গদ্য বিশেষ সংখ্যা

বাঙালির ঘুরে দাঁড়ানোর শেষ চেষ্টা | শুভদীপ মৈত্র | গদ্য | রাত দখল

Kanishka

প্রিয় পাঠক, আমাদের এই ভূখণ্ডে ‘জুলাই আন্দোলনে’র কিছুদিন পরেই সীমান্তের ওপারে শুরু হয় ‘রাত দখল’-এর আন্দোলন। জুলাই আন্দোলন নিয়ে তীরন্দাজ একটি বিশেষ সংখ্যা করেছে। এরপর ইচ্ছে ছিল ‘রাত দখল’ নিয়ে একটা বিশেষ সংখ্যা করবার। সেইভাবে লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তারা লেখাও দিলেন, অনেকের কাছ থেকে লেখা পাওয়ার প্রতিশ্রুতিও পেলাম। কিন্তু এর মাঝে হঠাৎ করে তীরন্দাজ-এর ওয়েব সাইটটিতে প্রযুক্তিগত সমস্যা দেখা দিল। থমকে গেল প্রকাশনার কাজ। অবশেষে সেই সমস্যা কাটিয়ে সংখ্যাটি লেখকদের সামনে হাজির করতে পেরে আমরা আনন্দিত। সময় মতো প্রকাশের প্রতিশ্রুতি আমরা রক্ষা করতে পারিনি বলে সীমান্তের ওপারের লেখক বন্ধুদের কাছে দুঃখপ্রকাশ করছি। সংখ্যাটি কেমন লাগল, আমাদের জানাতে ভুলবেন না। চিঠি লেখার ইমেইল অ্যাড্রেস : eteerandaz@gmail.com
সবার জন্যে শুভকামনা।

বাঙালির ঘুরে দাঁড়ানোর শেষ চেষ্টা শুভদীপ মৈত্র | গদ্য | রাত দখল

কোনো প্রতিবাদ বা আন্দোলন চলাকালে সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা করা সম্ভব হয় না। যা বোঝার চেষ্টা করা যায় তা হলো এর কারণ কী, ঝোঁক কোন দিকে বা তা কোন দিকে যেতে পারে। কলকাতার আরজি কর মেডিকেল কলেজে একটি ধর্ষণ ও খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে ওঠা রাজ্যের রাজনীতি ও গণআন্দোলনের ক্ষেত্রেও এই মুহূর্তে শুধু সেইটুকুই পর্যালোচনা করা যায়। প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে ধর্ষণ ও খুনের মতো অপরাধ নতুন নয়, এবং এমন অপরাধ কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নয়। পশ্চিমবঙ্গ কেন, গোটা ভারতবর্ষ এবং পৃথিবীজুড়ে মেয়েদের সঙ্গে যে অপরাধ ঘটে চলেছে, তার সংখ্যা কিছু কম নয় এবং তা ঘটমান, আজও, এই মুহূর্তেও। তা সত্ত্বেও এই একটি ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের জনসমাজকে এভাবে নাড়িয়ে দিল কেন, এবং প্রতিবাদ ক্রমশ আন্দোলনে পরিবর্তিত হল কেন – এটা ভাবার বিষয়।

আরজি কর মেডিকাল কলেজের জুনিয়ার ডাক্তারকে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা একটা প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিয়েছে। মনে হচ্ছে এ একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয়ের চিহ্ন। এটি মানুষের সহ্যের সীমানা পেরিয়ে হতাশা ও রাগের বহিঃপ্রকাশ হয়ে উঠেছে। প্রাথমিক স্লোগান উঠেছিল উই ওয়ান্ট জাস্টিস। এই জাস্টিস বা বিচারের দাবি শুধুমাত্র একটি ঘটনায় আর আটকে নেই, বরং মানুষের কাছে বিচার ব্যবস্থার একটি পরীক্ষা হয়ে উঠেছে। জাস্টিস বা বিচার সার্থক হয় শুধুমাত্র অপরাধীর শাস্তিতে নয় বরং অপরাধ দমন ও অপরাধমুক্ত একটা সমাজ গঠনের প্রয়াসে। এবং এ অবশ্যই একটি রাজনৈতিক দাবি। একটি সমাজ যখন মনে করে যে সে তার ন্যায্য বিচার পাচ্ছে না, তার পিছনে অবশ্যই থাকে প্রশাসনিক ব্যর্থতা, এবং যে প্রশাসন সাংবিধানিকভাবে দায়বদ্ধ দেশের নাগরিকের কাছে। সরকারে থাকা দল নাগরিকের ভোটে জিতে আসা তাদের প্রতিনিধি মাত্র এবং তার দায়িত্ব পালনে সে বাধ্য – অন্তত আদর্শ গণতন্ত্র বলতে সেটাই বোঝায়। সমস্যা হয় যখন ক্ষমতার গর্বে এবং শক্তিতে বলিয়ান হয়ে সেই জায়গাটা যদি তারা নষ্ট করে দেয়। পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকদের মনে এই ভাবনাই রয়েছে যে আরজি কর কান্ড সাধারণ অপরাধ নয় এর পিছনে রয়েছে প্রশাসনিক ব্যর্থতা এবং হয়ত তার একাংশের মদতও। তার কারণও রয়েছে।

সংবিধান স্বীকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকদের অধিকার থাকে অর্থনৈতিক, সামাজিক সুরক্ষার। সেই অধিকারগুলো যদি বিঘ্নিত হয়ে পরে তখন তার মনে ক্ষোভ জন্মায় এবং তার দাবিগুলোর কোনো সুরাহা না হলে, সে পথে নামে। ভারতবর্ষ তথা পশ্চিমবঙ্গে গত কয়েক দশকে এ ঘটনা ঘটেছে, সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলন থেকে কৃষক আন্দোলন সবেরই উৎস সেটাই। আমরা যদি পশ্চিমবঙ্গের কথায় আসি তো দেখা যাবে প্রায় দু-দশক আগে তৎকালীন রাজ্যসরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক এক গণ আন্দোলন হয় এবং ক্ষমতায় থাকা বামজোটের পরাজয় ঘটে নির্বাচনে। এই পরিবর্তনের পরে প্রায় দেশ দশক কেটে গেছে এবং বর্তমান শাসক দল ক্ষমতায়। এই দেড় দশকে এ রাজ্যের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার উন্নতির ক্ষেত্রে ব্যর্থতা মানুষের মনের ভিতর অস্থিরতা তৈরি করেছে। এবং কোথাও গিয়ে মানুষের মনে হচ্ছে যে এই সরকার তার দায়িত্ব নিতে ব্যর্থ শুধু নয়, প্রস্তুতও নয়। ফলে মানুষের নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে পথে নামতে বাধ্য হচ্ছে মানুষই। এবং তাদের দাবি তিলোত্তমার বিচার চাই।

এবার আসা যাক এই দাবির প্রশ্নে। এই দাবি একমাত্রিক নয়। এর অনেকগুলো স্তর রয়েছে। প্রাথমিক স্তর হল অপরাধী ও তার বা তাদের সাহায্যকারীদের খুঁকে বের করা ও শাস্তি। প্রশাসনের প্রাথমিক ভূমিকায় পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মনে হয়নি তা হয়েছে, এবং ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সুয়ো মোটো তা তদারকের দায়িত্ব নিয়েছে এবং কেন্দ্রিয় সংস্থাকে দিয়ে তদন্ত করানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের প্রতি মানুষের অনাস্থা স্পষ্ট এবং তারা যতদিন না কোনো স্পষ্ট বিচার পাচ্ছেন আন্দোলনে থাকতে চাইছেন। এর সঙ্গে মিলে গেছে দ্বিতীয় একটি দাবি তা হল নারী সুরক্ষা। কার্যত পশ্চিমবঙ্গে বর্তমান সরকারের আমলে পার্ক স্ট্রিট থেকে কামদুনি হয়ে আরজি কর পর্যন্ত নারী সুরক্ষার বেহাল দশা এবং সরকারের ব্যর্থতা নারীর মনে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। প্রত্যেক ঘটনার ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে রাজ্য সরকারের তাতে টনক নড়েনি, এবং প্রয়োজনীয় কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি। প্রথম দুইটি মিলিয়েই ১৪ অগস্ট-এর রাত দখলের ডাক দেওয়া হয় নাগরিকদের কাছে। এবং এই ডাকে অভূতপূর্ব সাড়া মেলে। এই সাড়ার দিকে তাকালে বোঝা যাবে এই দাবির পিছনে রয়েছে আরেকটি স্তর।

এই আন্দোলন শুধুমাত্র তিলত্তমার বিচার বা নারী সুরক্ষা পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সার্বিক আর্থসামাজিক অবস্থার ভেঙে পড়ার বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের প্রতিফলন হয়ে দাঁড়াল। না-হলে এত ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায় না, এবং এতদিন ধরে যে মানুষের স্বতস্ফুর্ত প্রতিবাদ আন্দোলনের কর্মসূচি চলছে তাও হয় না। এইটা একটা সার্বিক ব্যর্থতা ও অবস্থার বা বলা ভাল দূরবস্থার ফলশ্রুতি। জুনিয়র ডাক্তাররা কর্মবিরতির মাধ্যমে আন্দোলনে যে সামিল হন, তাতে তাদের যা দাবি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় একদিকে অর্থনৈতিক দুর্নীতি ও অন্যদিকে রাজনৈতিক ক্ষমতার হাত-মেলানোর ফলে সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, এবং একটা গা-জোয়ারি সংস্কৃতি বা থ্রেট কালচারের ফলে ডাক্তারি-শিক্ষা ব্যবস্থাতে ঘুন ধরেছে। এ এক মারাত্মক বিষয়। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, আরজি কর, ইত্যাদির মতো ডাক্তারি শিক্ষাকেন্দ্র গোটা দেশের ডাকআত তৈরির আঁতুরঘর, এর ইতিহাস আজকের নয়। সেই জায়গাটা নষ্ট হয়ে যাওয়া মানে দেশের মেধা-সম্পদের উপর হাত।

জুনিয়র ডাক্তাররা যে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামলেন এবং তাতে রাজ্যের মানুষের যোগদানের কারণও এইটা। এ-রাজ্যের অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সর্বত্র এই গা-জোয়ারি সংস্কৃতি ও দুর্নীনিতিতে তিতি-বিরক্ত মানুষ মুক্তি চাইছে, একটা সাফসুতরো ব্যবস্থা চাইছে। এইখানেই গণ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা। একটা গণতন্ত্রে সাধারণ মানুষ তার দাবি সম্পর্কে কতটা সচেতন এবং তার অধিকার সে প্রয়োগ করতে পারে তা দিয়ে গণতন্ত্রটির গুণগত অবস্থা বোঝা যায়। স্বৈরাচারের দিকে ঝুঁকে পড়ে একটা ব্যবস্থা যখন তা নিয়ন্ত্রণ করে দলীয় ক্ষমতা এবং লুম্পেনদের দিয়ে ভয় দেখিয়ে তাদের পদে বসিয়ে নাগরিকের অধিকার কেড়ে নিতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে আশঙ্কাজনক হয়ে উঠছে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও জীবিকার ক্ষেত্রে ক্রমশ এই দুর্নীতি ও পিছিয়ে পড়ছে ক্রমশ দেশের অন্যান্য জায়গার তুলনায়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে যে মানুষের অধিকার ব্যহত হচ্ছে, গোটা দেশের নিরিখে নির্বাচনী যে হিংসার যা সংখ্যা ও রূপ, তা এর প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। একদিকে ভেঙে পড়া আর্থসামাজিক অবস্থা অন্যদিকে স্বচ্ছ ও সুস্থ নির্বাচনী রাজনীতির অভাব মানুষের অধিকারের জায়গাকে একেবারে নষ্ট করে দিয়েছে। ফলে প্রতিবাদ ও আন্দোলন এত ব্যাপক ও বহুমুখী হয়ে উঠেছে।

এই আন্দোলন রাষ্ট্রবিপ্লব নয়, যেমন আমরা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখেছি। সব আন্দোলনের রাষ্ট্রবিপ্লব হয়ে ওঠার প্রয়োজনও থাকে না। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে সেটা অসম্ভবও। অনেকে যদিও বাংলাদেশের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন, সেটা একেবারেই ঠিক না, হয়ত আন্দোলনের পন্থা হিসেবে তার স্লোগান ইত্যাদির সঙ্গে কতক মিলের জন্যই হয়ত, কিন্তু দুটির উদ্দেশ্য আলাদা। প্রথমত পশ্চিমবঙ্গ ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য, এবং তার সরকার বা প্রশাসনের ব্যর্থতা সার্বিক রাষ্ট্র বা সংবিধানের পতন নয়। বরং দেখা যাবে ভারতের সুপ্রিমকোর্ট এই বিষয়ে যে মতামত রেখেছে তাতে স্পষ্ট যে নাগরিকদের এই আন্দোলনের আধিকার রয়েছে। দ্বিতীয়ত আন্দোলনকারীরাও লড়ছেন তাদের সংবিধানগত বিচার পাওয়ার আশায়, রাষ্ট্রব্যবস্থাকে উচ্ছেদের দাবিতে নয়। এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে সরকারে থাকা দলের বিরুদ্ধে মানুষের অনাস্থা যদি সরকার ফেলার দিকেও যায়, তা গণতান্ত্রিকভাবে অর্থাৎ নির্বাচনের মাধ্যমেই ঘটবে – এর অন্যথা হওয়ার কোনো উপায় যেমন নেই দাবিও নেই। এখানেই আসে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা। পশ্চিমবঙ্গের একটা বড় সমস্যা হল যে এখানে শাসকদল ঐতিহাসিকভাবে ক্ষমতায় দীর্ঘদিন থেকেছে এবং বিধানসভার আসনেও যে যখন ক্ষমতায় তার বিরোধী আসনসংখ্যা নগন্য থেকে গেছে। এর ফলে সাংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধীদের যে সদর্থক ভূমিকা সরকারকে সজাগ থাকতে বাধ্য করে এবং গণতান্ত্রিক রাখে, তার অভাব রয়েই গেছে।

এই সজাগ রাখার প্রশ্নটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। সংবিধান বলে দেশের মানুষই দেশের ক্ষমতার উৎস, সবার সমানাধিকার, সমান হক দেশ কেমন চলবে তার প্রশ্নে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে আধুনিক গণতন্ত্র বিশেষ করে এই উপমহাদেশে সেই সমানাধিকারের প্রশ্নে এখনও বহু কদম দূরে। উপমহাদেশে লিখলাম, কারণ এই সমস্যা কোনো না কোনো সময় কোনো কোনো জায়গায় বা কখনো একটা পুরো দেশ এই সমস্যার মুখে পড়েছে। নির্বাচনী গণতন্ত্রে দল ক্রমশ জাঁকিয়ে বসে এবং তাদের নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। ব্যবসায়ী ও পুঁজিপতি শ্রেণী তাদের সঙ্গে অন্যায় রফায় আসে, গণতন্ত্রের বাকি স্তম্ভগুলো আইন, প্রশাসন, সংবাদমাধ্যম সমস্ততেই তাদের নিজস্ব লোকজন বসাতে শুরু করে। এভাবে যে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের জায়গায় দলীয় গণতন্ত্র জাঁকিয়ে বসে। পশ্চিমবঙ্গে আমরা যা দেখছি তা তারই অতিসক্রিয় উদাহরণ। এবং এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয় যে সামান্য সরকার পরিবর্তনের জন্যও একটা আন্দোলনের প্রয়োজন হয়, সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে করা যায় না।

এর একটা বড় কারণ একুশ শতকের বুজোর্য়া ব্যবস্থা বা পুঁজির দাপট সাধারণ মানুষের অধিকারের জায়গাটা নষ্ট করে দিতে চায়। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে আজকে এই আন্দোলন এক নতুন জিনিস মনে হচ্ছে কেন? কারণ মানুষকে অরাজনৈতিক করে তোলা হয়েছে বিগত দেড় দশকে। যে দল ক্ষমতায় এসেছিল এক ব্যাপক গণ আন্দোলনের ফল হিসেবে, সে প্রথম সুযোগেই বনধ ইত্যাদি প্রতিবাদকে বেআইনি, ক্ষতিকর ইত্যাদি প্রমাণ করার চেষ্টা করল। রাজনীতিতে অপরাধী, গুন্ডা, লুম্পেনদের ঢুকিয়ে শিক্ষিত ভদ্র সাধারণকে অপসারিত করল। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির বৈশিষ্ট ছিল তাতে শিক্ষিত, মননশীল, মেধাবী মানুষের প্রতিনিধিত্ব – যা একটা সামাজিকভাবে নৈতিকতার বাতাবরন বজায় রেখেছিল। সেই জিনিসটা চলে গেল রাজনীতি থেকে। এই চলে যাওয়ার ফল হল ভয়াবহ। মধ্যবিত্ত শ্রেণী, যে এই গা-জোয়ারি সংস্কৃতি ও দুনীর্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারত, কারণ তাদের একটা সামান্য হলেও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ছিল – সেই জায়গাটা নষ্ট হয়ে গেল। আর আপামর গরিব সাধারণের পক্ষে ক্ষমতার বিরুদ্ধে একা দাঁড়ানো অসম্ভব তাদের ভয় দেখিয়ে, কখনো সামান্য কিছু টাকা ভাতা ইত্যাদির নাম করে দিয়ে মুখ বুঁজিয়ে দেওয়া হল। তাদের হল সবচেয়ে সর্বনাশ। মধ্যবিত্ত তবু বেসরকারি শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের সুযোগ নিতে পারে, আর্থিকভাবে পিছিয়-পড়ার সে জো নেই। না সে পেল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, না জীবিকা। এদিকে তার পরবর্তী প্রজন্ম শিক্ষার অভাবে হয় লুম্পেনে পরিণত হল অথবা পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে গেল। অপরদিকে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত-মানসকে শুনতে হল আন্দোলনজীবীর উপহাস, এভাবে ক্রমশ মানুষের ন্যায্য দাবিগুলোকে তোলার উপায় বন্ধ করে চালু হল বিকট এক লুম্পেন শাসন। পশ্চিমবঙ্গে শুরু হল চাঁদা-তোলা-কাটমানির অর্থনীতি। অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠল, বালি মাফিয়া থেকে পাচারকারীরা জায়গা নিল সুস্থ ব্যবসার জায়গায়। এই অবস্থায় যে সাংস্কৃতিক অবক্ষয় শুরু হয় তার লক্ষণ প্রকট হয়ে উঠল। বাংলা সিনেমার জগতে একইরকম দাদাগিরির আস্ফালন শুরু হল, গোটা দেশের ফিল্ম-ইন্ডাস্ট্রির তুলনায় পিছিয়ে পড়ে প্রায় ধরাশায়ী অবস্থা হল, সাহিত্যেও এক দশা – একের পর ধামাধরাদের পদে বসিয়ে টাকার হরির-লুট চালিয়ে মধ্যমেধাকে প্রশ্রয় দেওয়া হল। বাঙালী কবি সাহিত্যিকদের প্রথম দেখা গেল কোনো রাজনৈতিক নেত্রীর সামনে নতজানু হয়ে চেয়ার মুছতে, আমরা জানতাম রবীন্রনাথের পায়ের সামনে বসে তার বানী শোনেন নেহরু, এখন দেখলাম উলটোটা। শিক্ষিত শ্রেণীর চাকরি নেই, ব্যবসাবানিজ্য নেই। একদিকে যেমন বিশাল সংখ্যক মানুষ পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে ভিন রাজ্যে যাচ্ছেন, তেমনি শিক্ষিত মেধাবীদের ব্রেন ড্রেন ঘটছে, তারাও সুযোগের অভাবে রাজ্য ছাড়ছেন। সার্বিকভাবে এ রাজ্য প্রায় অন্ধকারে তলিয়ে যেতে বসেছে। এভাবে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির প্রায় যখন ভেন্টোলেশনে যাওয়ার অবস্থা – সেই সময় এই আন্দোলন তার শেষ-চেষ্টা ঘুরে দাঁড়ানোর।

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field