গদ্য বিশেষ সংখ্যা

রাত দখল দিন বদল | জয়া চৌধুরী | গদ্য | রাত দখল

প্রিয় পাঠক, আমাদের এই ভূখণ্ডে ‘জুলাই আন্দোলনে’র কিছুদিন পরেই সীমান্তের ওপারে শুরু হয় ‘রাত দখল’-এর আন্দোলন। জুলাই আন্দোলন নিয়ে তীরন্দাজ একটি বিশেষ সংখ্যা করেছে। এরপর ইচ্ছে ছিল ‘রাত দখল’ নিয়ে একটা বিশেষ সংখ্যা করবার। সেইভাবে লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তারা লেখাও দিলেন, অনেকের কাছ থেকে লেখা পাওয়ার প্রতিশ্রুতিও পেলাম। কিন্তু এর মাঝে হঠাৎ করে তীরন্দাজ-এর ওয়েব সাইটটিতে প্রযুক্তিগত সমস্যা দেখা দিল। থমকে গেল প্রকাশনার কাজ। অবশেষে সেই সমস্যা কাটিয়ে সংখ্যাটি লেখকদের সামনে হাজির করতে পেরে আমরা আনন্দিত। সময় মতো প্রকাশের প্রতিশ্রুতি আমরা রক্ষা করতে পারিনি বলে সীমান্তের ওপারের লেখক বন্ধুদের কাছে দুঃখপ্রকাশ করছি। সংখ্যাটি কেমন লাগল, আমাদের জানাতে ভুলবেন না। চিঠি লেখার ইমেইল অ্যাড্রেস : eteerandaz@gmail.com
সবার জন্যে শুভকামনা।

কলকাতায় আন্দোলনটা শুরুই হয়েছিল প্রাতঃস্মরণীয় চিকিৎসক ডা. রাধাগোবিন্দ কর স্থাপিত হাসপাতাল আর জি করে কর্মরত একজন জুনিয়র নারী ডাক্তারকে কর্মরত অবস্থায় নৃশংসভাবে খুন ও ধর্ষণ করার একটি ঘটনার পর থেকে। ফেসবুক ইনস্ট্রাগ্রামে আসার পর থেকে এখন পৃথিবীতে কোনো প্রান্তে কোনো ঘটনা ঘটলে তার অভিঘাত দ্রুত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। এবং প্রায়শই সেসব হয়েও থাকে। কিন্তু কোনো কোনো ঘটনার অভিঘাত এত তীব্র হয়ে যায় যে শুরুতে কারো আন্দাজই থাকে না ক্রমে বিষয়টা কীভাবে বহু মানুষের মনোজগতে বিপুলভাবে ব্যাপ্ত হয়ে পড়বে। একত্রিশ বছর বয়সী ডাক্তার মেয়েটি ৯ আগস্ট কলকাতার কেন্দ্রে অত্যন্ত ব্যস্ত একটি সরকারি হাসপাতালে খুন ও ধর্ষিত হয়েছিল। তাও আবার টানা ৩৬ঘণ্টা ডিউটি চলাকালে। পরদিন মৃতদেহ তড়িঘড়ি করে পুড়িয়ে ফেলতে নিয়ে যাবার সময় শববাহী গাড়িটির যাত্রায় বাধা দিতে থাকেন ডি ওয়াই এফ আই দলের সম্পাদক মীনাক্ষী মুখার্জীসহ বেশকিছু বামকর্মী। আর ঠিক এ কারণেই মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষিত হয় বিষয়টিতে। মুহূর্তে ছড়িয়ে যায় মিডিয়া মারফত। মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ‘কাজের জায়গায়’ মানুষের প্রাণ সম্ভ্রম যদি না থাকে তার চেয়ে বিপজ্জনক অবস্থা কী হতে পারে? তাই এ অপরাধটিকে বিরল থেকে বিরলতম অপরাধই বলা যাবে। আশ্চর্যের এই যে, এত এত অপরাধ প্রতিদিন টিভিতে খবরের কাগজে দেখবার পরেও এই বিশেষ ঘটনাটিতে সাধারণ মানুষ দুঃখে রাগে ফেটে পড়ল। আর ঠিক তখনই হাসপাতালটির তৎকালীন অধ্যক্ষ বলে বসল “অত রাতে সে ওখানে কী করছিল।” যে ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের প্রধান দায়িত্বে রয়েছেন, তিনি নিজেই যদি পাষণ্ডের মতো এরকম অভদ্র মন্তব্য করেন, তাহলে মানুষের ক্রোধের মাত্রা চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছাবে বলাই বাহুল্য। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে বিগত একদশক ধরে সমাজের প্রতিটি স্তরে যেভাবে বেআইনি কাজ বেড়েছে, অপরাধ যেভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়ে চলেছে, তাতে জনমানস এমনিতেই ক্ষিপ্ত হয়ে ছিল, তার উপরে এই অপরাধটি ছিল ক্ষমার অযোগ্য। সারা পৃথিবীতেই হাসপাতালকে বিশেষ সুরক্ষিত স্থান বলে মর্যাদা দেয়া হয়। যুদ্ধের সময় শত্রুপক্ষের সেনাও যদি হাসপাতালে চিকিৎসারত থাকে, তাহলে তাকে অসুরক্ষিত অবস্থায় কিছু করা যায় না। সুস্থ হলে তবেই তার বিচার করা যায়। সভ্য সমাজের এটাই রীতি। খ্রিস্ট ধর্ম অধ্যুষিত দেশগুলিতে আরেকটি নিয়ম মান্য করা হয়। কেউ যদি অপরাধ করে গির্জায় আশ্রয় নেয়, অর্থাৎ গির্জায় ক্রুশ জড়িয়ে থাকে তাহলেও তার ক্ষতি করা যায় না। এ সবকিছুই সভ্য সমাজ স্বীকৃত ব্যবস্থা, যা পৃথিবীর সভ্য মানুষ মেনে চলে। কিন্তু আর জি করের ঘটনায় এর সবই ভয়ংকরভাবে লঙ্ঘিত হয়েছিল।

শুরুর দিকে হোয়াটসঅ্যাপে অনুরোধ এসেছিল “টেক দ্য ব্যাক নাইট” নাম দিয়ে একটি মেসেজে। “সকল নারী ও এলজিবিটিকিউ-এ বন্ধুদের অনুরোধ, আকাদেমি/ কলেজস্ট্রিট/ যাদবপুরে আসুন ১৪ই আগস্ট। হাজার খানেক জন নামুক না পথে একরাত! হবে না? …।” এর অর্থ আয়োজকদের তখনো জানাই ছিল না মৃতা ডাক্তার কন্যার জন্য সমস্ত মানুষের বুকে কতখানি কান্না ক্রোধ হয়ে জমে গিয়েছিল। সেদিন রাতে যখন পথে নামতে স্থানীয় এক জমায়েতে গেলাম, নাগের বাজারের সেই অঞ্চলে তার একটু আগেই স্বাধীনতা দিবস পালন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানের জন্য শাসক দলের মাইক বাজছিল। গুটি গুটি পায়ে ঘরের মেয়েরা যারা সাধারণত মিছিলটিছিলে বেরোন না, যারা কেউ হয়ত রাতের রুটিটুকু করে বেরিয়ে পড়েছেন পথে, কেউ অফিস ফেরত সোজা চলে গেছেন ধরনাস্থলে, মাসীমা, বৌদি, বোন, বান্ধবী… একের পর এক মেয়েকে দেখছি এসে পাশে দাঁড়াচ্ছেন। ক্রমে বহু পুরুষও এসে দাঁড়ালেন সামনে পাশে পিছনে। মুখ গম্ভীর ভ্রূ কোঁচকানো, চাপা রাগে গর্জন করে উঠেছিল বহু কণ্ঠ – উই ওয়ান্ট জাস্টিস। থানার পঞ্চাশ গজের মধ্যেই পুলিশ তখন হতভম্ব হয়ে দেখছে। শাসক দলের ধারণাই ছিল না ক্ষোভ এইখানে পৌঁছেছে। আর ঠিক সে রাতেই ওই হাসপাতালেই টানা চল্লিশ ঘণ্টা ভাঙচুর লুটপাট চালালো একদল দুষ্কৃতি। আশ্চর্যজনকভাবে মিডিয়ায় লাইভ দেখাচ্ছিল, পুলিশ তখন নিষ্ক্রিয় হয়ে দাঁড়িয়ে। কেউই কিছু বুঝতে পারছিল না কী হচ্ছে এসব!

সেদিন রাতের পরে যারা মিছিলটির ডাক দিয়েছিল পুলিশ বিভিন্ন ধারায় তাদের গ্রেফতার করে। তার মধ্যে কিছু কিছু ধারা জামিন অযোগ্য ছিল। তারপর থেকেই গত একমাসেরও বেশি ধরে আমরা স্বচক্ষে মিডিয়ায় ইনস্ট্রাগ্রামে যা যা দেখছি সবকিছুই ইতিহাস। পুরুলিয়ার গ্রাম থেকে পেনসিলভ্যানিয়ার গ্রাম… Reclaim the night রাত দখল অধিকার দখলের জন্য স্বতঃস্ফূর্ত জনজাগরণ দেখা যেতে লাগল। শুরুতে যা ‘বিশেষ’ কিছু মানুষের ছিল, ক্রমে তা ‘সামান্যে’ বদলে গেল। সকলেই ক্ষুব্ধ। তা যদি ‘রাত দখল করো’ এই শিরোনামে হয় হোক, মৃতা ডাক্তার মেয়েটির বিচার আমাদের সকলের চাই-ই চাই। এরই একটি অংশ হলো মেয়েদের রাতের বেলা বেরনোর সুরক্ষার জন্য আন্দোলন। একদিকে যখন ক্ষমতাসীন সরকার বিধানসভায় অপরাজিতা বিল পাশ করালেন, অন্যদিকে আবার মেয়েদের রাতে ডিউটি দেওয়াকে নিষিদ্ধ করলেন। এর বিরুদ্ধে ফের ফুঁসে উঠল জনতা। মেয়েদের সমানাধিকারের যুগে এটি যে প্রাগৈতিহাসিক যুগে ফিরে যাবার ষড়যন্ত্র, সে বিষয়ে কারোরই সন্দেহ রইল না। একের পর এক মিছিল হতে লাগল এই নারী নিরাপত্তার দাবিতে। জন্মাবধি এই মাত্রার গণআন্দোলন দেখার সৌভাগ্য কখনও হয়নি আমার। যেটা লক্ষ্য করছি, তা হলো এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য মৃতা ডাক্তার কন্যাটির হত্যা ও ধর্ষণের বিচারলাভ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নারী সুরক্ষার আন্দোলন। হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসা ব্যবস্থার সম্পূর্ণ সংস্কার চেয়ে আন্দোলন ইত্যাদি। একে প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা বলেই মনে করছে জনগণ এবং সম্ভবত তদন্তকারী সংস্থাটিও। যদিও মামলা মোকদ্দমার বিষয় এটি। অপরাধী চিহ্নিত করে শাস্তি দেবার বিষয়টি এখনও ঢের দেরি। কিন্তু একটি মেয়ের মর্মান্তিক পরিণতি অবিশ্বাস্যভাবে সাধারণ মানুষের বিবেকের জাগরণ ঘটিয়ে দিল। যারা যতক্ষণ পর্যন্ত না নিজের গায়ে আঁচড় পড়ছে ততক্ষণ অবধি নির্বিচারে চোখ বুজেই থাকে সারা বছর, তাদের বিবেক নাড়া খেল। এরপর পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম উৎসব আসন্ন দুর্গাপূজার মরশুম শেষ হলো। সারাজীবনে এমন নিষ্প্রাণ উৎসব কলকাতাসহ গোটা পশ্চিমবঙ্গে কেউ দেখেননি। কেউ কাউকে বারণ করেনি কিছুই। শাসক দল তো বারবার উৎসবে গা ভাসাতে বলেছে জনগণকে। কিন্তু মানুষের বিবেক সাড়া দেয়নি। তাঁরা ভাবছেন ঘরের মেয়ের হত্যার বিচার পেতেই হবে। রিকশাওয়ালা, চা বিক্রেতা, শসার ব্যবসায়ী থেকে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, ডাক্তার, শিক্ষক, আইটি কর্মী সমাজের সব স্তর থেকে মানুষ বুঝছেন আজ লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে এই ঘটনা বারবার হবে, সব ক্ষেত্রে হবে। এই ভয়াল করাপশানের অক্টোপাশ সবাইকে গিলে পিষে মেরে ফেলবে। এ শুধুই মেয়েদের রাতের অধিকার নয়, আসলে এ আপামর সমাজের অধিকারের প্রশ্ন। রাতে জনতার অধিকার সুরক্ষিত থাকলে মেয়ে ও পুরুষ দুজনেই ভালো থাকবে।

আমাদের যত দিন লাগুক এই সুস্থিতির অধিকার অর্জন করতে গেলে পথে নেমে ক্ষোভ জানাতেই হবে। মহাত্মা গান্ধীর দেশের মানুষ আমরা, গণতন্ত্রের দেশের মানুষ। সভ্য সমাজের রীতি মেনেই ছিনিয়ে নেব আমরা নারী সুরক্ষা তথা জনসুরক্ষার অধিকার। নির্বাচনের মাধ্যমে যদি কুশাসন ক্ষমতায় আসে তাহলে নির্বাচনের মাধ্যমেই সুশাসন ফিরিয়ে আনব আমরা। আমেরিকা যদি পেরে থাকে আমরা তাহলে কেন নয়?

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field