উপন্যাস কথাসাহিত্য

হাওয়ার্ড ফাস্ট | মুক্তির পথ | ভাষান্তর :  মোবাশ্বেরা খানম বুশরা | অনূদিত ধারাবাহিক উপন্যাস

পর্ব ১

পটভূমি

হাওয়ার্ড ফাস্ট তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস `ফ্রিডম রোড’ (মুক্তির পথ)  উৎসর্গ করেছেন পৃথিবীর, ‘সব সাদা ও কালো, পীত ও বাদামী, নারী ও পুরুষদেরকে, যারাই স্বৈরাচারী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রাণ দিয়েছেন।’ অতএব উৎসর্গপত্রেই এর বিষয়বস্তু উদ্ধৃত। পদপিষ্ট মানুষের বেদনা ও বঞ্চনার গল্প, তাদের ঘুরে দাঁড়াবার ইতিহাস, অজেয় অমেয় শক্তি ফাস্টের সাহিত্য-প্রেরণা।

১৯৪৪ সালে প্রকাশিত উপন্যাস `ফ্রিডম রোড’ বাংলা ভাষান্তরে মুক্তির পথ বলছে, ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলে দাসত্ব মোচনের লক্ষে দীর্ঘ যে লড়াই কালোরা করেছিল, সেই লড়াইয়ের পর ঘরেফেরা মানুষগুলোর কথা। ফিরে এসে ওরা দেখতে পেল ওদের যেমন কোনো মনিব আর নেই, নেই খাবার দেয়ার লোক বা আশ্রয়ও। ক্ষত-বিক্ষত অতীত আর অনিশ্চিত বর্তমান ও ভবিষ্যত নিয়ে নিরক্ষর, হতবুদ্ধি, বোকা কালো লোকগুলো গিডিয়ন জ্যাকসনের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল যার পিঠে একশটা চাবুকের দাগ ওর গায়ের রঙের মতো কালো অতীতের স্বাক্ষর। সবাইকে সাথে নিয়ে দাস থেকে মানুষ হয়ে ওঠার লড়াইয়ে নেমে পড়ল ও। বুঝে নিতে চাইল যুদ্ধ শেষের প্রাপ্য, ওদের মানবিক সত্ত্বার অধিকার ও উদ্বোধন।   

উপক্রমণিকা

যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। দীর্ঘ রক্তঝরানো সেই যুদ্ধ। এ্যাতো বড় যুদ্ধ বোধহয় আর দেখে নি পৃথিবীর লোক। সে যুদ্ধ শেষ হলো শেষ পর্যন্ত। নীল পোশাক পরা লোকেরা ফিরে এল ঘরে। ধূসর পোশাক পরা লোকেরা হতবাক দৃষ্টি আর ক্ষরিত হৃদয় নিয়ে তাকিয়ে রইল তাদের বিস্তীর্ণ ভূমির দিকে। দেখল যুদ্ধ কি করতে পারে।

এ্যপোম্যাটোক্স কোর্ট হাউজে জেনারেল লী তার অস্ত্র সমর্পন করলেন আর অবসান হল এই যুদ্ধের। উষ্ণ দক্ষিণ দেশে চব্বিশ লক্ষ কালো মানুষ মুক্ত হল। বড় কষ্টে পাওয়া এই স্বাধীনতা, বড় মূল্যে কেনা। একজন মুক্ত মানুষের কাছে তার গতকাল আর আগামীকাল দুটোই একান্ত নিজের। সে দুটোরই হিসাব রাখে। ক্ষিদেয় পেট জ্বলছে, কিন্তু কোনো প্রভু নেই তোমার মুখে খাবার তুলে দেবার, তবে দ্রুত পা ফেলে হেঁটে গেলেও তো কেউ নেই যে বলবে, আস্তে হাঁটো। এই কালোদের মধ্যে দু’শ হাজার ছিল প্রজাতন্ত্রের সৈন্য। তাই যখন যুদ্ধ শেষ হলো অনেকেই ঘরে ফিরে এল হাতের বন্দুক সাথে নিয়ে।

গিডিয়ন জ্যাকসন ছিল তাদেরই একজন। দীর্ঘ মজবুত দেহে ক্লান্তি, হাতে বন্দুক, গায়ে রংচটা নীল পোশাক, সে ফিরে এল ক্যারোলাইনার মাটিতে, কারওয়েল জমিদারিতে (প্ল্যান্টেশনে)। বিশাল সাদা বাড়িটা যেমন ছিল তেমনি দাঁড়িয়ে আছে ওর মনে পড়ল। যুদ্ধে তার কিছুই হয় নি। কিন্তু মাঠে আর বাগানে আগাছা, জঙ্গল। কারওয়েলরা চলে গেছে, কেউ জানে না কোথায়। মুক্ত মানুষেরা ফিরে এসে তাদের পুরোনো দাস কোয়ার্টারগুলোতে আবার জীবন শুরু করল, যারা কোথাও যায় নি তাদের সাথে। যতই মাস যেতে লাগল কারওয়েল জমিদারিতে আরও আরও মুক্ত মানুষেরা ফিরে আসতে লাগল, উত্তরের ঠান্ডা ভূমি থেকে, যেখানে তারা স্বাধীনতা খুঁজতে গিয়েছিল, ইউনিয়ন সেনাবাহিনী থেকে যেখানে তারা লুকিয়ে ছিল, পাইনের বনে অথবা জলাভূমিতে। সব জায়গা থেকে মুক্ত মানুষের দল ফিরতে লাগল। পুরোনো জীবনে ফিরে গভীর বিস্ময়ের সাথে ওরা দেখল যে ওরা এখন স্বাধীন।

পর্ব ১ : নির্বাচন

নভেম্বরের শীতার্ত সকালে কাকের ডাক র‌্যাশেলের ঘুম ভাঙিয়ে দিল। জেনি ওর বুকের কাছে একটা গরম পুঁটুলি হয়ে ঘুমিয়ে আছে, পুরোনো কাপড়টা গলায় জড়িয়ে আরাম করতে করতে ও কাকের গান শুনতে লাগল। বহুদূর থেকে কা কা শব্দটা একটা বিষণ্ণতা বয়ে আনছে, তবে র‌্যাশেলের মতো যারা এটি অনেকদিন ধরে শুনছে তাদের কাছে খারাপ লাগে না, এ যেন প্রতিটি ভোরের সূর্যোদয়ের মতই নৈমিত্তিক। দিনটি শুভ অথবা অশুভ যাই হোক না কেন, কাকের কাছে সমান।

বুকের কাছে নরম পুটুলির মতো মেয়েটা কেঁপে উঠল। র‌্যাশেল ফিস ফিস করে বলল, ‘শুয়ে থাকো সোনা, লক্ষ্ণী হয়ে শুয়ে থাকো, আর শোনো সেই পুরোনো কাকের ডাক।

কিন্তু দিন শুরু হয়ে গেছে, তাকে তো থামানো যাবে না। খড়ের থলেটা গরম আর মুচমুচে, র‌্যাশেলেরও ইচ্ছে করছে সেখানে শুয়ে থাকতে। কিন্ত যখন হঠাৎই সূর্যটা কুয়াশার ঘের ভেঙে বেড়িয়ে এল, দরজার ফাঁক দিয়ে, কাঠের সব বাঁকা কোণ গলিয়ে এসে আলোর কণাগুলো বিদ্ধ করল পুরো কুঠুরিটাকে। জেফ সোজা টান টান হয়ে মেঝেতে পা ঠুকতে লাগল। র‌্যাশেলকে জড়িয়ে ধরে থাকা জেনি জেগে গিয়ে ওকে একদিকে ঠেলে দিল। ও যেখানে শুয়ে ছিল সেই গরম জায়গাটায় শীত সিরসিরিয়ে উঠল। মার্কাস হুই হুই বলে শব্দ করতে লাগল। জেফ ওকে গুঁতো দিল। তারপর দুজনেই হাতাহাতি করতে করতে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল।

ভোরবেলার এই সব শব্দই র‌্যাশেল চোখ বুজে টের পাচ্ছিল। নিজেকে ও একশবার জিজ্ঞেস করেছে কেন মানুষ এমন হঠাৎ করে, এমন মজার ভাবে ঘুম থেকে জেগে ওঠে? আরো একটুক্ষণ ও চোখ বুজে অন্ধকারটাকে অনুভব করল, পা ঝাঁকিয়ে সবাইকে থামাতে চেষ্টা করল, ‘থামো তো জেফ।’

জেফের পা তখন মার্কাসের পেট জড়িয়ে ধরেছে। ওর বয়স পনের কিন্তু ও পেয়েছে গিডিয়নের গড়ন। কিভাবে একজন কেউ পুরুষ মানুষ হয়ে ওঠে তা জানার আগেই ও বিশাল দৈত্যের মতো হয়ে উঠছে। ছয় ফুট লম্বা, বাদামি চকোলেট-রং ওর মতোই বেশি, গিডিয়নের মতো চকচকে কালো নয়, তবে গিডিয়নের মতো লম্বাটে মুখ আর সুদর্শন। যেন জন্মেইছে মেয়েদের জীবন নরক করে দিতে। অথচ মার্কাস বারো বছরে শুকনো হাড্ডিসার ছিল। র‌্যাশেল জেফকে ধমকে উঠল, ‘এ্যাই বোকা হাঁদা পা সরাও তো!’

জেনির বয়স সাত। ছুটে ও দরজার বাইরে চলে গেল, রোজ যেমন যায়, প্রথম আলোর আকাঙ্ক্ষায় ছুটে যাওয়া এক প্রাণীর মতো। ওকে দেখেই কুকুরটা মাথা নাড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল।               

জেফ উঠে দাঁড়াতে মার্কাস ওকে এক ঘা লাগিয়ে দিল যেন একটি কাঠঠোকরা বিশাল একটি গাছে ঠোকর মারছে। জেফ গিডিয়নের মতই খুব সহজ সরল সোজা ছেলে কিন্তু বুকের ভেতরে লুকোনো ইস্পাত কাঠিন্যটা ওর ভেতরে নেই যা কিনা গিডিয়নকে বিশেষ একজন মানুষ করে রেখেছে। জেফ সহজে রেগে যায় না বটে কিন্তু রেগে গেলে আগুনের মতো জ্বলে ওঠে। গিডিয়নের ক্রোধ ওর একান্ত ভেতরেই থাকে।

‘যাও দুজনেই বেরিয়ে যাও।’ র‌্যাশেল বলে উঠল, ‘দুজনেই এখান থেকে বেরিয়ে যাও।’

ও তখন হাসছে রীতিমত। রাশেল নিজে ছোটখাট চেহারার আর তাই ওর মস্ত বিস্ময় যে এই কৃষ্ণ সবল মাংসপিণ্ডগুলো ওরই একান্ত, ওরই দুই উরুর ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এসেছে, ওরই নাড়ির সাথে বাঁধা ছোট্ট পুটুলিটা থেকে। তবে হ্যাঁ, ওর মানুষটি ছিল বিশাল, গর্বের সাথে ও ভাবল এরা গিডিয়নের বাচ্চা। ঘরের চারদিকে তাকাল। ঘরটা এখন আলোয় ভরা, দরজাটা একদিকে নড়ছে। জেফ একটুকরো শুকনো কাঠ নিয়ে ঘরে ঢুকল। বৃষ্টির পানি জমানো পিপেতে মাথা ডোবানোয় ভেজা মাথা থেকে চুঁইয়ে পানি পড়ছে। ও নিজে পিপেটার কাছে গেল, ওর নিজের মাথা আর হাত চুবিয়ে তারপর জেনিকে ডাকল।

‘এসো এসো, তোমার ধোয়ার কাজটাও সেরে ফেল।’

পানিকে জেনি ঘেন্না করত। ওর উলের মতো চুলে ভরা মাথাটা পানিতে চুবানোর আগে অন্তত পাঁচবার ওকে ডাকতে হবে। এমন ভাবে চিৎকার করতে থাকবে যেন একটু ঠান্ডা পানি ওকে মেরে ফেলবে। যখন র‌্যাশেল ঘরে ফিরে এল, জেফ আগুন জ্বালিয়েছে। ও কাঠের গামলাটা নিয়ে খাবার মেশাতে লাগল, এদিকে জেফ গরম কাঠকয়লাগুলোতে ফুঁ দিয়ে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে ফেলেছে। নভেম্বরের এই শীতার্ত সকালে কুকুরটা আগুনের সামনে শুয়ে রইল।

প্রায় এক দশক আগে, তার সেই চরম গৌরবদীপ্ত অতীতে কারওয়েল প্ল্যানটেশনে দক্ষিণ ক্যারোলাইনার বাইশ হাজার উর্বর মাটি ছিল। সমুদ্রের তীর থেকে একশ মাইল ভেতরে, এই ভূমি শান্ত চড়াই-উৎরাই-ভরা দেশের ভেতর দিয়ে এমনভাবে চলে গেছে যেন সমতলের জোয়ারজল ও উঁচু পাহাড়ি ভূমির ভেতর এটি একটি সীমান্ত রেখা। যখন তুলোই এখানকার রাজা ছিল তখন একরে এর ফলন ছিল দেড় বেল (একটি মাপ), আর যখন দানাগুলো ফেটে তুলো বেরুত যদ্দুর চোখ যেত মনে হতো গভীর এক শ্বেতসমুদ্র।

পুরো দৃশ্য জুড়ে বিশাল খামারবাড়িটিরই আধিপত্য। চারতলা বাড়িটিতে বাইশটা ঘর, গ্রিক মন্দিরের মতো স্তম্ভওলা সামনের ঝুলবারান্দা। এটা দাঁড়িয়েছিল একটি উঁচু পাহাড়ের চুড়োয়, ভৌগলিকভাবে খামারটির একেবারে মাঝখানে। উইলো গাছের সারি চমৎকার একটি গাড়ির রাস্তা করে দিয়েছে। সতেজ ওক গাছগুলো সুরক্ষিত দেয়াল তৈরি করেছে। তুমি যদি আধ মাইল দূরে দাসদের কোয়ার্টারে দাঁড়াতে আর বিশাল সেই বাড়িটার দিকে তাকাতে তাহলে এটাকে আরো বেশি মন্দিরের মতো দেখতে লাগত। আর যখন সেটার পেছন দিয়ে আকাশে সাদা মেঘের দল ভেসে যেত তখন সেটা ঐ অঞ্চলের সব চেয়ে সুন্দর দৃশ্য হত।

সে তো অনেক অনেক পুরোনো দিনের কথা। এ বছর এই ১৮৬৭ সালে এখানে কোনো তুলো চাষ নেই। শোনা যায় যে ডাডলি কারওয়েল চার্লস্টনে থাকে, কিন্তু কেউই ঠিক মতো কিছু জানে না। আরো শোনা যায় কারওয়েলদের দুটো ছেলে যুদ্ধে মারা গেছে। ঋণ আর অনাদায়ী করের বোঝায় প্ল্যান্টেশনের অবস্থা অচলপ্রায়, যে অবস্থা এখন বৃহত্তর দক্ষিণের বেশিরভাগ প্ল্যনটেশনরই। বলা হয় যে এখন সরকারই এর মালিক, এমনও শোনা যায় যে প্রত্যেক পুরোনো কারওয়েল ক্রীতদাসকে চল্লিশ একর করে জমি দেয়া হবে আর একটি খচ্চর। এসব কথা আগুনের মতো ছড়ায় কিন্তু কেউই আঙুল ঢুকিয়ে বুঝতে পারে না ঠিক কি করতে হবে। অনেকবার সাদা লোকেরা কলাম্বিয়া থেকে গাড়ি করে এসেছে, এদিক ওদিক ঘুরে নাক গলাতে চেয়েছে, তারপর চলে গেছে।

এর মধ্যে মুক্ত দাসেরা এখানে বাস করতে শুরু করেছে। এদের মধ্যে অনেকেই যুদ্ধের প্রায় পুরো সময়টা এখানে ছিল, একের পর এক শস্য ফলিয়েছে, জায়গাটির দেখাশোনা করেছে। অন্যেরা গিডিয়নের মতো ইউনিয়ন আর্মিতে যোগ দিয়েছে। অনেকে আবার পালিয়ে গেছে, লুকিয়ে থেকেছে। তারপরও যখন মুক্তি এসেছে, বেশিরভাগ লোক থেকে গেছে যতটা নয় পলাতকদের জন্যে যে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা হয়েছে তার  চেয়ে বেশি এই জন্যে যে, ওদের তো আসলে যাবার কোনো জায়গা নেই। এটাই ওদের বাড়ি, এই মাটি ওদের, এটাই ওদের দেশ।                            

ভোট সেরে ফেরার সময় মার্কাসই প্রথম গিডিয়নকে দেখতে পেয়েছিল, পরে ও সেকথা মনেও রেখেছিল। ও, অ্যাক্স খ্রাইস্ট আর ক’জন ছেলে প্ল্যান্টেশন বাড়ির সামনে খেলা করছিল। ওরা যখন পাহাড়ের ওপরে উঠেছিল দেখতে পাচ্ছিল বাইরে রোদে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা রাস্তাটার প্রায় দুই মাইল অব্দি। রাস্তাটা কোথাও নিয়ে যায় না। কেউ বলে এটা ধরে তুমি যদি অনেকদূর যাও, তাহলে কলোম্বিয়ায় পৌঁছে যাবে। কিন্তু ওগুলো তো শোনা কথা আর এমন শোনা কথাই তো দুনিয়া জুড়ে ছড়ানো। মার্কাস আর ওর বন্ধুরা ভাবে রাস্তা চলে গেছে এই তো ব্যস, কোথাও আবার যেতে হবে কেন?

চারদিন আগে গিডিয়ন আর ব্রাদার পিটার একুশ বছরের ওপরে সব লোককে ডেকেছিলেন। এরও বেশির ভাগটাই আন্দাজের ওপর। কি করেই বা তারা জানবে যে তারা বিশ না একুশ না বাইশ? বয়স কোনো আন্দাজে ধরে হিসেবের ব্যাপার নয় বরং অংকে তাকে মেলাতে হয়। ব্রাদার পিটার তার স্মৃতি তন্নতন্ন করে খুঁজে অসংখ্য কালো জন্মকে আলাদা করেছেন আর শেষ পর্যন্ত তাঁর ভাষায় গরু থেকে বাছুরকে আলাদা করতে পেরেছেন। মোট সাতাশজন যাবে ভোট দিতে।

‘এখন এই ভোটটা কি শুনি?’ ওরা গিডিয়নের দিকে উত্তরের আশায় ফিরে তাকাল।

মার্কাস জানত সবাই গিডিয়নের দিকে ফিরে তাকাবে, সেটাই স্বাভাবিক। মৃত্যু আর ঈশ্বর – হ্যাঁ, এমন ব্যাপার হলে ওরা ব্রাদার পিটারকে জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু এছাড়া বাকি সব, চাষবাস, অসুখবিসুখ, সবকিছু ওরা জমিয়ে রাখবে গিডিয়নের জন্য।

আর এখন ওরা ভোট দিয়ে ফিরে আসছে। মার্কাস দেখতে পেল দুই মাইল দূরে ধূলিধূসরিত পথে একদল লোক ধীরে ধীরে হেঁটে আসছে। পাহাড়ের পাশ দিয়ে দৌঁড়ে যেতে যেতে মার্কাস চিৎকার করতে লাগল, ‘ওরা আসছে! ওরা আসছে! হুই….হুই….’

ওর পেছনে অন্য ছেলেরাও এসে জড়ো হলো আর এমন চেঁচাতে লাগল যে একমাইল দূর থেকেও শোনা যায়। হুড়মুড়িয়ে সবাই তাদের কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে এল কি হয়েছে দেখতে। র‌্যাশেল ভাবল কেউ বুঝি খুন হয়েছে, ও মার্কাসকে দুটো চড়ই মেরে বসল ওর কথার মানে বের করতে।

‘কে আসছে?’

‘বাবা।’

‘গিডিয়ন?’ সিস্টার ম্যারি জিজ্ঞেস করলেন, কেউ একজন সবার মনের আবেগ যোগ করে বলল, ‘ঈশ্বরের দয়া।’ এই ভোটটা একটা রহস্য, এটা অশুভ। সব পুরুষ মানুষরা চলে গিয়েছে আর দীর্ঘ নিঃসঙ্গ প্রতীক্ষার প্রহর কেটেছে এখানে, বিশেষ করে কেউই যখন জানে না ভোট কি! মেয়েরা আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে আসে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায় এই অনুমান করে যে, ভোট কি?

সবাই এখন চোখ মুছে পথের দিকে তাকাল। হ্যাঁ, নিশ্চিতই পুরুষ মানুষগুলো ফিরে আসছে। ধীরে হাঁটছে – অনেকটা পথ হাঁটতে হয়েছে তো, কিন্তু ফিরে আসছে। যারাই গুণতে পারে তারা সবাই গুণে দেখল, মনে হলো যে ক’জন গিয়েছিল তারা সবাই আসছে। র‌্যাশেল এর মধ্যেই গিডিয়নকে চিনে ফেলেছে, ওই তো ওর বিশাল দীর্ঘ দেহ।

গিডিয়ন একজন মানুষ বটে, ষাড়ের মতো গড়ন, বিশাল চওড়া কাঁধ, কোমরটা সরু, পা দুটো চিকন, যেরকম মানুষকে ষাড়ের মতো বলে, ঘিলুটা হাতের মুঠোয়। তবে গিডিয়ন ঠিক প্রবাদে যেমন বলে তেমনও নয়। ও ওর মতই। সবাই যে ওর দিকেই তাকায় তার একটা কারণ আছে। এটা ঠিক যে ওর শরীর আর মাথা দুটোই ধীরে এগোয় কিন্তু যদি দরকার পড়ে ও ঠিকই তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায়। যখন ওর মাথায় কোনো ভাবনা আসে সেটা উল্টে পাল্টে দেখতেই থাকে, একবার যখন মন ঠিক করে ফেলে তখন সেটা ওরই।

প্রথমে ও-ই এল আর র‌্যাশেল ওকে চিনে ফেলল, সেই ধীরে ধীরে ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটাই জানিয়ে দেয় কত কত মাইল ওরা পেছনে ফেলে এসেছে। বন্দুকটাকে টেনে টেনে নিয়ে হাঁটছে যেমনটি সেনাবাহিনীতে শিখেছে। কাঁধে একটি ঝোলা, নিশ্চয়ই তাতে বাচ্চাদের জন্যে কিছু আছে। ওর পাশে পাশে হাঁটছেন ব্রাদার পিটার, লম্বা, শুকনো, নিরস্ত্র, যাজকদের যেমন হওয়া উচিত। তারপর জেফারসন ভাইদুটো, দুজনের হাতেই রাইফেল। ছোট্ট হ্যানিবাল ওয়াশিংটন। জেমস, এনড্রু, ফার্দিনান্দ, আলেক্সান্ডার, হ্যারোল্ড, বাক্সটার, ট্রুপার, – এদের এখনো কোনো পারিবারিক নাম হয় নি। হয়ত শিগগিরই ওরা এ নিয়ে ভাববে আর কোনো নাম নিয়ে নেবে। তবে পারিবারিক নাম ঠিক করা একটা চিন্তার বিষয়ই বটে, বেশিরভাগ মানুষই এসব নিয়ে সহজে খুশি হয় না।       

পুরুষ মানুষদের দিকে জেফ দৌড়ে গেল, সাথে সাথে এক দঙ্গল বাচ্চা, মহিলা আর কিশোরী সবাই। র‌্যাশেল গেলনা। মার্কাসের কলার ধরে ওকে থামিয়েছে কুয়ো থেকে পানি তুলে দেয়ার জন্য, গিডিয়ন এলেই যেন ঠান্ডা পানি দিয়ে তেষ্টা মেটাতে পারে। ওকে কখনো বোকা বাচ্চাদের মত গিডিয়নের দিকে দৌড়ুতে হয় না। ওরা দুজন দুজনকে ভালই বোঝে।

নভেম্বরের এই শেষ বিকেলেও আজ বেশ গরম। গিডিয়ন আর ওর দলবল যখন কোনো রকমে হাঁটতে হাঁটতে ওদের কুঁড়েগুলোর কাছাকাছি এসেছে তখন ওদের কাল মুখে ঘামের ধারা, ধুলোয় ওদের চকচকে ফিতেগুলো ধুয়ে গেছে। র‌্যাশেল যে ওদের দরকারটা বুঝতে পেরেছিল তা বোঝা গেল যেভাবে ঢকঢক কওে ওরা ঠান্ডা পানি খেল তাতেই। আরো পানির জন্য কাঠের মগগুলো বাড়িয়ে দিতে লাগল। সবারই কিছু প্রশ্ন আছে, সেগুলো বৃষ্টির মতো সজোরে ঝরে পড়তে লাগল।

‘আচ্ছা এই ভোটটা তাহলে কি?’

‘তোমরা কিছুই আনো নি? ভোট কোথায়?’

‘ভোট কেন নি তোমরা?’

‘কিনেছ? কত দিয়ে?’

‘সাদা লোকদের কত ভোট আছে?’

‘সেগুলো কত বড়?’

‘কতগুলো?’

শেষ পর্যন্ত ব্রাদার পিটার মরিয়া হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন , ‘ভাই বোনেরা, বাচ্চারা, একটু থাম, চুপ কর, শান্ত হও, তোমাদের সব কথার উত্তর আমরা দিচ্ছি।’

পুরুষেরা তাদের স্ত্রী আর বাচ্চাদের চুমু খেল। গিডিয়ন র‌্যাশেলকে হাতের বাঁধনে টেনে নিল, শান্তভাবে চুমু খেল।

ওরা মিষ্টি মিছরি এনেছিল, সেগুলো এরই মধ্যে সবার হাতে হাতে ঘুরতে লাগল। গিডিয়নের ঝোলাটা খুলল, জেনির জন্যে ছিল লাল চৌখুপী আঁকা কাপড়ের তৈরি একটি গোলাপ, একেবারে সত্যিকার গোলাপের মতো দেখতে, যার ভেতরে কি সুন্দর মিষ্টি গন্ধ! সবার কথায় তুমুল হৈচৈয়ের শব্দ হচ্ছিল কিন্তু কেউ ভোটের কথা কিছু বলছিল না। কুকুরগুলো পাগলের মতো ছোটাছুটি করছিল, কারণ কুকুরদের মতই ওরাও আদরের অনেকটা ভাগ চাইছিল। শেষ পর্যন্ত ব্রাদার পিটার হাত তুলে সবাইকে শান্ত হতে বললেন। যাহোক কোনো রকমে থামানো গেল। পুরুষেরা গোড়ালির ওপর ভর দিয়ে বসল, বাচ্চারা ঘাসের ওপর বসে বা শুয়ে পড়ল। মহিলারা বসে পড়ল, অথবা একজন আরেকজনের ঘাড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।     

‘ভাই গিডিয়ন তোমাদের বলবে এই ভোট হলো বিয়ের মতো বা খ্রিসমাসের উপদেশ বাণীর মতো’, ব্রাদার পিটার বললেন। ‘এটা সবার জন্যেই। সরকার জিবরাইল ফেরেশতার মতো একটি শক্ত সমর্থ হাতকে ঠিক করবেন ও বলবেন এখন তোমরা নিজেরা ঘোষণা দাও। আমরা তা দিয়েছি। বোধ হয় আরো পাঁচশ কালো ও সাদা লোকের সাথে মিলে একজনকে প্রতিনিধি ঠিক করতে বলল সরকার। আমরা গিডিয়নকে ঠিক করেছি।’

গিডিয়ন ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। লোকেরা তাকে দেখতে লাগল, চোখে অনিশ্চিতের ছায়া। র‌্যাশেল বুঝতে পারল ও ভয় পেয়েছে, গিডিয়নের প্রতিটি ভাবভঙ্গি, আবেগ ও বুঝতে পারত। ওকে যে বানানো হয়েছে এর মানেটা কি? প্রতিনিধি মানে কি?

‘আমরা গেলাম আর ভোট দিলাম’, গিডিয়ন বলল। ওর গলার স্বর অনেক পরিণত, তবে খুব ধীর হয়ে এসেছে, এখন ব্যাপারগুলো ও মনে মনে উল্টে পাল্টে সাজিয়ে নিচ্ছে।

‘ ভোট দেয়া .. ’, গিডিয়ন বলল।

ওর মনে পড়ল মাত্র ক’দিন আগে ওরা যখন শহরে ভোট দিতে গেল তখন কেমন ছিল। ওদের নিজেদের দলের ভেতরেই একটা সন্দেহ ছিল ভোট কি তাই নিয়ে। ব্রাদার পিটার আর ও যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে বোঝাতে যে এটা হল নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই ঠিক করা। ওরা এখন মুক্ত মানুষ ওদের নিজস্ব মতামত আছে। যখন ওদের নিজেদের জীবন নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠবে তখন তাদের মতামত সেই কণ্ঠস্বরে প্রকাশ করবে, সেটাই ভোট। কিন্তু এগুলো সবই তো বিমূর্ত বিষয়, এই বিমূর্ততা ওদেরকে র্ধাঁধায় ফেলে দিল। ওরা অপেক্ষা করে দেখবে ব্যাপারটা কি দাঁড়ায়।

যখন শহরে গেল গিডিয়নের মনে হয়েছিল পৃথিবীর সব সাদা ও কালো মানুষরা বুঝি এখানে এসে ভীড় করেছে। এখানে সেখানে সবখানেই জটলাবাঁধা মানুষ। বড় রাস্তার ওপরে, গাড়ি বারান্দায়, বিশাল স্তম্ভের ধারে, সবাই প্রাণপণে চেঁচাচ্ছে আর ভোট নিয়ে কথা বলছে। এদের সাদা কালো অর্ধেকের হাতে বন্দুক। ইউনিয়ন বাহিনীর একটি কোম্পানি সবাইকে শান্ত রাখছিল। গিডিয়ন ঈশ্বরকে সেজন্যে ধন্যবাদ দিল, যত বেশি বন্দুক ততবেশি গরম মাথাও এখানে আছে।

(চলবে)

অনুবাদক

মোবাশ্বেরা খানম বুশরা-র জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, বেড়ে ওঠা ঢাকায়। বাবা মোহাম্মদ মোস্তফা আলী ‘কাশতকার’ ছদ্মনামে জনপ্রিয় ছিলেন কৃষিবিষয়ক লেখালেখির জন্যে। মা মোহসেনা খানম আগ্রহী ছিলেন চিত্রাঙ্কনে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরোজি বিভাগে স্নাতক, মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। বেশ কিছু টেলিভিশন নাটকের নাট্যরূপ দিয়েছেন যেগুলো প্রচারিত হয়েছে বিভিন্ন চ্যানেলে। নাট্যরূপ দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের। মৌলিক নাটকও লিখেছেন। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক ও ডীন হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে অবসর জীবন যাপন করছেন। জীবনসঙ্গী : বরেণ্য চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন নাটক নির্মাতা সাইদুল আনাম টুটুল (প্রয়াত)। তাঁদের দুই কন্যা ঐশী আনাম ও অমৃতা আনাম। প্রকাশিত অনূদিত গ্রন্থ : মার্ক টোয়েনের আত্মজীবনী (মূল : মার্ক টোয়েন), নারীর ভাগ্য জয়ের অধিকার (মূল : ম্যারি উলস্টোনক্রাফট), নারী এবং ক্রমবিবর্তিত সভ্যতা (মূল : উইনিফ্রেড হন্টবি), শৈশব, কৈশোর ও যৌবন (মূল : লিও তলস্তয়), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি (মূল : এ জি স্টক)। স্মৃতিচারণ : পাতার কুটির।

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field