গণঅভ্যুত্থান সংখ্যা
মিশর তিউনিসিয়া নয় এবং তিউনিসিয়াও মিশর নয়। তিউনিসিয়ার গণজাগরণের পর প্রায় সবাই এমন কথাই বলেছিল। কেউ ভাবতে পারেনি যে, আরব বসন্তের জোয়ার মিশরেও আসবে।
পঁচিশে জানুয়ারির কয়েকদিন আগে আমি এবং আমার বন্ধুরা যখন বিপ্লবের ঘোষণা শুনেছিলাম, তখন আমাদের প্রতিক্রিয়া ছিল হাস্যকৌতুকপূর্ণ। তার কারণ এই নয় যে, আমরা শাসনব্যবস্থাকে পছন্দ করতাম, বরং আমরা চিন্তা করতাম, ‘কেমন করে আপনারা গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত করতে পারেন এবং দিনক্ষণ নির্ধারণ করে দিতে পারেন? কোনো তারিখ ছাড়াই বিপ্লব সংঘটিত হতে পারে। নির্দিষ্ট কোনো তারিখ দিলে পুলিশ এবং শাসকগোষ্ঠী গণঅভ্যুত্থান কঠোরভাবে দমন করতে তৈরি থাকবে।’ আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে, ঘর থেকে বেরিয়ে কেউ রাস্তায় যাবে না এবং চায়ের কাপে ঝড় তোলা ছাড়া তেমন কিছুই হবে না।
সেদিন কত তারিখ ছিল, পঁচিশ তারিখ? সেদিন আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি। তারা সবাই আমার সন্দেহের বিষয়টি বিবেচনা করেছে। সুতরাং আমরা রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি। তখন অন্যান্য বন্ধুদের কাছ থেকে আমরা ফোন পেতে শুরু করি। তারা বলছিল যে, হাজার হাজার লোক রাস্তায় জড়ো হয়েছে এবং সব জায়গায় বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। আমার মনে আছে এক বন্ধু বলেছিল, ‘মনে হচ্ছে আমরা বিশাল একটা কিছু থেকে বঞ্চিত হয়েছি।’ আমার বাবা-মা আমাকে ফোন করে অনুরোধ করেছিলেন যেন আমি বাড়ি ফিরে যাই। কেননা তারা মনে করেছেন যে, পরিস্থিতি নিরাপদ ছিল না। ফেরার পথে দেখতে পেলাম আলেকজান্দ্রিয়া শহরের কর্নিশ১-এর দিকে বিক্ষুব্ধ লোকজন যাচ্ছে। কেন তারা যাচ্ছে, সেই সময় আমার মাথায় অস্পষ্ট ছিল।
টেলিভিশন ও অন্তর্জালে—যা তখনো নিষিদ্ধ করা হয়নি—সংবাদ এবং তাহরির স্কোয়ারে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ের বিখ্যাত ছবি দেখে আমি অত্যন্ত আনন্দ অনুভব করেছি, যা আমার সন্দেহকে ভুল প্রমাণিত করেছে। আমি ছবিটি ফেসবুকে দিয়েছি এবং মন্তব্য করেছি, ‘এই দিন মিশরীয়রা না বলেছে।’ আমার এক স্প্যানিশ বন্ধু আমাকে লিখেছে, ‘যাও… চালিয়ে যাও… এগিয়ে যাও…’ আমি আপনমনে ভাবলাম, ‘এটা অনেক বড়… যা ঘটছে এবং বিশ্ব দেখছে।’ ঘরের ভেতর আমরা সবসময়ই মুবারক এবং তার দুর্নীতি ও শাসনব্যবস্থার বিরোধিতা করতাম। আমার মা সবসময় ভাবতেন, তিনি যে সুন্দর মিশরে বড় হয়েছেন, সেই মিশরের অবস্থা এখন কী হয়েছে।
কেন পরিস্থিতি সবসময় খারাপ থেকে খারাপের দিকে যায়? আমি ভেবেছি, খারাপ সময় বদলানোর জন্য এই আমাদের সুযোগ।
বিক্ষোভ শুরু হয় ২৮শে জানুয়ারির সকাল থেকে। আমার বাবা-মা আমাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তারা ভীষণ ভয় পেয়েছিলেন এবং আমার বাবা বাড়ির দরজায় তালা ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। সেই পরিস্থিতিতে আমাকে প্রথম বাধাটি অতিক্রম করতে হয়েছিল এবং বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি। আমি মিথ্যা বলেছিলাম যে, আমাদের বাড়ির কাছাকাছি বিক্ষোভ এলে আমি দেখার জন্য শুধু নিচে যাব। আমি নিচে যাই এবং এল-রামল স্টেশনের দিকে হাঁটতে থাকি, যেখানে বিক্ষোভকারীরা এল-কায়েদ ইব্রাহিম মসজিদে জড়ো হয়েছিল।
শ্যাম্পোলিয়ন সড়কের সভাস্থলের এক রাস্তা পরেই এল-রামল স্টেশন এবং সেখান থেকে ধোঁয়া বের হতে আমরা দেখেছি। একটি মেয়ে চিৎকার করে বলছিল যে, নামাজ শেষ হওয়ার আগেই মসজিদের ভেতরে সব মুসল্লিদের আটকে রেখেছে, যেন তারা বেরিয়ে এসে বিক্ষোভ করতে না পারে এবং তার মাকেও আটক করা হয়েছে। এক লোক মাথায় রাবার বুলেট নিয়ে দৌড়ে আসে এবং সব জায়গায় রক্ত। এল-রামল স্টেশনে যাত্রীদের নিত্যদিনের যাতায়াতের ভিড়ের মধ্যে কয়েকজন মসজিদের ভেতর আটকে পড়া মুসল্লিদের রক্ষা করার জন্য ত্রস্তব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম গুলির আওয়াজ ক্রমশ আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিল।
পুলিশ রাবার বুলেট, সিসা বুলেট, কার্তুজ বুলেট ছুঁড়েছিল এবং কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করেছিল। ঘটনাটি খুবই অধিবাস্তব ছিল। তারা আমাদের দিকে এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে শুরু করেছিল। একসময় গোলাগুলি দূরে সরে যায়, কারণ গ্যাস স্টেশনের কাছে জনতা স্লোগান দিচ্ছিল, ‘জনগণ সরকারের পতন চায়।’
লোকজন এলোপাথারি দৌড়াচ্ছিল, পুলিশকে পাথর ছুঁড়ে আক্রমণ করছিল—যা ছিল আমার জন্য ফিলিস্তিনের এক বেদনার্ত স্মৃতি রোমন্থন—এবং আমাদের ফুসফুস পরিপূর্ণ হয়েছিল কাঁদানে গ্যাসে। গোলাগুলি কতক্ষণ চলেছিল, জানি না। স্থান কিংবা সময় সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। কাঁদানে গ্যাসে দমবন্ধ হয়ে আসা বিক্ষোভকারীদের জন্য লোকজন তাড়াতাড়ি তাদের ঘরবাড়ি খুলে দিয়েছিল। বাসিন্দারা তাদের বাসা-বাড়ির বারান্দা থেকে ভিনেগার আর পেঁয়াজ আমাদের দিকে নিক্ষেপ করেছিল, যা তিউনিশিয়ার বিপ্লবের একটি পরামর্শ এবং আমরা মিশরীয়রা তা ফেসবুকের মাধ্যমে শিখেছি।
স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার এবং সত্যিকারের গণতন্ত্র ছিল জনগণের কাছে সাধারণ মূল্যবোধ, যা আমাদের একত্রে আবদ্ধ করেছে এবং আমাদের উপলব্ধি করতে শিখিয়েছে যে, আমরা একই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করছি এবং আমাদের উদ্দেশ্য অভিন্ন।
পরবর্তীতে আমরা আলেকজান্দ্রিয়ার সব জায়গায় আমাদের দাবি ছড়িয়ে দিতে কর্নিশের দিকে যাত্রা শুরু করি। পুলিশ আমাদের ধাওয়া করার সময় আমরা মিছিল করে এগোতে থাকি। প্রতি দুই এলাকার মধ্যে পুলিশ তল্লাশি কেন্দ্র রয়েছে এবং সেখান থেকে বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা হয়েছে। কিছু তল্লাশি কেন্দ্রে পুলিশ বাহিনী আমাদের ওপর আক্রমণ করতে অস্বীকার করে, যখন আমরা উচ্চস্বরে স্লোগান দিচ্ছিলাম : ‘সেলমেয়া, সেলমেয়া’ (শান্তিপূর্ণ, শান্তিপূর্ণ)। আমি যতই হাঁটছিলাম, ততই আমার শিরা-উপশিরার মধ্যে সাহস সঞ্চারিত হচ্ছিল। একসময় আমি এমন সাহসী হয়ে উঠি, যা আগে কখনো অনুভব করিনি। আমরা যখন মিছিল করছিলাম, তখন লোকজন তাদের বারান্দা থেকে ফলমূল, পানি ও ফলের রসের বোতল ছুঁড়ে দিচ্ছিল। যখনই আমরা মুবারকের শাসন আমলের কারোর ছবিসহ ব্যানার পেয়েছি, তখনই তা ছিঁড়ে ফেলেছি। আলেকজান্দ্রিয়ার গভর্নর আদেল লাবিবের একটা বিশাল প্রতিকৃতি আমার সবচেয়ে বেশি মনে আছে, যা অন্তত পনেরো তলা উঁচু একটা বিল্ডিংয়ের সম্মুখভাগে টানানো ছিল।
মিছিলের সময় হাজার হাজার মানুষ ছিল। আমাদের মধ্যে ছিল পুরুষ, নারী, মুসলমান, খ্রিস্টান, নাস্তিক, পর্দানশীল ও পর্দাহীন মহিলা, শিশু, গন্যমান্য ব্যাক্তি, গৃহহীন মানুষ, ছাত্র এবং বিদেশিরা, যারা মিশরীয়দের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন এবং বিক্ষোভকে সমর্থন করেন। মহিলাদের প্রতি প্রচলিত মৌখিক ও শারীরিক হয়রানি বিলীন হয়ে যায়। জাতীয় টেলিভিশনের খবরে বলা হয় যে, বিক্ষোভকারীরা থানা জ্বালিয়ে দিচ্ছে এবং কারাগার থেকে চোর-ডাকাত ও অপরাধীদের মুক্ত করছে। আমি বিশ্বাস করিনি যে, সেই সব সাহসী বিক্ষোভকারী, যারা বিক্ষোভের সময় সারাক্ষণই মৃত্যুর মুখোমুখি ছিল, তারা এ কাজ করবে, বিশেষ করে যখন থানা জ্বালিয়ে দেওয়া আমাদের বিদ্রোহ দমনের চেষ্টাকারীদের থেকে তাদের আলাদা করবে না। পঁচিশে জানুয়ারি বিপ্লব শুরু হওয়ার পর থেকে জাতীয় টেলিভিশন জনগণের প্রতিবাদকে হয় উপেক্ষা করছে, নতুবা মিথ্যা সংবাদ প্রচার করছে। অন্যান্য সংবাদ মাধ্যম কায়রোর তাহরির স্কয়্যারে সংঘটিত ‘উটের যুদ্ধ’ নামে খবর প্রচার করতে শুরু করে। আটাশতম দিনটি ছিল বিপ্লবের সবচেয়ে তীব্র এবং সহিংস দিন। সেদিন অনেকে রাবার বুলেটের আঘাতে চোখ হারিয়েছে; অন্যরা গুরুতর আহত হয়েছে; আর শত শত বিক্ষোভকারী প্রাণ হারিয়েছে। সেদিনের রক্তপাত আমাদের এগিয়ে যাওয়ার শক্তি জুগিয়েছে। কারণ আমরা প্রত্যেকেই বিশ্বাস করেছি যে, একদিন শহীদরা আমাদের জিজ্ঞেস করবে আমরা তাদের হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছি কিনা।
‘কালো আঠাশ’-এর একই দিনে আমাদের বিভ্রান্ত করতে এবং মিশর জুড়ে বিক্ষোভকারীদের ভয় দেখানোর জন্য কারাগার থেকে চোর-ডাকাত ও অপরাধী বন্দীদের মুক্ত করা হয়েছিল, যা নিঃসন্দেহে ছিল শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র। সেনাবাহিনী ঘোষিত সান্ধ্য-আইন চলাকালীন সময়ে বাড়িঘর এবং বিষয়সম্পত্তি রক্ষার জন্য কিছু সংখ্যক নগরবাসী মিলে নাগরিক কমিটি গঠন করে। শাসকগোষ্ঠীর এসব কর্মকাণ্ড জনগণের সংকল্পকে দুর্বল করতে পারেনি। আলেকজান্দ্রিয়ার চারপাশের দেয়ালে গ্রাফিতি দেখা গিয়েছে এবং সেখানে লেখা ছিল, ‘দিনে প্রতিবাদ এবং রাতে বাড়িঘর পাহারা, যতদিন না পর্যন্ত শাসকগোষ্ঠীর পতন হয়।’
আমরা প্রতিদিন আলেকজান্দ্রিয়ার রাস্তায় মিছিল করেছি এবং পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করার জন্য একত্রিত হয়েছি। আমি সকালে বিক্ষোভে যেতাম এবং সান্ধ্য-আইন শুরু হওয়ার আগে বাড়ি ফিরে আসতাম। সান্ধ্য-আইনের সময় আলেকজান্দ্রিয়ার মতো প্রাণবন্ত শহরকে জীবনহীন দেখে অবাক হয়েছি। বন্দুকের গুলি এবং সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্কের ভয়ঙ্কর শব্দ ভূমধ্যসাগরের নববধূ নামে পরিচিত শহরটির আনন্দ-মুখরিত কোলাহলকে গ্রাস করেছিল। সৈনিকেরা বাতাসে কামান দাগিয়ে বিভিন্ন রাস্তায় টহল দিয়েছে। রাতের বেলা আমার বাবা এবং আমাদের প্রতিবেশীরা সারা রাত আমাদের রাস্তাকে চোর-ডাকাত এবং অপরাধীদের হাত থেকে রক্ষা করেন; রাতে গোলাগুলির শব্দ এবং আহত বা নিহত হওয়ার খবর শোনা নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়।
সারা দেশ স্থবির হয়ে গিয়েছিল। কেউ কাজে যেত না। সেই সময় খাদ্য ঘাটতির অনিশ্চয়তার ভয় আমাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। সুপারমার্কেটগুলো দিনে তিন ঘণ্টারও কম সময়ের জন্য খোলা থাকত। ব্যাংক থেকে টাকা তোলা অসম্ভব হওয়ায় মানুষের কাছে টাকা ফুরিয়ে যেতে শুরু করে। সব ব্যাঙ্ক বন্ধ ছিল এবং সমস্ত এটিএম মেশিন খালি করে রেখেছিল। কেননা চোর-ডাকাত এটিএম মেশিন থেকে টাকা চুরি করছিল। সবাই হতাশ এবং আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। বিক্ষোভের প্রতি শাসকগোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া এবং মুবারকের প্রতিটি ভাষণ শুনে ও দেখে তার দুঃশাসনের প্রতি মানুষের ঘৃণা আরও বেড়ে যায়। মুবারক এক ভাষণে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তিনি সেপ্টেম্বরে পদত্যাগ করবেন এবং ক্ষমতা ছেড়ে চলে যাবেন। কিন্তু সেই সময়ে অনেকেই বিভ্রান্ত এবং হতাশ হয়েছেন, কারণ আমরা খুব নিরাপদ ছিলাম না এবং অনিশ্চিত জীবনযাপন করছিলাম। বেশীরভাগ মানুষ বিশ্বাস করেছিল যে, শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতায় থাকার জন্য কৌশল প্রয়োগ করেছে। তাই আমরা আমাদের দাবি অব্যাহত রেখেছি।
এগারোই ফেব্রুয়ারির কয়েকদিন আগে বিবলিওথেকা২ আলেকজান্দ্রিয়া থেকে শুরু করে মিশরের দীর্ঘতম পতাকা নিয়ে কর্নিশের প্রায় শেষ মাথা পর্যন্ত পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। আমি আমার ক্যামেরা নিয়ে গন্তব্যে চলে যাই।
সেদিন মানুষের মধ্যে অনেক আশা ছিল, ছিল দৃঢ় সংকল্প। বিক্ষোভকারীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, আমরা মিশরের রাষ্ট্রপতির সবগুলো প্রাসাদের সামনে বিক্ষোভ করব, যেন মুবারক পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
সেই দিন বিকেলে আমার প্রচণ্ড মাথাব্যথা হয়, কারণ দিনের বেলা সূর্য ছিল খুবই প্রখর। আমি আমার বন্ধুদের বলেছি যে, আমি কিছুক্ষণ বিশ্রামের জন্য বাড়িতে যাব এবং বিশ্রাম শেষে পুনরায় রাস্তায় এসে বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করব। আমি বাসায় ফিরে যখন মুখ ধুচ্ছিলাম, তখন মায়ের চিৎকার শুনতে পাই এবং তারপর বাবার মৃগীরোগীদের মতো হাততালি আর চেঁচামেঁচি। আমি বাথরুম থেকে দৌড়ে বসার ঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘কী? কী হয়েছে? সে কী মারা গেছে? সত্যি, সে মারা গেছে?’ আমি আশা করেছিলাম যে, মুবারক মারা গেছেন এবং তারপর সবকিছু স্থিতিশীল হয়ে যাবে। আমার বাবা-মা উল্লসিত কণ্ঠে বললেন, ‘সে পদত্যাগ করেছে। মুবারক পদত্যাগ করেছে।’ চারিদিকে শোনা গেল বিরামহীন চিৎকার-চেঁচামেঁচি। আমি আগে আমার বাবা-মাকে কখনই এত উৎফুল্ল, আনন্দিত এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের চরম সুখ প্রকাশ করতে দেখিনি। আমার মা হাসতে থাকেন, আনন্দে লাফিয়ে ওঠেন এবং বারান্দায় দাঁড়িয়ে গান গাইতে শুরু করেন। আর আমার বাবা বললেন, ‘অবিশ্বাস্য। অবিশ্বাস্য।’
ঘর ছেড়ে আমি রাস্তায় নেমে যাই, যেখানে সমস্ত আলেকজান্দ্রিয়া বিজয় উদযাপন করছিল; সবাই সবাইকে সালাম দিচ্ছিল, ‘মাবরুক লে মাসর। মাবরুক লে মাসর৩।’ সেখানে আতশবাজি ছিল এবং উল্লসিত লোকজন গান গাইছিল আর নাচছিল। পুরো পরিবেশ জুড়ে ছিল অত্যন্ত আনন্দদায়ক অনুভূতি, অশ্রু, হাসি এবং আশা—সব কিছু মিলে একটি অবিস্মরণীয় রাত। আমার সঙ্গে নিজের ক্যামেরা ছিল এবং ছবি তোলার সময় লোকজন বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করেছিল এবং হাত নেড়েছিল। তারা প্রত্যেকেই একজন আরেকজনের চেয়ে নিজেকে সুখী কিংবা বেশি দেশপ্রেমিক প্রমাণ করার চেষ্টা করছিল। কর্নিশে অবস্থিত ঐতিহাসিক মিশরীয় নেতা সাদ জগলুলের মূর্তির সামনে একটা বড় পতাকা কিনে আমি বন্ধুদের সঙ্গে নেচেছি। মিশরকে প্রশংসা করে যেসব সঙ্গীত রচিত হয়েছে, আমরা সবগুলো গানই গেয়েছি। আমাদের আনন্দ দেখে সৈনিকেরা সামরিক উর্দির আড়ালে হাসি লুকাতে পারেননি।
সেই রাতে বিশ্ব আমাদের সঙ্গে বিজয় উদযাপন করেছে এবং আমাদের বিপ্লবকে সম্মান জানিয়ে টুপি উঁচিয়ে দেখিয়েছে, কিন্তু একটি নির্দিষ্ট ধারণা আমাকে তাড়া করেছে : আমার অস্তিত্বের কারণ ঘটলো আজ। আমি এই দিনটির সাক্ষী হতে, বিজয় ও মর্যাদার স্বাদ নিতে এবং আমার সন্তানদের এই বিজয় সম্পর্কে সবকিছু বলার জন্য বেঁচে থাকব।
আমার জন্য, এ কেবল… আরম্ভ…
টীকা : মূল গল্পে নেই, তবে পাঠকের সুবিধার্থে দেওয়া হলো—অনুবাদক
১ কর্নিশ—আলেকজান্দ্রিয়ার প্রধান সড়ক, যার একদিকে মনোরম ভূমধ্যসাগর এবং অন্যদিকে শহরের একাংশ।
২ বিবলিওথেকা—গ্রন্থাগার (লাইব্রেরি), আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারের প্রাচীন নাম।
৩ মাবরুক লে মাসর (আরবী)—অর্থ মিশরকে ধন্যবাদ।
লেখক পরিচিতি : সারা হ্যানি একজন ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট। তিনি মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে বসবাস করেন।
Leave feedback about this