পাঠকমাত্রই জানেন। একজন পরিশ্রমী, তীক্ষ্ণ সাংবাদিক এবং সফল গোয়েন্দার মধ্যে মিলমিশের যে একান্ত গোধূলিবেলাটি রয়েছে, তার বিস্তার সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা গল্পে বা ফেলুদা চরিত্রে যেন আরও অনেকটাই বেশি।
‘গ্যাংটকে গণ্ডগোল’ গল্পে বাগডোগরা যাচ্ছে ফেলুদা, তোপসে আর জটায়ু। একজন বিশেষ সহযাত্রী, কোন প্রদেশের লোক তোপসে বলতে না পারায় ফেলুদা জিভ দিয়ে ছিক করে একটি শব্দ করে বলে, ‘কবে যে অবজারভেশন শিখবি তা জানি না।’
‘অবজারভেশন!’ এক গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার কথাই সত্যজিৎ রায় তোপসের মাধ্যমে আমাদের মনে করিয়ে দেন, যা মগজাস্ত্র এবং কোল্ট রিভলভারের পাশাপাশি গোয়েন্দা ফেলুদার অন্যতম মোক্ষম অস্ত্র। একের পর এক রহস্য সমাধানে এই পর্যবেক্ষণের ভূমিকা ফেলুদার পাঠকমাত্রই জানেন। একজন পরিশ্রমী, তীক্ষ্ণ সাংবাদিক এবং সফল গোয়েন্দার মধ্যে মিলমিশের যে একান্ত গোধূলিবেলাটি রয়েছে, তার বিস্তার সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা গল্পে বা ফেলুদা চরিত্রে যেন আরও অনেকটাই বেশি। কোনও সাংবাদিকের সমুদ্রে ডুব দিয়ে খবর খুঁজে আনার প্রথম শর্তই হল, তাঁর চোখ এবং কানকে হতে হবে ধীমান। প্রয়োজনে নাককেও। সবার যা চোখ এড়িয়ে যাবে, তাকে বিঁধতে। কারণ তথ্য তো বাতাসে গজায় না!
পর্যবেক্ষণশক্তির পাশাপাশি লক্ষণীয়, ফেলুদার বহু বিষয়ে কৌতূহল, স্থান-কাল-পাত্র সম্পর্কে জানার প্রবল খিদে এবং ইতিহাসবোধ, পুরাতত্ত্ব সম্পর্কে গড়পড়তা ধারণা, কোনও নতুন শহরে যাওয়ার আগে সেখানকার হোমওয়ার্ক সেরে নেওয়া, এবং সেই শহর বা জনপদকে প্রাঞ্জলভাবে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষমতা, দক্ষতা ও প্রবণতাগুলো। এই প্রবণতাগুলো চালিত করে সাংবাদিককেও। প্রতিনিয়ত এক থেকে অন্য সংবাদে, ঘটনায়, পরিস্থিতিতে তাঁর দীর্ঘমেয়াদী জার্নি সম্ভবই হয় না, এই প্রবণতা এবং বিশেষত্বগুলো ছাড়া।
একজন সাংবাদিকের আসল দম পরীক্ষিত হয়, যখন তিনি নিজের ওয়ার্ক স্টেশনের (সেটা কলকাতা হতে পারে বা দিল্লি, অথবা বর্ধমান, পটনা, যেখানে তিনি তিনশো পঁয়ষট্টি দিন কাজ করেন) বাইরে গিয়ে, অর্থাৎ নিজের কমফোর্ট জোনের বাইরে, উপদ্রুত এক স্থান বা সময়ে গিয়ে কাজ করেন। তাঁকে তাড়া করে টাইম লাইন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আসল খবরটিকে শনাক্ত করে পাঠকের সামনে প্রমাণ হিসাবে তুলে ধরার দায়। এই প্রমাণ গাজাখুঁড়ি হলে জনতার আদালতে ধোপে টিঁকবে না বলাই বাহুল্য। তাঁকে হতে হবে, নির্ভুল, অকাট্য। নতুন জায়গায় তিনি তাঁর পরিচিত সোর্স পাবেন না, একজন সাংবাদিকের কাছে যা কোহিনূরের মতো মূল্যবান। তাঁকে তৈরি করতে হবে নতুন সোর্স। বিশ্বাস এবং অবিশ্বাসের দোলাচলের মধ্যে দিয়ে যাত্রা করতে করতে সাংবাদিক খুঁজে পাবেন ঘটনার সঠিক বিবরণ, কার্য, কারণ, এবং দেখতে পাবেন ভবিষ্যৎ পরিণতিও।
এগুলো পেতে হলে ঘটনার চারপাশে ঘুরপাক খাওয়া চরিত্রগুলোর মধ্যে থেকেই চালাতে হবে জিজ্ঞাসাবাদ। কে সত্যি বলছে, আর কার বলায় খাদ রয়েছে তা বুঝে নিতে হবে দ্রুত। ক্রস চেক করে মিলিয়ে দেখতে হবে প্রতিটি তথ্য। সেই ঘটনা হতে পারে হত্যা বা গণধর্ষণের ঘটনা। অথবা তা হতে পারে কোনও বড়ো প্রাকৃতিক বিপর্যয়, মহামারি, অগ্নিকাণ্ড অথবা কোনও বড়ো মাপের রাজনৈতিক, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক সম্মেলন।
এই পুরো প্রক্রিয়াটির মধ্যে দিয়ে বারবার আমরা যেতে দেখি ফেলু মিত্তির অথবা তাঁর স্রষ্টা সত্যজিৎ রায়কে। ফেলু মিত্তিরের রহস্য গল্পগুলোর প্লটের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্যই হল, ঘটনাপ্রবাহ কলকাতায় শুরু হয় ঠিকই। কিন্তু তারপর ব্যাগ গুছিয়ে ফেলুদা, তোপসে আর জটায়ু পাড়ি দেয় অন্য শহরে। লখনউ, সিমলা, গ্যাংটক, বম্বে, রাজস্থান তো রয়েছেই পরবর্তীকালে দেশের বাইরেও ফেলু-তোপসেরা গিয়েছে অ্যাসাইনমেন্ট-এ।
<<সত্যজিতের বহু ফেলুদা প্লটই হয়ে উঠতে পারত সাংবাদিকের স্বর্গ। অনেকগুলো থেকেই একজন সাংবাদিক ছেঁকে আনতে পারেন ‘নিউজ স্টোরি’। যে কোনও নতুন জায়গায় গিয়ে পায়ে হেঁটে ঘুরে না দেখলে যে সেই জায়গাকে যে ভালো করে চেনা হয় না—এই প্রজ্ঞা ফেলুদা বা তোপসের পাশাপাশি একজন সজাগ সাংবাদিকেরও।>>
একজন সাংবাদিক যেমন তাঁর কর্মজীবনে বারবার ছুটে বেড়ান শহর থেকে শহরে, রেল স্টেশন থেকে বিমানবন্দরে, এক ঘটনা থেকে অন্য প্রবাহে, ঠিক একইভাবে ফেলু মিত্তিরকেও আমরা ছুটতে দেখেছি শহরে, মফস্বলে এমনকি বিদেশেও। একজন সাংবাদিকের যেমন পড়াশুনোর বিষয়বৈচিত্র এবং সব ব্যাপারে কাজচলতি জ্ঞানগম্যি থাকা কাঙ্ক্ষিত তা পুরোমাত্রায় রয়েছে ফেলুদার, এবং হয়তো একটু বেশি মাত্রাতেই রয়েছে। আর তাই ঔরঙ্গজেবের আংটি, উনিশ শতকের ভ্রমণকাহিনির পাণ্ডুলিপি, রেনেঁসা পর্বের ছবি, পার্ক স্ট্রিটের পুরনো কবরখানা, নেপোলিয়নের হাতে লেখার চিঠির মতো একের পর এক বিষয়বৈচিত্রের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে ফেলুদা। যার মধ্যেকার রহস্যটুকু ছেঁকে নিলেও পড়ে থাকে সংখ্যাতত্ত্ব, জ্যামিতিক থিয়োরি, রেঁনেসা যুগের শিল্পকলা, পুরনো কলকাতার বিভিন্ন কথকতা, হিপনোটিজম, প্যারাসাইকলোজি — এরকম কতই না বিষয়। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশুনো থাকলে (‘মাস্টার অব নান’ বলে যে প্রয়াসকে হেয় করা যায় না) তা কার্যক্ষেত্রে যে কতটা উপকারে আসে, সাংবাদিকমাত্রই জানেন। আর মোক্ষমভাবে জানে ফেলুদা। আর তাই তাকে সারারাত জেগে প্যারাসাইকোলজি সংক্রান্ত জার্নাল পর্যন্ত পড়তে দেখা যায়।
সত্যজিতের বহু ফেলুদা প্লটই হয়ে উঠতে পারত সাংবাদিকের স্বর্গ। অনেকগুলো থেকেই একজন সাংবাদিক ছেঁকে আনতে পারেন ‘নিউজ স্টোরি’। যে কোনও নতুন জায়গায় গিয়ে পায়ে হেঁটে ঘুরে না দেখলে যে সেই জায়গাকে যে ভালো করে চেনা হয় না—এই প্রজ্ঞা ফেলুদা বা তোপসের পাশাপাশি একজন সজাগ সাংবাদিকেরও। কোনও কঠিন অ্যাসাইমেন্টে যাওয়ার আগে, যে অ্যাসাইনমেন্ট-এ দৌড়ঝাঁপ আছে, নেহাতই পাঁচতারা হোটেলের ত্রিদেশীয় সম্মেলন নয়, একজন রিপোর্টেরের ঝোলাতে কী কী থাকে? একবার চোখে বুলিয়ে দেখি ফেলুদার ব্যাগ প্যাক! যার হদিস প্রথম পাওয়া গিয়েছে কৈলাসে কেলেঙ্কারিতে। থাকে, ওষুধপত্র, ফার্স্ট এইডের সরঞ্জাম, নিউম্যান কোম্পানির রেল, বাস আর প্লেনের টাইমটেবিল, রোড ম্যাপ, হান্টিংবুট প্রভৃতি। আমি নিশ্চিত, আজও যদি ফেলুদা গোয়েন্দাগিরি চালিয়ে যেত, তাহলে স্মার্ট ফোন এবং নেটপ্রযুক্তির কারণে টাইমটেবল বা রোড ম্যাপ তার হয়তো আর প্রয়োজন হত না। নতুন ওয়েব সিরিজে শার্লক হোমস যেমন প্রতি পদে নেট-নির্ভর। কিন্তু নয়ের দশক পর্যন্ত নতুন দেশে বা শহরে যাওয়ার আগে ফেলুদার মতোই একজন রিপোর্টারের ব্যাগেও এগুলো পাওয়া যেত। আর পাওয়া যেত নোটবুক, যা ফেলুদার খেরোর খাতার পরমাত্মীয়।
এসব তো বাহ্যিক দিক। প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, সপ্রতিভতা, সব জায়গায় নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার সহজাত ক্ষমতা, নিরপেক্ষভাবে যে কোনও ঘটনাকে যাচাই ও বিশ্লেষণ করার বোধ, তীব্র পর্যবেক্ষণশক্তি। এর পাশাপাশি একজন সফল সাংবাদিকের মনকে সর্বদা থাকতে হয় তরতাজা। একজন ক্রাইম বিট-এর রিপোর্টারের কাজ, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শহরের, গ্রামের, মফস্বলের বা দেশের বিভিন্ন রকম অপরাধ ঘেঁটে চলা। তাদের দিন শুরু হয় পুলিশ হেডকোয়ার্টারে। তাদের কাছে প্রিয় পাঠ্য ক্রিমিনালদের রিপোর্ট, বিভিন্ন এফআইআর-এর কপি। একইভাবে ফেলুদাকেও মানুষের মনের অন্ধকার দিকগুলো নিয়ে কাজ করতে হয়, কিন্তু সে নিজের মনকে অন্ধকার হতে দেয়নি। ম্যাজিক থেকে ইন্ডোর গেম, দেশ দেখার সাধ ও উত্তেজনা তার সদাজাগ্রত। সিধু জ্যাঠার পরামর্শে সে সর্বদা মনের জানলা খুলে রাখে। আর সে কারণেই ‘বাক্স রহস্য’ গল্পে মক্কেলের কাছ থেকে পারিশ্রমিক হিসাবে চেয়ে নেয় শম্ভুচরণের ভ্রমণকাহিনির পাণ্ডুলিপি, আবার অপরাধীর কাছ থেকে কিছু নেবে না বলে ফেরত দেয় এমিল গাবরিও-র বইয়ের সেট।
একজন রিপোর্টারের ‘ফার্স্ট হ্যান্ড নলেজ’-এর উপর ভিত্তি করে তৈরি হয় নিউজ স্টোরি। সেই নিউজ স্টোরি, ছবি গ্রাফিক্স অলঙ্করণের মাধ্যমে পাতায় বসে। বা চ্যানেলে সম্প্রচারিত হয়। অথবা পোর্টালে আপলোড হয়। ফলে এই ‘ফার্স্ট হ্যান্ড নলেজ’ বা প্রথম দর্শনে বিষয়টিকে ছেঁকে নেওয়ার কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার উপরেই দাঁড়িয়ে থাকে গোটা সংবাদপত্র বা চ্যানেল বা পোর্টালের পরিবেশনটির ঠিক বা ভুল। ‘রিপোর্টার্স ইনস্টিংক্ট’ কথাটি খুবই প্রচলিত এই প্রসঙ্গে। এটা সবার থাকে না। যাঁরা খবরের গন্ধ পান বা শুঁকে বলে দিতে পারেন, তাঁরা সেই গন্ধটা পাওয়ার জন্য ঘ্রাণেন্দ্রিয় ব্যবহার তো করেন না। করেন সেই ‘মগজাস্ত্র’ এবং সহজাত প্রবণতা। এবং আগে যেটা বলা হল, সেই তীব্র পর্যবেক্ষণশক্তির মাধ্যমে।
মনে করুন কোনও রিপোর্টার কাশ্মিরে গিয়েছেন নির্বাচন কভার করতে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পৌঁছেছেন বারামুলার এক গ্রামে। হাতে সময় কম, কারণ সন্ধ্যা নামার আগেই নিজের এবং অপেক্ষমান গাড়িটির ড্রাইভারের নিরাপত্তার কারণেই তাঁকে লম্বা পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে নামতে হবে শ্রীনগরে। হাতে রয়েছে মেরেকেটে ঘণ্টা দুয়েক সময়। প্রাণের ভয়ে গ্রামবাসী ‘পত্রকার’-কে দেখে মুখে কুলুপ এঁটেছে। হয়তো দু’রাত আগেই সেখানে ঘটেছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা, যেমনটা হামেশাই ঘটে সেখানে। রক্ষকই ভক্ষক হয়ে বুটের চিহ্ন এঁকেছে কাঠের বাড়ির ভিতরে যত্রতত্র। হয়তো হয়েছে শারীরিক নিপীড়নও। চোখ কান খোলা একজন রিপোর্টারকে ওই অল্প সময়ের মধ্যে শুধুমাত্র সেখানকার ইতিহাস, মানুষের পেশা, রাজনৈতিক বোধ, অভাব অভিযোগের বিষয়গুলোই কেবল বুঝলে চলবে না। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজে লাগিয়ে তাঁকে বুঝে নিতে হবে গতকাল রাতে ঠিক কী কী ঘটেছিল, বা এমনটাই বরাবর এখানে ঘটে থাকে কিনা। যদি থাকে, তাহলে তার মূল কারণ কী? এখানকার মানুষের ভালনারিবিলিটি কোথায়? যদি জঙ্গিদের হামলাও ত্রাসের কারণ হয়, তাহলে কি তাদেরই কোনও লোক ভিড়ে মিশে রয়েছে আপনার সামনে, ভালোমানুষের মতো মেপে নিচ্ছে আপনার সঙ্গে গ্রামবাসীর কথোপকথনের ধরন? এক্ষেত্রে মানব মন পড়ার বিদ্যা তো প্রয়োজন বটেই, সেইসঙ্গে প্রয়োজন তীক্ষ্ণ পাওয়ার অব অবজারভেশন। ‘টিনটোরেটোর যীশু’ উপন্যাসে জন্মসূত্রে ইতালিয় নাগরিক এবং গোটাজীবন ইউরোপে কাটিয়ে সদ্য দেশে ফেরা রুদ্রশেখরের বহু পুরনো জুতো যে বাটা কোম্পানির দিশি জুতো তা বুঝতে যে পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা দরকার হয়, এও খানিকটা সেরকমই। এই পর্যবেক্ষণই ফেলুদাকে রহস্য উদঘাটনের কাছাকাছি নিয়ে যায়। সাংবাদিককে সত্যের কাছে।
এখনও এই ভারতবর্ষে বহু গ্রাম রয়েছে, যা জাতপাতের সমীকরণে চলে। আপাতদৃষ্টিতে ভোটের আগে সমাজসেবী দলিত দরদী হয়ে ওঠা কোনও ঠাকুর বংশীয় রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে গোটা দিন ঘুরলে এবং তার বডি ল্যাংগুয়েজটুকু শুধুমাত্র ভালো করে নজর করলেই একজন প্রকৃত রিপোর্টার বুঝতে পেরে যান, নেতামশাই মুখে যা বলছেন তা সর্বৈব মিথ্যা না কিছুটা সত্যিও? ভোট শেষ হলে, কোনও অবাধ্য, বশ না হওয়া গ্রামবাসীকে রাতের অন্ধকারে কুপিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিতে তার চোখের তারা কি কাঁপবে?
গোয়েন্দা ফেলুদা এবং তাঁর স্রষ্টার যে মৌলিক প্রবণতাগুলো একজন সফল বা পরিশ্রমী সাংবাদিকের সঙ্গে কতটা সাযুজ্যপূর্ণ সেই প্রসঙ্গে আরও একটি কথা না বললে নয়। যে ভাষায় এই গোয়েন্দাকাহিনিগুলো লেখা হয়েছে তা একজন সার্থক সাংবাদিকের কাছে শিক্ষণীয় নয় কি?
<<বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রায় সাংবাদিকসুলভ পুর্নগঠনে তিনি হত্যাকাণ্ড অথবা পরিবেশ পরিস্থিতি বর্ননা করেছেন। নিছক কল্পনা, মূর্ছনার স্বাধীনতা জাহির করে নয়। সংশ্লিষ্ট চরিত্রদের সংলাপ, জবানবন্দি ও ঘটনাস্থলের নিঁখুত বর্ণনায় তা হয়ে উঠেছে সাহিত্য।>>
ঘটনার পুনর্গঠন করা সাংবাদিকের কাজ। এ কাজে তার সহায়ক, আদালতের দলিলপত্র, বিভিন্ন ব্যক্তির পক্ষে-বিপক্ষে বক্তব্য, জবানবন্দি। সাংবাদিকতাকে তাই বলা হয় অ্যারেঞ্জমেন্ট অব পার্সপেক্টিভ। সেখানে আলগা, অগোছলো, গন্তব্যহীন ভাষার কোনও স্থান নেই। অন্তত থাকার কথা নয়। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ, পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা, পথচারী-সহ নানা জনের বিবৃতির সমাহার শুধু নয়, নিজের চোখে দেখা ঘটনাস্থলের পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং এই সবের আন্তঃক্রীড়ায় গড়ে ওঠে রিপোর্টারের প্রতিবেদনটি। সেখানে সাহিত্যবিলাসের সুযোগ নেই ঠিকই, কিন্তু নিপুণ, পরিমিত, অনমুপুঙ্ক্ষময়, সংযত, ডিটেলসমৃদ্ধ বাস্তব একটি রিপোর্টও যে সাহিত্য হয়ে উঠতে পারে তা গোয়েন্দা ফেলুদার গল্পগুলোতে বিধৃত। বহুক্ষেত্রেই একজন সাংবাদিকের চোখে দেখেছেন সত্যজিৎ, লিখেছেনও। তত্ত্বকথা না বলে এখানে দুটি ছোট উদাহরণ দেওয়া যাক।
“বন যে সব জায়গায় সমান ঘন, তা নয়। বাঁ দিকে চাইলেই বোঝা যায় ওদিকে নালা থাকার দরুন বন পাতলা হয়ে গিয়েছে। জানোয়ারের মধ্যে এক বাঁদরই দেখা যাচ্ছে মাঝে মাঝে—ল্যাজ পাকিয়ে গাছের ডাল থেকে দোল খাচ্ছে, এ গাছ থেকে ও গাছে দিব্যি লাফিয়ে চলে যাচ্ছে, আর আমাদের দেখলে দাঁত খিঁচোচ্ছে। ……
লালামোহনবাবুর বুটের ঠোক্কর খেয়ে একটা জিনিস ছিটকে প্রায় দশ হাত দূরে গিয়ে পড়তেই আমাদের চোখ সেদিকে গেল।
একটা গাঢ ব্রাউন রংয়ের চামড়ার মানিব্যাগ। ফেলুদা সেটা খুলতেই তার ভিতর থেকে দুটো একশো টাকার নোট আর বেশ কিছু অন্য ছোট ছোট নোট বেরিয়ে পড়ল। এসব ছিল বড় খাপটায়। অন্য খাপ থেকে কয়েকটা রং চটে যাওয়া কুড়ি পয়সার ডাকটিকিট, দু-একটা ক্যাশ মেমো আরেকটা ওষুধের প্রেসক্রিপশন বেরোল। বৃষ্টিতে ভিজে ব্যাগটার অবস্থা বেশ শোচনীয় হলেও নোটগুলো এখনও দিব্যি ব্যবহার করা চলে। …” (রয়েল বেঙ্গল রহস্য) অথবা—
“তিনজনে ঢুকলাম ভিতরে। একটা মাঝারি সাইজের বৈঠকখানা। দরজার উলটোদিকে একটা সোফা, তার কাপড়ের ঢাকনির তিন জায়গায় ফুটো দিয়ে নারকোলের ছোবড়া বেরিয়ে আছে। সোফার সামনে একটা শ্বেতপাথরের টেবিল, — এখন শ্বেত বললে ভুল হবে, কিন্তু এককালে তাই ছিল। বাঁয়ে একটা কালো প্রাচীন বুক কেস, তাতে গোটা পনেরো প্রাচীন বই। বুক কেসের মাথায় একটা পিতলের ফুলদানিতে ধুলো জমা প্লাস্টিকের ফুল, সে ফুলের রং বোঝে কার সাধ্যি। দেয়ালে একটা বাঁধানো ছবি, সেটা ঘোড়াও হতে পারে, রেলগাড়িও হতে পারে, এত ধুলো জমেছে কাঁচে। যে ফিলিপস রেডিওটা সোফার পাশের টেবিলে রাখা রয়েছে সেটার মডেল নির্ঘাত ফেলুদার জন্মেরও আগের। আশ্চর্য এই যে সেটা এখনও চলে , কারণ সেটা থেকেই গানের শব্দ আসছিল।” (গোরস্থানে সাবধান)
এরকম উদাহরণ অসংখ্য, ছত্রে ছত্রে। সরল, নিরপেক্ষ এবং নিরাভরণ এক ভাষায় সত্যজিৎ প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন বিষয়ের বাস্তবতা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রায় সাংবাদিকসুলভ পুর্নগঠনে তিনি হত্যাকাণ্ড অথবা পরিবেশ পরিস্থিতি বর্ননা করেছেন। নিছক কল্পনা, মূর্ছনার স্বাধীনতা জাহির করে নয়। সংশ্লিষ্ট চরিত্রদের সংলাপ, জবানবন্দি ও ঘটনাস্থলের নিঁখুত বর্ণনায় তা হয়ে উঠেছে সাহিত্য। পাঠক, বেনারসের গলিতে শশীবাবুর খুনের দৃশ্যটা ভেবে দেখুন। পরিবেশ বর্ণনায় সত্যজিৎ একেবারে সংবাদ পরিবেশনের বিরপেক্ষতা ধারণ করেছেন। প্রাত্যহিকের বর্ণনাও যে সূক্ষ্ম ও যৎপরোনাস্তি রসময় হয়ে উঠতে পারে তা ফেলুদার গল্পগুলোতে ছত্রে ছত্রে বিধৃত। সাংবাদিকতা এবং সাহিত্যের ভাষাকে ক্রমশ কাছাকাছি নিয়ে এসে, মিলমিশ ঘটিয়ে দেওয়ার কাজটি করে গিয়েছেন সত্যজিৎ রায়, যা অবশ্যই আরও বৃহত্তর মূল্যায়নের অপেক্ষা রাখে।
অগ্নি রায়
কবি ও লেখক