কথাসাহিত্য ছোটগল্প বিশেষ সংখ্যা

দীপংকর গৌতম | তাপদাহ ও একটি এসি | অণুগল্প সংখ্যা

তাপদাহ ও একটি এসি
অফিস থেকে বেরিয়ে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। তাপদাহে জীবন অতিষ্ঠ। সূর্যটা যেন মাথার কাছে চলে আসছে। খিলক্ষেত বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে দেখছি। গলে পড়া সূর্যের আলোর ভিতরে একদল রিক্সাচালক ঘামভেজা শরীরে শরবত বিক্রেতার কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। হলুদ রঙের শরবত। কাঁচের জারে বেলের দুয়েকটা কণা উঁকি দিচ্ছে, তারমাঝে ভাসছে তোকমাদানা। বরফের আস্তরলেখ ফুলে ফেঁপে আছে। সবাই গ্লাস ভরে ঠান্ডা শরবত খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে। কেউ-বা খাচ্ছে খোলা তরমুজফালি। কতগুলি কুকুর পাশে বসে জিভ বের করে হাঁপাচ্ছে। গাছের পাতাগুলি নিথর। বাতাস নেই। তীব্র দাবদাহের এ দৃশ্য দেখতে দেখতে কাঙ্ক্ষিত বাসের সারি দেখছি। ফিটনেসহীন গাড়ি থামাচ্ছে পুলিশ। হেলপাররা কাগজপত্র দেখিয়ে কেউ বিশেষ ব্যবস্থায় যাচ্ছে। আবার কোনটা পুলিশের সঙ্গে ছাড়ার কলা-কৌশল ব্যবহার করছে। এসব দেখতে দেখতেই আমার হালকা সবুজ রঙের বাসে উঠে পড়ি। বাসের ভেতরে মানুষ ভর্তি। কোনোরকম দাঁড়ালেও এ আরেক দোযখ। বাসের ভেতরের ফ্যানগুলির অধিকাংশই নষ্ট। যাত্রীরা গরমে হাঁসফাঁস করছে। আবার কোনো কোনো যাত্রী অসহ্য হয়ে নষ্ট ফ্যানের জন্য গালাগালি করছে ড্রাইভার-হেলপারকে। সবাই ঘামে চুবুচুবু। এর মঝে ঠান্ডা পানি, কাঁচা আম, শসা নিয়ে হাঁকাহাকি করছে বিক্রেতারা। রাস্তার পাশে অফিস ফেরা যাত্রীদের ভিড়। গাড়ি চলে কি চলে না, বাসভর্তি যাত্রী। অফিসে এসি রুম থেকে যারা এসে বাসে উঠছে তাদের অবস্থা আরো খারাপ। আষাঢ়ের বৃষ্টির মতো ঘাম সহ্য করে গণপরিবহনের সংকটে এসব গাড়ির অবস্থা দেখেও উঠে পড়ছে। যেভাবেই হোক বাসায় যেতে হবে। সবাই কোনো রকমে উঠতে পারলেই যেন বাঁচছে। বাস থামলেই মোহাম্মদপুর। সবাই হুমমুড় করে নেমে পড়ে ছুটছে। আমি একটা এসির শোরুমে ঢুকে যাই। শীতল কক্ষ। অনেকগুলো এসি থেকে গলগল করে নামছে শীতল হাওয়া। শোরুমের কোনে একটি এসির দিকে দৃষ্টি আমার। লাল-নীল অক্ষরে লেখা কোম্পানির নাম। বার বার এসিটিকে দেখছি। একজন কর্মচারী এসে দাঁড়িয়ে আমাকে ইনভার্টার নন ইনভার্টারের পার্থক্য বুঝাচ্ছে। সঙ্গে বিভিন্ন অফার। হ্যাঙ্গার, পাইপসহ লাগিয়ে দিয়ে আাসবে তারা। এক বছর সার্ভিস ওয়ারেণ্টি, পাঁচ বছর সার্ভিস ওয়ারেন্টি। দাম দেড়টন নিলে ৮০ হাজার। একটনে ৬০ হাজার। কতদিন গরমে ঘুমাতে পারি না। লেখক মানুষ, অফিস শেষে এসে গরমে লিখতেও মন চায় না। কম্পিউটারটাও ঠিক করতে হয়। এমন একটা এসি হলে আর সংকট থাকে না। শীতল বাতাস খেয়ে ঘুম,লেখা! আহা! এর চেয়ে শান্তি আর কী আছে। বিক্রি হচ্ছে দেদারছে। কারো যেন টাকার কোনো সংকট নেই। যত সংকট সব আমার। এত টাকা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস খাওয়া আমার কাছে বিশাল ব্যাপার। তাছাড়া মেয়েটার পরীক্ষা সামনে, স্ত্রীর জরুরি অপারেশন, সব ভাবছি। আবার কেনার পরে সার্ভিসের ঝামেলা, কত কী! ততক্ষণে ঘাম শুকিয়ে আমি শীতল মানুষ। এখান থেকে বের হলেই আবার গরমে ঘামতে ঘামতে বাসায় ফিরে কখন একটু ঘুম আসবে। ভাবছি। কিছুক্ষণ পরে শোরুম থেকে বের হতে গেলেই বিক্রেতা ছেলেটা বলে, ‘স্যারের বাসা কোথায়? নিলে আজই বুকিং দেন। কাল থেকে এই অফার থাকবে না। জৈষ্ঠ্য মাস এলে গরম আরো বাড়বে।’ শুনতে শুনতে নিঃশব্দে বেরিয়ে দেখি সেই একই দৃশ্য। মানুষ শরবত খাচ্ছে, কেউ-বা চাঁদ আকৃতির লালরঙা তরমুজফালি। ধূলো উড়িয়ে লেগুনা আসতেই ঠাসাঠাসি করে উঠে পড়ি। তাপ যেন বাড়ছেই। জামার বোতাম খুলে ফুঁ দেই বুকে। মনের পটে ভেসে ওঠে মায়ের মুখ। সেই কবে মা চলে গেছেন। তখন আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ আসেনি। রান্না শেষে মা, মাটির মেঝেতে আঁচল বিছিয়ে শুয়ে থাকতেন। একটু শীতলতার জন্য কি আকুতি ছিল মায়ের। বাবার তখন সঙ্গতি ছিল না। গরীবের চিকিৎসক বাবার আমাদের পড়া-শেখার খরচ যোগাতেই শীতেও ঘাম ঝরত রীতিমতো। এখন কত এসি চারদিকে। আর ফ্যানতো সবার ঘরে। টিনের ঘরে গরমের মৌসুমটায় মায়ের কষ্টের কথা মনে করতে করতে আমি পৌঁছে যাই স্টেশনে। আমার চোখ ভিজে ওঠে। কষ্ট করে হলেও মাকে তখন একটা এসি দিতে পারলে মৃত্যুর আগে একটু শান্তি পেতেন। সে সুযোগ আর এ জন্মে পেলাম না। ভাবতে ভাবতে বাসার দরোজায় পৌঁছে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে দেখি আমার ঘাম শুকিয়ে গেছে। জীবনের না পাওয়া সব যন্ত্রণার কাছে এসি যেন নিরর্থক হয়ে পড়ে।

গল্প লেখার কথকতা

মূলত শৈশব থেকে কবিতা লিখতাম, ছড়াও কখনও কখনও। স্কুলের দেয়ালিকা থেকে গোপালগঞ্জ শহরের সাহিত্যপত্রে আমার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। বাড়িতে তখন সোভিয়েত সাহিত্যের বহু বই আসত, আসত পত্রিকা, সবই গোগ্রাসে পড়তাম। তারপর ঢাকায় এসে পড়াশুনার ভেতরেই দৈনিক আজকের কাগজে ঢুকে পড়ি। সাব এডিটর হিসাবে কাজ করার সময় দৈনিকের ম্যাগাজিনে লিখতে হতো। আমি তখন ছুটির দিনে কোনো না কোনো গ্রামে একটা জেনিথ ক্যামেরা নিয়ে চলে যেতাম। এর মধ্যে বাম রাজনীতি করার সূত্রে বিভিন্ন গণসংগঠনের প্রকাশনায় গল্প পড়তাম। পড়তাম বিভিন্ন ধরনের বই। একদিন হাতে আসে চারণ সাংবাদিক সত্যেন সেনের ‘গ্রাম বাংলার পথে পথে’। তারপর হাতে পাই মোনাজাত উদ্দিনের ‘পথ থেকে পথে’, ‘সংবাদ নেপথ্যে’, ‘কানসোরার মুখ’, ‘পায়রা বন্দের শেকড় সংবাদ’ ইত্যাদি। তাতে আমার প্রতিবেদন যেন প্রাণ পায়। ইতিমধ্যে অজস্র সাহিত্যের বই পড়া হয়। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সুবাদে পড়তে থাকি দেশি-বিদেশি গল্পের বই। এরমধ্যে শিশু একাডেমির ‘শিশু’ পত্রিকায় ছাপা হয় আমার গল্প ‘বাদল নামের সেই ছেলেটি’। এটা দেখার পরে আজকের কাগজের ম্যাগাজিন ‘খবরের কাগজে’র বন্ধু কবি, শিল্পী, হাসান মাহমুদ একদি গল্পের সংকটে আমাকে একটা গল্প লিখতে বলে, আমি অনেক রয়েসয়ে লিখে ফেলি গল্প ‘কালসাপ’। এটা পাঠকপ্রিয়তা পেলে আরেক বন্ধু কবি আসাদ আহমেদ, (বর্তমানে বাংলা একাডেমিতে কর্মরত) সে তখন আজকের কাগজের সাহিত্য পত্রিকা ‘আজকের সভ্যতা’য় গল্প দিতে বলে। আসাদ ও আমি তার কিছুদিন আগে শেরপুর যাই কমরেড রবি নিয়োগীর ওপর একটা স্টোরি করতে। সেখানে শ্মশানঘাটে আমাদের সঙ্গে কথা হয় ডোম জনৈক রামলাল দেশনায়েকের সঙ্গে। লাল কাপড় পরিহিত রামলালের সঙ্গে কথা বলে আমরা দুজন রামলালকে নিয়ে একটা গল্প লেখার পরিকল্পনা করি। ঢাকায় এসেই লিখে ফেলি গল্প। সেটা ছাপা হওয়ার পর দৈনিক যুগান্তরের সাহিত্য সম্পাদক শ্রদ্ধেয় আলীম আজিজের সঙ্গে কথা হলে তিনি গল্প লিখতে বলেন। আমি লিখে চলি। কিন্তু এর মধ্যে কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদারের গল্প ‘বিশ্বাসের আগুন’ পড়ে আমার গল্প লেখার ধারা বদলে যায়। এরপর এসব গল্প নিয়ে কথা হয় বরেণ্য কথাসাহিত্যিক কুলদা রায়ের সঙ্গে। আলীম আজীজ ততদিনে প্রবাসে চলে গেলেন। এরপরে গল্পপাঠে লিখলেও কুলদা রায়ের গল্প ‘সুবোলসখা বৃত্তান্ত’ শওকত আলী স্যার, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্প পড়ে আমি গল্প লেখা বন্ধ করে দেই। তারপর গল্পের নতুন বুনোট খুঁজি। এভাবে গল্প লেখা আবার শুরু হয়। এখন লিখছি বিভিন্ন কাগজের সঙ্গে গল্পপাঠে। আমি এখনো উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো গল্প লিখতে পারিনি। তবুও পত্রিকায় কাজ করার সূত্রে আমন্ত্রণ পেলে লিখি। লেখা আমার আনন্দ। গল্প কতটুকু হয় তা পাঠক জানেন। তবে আমার গল্পের বিষয় আমার দেখা বিভিন্ন জনপদের মেহনতী মানুষের জীবনালেখ্য। এটা পাঠক গল্প হিসাবে না নিলেও এভাবেই লিখে যাব

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field
    X