গদ্য

`প্রায় শূন্য’ শূন্য নয় | ফেরদৌস হৃদয় | কবিতার কথা

সম্পাদকীয় নোট

কীরকম কবিতা লেখেন জাহিদ সোহাগ? একটি কবিতা দিয়ে তা নিরূপণ করা চরম নির্বুদ্ধিতা, নিঃসন্দেহে। কিন্তু একটু-আধটু ইশারা কি মিলবে না? ভালো তীক্ষ্ণধী পাঠক ও আলোচক যিনি, তিনি ঠিকই কবিতা হিরকখণ্ডের দ্যুতিটুকু দেখতে পান। ফেরদৌস হৃদয়ও দেখতে পেয়েছেন আর সেটা আমাদের বিশ্লেষণ করে দেখিয়েও দিলেন এই লেখায়, আকারে ছোট্ট হলেও অনুভবে গভীরতায় অতলস্পর্শী।

“There is a terrible emptiness in me, an indifference that hurts.”
~ Albert Camus

শেষবারের মতো শূন্যতা সম্পর্কে এই কথাগুলো বলেছিলেন আলব্যের কামু, তারঁ শেষ ও অসমাপ্ত উপন্যাস “দ্য ফার্স্ট ম্যান” উপন্যাসে। উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিটা দূর্ঘটনাস্থলের অদূরেই পড়ে ছিল।

“যে জেনেছে,—আর এক ক্ষুধা তবু—এক বিহ্বলতা/ তাহারো জানিতে হয়! এই মতো অন্ধকারে এসে!—/ জেগে জেগে যা জেনেছে—জেনেছে তো—জেগে জেনেছে তা,—/ নতুন জানিবে কিছু হয়তো বা ঘুমের চোখে সে!/ সব ভালোবাসা যার বোঝা হলো,— দেখুক সে মৃত্যু ভালোবেসে।” এখানে জীবনানন্দের কবিতাটি তুলে দেয়া ঠিক হলো কি?এবার তাহলে পাশাপাশি তুলে দিচ্ছি জাহিদ সোহাগের দীর্ঘকবিতাংশটি :
“রাতও এত দগ্ধ; শুতে যাই, ঘুমের ওপর ভেসে ওঠে নিভন্ত তক্তা; আমি কোথায় যাই, কোথায় যাই; ধান ছিটিয়ে উঠোনে, আর স্তুপ স্তূপ খড়ে একা চাঁদ; তুমি কি তাকে চেনো, চেনো তাকে… কেবল শূন্য, কেবল শূন্য, প্রায় শূন্য, প্রায় শূন্য; নিপাখি নিপাখি….”

প্রায় একই রকম এক অবচেতনার শীতল স্বর শুনে ওঠা গেল কি উভয় কবির কণ্ঠে? এই কবিতায় বর্ণিত যে মধ্যম পুরুষ তুমি অথবা তোমাকে তা কি কোনো নারী, ছোটো অর্থে? নাকি নিজেরই সত্তা, নাকি আরও বড় পরিসরে তা ব্রহ্মাণ্ড? (যেরকম আমরা বিভ্রান্ত হই রহস্যময় মোনালিসা/ বনলতাকে নিয়ে) যার মুখোমুখি ধাতুর মতো ক্ষয়ে ক্ষয়ে জাহিদ সোহাগ হয়ে পড়ছেন ‘প্রায় শূন্য’! তাহলে তো আরও কিছু বাকি থেকে যায় তাঁর অস্তিত্বের উপস্থিতি। বুঝে উঠি কবিতার পরতে পরতে একটা তীক্ষ্ণ আর্তচিৎকার ট্রেনের হুইসেলের মতো দিগন্তের শূন্যতাকে পেঁচিয়ে ধরছে। কবিতার বুকে কান পাতলেই শোনা যায় সেই প্রতিধ্বনি। ‘প্রায় শূন্য’ যেন দিগন্তে প্রতিধ্বনিত সেই হুইসেলটুকুরই বিশুদ্ধ অনুবাদ যা কবি তাঁর অনুভব-নিহিত-শব্দে লিখে গেছেন। যেন শুধু ‘প্রায় শূন্য’ই এক পূর্ণ শূন্যতায় পুনরায় ফিরে যাবার একমাত্র পথ হয়ে দেখা দেয়।

কবিতার নিবিড় সংস্পর্শে এসে আরও শুনি একটা নির্দিষ্ট টেম্পোর সাংগীতিক সুর কবিতার মাংস, মজ্জা, মেদে বয়ে চলে যাচ্ছে যা এই কবিরই অবিরল চৈতন্যপ্রবাহ নিশ্চিত :

“কোথাও ফলেছে গাঢ় রাত, বা এক থোকা আঙুর, লালাভ;… মৌচাকে যেভাবে ঝোলে, অন্তর্গত ডালে তারও; তোমাকেও বলি পাতা ঝরার আগে; দেখবে মেডিকেল-ব্লেড চকচকে, শিশুর জিভের মতো বেপরোয়া… “

দেখি ‘গাঢ় রাত’, ‘থোকা আঙুর’, ‘মৌচাক’-এর অন্তর্নিহিত সম্বন্ধপরতা— ঝুলে আছে ডালে। ডাল? এ ডাল কিন্তু অন্তর্লীন— কবির অন্তর্লোকে। স্পষ্ট ঝুলে থাকাটা দেখি ‘গাঢ় রাতের’ এক মৌলিক উপমায়। আরও একটু অংশ তুলে দিচ্ছি এখান থেকে— বলে রাখি ‘প্রায় শূন্য ‘দীর্ঘ কবিতাটিতে মালার পুতির মতো মসৃণ ঘন হয়ে সন্নিবেশিত হয়েছে খণ্ড খণ্ড কবিতাগুলি— যেখানে কবি আরও আশ্চর্য কৌশলে জগতের অস্তিত্বের সাথে নিজে দ্রবীভূত হয়েছেন :

“…আর হাত-পা পুড়িয়ে তাপাই নিরীহ কড়াই; আমি তোমাকে দুঃখ বলি না; তুমি স্পষ্টতই দ্রাক্ষা; অনেক অশ্রুর কাঁচ জমিয়ে জমিয়ে জন্ম দিয়েছ নিজেকে”

থেমে যাই। স্রেফ নিরূপায় থেমে যেতে হলো। এ যেন কোনো প্রাচীন ভূগর্ভস্থ গুহার রহস্য উন্মোচনে এসে আচমকা পূর্বাভাস ছাড়াই ঠেঁসে বসলো গুহার ছাঁদ পলকা শরীরে আমার, খনিজ উত্তাপ পাই, এখন শুধু ভয়ানক গলে যাওয়া!

‘অশ্রুর কাঁচ’!
পাঠক, কল্পনা করুন দ্রাক্ষার দৈহিক গঠন: অশ্রুর কাঁচের মতো অসংখ্য গুড়ো গুড়ো রঙে গড়ে ওঠে, বিস্ময়।

এবার এক্ষুণি একটা কবিতার লাইন আমাকে মাটি ভেবে নিয়ে অঙ্কুরের মতো ফেঁড়ে দিলো মহীরুহ হতে, লাইনটি নেরুদার : Tonight I can write কবিতাটিতে—

“Love is so short, forgetting is so long”

লক্ষ্য করুন, দুই মেরুর দুজন কবি সম্পূর্ণ আলাদা দুটি কবিতায় একই বোধ কিভাবে বুনে দিলেন। একেই বলে সমগ্রতা। মহাজাগতিক একতা।

কত অবিরল জন্ম-মৃত্যু-চক্র শেষে অসংখ্য অশ্রুর কাঁচের মতো একটি দ্রাক্ষা-জীবন চোখের সামনে আসে! নেরুদা যেমন আমাদের এই মানবজন্মের সংক্ষিপ্ত কালপ্রবাহকে মহাজাগতিক অসীম জীবনের কালপ্রবাহের পাশে রাখেন, এবং তখন, আমাদের অফুরন্ত অন্তর্গত বেদনাময় দীর্ঘশ্বাসটি বেরিয়ে পড়ে ঠিক সেই কাজটিই জাহিদ সোহাগও করেন অত্যন্ত নিপুণ প্রতিভায়— দুঃখহীন এক সংক্ষিপ্ত দ্রাক্ষা জীবনের পাশে রেখে দেখান অসীম জগতের মহাজীবনকে। সেই মহাজীবনই হয়তো বয়ে আনে মূলত দীর্ঘশ্বাস আর দুঃখ।

এভাবে লাইনের পর লাইন পাঠে আমি আবিষ্ট হই, তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় আমাকে কবির সেসব জীবন্ত বোধ চক্রবুহ্যের মতো। যেমন :

ক. “আমার আঙুলই বরং সাপ, দুই হাতের দশটি… কখনো বলি এই বাড়িয়েছি হাত; টলোমলো সাঁকোর উপর দাঁড়িয়ে… আর বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি সন্ধ্যায়, আমাকে কে ছোঁবে, কে নেবে বিরামহীন আঙুলগুচ্ছ” (২ সংখ্যক কবিতা)

খ. “আমার ভেতরে কাক, দাঁড়কাক, ওড়ে, দুইটি, তিনটি বা একটি; আমিও মানুষ চিনতে পারিনি…” (৪ সংখ্যক কবিতা)

গ. “আমি এক শস্যদানা, ভরদুপুরে তোমার আঁচল খসে যাবে, গুপ্ত সিন্দুকের মতো নাভি…”

ঘ. “আমি এখনো উট, মাঝপথে এখনো সন্ধ্যা, মুছে যায়, মুছে যায় রেখা…”

এসব পঙক্তি ও ভাবালুতাবিহীন ভাব আমাকে চিরন্তনতার সাথে জুড়ে দেয়। কিন্তু তারপরও কবিতার কোথাও কোথাও কবির ব্যক্তিগত দহন জগতের নিহিত অস্তিত্বের সাথে মিশে যেতে সক্ষম হলো কি (?), খুব নিশ্চিত করে বলাটা কঠিন। এবং সেই সাথে দীর্ঘ কবিতা হতে গেলে তো আমিহীনতা প্রয়োজন, কবিতার ব্যাপ্তির সুবিধার্থে। যে-কারণে ১৭৮ টি লাইন থাকা সত্ত্বেও কিন্তু জীবনানন্দের “কয়েকটি লাইন” কবিতাটি ব্যর্থ হয়ে পড়ে দীর্ঘকবিতা হিসেবে। এটা নিশ্চয়ই ঠিক যে যে-কোনো ধরনের কবিতায় (দীর্ঘ, হ্রস্ব, অণু) সমগ্রতা খুবই আবশ্যক। সে দিক দিয়ে দীর্ঘ কবিতাটি উৎরে যাবে হয়তো, কিন্তু দীর্ঘ কবিতার ব্যাপক উপাদান, বিষয়ের গাম্ভীর্য, এবং সর্বোপরি এক ব্যাপক আবহমণ্ডলের ঘাটতিও আছে বলে মনে করি এক ব্যর্থ পাঠক হিসেবে আমি। এছাড়াও; উপমা, উৎপ্রেক্ষা, প্রকরণ, ব্যঞ্জনার যে ব্যাপক বিন্যাস আছে আমরা দেখি— এলিয়ট, জীবনানন্দ, অক্টাভিও পাস (Sunstone), শম্ভু রক্ষিত, গিন্সবার্গ এবং আরো অনেকের মহৎ দীর্ঘ কবিতায় যা নিশ্চিতভাবেই মননের স্থানান্তরের মাধ্যমে আমাদের ‘ক্লান্ত’ করে, অনুপ্রাণিত করে কবিতার প্রতি এবং বোধের চূড়ান্ত শিখরে সফলভাবে পৌঁছে দিতে পারে।
আলোচ্য দীর্ঘ কবিতাটির শরীর ও আত্মা নির্মিত হয়েছে অবিরাম চৈতন্যপ্রবাহে আর চিরন্তন সমগ্রতায়, আর নেই অতিকথনের অপপ্রয়াস তাই সহজেই খারিজ করে দেয়া যায় অ্যালান পো‘র সেই উক্তিটি : “…long poem doesn’t exist.”।

ফেরদৌস হৃদয়

কবি। জন্ম ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৮৭, কুড়িগ্রামে। পেশা শিক্ষকতা।

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field