অরুণিমা
টিউশন থেকে আজ ফিরতে বেশ দেরি হয়ে গেল। অরুণিমা বার বার ঘড়ি দেখছে। হলের গেট বন্ধ করে দিলে বড্ড ঝামেলায় পড়তে হবে। এ মাসে দুই বার দেরি করে ফিরেছে সে। আজ দেরি হলে সিদ্দিক মামার হাত থেকে আর রক্ষা নেই। সোজা হোস্টেল সুপারের কাছে ডাক পড়বে। হল থেকে বের করে দিলে পড়ালেখা বন্ধ করে গ্রামে চলে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। এসব ভাবতে ভাবতেই আনন্দ সিনেমা হলের পাশের চাপা গলি পেরিয়ে লেগুনা স্ট্যান্ডে চলে আসে অরুণিমা। হাতে এখনো ৩০ মিনিটের মতো সময় আছে। ফার্মগেট থেকে ইডেন কলেজ আসতে এ সময়টা যথেষ্ট। কিন্তু জ্যাম এর কারণে সব হিসেব-নিকেশ ভুল প্রমাণিত হয়ে যায়। এক হাঁটু পানি জমে আছে রাস্তায়। রিকশা, লেগুনা দুয়েকটা যা দেখা যাচ্ছে সব প্লাস্টিকের কাগজে মোড়ানো। চায়ের দোকানগুলো মুড়ে আছে প্লাস্টিকে। এখনো টিপটপ বৃষ্টি ঝরছে। একটা লেগুনা এসে দাঁড়ালো ল্যাম্পপোস্টটার নিচে। ছাতা বন্ধ করতে করতে দৌড়ে গিয়ে উঠে পড়লে অরুণিমা। কিন্তু একটাও যাত্রী নেই দেখে চিন্তায় পড়ে গেল। যাত্রী না হলে তো এরা ছাড়বেও না। কী যে আছে আজ কপালে!
“মামা, কই যাইবেন? এত অস্থির হইতাছেন কেন?”
লেগুনার দরজায় মাথা ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলো হেল্পার।
“নীলক্ষেত নামবো”- বললো অরুণিমা।
“ও মামায় কি ইডেনে পড়েন?”
“হুম মামা, হল বন্ধ হয়ে গেলে খুব বিপদে পড়বো।”
“চিন্তা কইরেন না। টাইমের গাড়ি। তাছাড়া এত ঝড় তুফানের মধ্যে রাস্তায় গাড়ি চালায় না ওস্তাদ।”
হেল্পার ছেলেটি ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে কি যেন বললো। এরপর ছেলেটি বাইরে এসে একলাফেই লেগুনার মধ্যে ঢুকে পড়লো। লেগুনা ছুটতে শুরু করলো, অরুণিমা হাঁফ ছাড়লো। এবারের মতো হয়তো রক্ষা পেল। এরপর আর দেরি করবে না। আগে আগেই বের হয়ে আসবে টিউশন থেকে। বৃষ্টির বেগ বাড়তে শুরু করেছে। ছেলেটা সিগারেট ধরিয়ে উল্টোমুখো হয়ে টানতে লাগলো। কিন্তু গন্ধটা বিকট লাগলো ওর কাছে। এটা স্বাভাবিক সিগারেট নয়, বুঝলো অরুণিমা। হঠাৎ করেই লেগুনাটা শুনশান একটা ছোট্ট গলিতে ঢুকে পড়লো। অরুণিমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে ছেলেটি সবগুলো দাঁত বের করে হেসে বললো, “ওস্তাদ আপনার সমস্যার জন্যই তো শর্টকাট পথে আসলো।” ছেলেটির হাসি দেখে বিশ্রী লাগলো অরুণিমার। কেমন যেন ভয় করে উঠলো ওর। গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়লো কোথাও। অন্ধকারে কিছু বোঝার উপায় নেই। বৃষ্টির শব্দ, বাতাসের তীব্রতায় পলিথিন বাড়ি খাচ্ছে। ভয়ার্ত চোখে তাকালো অরুণিমা। হেল্পার ছেলেটা কনিষ্ঠ আঙুল উঁচু করে বুঝিয়ে দিল থামানোর কারণ। পলিথিন তুলে বাইরে তাকালো অরুণিমা। আলোর ঝলাকানিতে দেখলো দুটো মাথা এক হয়ে কী যেন আলোচনা করছে। হঠাৎ মনে হলো অরুণিমার নেমে দৌড় দেওয়া উচিত। কিন্তু এই অন্ধকারে বৃষ্টির মধ্যে দৌঁড়ে কোথায় যাবে কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। পা লোহার থেকেও কয়েকগুন বেশি ভারী মনে হলো। ছেলেটা ভেতরে ঢুকে ভাড়া চাইলো। অরুণিমা ব্যাগ থেকে ভাড়া বের করতে গিয়ে খেয়াল করলো ওর হাত কাঁপছে। কেন এত ভয় করছে, বুঝতে পারছেনা। টাকা বের করে মাথা তুলতেই পেছন থেকে একটা গামছা দিয়ে অরুণিমার মুখ বেঁধে ফেললো ড্রাইভার। অরুণিমার মনে হলো দুঃস্বপ্ন দেখছে সে। চিৎকার দিল পৃথিবী কাঁপিয়ে, কিন্তু কোন আওয়াজ বের হলো না। দম বন্ধ হয়ে আসলো ওর। হেল্পার ছেলেটা ওর হাত দুটো বেঁধে দিলো এক পলকেই। দুই সিটের মাঝে অরুনিমা নিজেকে আবিষ্কার করলো। ওর সালোয়ার উড়ে গিয়ে পড়লো হয়তো পাশের ড্রেনে না হয় পানি জমা রাস্তায়। গোলাপি রঙের শখের জামাটা ছিঁড়ে ফেলতে কি তাড়াহুড়ো ওদের! মাথার মধ্যে কতো কী প্রশ্ন এসে ভিড় করছে… আচ্ছা, গোলাপি রঙের সালোয়ার না কি তার ছবি দিয়ে খবর হবে পত্রিকায়? মা কী করবে? আমি কি মরে যাচ্ছি? আমার বিয়ের জন্য জমানো টাকা নিশ্চয়ই ছোটুটা নিয়ে যাবে। আমার কলেজের শিক্ষক হবার স্বপ্ন নিয়ে বিভোর মা কি আমার জন্য কাঁদবে? না কি স্বপ্ন ভাঙার যন্ত্রণায়? হলের সিটটায় নতুন করে কে উঠবে? টিউশনির বেতন বাকি দুই মাসের, নেওয়া হলো না।
কী অদ্ভূত! এখন কি অরুণিমার এসব ভাবার কথা? বৃষ্টির শব্দে অরুণিমা হারিয়ে গেল বরিশালের ছায়াঘেরা গ্রামে, নৌকায় ভেসে বেড়াতে থাকলো। হঠাৎ ছোটুকে রেখে সাদা বক হয়ে গেল অরুণিমা। স্বপ্নের আকাশে উড়তে উড়তে হঠাৎ দিক হারিয়ে গেল। ছোটু, মা, গ্রাম সব ঝাপসা হয়ে আসলো।। কে যেন ডানাটা ভেঙে দিল, গলাটা ছুরি দিয়ে দুভাগ করে দিল। এবার রক্তমাখা সাদা বক নিচে পড়তে থাকলো দ্রুত! টুপ করে ঝিলের পানিতে ডুবে গেল।
আমার গল্প লেখা
যাপিত জীবনের আঘাত, যন্ত্রণা, দীর্ঘশ্বাস, ভুলে যাওয়ার অন্যতম উপায় হচ্ছে আমার লেখালেখি। আসলে, হৃদয়ের রক্তক্ষরণ, যন্ত্রণার তীব্রতর অনুভূতি কারো কাছে বলতে চাওয়া বা প্রকাশ করতে চাওয়া থেকেই লেখালেখি শুরু করি। চারপাশের মানুষ, মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবন, প্রকৃতি সাথে সাথে মানুষের এই যে বদলে যাবার খেলা, খোলসের আড়ালে ভিন্ন আরেক জগৎ এই সব কিছুই আমাকে আন্দোলিত করতো। সেই অনুভূতি প্রকাশ করতে চাওয়া থেকেই লেখা শুরু হয় মূলত। লেখার মধ্যে দিয়ে অদ্ভুত এক প্রশান্তি পাই, তাই লিখতে ভালোবাসি।
জীবনের শুরুতে ঝালমুড়িওয়ালা হতে চেয়েছি, হতে চেয়েছি আইসক্রিম বিক্রেতা। একটু বড় হওয়ার পর দেখেছি হাজারো মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো আমার বাবা-মায়ের মেয়েকে ডাক্তার বনানোর স্বপ্ন। বুঝে না বুঝে আমিও ডাক্তার হতে চেয়েছি। অথচ আমি জানতাম-ই না আসলে আমি কী হতে চাই! কোন কাজে আমার ভালোলাগা! তবে এখন খুব ভালো করে উপলব্ধি করতে পারি যাপিত জীবনের দীর্ঘশ্বাস মুছে দিতে পারে আমার লেখা।
ছোটবেলা থেকেই আমি গল্প শুনতে ভীষণ ভালোবাসতাম। সবার কাছে শুধু গল্প শুনতে চাইতাম। বই পড়ার প্রতি ছিল প্রবল ঝোঁক। কিন্তু লেখক হবো এটা ভাবনায় আসেনি কখনো। তবে আমি প্রচণ্ড কল্পনাপ্রবণ ছিলাম। পাঠ্যবইয়ের কোন ছবি দেখে আমি কল্পনায় হারিয়ে যেতাম, গল্প তৈরি করতাম নিজের মতো করে, সেই গল্পের পছন্দের চরিত্রে নিজেকে রাখতাম। পড়া বাদ দিয়ে এমন কল্পনায় হারিয়ে যাবার জন্য মায়ের হাতের মার খেয়েছি অনেক। পছন্দ অনুযায়ী একটা কল্পনার জগৎ তৈরি করে রেখেছিলাম আমি। বই পড়ার বাইরের সময়টুকু আমি এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে বাস করতাম।
আমার ব্যক্তিগত জীবনে হঠাৎ করেই ছন্দপতন হয়। আমি সিঙ্গেল লাইফ বেছে নিই। ওই সময়টা পার করা ভীষণ কঠিন ছিল আমার জন্য। একটা মেয়ের সেপারেশন লাইফ নিয়ে শুরু হয় নানা গুঞ্জন। মানুষের নানারকম কৌতূহলী প্রশ্ন, তাদের মতো করে গল্প তৈরি করে নিজ দায়িত্বে তা ছড়িয়ে দেয়া নতুন কিছু নয়। আমি তখন ক্লান্ত হয়ে গেছি চারপাশের নানা কারণে। এসব ভুলতে দিনরাত বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকতে শুরু করি। হৃদয়ের তোলপাড় থামাতে হাতে তুলে নিই কলম। নিজের তীব্র অনুভূতি প্রকাশ করতে পেরে একসময় আবিষ্কার করি শান্ত হৃদয়। এভাবেই আসলে আমার লেখক হয়ে ওঠার গল্পের শুরু।
আমার পরিবারের সবাই বিশেষ করে আমার মা আর আমার ভাইয়ের সাপোর্ট সবচেয়ে বেশি। সমাজের মানুষের নানারকম কথা উপেক্ষা করেও আমার ভালোলাগাকে প্রাধান্য দিয়েছে আমার পরিবার। ২০১৭ সালে আমার প্রথম ফেসবুক একাউন্ট খোলা হয়। উদ্দেশ্য ছিল সমসাময়িক লেখকদের লেখা পড়া। একদিন হঠাৎ করেই একটা অনলাইন পোর্টাল চোখে পড়লো, বেশ ভালো লাগলো। সাহস করে একটি লেখা পাঠালাম। আমার শ্রদ্ধেয় এক স্যারকে নিয়ে লেখা একটি গল্প। লেখাটি প্রকাশিত হলো। এরপর বেশ কয়েকটি গল্প পরপর প্রকাশিত হলো। “কালি ও কলম” অনলাইন গল্প লেখার প্রতিযোগিতায় আমার একটি গল্প স্থান পেল “খসে পড়া তারার গল্প” নামে। আত্মবিশ্বাস বাড়লো। এরপর ফেসবুক অনলাইন গ্রুপ পেন্সিলে লিখতাম নিয়মিত। নতুন লেখকদের বই প্রকাশ করে পেন্সিল, সেখানে পাণ্ডুলিপি জমা দিলাম। আমার পাণ্ডুলিপি নির্বাচিত হলো এবং ২০২০ সালে প্রথম ছোটগল্পের বই “কয়েদি নম্বর ৩৩২” বইটি প্রকাশিত হয়। পেন্সিল পাবলিকেশন্স থেকে এ পর্যন্ত ৩টি বই প্রকাশিত হয়েছে আমার। আমার মতো নতুন লেখকের জন্য পেন্সিল সত্যি আশীর্বাদ। এভাবেই আমার লেখক হয়ে ওঠা।
না লিখলে দম বন্ধ হয়ে আসে, নিজের মনের সাথে সারাক্ষণ কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠি, তাই আমি ভালো থাকার জন্য লিখি, হৃদয়কে শান্ত রাখার জন্য লিখি।
Leave feedback about this