ছাতা
গত ত্রিশ বছর ধরে বাবার সঙ্গে কথা বলে না শাহেদ। বাবাকে সে ভয় পায়। কথাটা শুনতে খুব স্বাভাবিক মনে হতেই পারে, অন্য অনেকেই বাবাকে ভয় পায়, কিন্তু শাহেদের ভয় পাওয়াটা একটু আলাদা। সাবেক স্কুলশিক্ষক বাবাকে দেখলেই তার সারা গা কাঁপতে থাকে থরথর করে। মাথা কাজ করে না একদম। এমনকি মাঝেমাঝে স্বপ্নেও বাবাকে দেখলে আতঙ্কে ঘুম ভেঙে যায় তার।
মনোচিকিৎসকের কাছেও গিয়েছে সে অনেকবার সমস্যাটা নিয়ে। লাভ হয়নি কোনো। বরং দিনদিন এই ভয়াবহ সমস্যাটি বুকে পুষে নিয়ে বেড়াতে হচ্ছে শাহেদকে।
দুই
শুরুটা হয়েছিল এক বর্ষাকালে। শাহেদ তখন ক্লাস নাইনে পড়ে। আরও তিনটি বোন আছে তার। একটি ছেলেসন্তানের আশায় থেকে থেকে তিন মেয়ের পর শাহেদের জন্ম হয়। বড় আপার সাথে তার বয়সের পার্থক্য দশ বছরের।
দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা চলছিল শাহেদের। আগের রাত থেকে শুরু হয়েছে বর্ষা। বাসায় অন্য যে দুইটা ছাতা আছে, একটা নিয়ে গেছে সালেহা আপা, আরেকটা নিয়ে মা যেন কই গেছে। কাউকে কিছু না বলে চুপি চুপি বাবার ছাতাটা নিয়ে বেরিয়ে যায় শাহেদ। বাবা তখন ঘুমাচ্ছেন।
তিন
শাহেদ ক্লাস এইটে থাকতে চাকরি থেকে অবসরে যান বাবা। বিদায়ের দিন বাবার সহকর্মীরা কিছু উপহার দিয়েছিলেন তাকে। সেগুলোর মধ্যে একটি ছিল ছাতা। অন্য উপহারগুলো এক বছরের মধ্যে হয় নষ্ট নয় উধাও হয়ে গিয়েছিল, থেকে যায় কেবল ছাতাটি। যকের ধনের মতো বাবা আগলে রাখতেন এটিকে। সম্ভবত এ কারণেই শাহেদ এক নিষিদ্ধ আকর্ষণ বোধ করত ছাতাটির প্রতি। টের পেয়ে মা বারবার তাকে মনে করিয়ে দিতেন, ভুলেও যেন বাবার ছাতা না ধরে সে।
চার
পরীক্ষা শেষ করে বাসায় ঢুকতেই মা খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘শাহেদ, তুই কি তোর বাবার ছাতা নিয়ে গেছিস স্কুলে?’ শাহেদের মনে পড়ে যায়, হায়, ছাতা তো সে স্কুলে ফেলে এসেছে। একদৌড়ে আবার স্কুলে। ছাতা পাওয়া যায়নি আর।
খালি হাতে বাসায় ফেরার সময় ভয়ে ভয়ে শাহেদ ভাবছিল, যে স্কুল থেকে ছাতা এসেছিল, সে স্কুলেই ফেরত গেছে—এটা ভেবেও কি বাবা মাফ করবেন না? না, মাফ করেননি তিনি। বাসায় ঢুকতে শুধু বাকি, কী মারটা যে মেরেছিলেন সেবার!
পাঁচ
আজ শাহেদের অবসরে যাওয়ার দিন। একত্রিশ বছর একই প্রতিষ্ঠানে থেকে চাকরিজীবন শেষ করল সে। সহকর্মীরা যখন একেকজন করে বিদায়ী উপহার তুলে দিচ্ছিল, শাহেদের মনে হলো, আজ যেন সে বাবার সেই অবসরের দিনটাই মঞ্চস্থ করছে।
সবশেষে শাহেদের হাতে উপহার তুলে দেয় মিসেস ডি কস্টা। বছর পাঁচেক আগে এখানে যোগ দিয়েছে মিসেস ডি কস্টা। প্রথম দিন থেকেই শাহেদের ভেতরে কেমন একটা অন্যায় কাঁপুনি তৈরি হয় তাকে দেখলে। এই কাঁপুনি অবশ্য বাবাকে ভয় পাওয়ার কাঁপুনি নয়। সম্পূর্ণ আলাদা এক কাঁপুনি। অব্যাখ্যেয়। কিংবা চাইলে ব্যাখ্যা করা যাবে, শাহেদ চায় না।
মিসেস ডি কস্টার র্যাপিং পেপারে মোড়ানো উপহারটি দেখেই শাহেদ আন্দাজ করে, এটা একটা ছাতা। খুব ছোট্ট। দেশে বোধ হয় তৈরি হয় না এ ধরনের ছাতা।
ছয়
বাড়িতে ফেরার পুরোটা পথ ছাতাটা বুকের মধ্যে লাগিয়ে রাখে শাহেদ। বৃষ্টি হচ্ছে, তবু ছাতা খুলতে মন চায় না তার। ভিজলেই যেন নষ্ট হয়ে যাবে! তার মাথায় শুধু একটাই ভাবনা, আর দেখা হবে না মিসেস ডি কস্টার সঙ্গে! আর নাহ!
বাসায় ঢুকেই সবার আগে বাবার ঘরে ঢোকে শাহেদ। প্রায় অর্ধমৃত বাবার পায়ের কাছে ডি কস্টার দেওয়া ছাতাটা রাখে সে। তার যে আজ আর বাবাকে ভয় করছে না, এতে সে মোটেই আশ্চর্য হলো না। সে জানে, আর কোনো দিন ভয় পাবে না তাকে।
ফিসফিস করে বাবাকে শাহেদ বলল, আমাকে ক্ষমা কোরো, বাবা।
কেন গল্প লিখি
আমি বিশ্বাস করি, পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের কাছে অন্তত একটি গল্প জমা আছে। একেকটি গল্প লিখি আর মনে হয়, তাদের একেকজনের কাছ থেকে তার গল্পটি চুরি করে নিয়ে নিলাম। অনাবিষ্কৃত ঘটনা আবিষ্কারের এক গরিমাও বোধ করি গল্পটি লিখে।
আমার লেখালেখির শুরুই গল্পের মাধ্যমে। প্রথম প্রকাশিত লেখাটিও ছিল গল্প, কাজী আনোয়ার হোসেন সম্পাদিত রহস্য পত্রিকায়। গল্প লেখার ইচ্ছা না হলে আমি কোনোদিন কলমই ধরতাম না, বিশ্বাস করি। তাই নিজের মূল পরিচয় গল্পলেখক পরিচয়েই দিয়েই পুলক বোধ করি।
প্রতিটি মুহূর্তে অজস্র চরিত্র তাদের একেকটি গল্প নিয়ে ঘুরে বেড়ায় আমার মাথায়, লেখার আগপর্যন্ত স্বস্তি পাই না। তবু নিদারুণ আলস্যের কারণে অনেক গল্প হারিয়ে যায় মাথা থেকেই। লেখালেখি এখনো উপভোগ করি আমি। উপভোগ করি আলস্যও। তাই গল্পগুলো হারিয়ে গেলেও খুব খারাপ লাগে না। আরও নতুন নতুন গল্প নিয়ে নতুন নতুন চরিত্ররা ঘুরে বেড়াতে থাকে। গল্প লিখলে অনুভব করি, কোনো এক ভার যেন নেমে গেল মাথা থেকে, বুক থেকে।
Leave feedback about this