ো হয়েছেন। এ কারণেই কমিক্স, সুপারহিরো মুভি, মাঙ্গা – এগুলোর প্রতি তার আগ্রহ দেখা গেছে। এরই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ যে খবর, মারভেলের ‘ইটারনাল’ সিনেমার পরিচালক হিসেবে তিনি কাজ করবেন। নোমাডল্যান্ডের তুলনায় যে সিনেমার ধরনটাই একেবারে ভিন্ন। শুধু ভিন্ন নয়, নোমাডল্যান্ডের পরিচালক কীভাবে ইটারনালের মতো ‘সুপারহিরো’ সিনেমা বানাতে রাজি হলেন, তাও বিস্ময়কর বলা যায়। এটা ঘটছে সম্ভবত নিজের গভীরে সিনেমার প্রতি ভালোবাসা থেকে। এই হচ্ছে ঝাওয়ের সিনেমাভাবনা ও সিনেমা নির্মাণের পটভূমি। সবকিছুই আসলে তার জীবন, পারিবারিক ইতিহাস, বেড়ে ওঠার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। হয়তো এর কিছু ব্যাখ্যা আমরা পারো, কিছু আবার ব্যখ্যাতীতও।

আগেই বলেছি সুপারহিরো মুভির প্রতি ঝাওয়ের আগ্রহের কথা। অনেকেই মনে করেন এবং মনে করার সঙ্গত কারণও আছে যে, সুপারহিরো মুভিগুলোকে ঠিক চলচ্চিত্র বা সিনেমা বলতে যা বোঝায় তা নয়। তাদের মতে এগুলো হলো শৈশব-কৈশোরের সুপারহিরো গল্পের সহজ-সরল উপস্থাপন। কিশোর টিনএজারদের সুপারহিরো গল্প পড়ে, ছবি দেখে, কমিক্স পড়ে বড়ো হবার আনন্দকে পুঁজি করে এই ব্যবসার জাল বিস্তার ঘটেছে। এ হচ্ছে যেন ডোপামাইনের উত্তেজনা দেবার মতো ড্রাগ, এই ব্যবসার জন্যে প্রতিবছর নতুন নতুন নায়ক-নায়িকাকে হাজির করা হচ্ছে। নতুন প্রজন্মের জন্য আলাদা আলাদা সুপারহিরো, সুপারম্যান, বায়োনিক ওম্যান বানিয়ে দীর্ঘমেয়াদী ব্যবসা ফাঁদা হয়েছে। সিনেমা-ক্ষুধার্ত তরুণদের একটা বিশাল অংশ এসব দেখে ও উপভোগ করে। এরই মধ্যে তাই আমরা দেখি প্রায় একশ জন স্পাইডার ম্যান এসে গেছে। আরও অপেক্ষমান। এরকমটাই চলে আসছে, চলছে। কিন্তু এরকম একটা সুপারহিরো ছবির পরিচালক হয়েছেন ক্লোয়ে ঝাও। যিনি ইতিমধ্যে নোমাডল্যান্ডের মতো অপ্রথাগত সিনেমা নির্মাণ করে শ্রেষ্ঠ পরিচালকের অস্কার পুরস্কার পেয়েছেন। যে প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে তিনি সুপারহিরো ছবিটি নির্মাণ করছেন সেই প্রতিষ্ঠানের নাম মারভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্স আর যে ছবিটি তিনি পরিচালনা করছেন তার নাম ‘ইটারনালস’। মুভিটা এবছরের নভেম্বরে মুক্তি পাবে। একই পরিচালক কি করে এরকম বিপরীতধর্মী মুভি পরিচালনা করতে পারেন, ভাবছি তাই নিয়ে। এক সাক্ষাৎকারে ক্লোয়ে ঝাও বলেছেন, এটা তিনি পরিচালনা করছেন ছোটবেলায় তার মাঙ্গা মুভির প্রতি ভালোবাসা থেকে। অনেকেই হয়তো জানেন, মাঙ্গা হলো কমিক্স বা গ্রাফিক্স নভেল। এই পদ্ধতিটি উনিশ শতকে জাপানিরা আবিষ্কার করেন এবং সারা বিশ্বেই পরে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। জাপানে মাঙ্গা শব্দটা কমিকস এবং কার্টুন দুই ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়। বোঝাই যায়, মাঙ্গার প্রতি ভালোবাসাই ঝাওকে এই সুপারহিরো মুভিতে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করেছে। তিনি কাজটা নিয়েছেন সেটা একটা দিক, কিন্তু আরেকটা দিক হলো, হঠাৎ সুপারহিরোখ্যাত প্রতিষ্ঠান মার্ভেল কেন তাকেই এই পরিচালনার কাজটা দিলো? হয়তো এও আরেক ধরনের ব্যবসায়িক কৌশল। ঝাও তাদের মুভি পরিচালনা করছেন, এ নিয়ে বিস্তর আলাপ-আলোচনা হবে, প্রচার পাবে তারা। স্বাভাবিকভাবেই মুনাফাও বাড়বে। কেননা মুনাফা ছাড়া আর কিছু তো তারা ভাবে না। অনেকেই ঝাওয়ের কারণে টাইম পাস করার জন্যে মুভিটা দেখেবে। মার্টিন স্করসিস তো বলেই দিয়েছেন, আমি সুপারহিরো মুভি দেখি না। তারা আসলে সুসজ্জিত মনোরঞ্জক একটা কক্ষ তৈরি করে। যতো সুন্দর করে সেই কামরাটা বানানো যায়, অভিনয়শিল্পীরা সেই চেষ্টাটাই করে। কতগুলো বাধাধরা ঘটনার ভিত্তিতে নির্মাণ করা হয় এই ধরনের মুভি, অনেকটা থিম পার্কের মতো। এর অর্থ, আপনেকে একটা থিম পার্ক দেয়া হলো, আপনি অভিনয়ের নামে সেই পার্কে কিছুক্ষণ লাফালাফি করবেন, অনেকটা এইরকম। এটা সিনেমা নয়। সিনেমা হলো যেখানে মানুষের আবেগ, মানসিক টানাপোড়েন ইত্যাদির প্রকাশ ঘটে। ঝাও সেরকমই তিনটি সিনেমা পরিচালনা করেছেন, একটার জন্যে তো আবার পুরস্কারও পেলেন, কিন্তু তিনি কেন সুপারহিরো মুভি বানাচ্ছেন? আসলে ঝাওয়ের শৈশবটা একটু বোঝা দরকার। এবার সে প্রসঙ্গে আরেকটু বলি।

ক্লোয়ে ঝাওয়ের জন্ম মার্চের ৩১ তারিখে, ১৯৮২ সালে। তিনি এই সময়ের একজন স্বনামধন্য চীনা চলচ্চিত্রনির্মাতা। বিশেষ করে মার্কিন স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণে তার অবদানের জন্য সুপরিচিতি। অস্কার তাকে দিয়েছে বিশ্বখ্যাতি। তার প্রথম পরিচালিত সিনেমা সংস মাই ব্রাদার টোট মে (২০১৫), যে-সিনেমাটি সান্ডেন্স ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ায়। তার পরের সিনেমা দ্যা রাইডার (২০১৭)। এটিও ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্পিরিট অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট ফিল্ম আর শ্রেষ্ঠ পরিচালকের নমিনেশন পায়। এরপর ২০২০১ সালে এলো নোমাডল্যান্ড। এই সিনেমাটি তাকে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অঙ্গনে বিপুল পরিচিতি এনে দেয়। ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গোল্ডেন লায়ন জিতে নেয়। টরেন্টো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও দর্শকদের বিচারে সেরা সিনেমার পুরস্কার পায়। এর পর ঝাও তার পরিচালনার কৃতিত্বের জন্য একাডেমি অ্যাওয়ার্ড, ডিরেক্টরস গিল্ড অব আমেরিকা অ্যাওয়ার্ড, গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড এবং ব্রিটিশ একাডেমি ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড পান। প্রতিটি পুরস্কারের ক্ষেত্রেই ঝাও ছিলেন দ্বিতীয় নারী যিনি এই পুরস্কারগুলি অর্জন করেন।

এই মুভিতে নোমাডদের জীবন সম্পর্কে ডকুমেন্টারি ফিল্মের মতো আমরা তাদের জীবনযাপনের সাথে পরিচিত হতে থাকি। বিভিন্ন জনের এই নোমাডজীবন বেছে নেবার গল্প, জীবনদর্শন জানতে থাকি। এভাবেই নোমাডদের জীবনের বোধটাকে সফলভাবে তুলে আনার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন পরিচালক।
++
হলিউডের ‘সেলফি-মার্কা’ ছবির বাইরে আমেরিকার জনগণের সত্যিকারের গল্পের সিনেমা নোমাডল্যন্ড। হলিউডি সিনেমাতে যে আমেরিকাকে আমরা দেখি, যে আমেরিকান ড্রিমে আমরা ডুবে থাকি, যার দিকে ছুটে যেতে চাই নেশাগ্রস্তের মতো, সেই ‘আমেরিকান ড্রিম’ টাইপ সিনেমার বাইরের ছবি এটি। এই সিনেমায় সত্যিকারের যাযাবর মার্কিনীদের জীবন-জীবিকা, পারস্পরিক সম্পর্ক, জীবনদর্শনের কথা পাওয়া যায়। ডকুমেন্টারি ফিল্ম স্টাইলে সিনেমাটি নির্মাণ করেছেন ঝাও। এই ছবিতে দেখি দূরস্থিত লং শটের প্রাধান্য, যা দিয়ে নোমাডদের (যাযাবর) জীবনযাপন, তাদের নিরন্তর ছুটে চলা, পুরা দেশ ঘুরে দেখার বাসনা ইত্যাদি বিষয়কে ক্যামেরায় নান্দনিক জায়গা থেকে নিপুণভাবে ধারণ করা হয়েছে। এই যাযাবরদের মধ্যেকার কথোকথন, আলাপ-আলোচনাকে আবার ধারণ করা হয়েছে হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরার মাধ্যমে। এতে দৃশ্যগুলি বেশ প্রাণবন্ত লেগেছে। ফার্ন নামের এক নারীর গল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নোমাডল্যান্ডের মূল কাহিনি। একটা শিল্পকারখানা পরিত্যক্ত ঘোষিত হলে তার সঙ্গে সম্পর্কিত সবার চাকরি চলে যায়। তখন ফার্ন, যার স্বামী ওই শিল্পাঞ্চলে থাকতেন, তিনি মারা গেলে তাদের সব সম্পদ বিক্রি করে একটা গাড়ি কেনেন। গাড়িটা ঠিক একটা ছোট বসবাস করার যোগ্য ঘরের মতো। এই গাড়িতেই শুরু হলো যাযাবার বা নোমাডজীবন। এই জীবনে ফার্ন বিভিন্ন জায়গা – যেমন আমাজন, বা কোনো রিসোর্ট বা কখনো কোনো রেস্তরাঁতে কাজ করতে চলে যায়। এর মধ্যে তার দেখা হয় আরো অনেক যাযাবরের সঙ্গে। এভাবেই এই মুভিতে নোমাডদের জীবন সম্পর্কে ডকুমেন্টারি ফিল্মের মতো আমরা তাদের জীবনযাপনের সাথে পরিচিত হতে থাকি। বিভিন্ন জনের এই নোমাডজীবন বেছে নেবার গল্প, জীবনদর্শন জানতে থাকি। এভাবেই নোমাডদের জীবনের বোধটাকে সফলভাবে তুলে আনার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন পরিচালক। এই সিনেমায় ফার্নের চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন অভিনেত্রী ফ্রান্সেস ম্যাকডরমেন্ট। তিনিও এই সিনেমায় অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রীর অস্কার পুরস্কার পেয়ছেন। তার অনেক আগের অভিনীত সিনেমাটি হলো ফারগো, যা এখনো একটা বহুল আলোচিত মার্কিন সিনেমা হিসেবে উল্লেখযোগ্য হয়ে আছে। ম্যাকডরমেন্ট আসলে একজন পুরোদস্তুর শিল্পী, যিনি মানবিধাকের জন্যে সব সময় সোচ্চার। প্রতিটি অস্কারে দেয়া তার বক্তব্য শুনলেই আমরা বুঝতে পারি, শুধু অভিনয়ের জন্যই তিনি অভিনয় করেন না। পরিচালক ক্লোয়ে ঝাও একদম সঠিক মানুষটাকেই এই ফার্ন চরিত্রের জন্যে বেছে নিয়েছিলেন।
++
প্রত্যেক শক্তিশালী পরিচালকেরই ইচ্ছা থাকে নিজের দেশের পরিচিত মানুষদের সত্যিকারের গল্পটা পর্দায় তুলে আনার, কিন্তু চীনে এই কাজ কোনো দিনই করা যাবে না। আর পৃথিবীও চীনের সাধারণ মানুষদের কথা জানা থেকে বঞ্চিত হবে।
++
দুঃখজনক হলেও সত্যি, চীনের শাসনব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্যাপারে মন্তব্যের কারণে ঝাওয়ের কোনো সিনেমা চীনে প্রদর্শনের ছাড়পত্র পায় নি। অনেক অল্প বয়সে তিনি লেখাপড়া করার জন্যে চীন ছাড়েন। পনেরো বছর বয়সে তিনি ব্রিটেনের ব্রাইটন কলেজে ভর্তি হন। পরে স্কুলের পড়াশোনা শেষে চলে আসেন লস এঞ্জেলেস। এরপর ভর্তি হন ম্যসাচুসেটসের মাউন্ট হোলিউক কলেজে। তার পড়াশোনার মূল বিষয়টি ছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞান। ফিল্ম স্টাডিজ ছিলো তার মাইনর সাবজেক্ট। ২০০৫ সালে এখান থেকে গ্রাজুয়েশন করে সিনেমা সম্পর্কে বিস্তারিত আর গভীরভাবে জানার জন্যে কানবার ইন্সটিটিউট অব ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশনের গ্রাজুয়েট প্রোগ্রামে ভর্তি হন। এই ইন্সটিটিউটটা নিউইউর্ক ইউনিভার্সিটির দি স্কুল অব দ্যা আর্টস-এর অধীন। ওং কার-ওয়াইয়ের ‘হ্যাপি টুগেদার’ (১৯৯৭) সিনেমাটি দেখার পর ঝাওয়ের প্রথম সিনেমা বানানোর ইচ্ছা জাগে। তাকে আরও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছেন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ও চলচ্চিত্র নির্মাতা স্পাইক লি। অ্যাং লি, ওয়ার্নার হেরজহগ এবং টেরেন্স মালিকও ঝাওকে সিনেমা নির্মাণের জন্যে বেশ প্রভাবিত করেছেন।
২০১৩ সালের দিকে ঝাও যখন তার সিনেমা ‘সংস মাই ব্রাদারস টট মি’-র কাজ করছিলেন তখন ফিল্মমেকার ম্যগাজিনের এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, একটা বদ্ধ পরিবেশে বেড়ে ওঠা টিনএজারদের আত্মহত্যার উঁচু প্রবণতার কথা তিনি যখন ভাবেন তখন চীনা বদ্ধ সমাজের কথা তার মনে পড় যায়। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেছিলেন, ”এটা সেই সময়ের কথা যখন আমি চীনে একজন টিনএজার হিসাবে বেড়ে উঠছিলাম। আমি এমন একটা জায়গাতে ছিলাম যেখানে চারদিকে শুধু মিথ্যার ছড়াছড়ি। এরকম পরিবেশে থাকলে আপনার মনে হবে, আপনি বুঝি আর কখনো এরকম বদ্ধ পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন না। আমি যখন আরো ছোট ছিলাম তখন অনেক কিছু জেনেছি যা একেবারেই সত্যি নয়। সেই বয়সেই আমি আমার পরিবার এবং ব্যকগ্রাউন্ডের ব্যাপারে বিদ্রোহী হয়ে উঠি। এরপর হঠাৎ করে চলে আসি ইংল্যন্ডে। নতুন করে আমাদের ইতিহাসের কথা জানলাম। একটা মুক্ত উদার আর্টস কলেজে পলিটিকাল সায়েন্স পড়তে গিয়ে আমি বুঝতে শুরু করলাম যে, কোনটা আসলে সঠিক। … প্রত্যেক শক্তিশালী পরিচালকেরই ইচ্ছা থাকে নিজের দেশের পরিচিত মানুষদের সত্যিকারের গল্পটা পর্দায় তুলে আনার, কিন্তু চীনে এই কাজ কোনো দিনই করা যাবে না। আর পৃথিবীও চীনের সাধারণ মানুষদের কথা জানা থেকে বঞ্চিত হবে।

ক্লোয়ে ঝাওয়ের দিকে এখন অনেকেই তাকিয়ে। চল্লিশে পৌছানোর আগেই পৃথিবীতে নিজেকে একজন গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রনির্মাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার আরো অনেক চলচ্চিত্র এবং কাজ দেখার অপেক্ষায় থাকবেন সিনেমাপ্রেমীরা। আপাতত নোমাডল্যন্ডকে দেখা এবং আগের সিনেমাগুলোকে নিয়ে ঝাওকে ভালোভাবে বোঝার জন্যে সময় দিচ্ছেন তারা। আলোচনাও হচ্ছে বেশ। একটাই প্রশ্ন, বাংলাদেশে যারা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তারা কী তাঁর সিনেমাগুলো দেখে কিছু শিখবে, নাকি শিখতে পারবে, বিশেষ করে তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতারা? এর উত্তর আমার জানা নেই। তবে বাংলাদেশেও বিশ্বমানের চলচ্চিত্র নির্মিত হোক এই প্রত্যাশা।

Exit mobile version