গদ্য বিশেষ সংখ্যা

এক অভয়া-তিলোত্তমা ব্যবস্থা | কণিষ্ক ভট্টাচার্য | গদ্য | রাত দখল

প্রিয় পাঠক, আমাদের এই ভূখণ্ডে ‘জুলাই আন্দোলনে’র কিছুদিন পরেই সীমান্তের ওপারে শুরু হয় ‘রাত দখল’-এর আন্দোলন। জুলাই আন্দোলন নিয়ে তীরন্দাজ একটি বিশেষ সংখ্যা করেছে। এরপর ইচ্ছে ছিল ‘রাত দখল’ নিয়ে একটা বিশেষ সংখ্যা করবার। সেইভাবে লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তারা লেখাও দিলেন, অনেকের কাছ থেকে লেখা পাওয়ার প্রতিশ্রুতিও পেলাম। কিন্তু এর মাঝে হঠাৎ করে তীরন্দাজ-এর ওয়েব সাইটটিতে প্রযুক্তিগত সমস্যা দেখা দিল। থমকে গেল প্রকাশনার কাজ। অবশেষে সেই সমস্যা কাটিয়ে সংখ্যাটি লেখকদের সামনে হাজির করতে পেরে আমরা আনন্দিত। সময় মতো প্রকাশের প্রতিশ্রুতি আমরা রক্ষা করতে পারিনি বলে সীমান্তের ওপারের লেখক বন্ধুদের কাছে দুঃখপ্রকাশ করছি। সংখ্যাটি কেমন লাগল, আমাদের জানাতে ভুলবেন না। চিঠি লেখার ইমেইল অ্যাড্রেস : eteerandaz@gmail.com
সবার জন্যে শুভকামনা।

অভয়া-তিলোত্তমা কোনও ব্যক্তিনাম নয়।
অভয়া-তিলোত্তমা কেবল দেশের আইন বাঁচানো প্রতীকায়িত নাম নয়।
অভয়া-তিলোত্তমা কেবল নিজ কর্মক্ষেত্র সরকারি হাসপাতালে ছত্রিশ-ঘণ্টা চিকিৎসা করার পর কোনও ধর্ষিত ও খুন হওয়া একত্রিশ বছরের চিকিৎসক তথা চিকিৎসা বিজ্ঞানের উত্তর-স্নাতক ছাত্রী নয়।
অভয়া-তিলোত্তমা আমাদের রাজ্যে, গ্রামে-মফস্বলে সরকারি চিকিৎসা-ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কারণে, কলকাতা শহরের মেডিক্যাল কলেজগুলিতে রেফার হওয়া অসংখ্য মানুষের গিজগিজে ভিড়ের মধ্যে, যেখানে পাঁচশো মিটারের মধ্যে আরও চিকিৎসক, নার্স, সরকারি স্বাস্থ্যকর্মী, স্বাস্থ্যপ্রশাসনের লোক, আয়াদিদিরা, সরকারি পুলিশ, ব্ল্যাকশার্ট-ব্রাউনশার্টের মতো সরকারি দলের গেস্টাপো তথা নীলজামা-সবুজজামা, অবাঞ্ছিত দালাল, অগণন রোগী এবং হাসপাতালে রাত্রিবাস করা নিযুত রোগীর পরিজনের মাঝে একশট্টি কেজি ওজনের একজন একত্রিশ বছরের সুস্থসবল মহিলা চিকিৎসক, যিনি ধর্ষিত ও খুন হয়েছেন।
যাঁর শরীরে অসংখ্য ক্ষত ও প্রতিরোধের চিহ্নের কথা সংবাদমাধ্যমে ইতোমধ্যে প্রকাশিত।
অথচ কেউ নাকি কিছুই জানেন না!

দেড়মাস কাটল। তিন পক্ষকাল। ছয় সপ্তাহ। পঁয়তাল্লিশ দিন। একহাজার আশি ঘণ্টা।
চন্দ্রভুক অমাবস্যার থেকে গৃহত্যাগী জ্যোৎস্নার পূর্ণিমা পেরিয়ে আরেক চন্দ্রভুক অমাবস্যা আসন্ন।
অথচ কেউ কিছুই জানে না।

কলকাতা পুলিশ, যাকে একসময় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সঙ্গে তুলনা করা হতো, সিবিআই যারা দেশের সর্বোচ্চ তদন্তকারী সংস্থা – কেউ কিছুই জানে না।
তার পরের ঘটনাক্রমকে হয়তোবা আশ্চর্যজনক বলা যেত।

কী সেই ঘটনাক্রম? সংক্ষেপে বললে, ১. এই ঘটনাকে মৃতার বাবা-মাকে ফোন করে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করা হল। ২. প্রিন্সিপাল ইতরবাক্য বললেন ‘রাতে কেন সেমিনার রুমে…’। ৩. মৃতার বাবা-মাকে কন্যার দেহ দেখতে দেওয়া হল না। ৪. ময়নাতদন্তের কানুন ভেঙে সূর্যাস্তের পর ময়নাতদন্ত হলো। ৫. বাম ছাত্রযুব সংগঠনের নেতৃত্ব গিয়ে দেহ না আটকাল পুনর্বার ময়না তদন্তের জন্য। ৬. রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে ধর্ষিতা ও নিহতের দেহ দাহ করে দেওয়া হল। ৭. এমনকি শ্মশানের সার্টিফিকেটে মৃতার বাবা মা নিকট আত্মীয় নয়, সই করলেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা। ৮. বাবা-মাকে টাকার লোভ দেখানো হলো প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে। ৯. এক মদ্যপ লম্পট গেস্টাপো, থুড়ি সিভিক ভলান্টিয়ারকে পাকড়াও করে তাকেই একমাত্র দোষী বলে প্রমাণ করতে চাইল কলকাতা পুলিশ যাকে নাকি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সঙ্গে তুলনা করা হতো। ১০. পরিকল্পিতভাবে ক্রাইম সিন নষ্ট করা হলো। ১১. রাত দখলের রাতে কিছু লুম্পেন পাঠিয়ে হাসপাতালের কিছু বিশেষ জায়গায় ভাঙচুর করানো হলো, এবং কলকাতা পুলিশ হাসপাতালের নার্সদের বয়ান অনুসারে শৌচাগারে আর ওয়ার্ডে রোগীর কম্বল চেয়ে গাঢাকা দিল। ১২. পিডাব্লিউডি হঠাৎই তৎপর হয়ে উঠে ক্রাইম সিনের আসেপাশে ভাঙচুর করে উন্নয়ন করতে লাগল। ১৩. প্রিন্সিপালের পদত্যাগের খবর মিডিয়ায় আসার চারঘণ্টার মধ্যে তার প্রাইজ পোস্টিং হলো।

তবু এই সর্বসিদ্ধা ত্রয়োদশীর পরেও আশ্চর্য হলেন না রাজ্যের মানুষ। হলেন না নিজের অভিজ্ঞতা থেকে। পার্ক স্ট্রিট, কামদুনি, খড়গ্রাম, গেদে, কাকদ্বীপ, কাটোয়া, মধ্যমগ্রাম, রানাঘাট, সিউড়ি, হাঁসখালির একের পর এক নারী নির্যাতনের পরে প্রশাসনের ভূমিকা মানুষ দেখেছে। প্রশাসন ও শাসকদলের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত যে ভিক্টিম-ব্লেমিং ও ইতরবাক্যের বন্যা বয়েছে, আইনি ও বেআইনি পথে ঘটনাগুলো সরাসরি ধামাচাপা দিয়েছে শাসক, তাতে আর নতুন করে আশ্চর্য হলেন না রাজ্যের মানুষ।
এই ঘটনাগুলোর কী প্রতিবাদ হয়নি? হ্যাঁ, হয়েছে। সে প্রতিবাদ সামগ্রিক সামাজিক হয়ে না উঠলেও, হয়েছে। এখানেই এই ঘটনাগুলোর থেকে অভয়া-তিলোত্তমায় এসে পার্থক্য ঘটে গেল মানুষের মনে। মানুষ তার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছেন কে প্রতিবাদ করবে তার জন্য অপেক্ষা করার সময় নেই আর। রাত দখলের মতো একটি আর্বান-লিবারেল ডাক শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে প্রান্তিক পরিধির দিকে ছড়িয়ে পড়ল। কেন্দ্রীভূত কোনও নিয়ন্ত্রকশক্তি নেই যার। কেবল একটি ধারণা তাও ছড়িয়ে পড়ল মফস্বলে প্রান্তিক গ্রামে, সমাজ শর্তে যা আর্বান-লিবারেল নয় এমন সব জায়গায়। আমরা দেখলাম নানা পেশাগত ও পরিচিতিগত সত্তায় মানুষ পথে নামলেন। এমনকি শাসক-ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত মুখও নামতে বাধ্য হলো নানা কারণে। মানুষ সংগঠিত হলেন নানা পরিচিতিসত্তায় নির্ভর করে।

অরাজনৈতিক থেকে অদলীয় এই ধারণায় আসতে যে সপ্তাহ ঘুরে গেল আমাদের, তার অন্যতম কারণ সম্ভবত আমাদের বিশ্বাসযোগ্য সিভিল সোসাইটির অভাব। মানুষ নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন সিভিল সোসাইটির মুখ হয়ে উঠে টেলিমিডিয়ায় মুখ দেখানো কিছু মানুষ নিজেদের শাসকের এঁটোকাঁটা আশ্রিত করে তুলেছেন একদশক ধরে। এইখানে ঘটল দ্বিতীয় বদল। মানুষ বিশ্বাসযোগ্য কোনও মুখ পেলেন না বলে কোনও মুখের অপেক্ষায় বসে থাকলেন না, নিজেরাই নিজেদের মতো করে প্রতিবাদে পথে নামলেন।

এই প্রতিবাদ আরও গভীর সামাজিক ভিত্তি পেল প্রশাসনের ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান ম্যাচ বাতিল করায়। দুই প্রধানের ম্যাচ বাতিল হওয়ায় উলটে তিন প্রধানের সমর্থকেরা নামলেন প্রতিবাদে। খেলা ভাঙার খেলা হলো শহরের রাজপথে। বাঙালির ময়দানের চির প্রতিদ্বন্দ্বী তিন প্রধানের সমর্থকেরা কাঁধে কাঁধ দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করে পুলিশের লাঠি খেলেন। গলা তুলে স্লোগান দিলেন শাসকের বিরুদ্ধে। এবং লক্ষণীয়, যখন দিল্লি কিংবা বাংলাদেশের স্লোগানে মুখরিত সমস্ত মিছিল ও সভা তখন তাৎক্ষণিকভাবে বাংলা স্লোগান তৈরি হল পুলিশের লাঠির মুখে। দলিল হয়ে থাক সে স্লোগান। ‘এক হয়েছে বাঙাল ঘটি / ভয় পেয়েছে হাওয়াই চটি’, ‘এক হয়েছে লক্ষ গলা / ভয় পেয়েছে চোদ্দ তলা’, ‘ডার্বি বাতিল করে দে / মেয়েটাকে ফিরিয়ে দে’, ‘তিন প্রধানের এক স্বর / জাস্টিস ফর আরজিকর’। সেই রৌদ্রছায়ার ফুটবল। বাঙালির ছিন্ন শিরার ইতিহাস। খালি পায়ে ঔপনিবেশিক শাসক ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে খেলার সেই ইতিহাস যেন পুনর্লিখিত হল নব্যস্বৈরতন্ত্রী শাসকের বিরুদ্ধে কলকাতার রাজপথে।
শহরের নানা জায়গায় ঘোষিত অঘোষিত কারফিউ জারি হলো। গোটা শহর যেন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন তার নাগরিকদের জন্য। কোথায় উত্তরে আর জি কর হাসপাতাল আর দক্ষিণে নন্দন চত্বরে তালা ঝুলল। কেবল হলের সামনের গেট খোলা হবে সিনেমা শুরুর দশ মিনিট আগে। সিনেমা দেখে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে যেতে হবে বলে দর্শকদের জানিয়ে দিচ্ছেন নিরাপত্তা রক্ষী। বলে দেওয়া হচ্ছে চত্বরে ঘোরাঘুরি করা যাবে না। দরজা খোলেনি, বাইরে লাইনে ভিজছে দর্শক। আগস্ট মাসে তুমুল বৃষ্টিতে ইতিহাস লেখা হচ্ছে। আগস্ট, দেশের স্বাধীনতার মাস – যে স্বাধীনতার জন্য সবচেয়ে বেশি রক্ত দিয়েছে বাংলা। নারীপুরুষ নির্বিশেষে, সবচেয়ে বেশি আত্মবলিদান যে জাতির। যাদের রক্তে লেখা এদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস। কলকাতা যার কেন্দ্রবিন্দু। সেই কলকাতায় নন্দন চত্বর বন্ধ, যেখানে মানুষের বন্ধুত্ব প্রেম প্রতিবাদ ছড়িয়ে আছে জনসমাগমের দিনে। সেখানে বাংলা ছবি দেখতে এসে চত্বরের বাইরের লাইনে ভিজছেন দর্শক। আর আমার শহরে মেডিকেল কলেজে এক কর্মরতা চিকিৎসক-পড়ুয়া ধর্ষিত ও খুন হয়েছেন। গোটা অঞ্চলে নাকি তাই কারফিউ জারি। প্রতিবাদ কি ওভাবে বন্ধ করা যায়!

পেশা আর পরিচিতিসত্তা নির্ভর মিছিল সভা পেরিয়ে একটি বড়ো নাগরিক মিছিল শহর ইতিমধ্যে দেখে ফেলেছে আগস্টের ২৯ তারিখে। সেখানে পেশা বা পরিচিতিকে অস্বীকার করে নয় বরং তাকে অঙ্গীকার করেই নাগরিক মিছিলে যুক্ত হয়েছেন মানুষ। কৃষক রমণীর পরের সারিতে ব্যান্ড মিউজিকের গিটার, আইনজীবীর পোশাকের পাশে যৌনকর্মীর প্ল্যাকার, মাঠের জার্সির পাশে শিল্পীর তুলি, শিক্ষকের পাশে ছাত্রছাত্রী, মিডিয়াকর্মী হাউস থেকে ছুটি নিয়েছেন মিছিলে হাঁটবেন বলে।
এরপরে জুনিয়র চিকিৎসকেরা কলকাতা পুলিশ হেডকোয়ার্টার লালবাজার অবরোধ করলেন পুলিস কমিশনার বিনীত গোয়েলের পদত্যাগ চেয়ে। কারণ ততদিনে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে মামলা তুলে নিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট এবং সেখানে বলা হয়েছে এই হত্যা প্রাতিষ্ঠানিক ও তার তথ্যপ্রমাণ লোপাট করা হয়েছে। দুদিন টানা অবস্থানে বসে থেকে কলকাতা পুলিশ কমিশনারকে প্রতীকী শিরদাঁড়া দিয়ে এসেছেন জুনিয়র চিকিৎসকেরা। এরপরে তাঁরা করলেন স্বাস্থ্যভবন অভিযান, কারণ পশ্চিমবাংলার সমস্ত সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে চলে শাসকদলের হুমকিরাজ, যাকে তাঁরা বললেন থ্রেটকালচার। স্বাস্থ্যভবনের কর্তারাও তাঁদের সঙ্গে দেখা করলেন না। জুনিয়র ডাক্তারেরা রাজপথে অবস্থানকালে তাঁদের রোদবৃষ্টি থেকে বাঁচাতে পাশে এসে দাঁড়ালেন নাগরিক সমাজ। নাগরিক সমাজের উদ্যোগে ও অর্থে এলো ত্রিপল থেকে চৌকি, শুকনো খাবার আর জলের বোতলের ঢিপি তৈরি হলো এত উঁচু যে সোশ্যালমিডিয়ায় জুনিয়র চিকিৎসকদের জানাতে হলো আর পাঠাবেন না। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা এলো তাঁদের ক্যান্টিনে তৈরি খাবার নিয়ে। এক মা তার আগে হাতপাখা নিয়ে এসেছিলেন কটা, নিজেই বাতাস করছিলেন ছেলেমেয়েগুলোকে। বঙ্গীয় ভাদ্রের পচা গরমে বইছিল নতুন ইতিহাস লেখার হাওয়া।
আমরা ধীরে ধীরে জানতে পারছি সংবাদমাধ্যমে নিছক ধর্ষণ খুন নয় যেন! সুপ্রিম কোর্ট বলছে বিরাট কিছু ঢাকা দেওয়ার প্রবণতা আছে। কেবল নারী সুরক্ষার প্রশ্ন নয়। যেমন সরকার দেখাতে চাইল দশদফা এমন নিদান দিয়ে যা আমাদের মতো দেশে নব্বই শতাংশের অধিক নারীপুরুষ যেখানে অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করে সেখান থেকে নারীদের সরিয়ে দেওয়ার নিদান হয়ে দাঁড়ায়। নারীদের সামাজিক ও কর্মক্ষেত্রের গণ্ডি তৈরি করে দিতে চায়। এবং স্পষ্ট করে দিয়ে চায় যে, ওই গণ্ডির মধ্যে থাকলেই তবে তার সুরক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের! নচেৎ নয়।

এমন এক রাজ্য যেখানে কোনও শিল্প নেই, যাও চেষ্টাচরিত্র করে এসেছিল তাও পাত্তারি গুটিয়েছে। যেখানে সরকারি শিক্ষকের চাকরির পরীক্ষায় দুর্নীতির দায়ে একডজন মন্ত্রী বিধায়ক আমলা জেলে। যেখানে বছরের পর বছর পরীক্ষা হয় না চাকরির। যেখানে শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ বন্ধ। লেখাপড়া ছাড়ার হার উদ্বেগজনক তা সরাসরি পেশার ক্ষেত্রের লোকজন জানেন, সরকারি কাগজ যাই বলুক না কেন! জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা আনুপাতিকভাবে মেলে না! সংবাদপত্রে দেখা যায় উচ্চশিক্ষায় বহু কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন খালি পড়ে থাকে। শিক্ষার্থীরা উৎসাহী নয়, কাজ নেই বলে। জনস্রোত চলেছে আমার রাজ্য ছেড়ে পরিযায়ী শ্রমিক হতে। যারা পড়ে থাকছে এই নৈরাজ্যের নেই-রাজ্যে, সেই হতাশ ন্যুব্জ যৌবন ভিন্ন পথে যেতে বাধ্য হচ্ছে পেটের তাগিদে, হয়ত তেমন ভালো পথ নয় তা। ব্যবহৃত হচ্ছে ক্ষমতার বোরে হিসেবে।

একজন কর্মরতা চিকিৎসক পড়ুয়া তার কর্মক্ষেত্র তথা শিক্ষাক্ষেত্রে ধর্ষিত ও খুন হয়েছে। অবশ্যই পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন নৈতিক কর্তব্য। কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছে তত বিশাল, ব্যাপক ও অতিগভীর দুর্নীতির সংবাদ আসছে মাধ্যমে। তা কী কেবল পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সমাধান হবে! এ তো পুঁজির প্রাথমিক শর্তের গল্প, সর্বাধিক লাভের গল্প। তা দুর্নীতি ভিন্ন হবে কী করে! আরও বড়ো প্রশ্ন, তা অদলীয় রাজনীতির মাধ্যমেই বা হবে কী করে! সিভিল সোসাইটি তো গণতন্ত্রে নির্বাচনকেন্দ্রিক যে ব্যবস্থা তার অভ্যন্তরীণ নয়! যেমন প্রশ্ন জাগে, এক কর্মরতা নারীর ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় কেবল ছাত্র সংগঠন, যুব সংগঠন না মহিলা সংগঠনকে কেন বিশেষভাবে সক্রিয় হয়ে উঠতে দেখি! শ্রমিক সংগঠনকে নয় কেন!
অর্থনীতির মাজাভাঙা এই ব্যবস্থার নির্মাণ তো এই জন্য যে, শাসক মুখাপেক্ষী ও নির্ভরশীল একটা ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়! শিক্ষা ব্যবস্থার ভেঙে পড়ার যে গভীর হতাশাব্যঞ্জক প্রভাব, শিল্পহীনতার কারণে যে কর্মহীন যৌবন, তাই তো শাসকের এই দুর্নীতি নিয়ন্ত্রিত লুঠ ও তোলাবাজিনির্ভর ব্যবস্থার শিরদাঁড়া। স্বাভাবিকভাবেই তার সঙ্গে যুক্ত হয় হুমকিরাজ, আজকে যাকে জুনিয়র চিকিৎসকরা চিহ্নিত করেছেন থ্রেটকালচার বলে।

ফলে অভয়া-তিলোত্তমা কোনও ব্যক্তিনাম নয়।
অভয়া-তিলোত্তমা কেবল দেশের আইন বাঁচানো প্রতীকায়িত নাম নয়।
অভয়া-তিলোত্তমা কেবল নিজ কর্মক্ষেত্র সরকারি হাসপাতালে ছত্রিশ-ঘণ্টা চিকিৎসা করার পর কোনও ধর্ষিত ও খুন হওয়া একত্রিশ বছরের চিকিৎসক তথা চিকিৎসা বিজ্ঞানের উত্তর-স্নাতক ছাত্রী নয়।
তাই অভয়া-তিলোত্তমা আমার রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নাম আজ।
অভয়া-তিলোত্তমা আমার রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার নাম আজ।
অভয়া-তিলোত্তমা আমার রাজ্যের খাদ্য ব্যবস্থার নাম আজ।
অভয়া-তিলোত্তমা আমার রাজ্যের অর্থনীতির নাম আজ।
অভয়া-তিলোত্তমা আমার রাজ্যের শিক্ষাহীন, কাজের সুযোগহীন, পরিযায়ী অথবা নিখোঁজ যৌবনের নাম আজ।
যারা প্রত্যেকে সরকারি ব্যবস্থাপনার অন্দরে যেখানে তাঁদের সবচেয়ে নিরাপদ বোধ করার কথা সেখানেই ধর্ষিত ও নিহত হয়েছে। এবং সেই ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রের সমস্ত যন্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে।

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field