ছোটগল্প বিশেষ সংখ্যা

সুইমিং পুল | তাইবা তুলবি | ছোটগল্প | উৎসব সংখ্যা ২০২৪

চকচকে সানগ্লাস পরে সেলিম এখন মাছের ব্যাবসা করতে যায়। একেকবার জাল ফেললে তার হাতে উঠে আসে ভেজা ভেজা কাঁচা টাকা। মাছের গন্ধে ভরা একেকটা নোটে কোটি কোটি জীবনের হিসাব নম্বর—ওগুলো ঠিকমত গুণে সেলিম পকেটে ঢুকাল। অবিলম্বে রোদ ঢেকে দিয়ে নিঃশব্দ মেঘেরা ঝাঁকে ঝাঁকে বৃষ্টি নামাল।

আবাহাওয়া চমৎকার। তাছাড়া বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকা এখন সেলিম সাহেবের সাথে নিতান্ত বেমানান। তাই বাকি স্টাফদের সবকিছু ভালমত বুঝিয়ে দিয়ে বাড়ি ফেরার পথ ধরল সেলিম।

বৃষ্টিতে চোখ-মুখ দলা করে করে সামান্য হেঁটে সে গাড়িতে গিয়ে উঠল। কখনো তার কাঁচাপাকা দাড়ি লক্ষ করতে পারলে আশেপাশের লোকজন সরে দাঁড়ায় এবং মিলিটারির মতন লম্বা সালাম দেয়। তখন গর্বে সেলিমের বুক ফুলে ওঠে।

কিছুসময়ের মধ্য বৃষ্টির তোড় বেড়ে গেল। সেলিম অনেকক্ষণ সামনের কাঁচে চেয়ে থাকে ভাবনাহীন। সামনের সাদাটে ঘোলা রাস্তাটা তার চোখে ডিপ ফ্রিজের মতন লাগে। সানগ্লাসটা মুছে সে আবার পরে নেয়; এখন সবকিছু ভাল।

টনির দোকানের সামনে গিয়ে সেলিমের গাড়িটা থামল। ‘কি খবর ভাইসাব?’ টনি তাকে একচোখে খেয়াল করে সিঙ্গারার খিলিতে পুর ভরতে ভরতে হেঁকে বলল।

‘আলহামদুলিল্লাহ, ভাল!’ সেলিম বলল। তারপর হাত বাড়িয়ে শোকেস দেখিয়ে, ‘আমাকে পাঁচটা করে দশটা সিঙ্গারা-সমুচা দিবি। তুই কেমন আছিস?’

চেনা জানা অনেকেই সেলিমের দিকে চেয়ে থাকে। এটা সেই সেলিম যে বছর কয়েক আগেও মাছ বিক্রেতা ছিল। দশ-বিশ টাকার জন্য পোশাকে হাত মুছে উঠে পড়ে লাগত, ঝগড়া বাধাতো। এ দোকানেরই অনেকে এসব ঘটনা মনে করতে পারে আর যারা নতুন তারা অধীর উৎসাহ নিয়ে চা খেতে খেতে কেবল শুনে যায় এক আদর্শ জীবনকথা।

সেলিম কোত্থাও বেশিক্ষণ দাঁড়ায় না; আজ বৃষ্টিতে নামলও না। এক ঠোঙা গরম গরম সিঙ্গারা হাতে নিয়ে সে দ্রুত গাড়ির কাঁচ তুলল।

বাড়ি ফিরে ভেজা গায়ে সে তাড়াতাড়ি করে চটি খুলে ফেললেও, চোখের সানগ্লাসটা খোলে না। এখন আঁধারি কিংবা মাইল্ড দৃশ্য দেখতে দেখতে সে এতটা অভ্যস্ত যে এভাবেই চোখের স্বস্তি; স্বাভাবিক আলোতে তার চোখগুলো স্থানীয় পাহাড়িদের মতন ছোট হয়ে আসে।

চোখে অন্ধকার দেখতে দেখতে সেলিম তার মহলমত বাড়িটার ভেতরে ঢুকল। মেঘাবৃত বেলায় গর্জানো বৃষ্টির শব্দ। একটা তেলোপোকাও বিলবিল করতে করতে সেলিমের পেছন পেছন ঢুকল। সে যেন নিজের বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে কার বাড়িতে ভুল করে ঢুকে পড়েছে। সেলিম যখন হলঘরে এসে পুলের সামনে থামল; এন্টেনা নাড়তে নাড়তে ওটাও থামল।

সামনেই হলঘরের মাঝখানে একটা বারো ফুট ইনডোর স্যুইমিং পুল; সেলিম বাড়ি ফিরলে সবার আগে এদিকে এসে দাঁড়ায়। তারপর একমনে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। পুলের পানি কিংবা কোনো মাছ না; নিচে থাকে তার একমাত্র মিষ্টি মেয়ে পিয়া। যাকে কিঞ্চিৎ নড়তে চড়তে দেখতে পেলেও তার অসম্ভব ভাল লাগে।

সেলিম নিচে কিছু সময় ধরে পিয়াকে দেখল এবং খাটের দিকে আন্দাজ করে একটা সিঙ্গারা ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ‘তুমি স্কুলে যাও নাই?’ প্রতিবার আনুষ্ঠানিক প্রশ্ন করে সে চোখাচোখি ফাঁকি দেয়; অন্যদিকে চেয়ে থাকে।

সত্যি বলতে সেলিমের মনে হয়, পিয়ার ভাষাটা আলাদা। যে ভাষা সে কোনোভাবেই বুঝতে পারে না। চোখে পড়লে অল্পস্বল্প জাপানি বলার মতন হাঁফ ছাড়তে হয় তাকে প্রতিবার।
সিঙ্গারাটা বালিশের পাশ থেকে কুড়িয়ে নিয়ে পিয়া জবাব দিল, ‘নাহ্। স্কুল তো বন্ধ।’

তেলেপোকাটা এবার উড়ে গিয়ে দূর কোণের অন্ধকার পর্দার ভাজে বসল। তারপর উপরের দিকে হেঁটে হেঁটে মহলের কোথায় যেন নিখোঁজ হবে বলে লুকিয়ে গেল।

সেলিম আর কিছু না বলে ডানদিকের করিডোর পেরিয়ে নিজের কামরায় গিয়ে ঢুকল আর পায়ের উপর পা তুলে, হাওয়ার উপর পাওনাদেরদের হিসাব করা শুরু করল— প্রতিদিনই করে।
হলঘরের বড় ঘড়ির ঘণ্টায় বারোটা বাজলে পিয়ার পোষা দুই কেজি ভারি মাছটা জারে পাক দিয়ে উঠল— এতে সুবিশাল ঘরে কোনোরকম আলোড়ন হলো না।

যা যা দরকার সবই রাখা আছে পুলটাতে। শূন্য সুইমিং পুলে কালো কারপেট বিছিয়ে বানানো বারবি ডলের মতন একটা পর্যবেক্ষিত রুম—কোনো দরজা নেই, জানালা নেই; একটা লোহার সিঁড়ি আছে ওঠা-নামার জন্য। পিয়া শুধু উপরে উঠে বাথরুমে আর স্কুলে যায় এবং পুনরায় পুলের নিচে ফিরে আসে।

পিয়ার মা পরি জানে—পিয়ার যেমন উচ্চতা ভয় করে, তেমনি ভয় করে গভীরতা। কিন্তু বাড়িতে যেহেতু কোনো কামরা খালি নেই তাই…
প্রত্যেকটা কামরা একেকটা তালাবদ্ধ ফ্রিজার এবং সেগুলো ভর্তি আছে শতশত মাছের লাশে। লেজ বাঁকা, চোখ খোলা, বরফ ধারাল মাছগুলো প্রত্যেকটা কামরা দখল করে আছে। উপরে নিচে মোট বারোটা কামরা। বারোমাস হিমশীতল পরিবেশে চোখের আড়াল হয়ে থাকে সেগুলো।

মধ্যরাতে পিয়া বাথরুমে গেলে আসার পথে খুব গোপনে পা টিপে রুমগুলোর পাশ ঘেঁষে ঘেঁষে ফিরে আসে। আর তখন পিয়ার কোমল মনুষ্যচর্ম ভেতরের কল্পনা করে সরীসৃপের মতন শীতল হয়। তবু সে ভেতরে ঠাণ্ডা মাছগুলো দেখার তীব্র কৌতূহল অনুভব করে এবং ভাবে—কি অদ্ভুত! সে মানুষ হয়ে পুলে থাকে আর মাছগুলো মাছ হয়ে কামরায় থাকে।

দেড় বছর আগের একদিন— যখন নতুন বাড়িতে পিয়া বারো ফুট গভীর নীল পুলটা দেখল, জ্ঞান হারিয়ে পিছলে যেতে যেতে কিভাবে আবার হুঁশ করে দাঁড়াল নিজেও না কিন্তু তৎক্ষণাৎ উপরের দিকে চোখ পালাতে গিয়ে মুশকিলটা হলো।
তখন উপরের উচ্চতাটাও না চাইতে দেখে ফেলতে হলো— পুলের প্রায় একই উচ্চতায় হলঘরের সিলিং; উপরেও বারো ফুট! কত বিশাল!

ধাধাঁনো চোখে জলের আলো খেলা দেখতে দেখতে পিয়ার শরীর চারাগাছের মতন নেতিয়ে গেল। আধখোলা চোখ নিয়ে সে পুরোপুরি জ্ঞান হারাল। তখনও পিয়া জানত না, তাকে পানিশূন্য করে এই ভয়ানক পুলের তলাতেই থাকতে দেয়া হবে।
যখন পিয়া পুলটার কোণে পাতানো খাটে শোয়, তার মনে হয় বিশ-পঁচিশ ফুট নিচে তাকে কেউ পুঁতে রেখেছে আর যখনই নীল পাথুরে মোজাইক করা দেয়ালগুলো সে বিছানায় বসে ব্যাপক দৃষ্টিকোণে দ্যাখে, পরিবেশটা ভয়ঙ্কর মাথা ঘুরিয়ে দেয়— চারদিক স্বয়ং সমুদ্র যেন ঢেউ তুলে দাঁড়িয়ে আছে… শুধু ভেঙে পড়ার অপেক্ষা।

প্রতিদিন নিচে থেকে পিয়া দেখতে পায় তার পুরো পরিবারকে— চাচাতো, খালাতো, মামাতো, ফুফাতো আরও দূর দূরের মানুষকে; যারা কেউ কেউ কামরাগুলোতে যায় আর ব্লক ব্লক মাছ নিয়ে একে একে বেরিয়ে আসে।

এরা সেলিমের মাছের ব্যাবসা সংক্রান্ত কাজেকর্মে প্রায়ই আসে—স্থলজ প্রাণির মতন উপরে হাঁটা চলা করে বেড়ায়, আড্ডা দেয় আর মাঝেমাঝে ছাদহীন তার ঘরটাকে উঁকি মেরে যায়।

মাঝেমাঝে পিয়ার অজান্তে তার গতিও পর্যবেক্ষণ করে ফেলে তারা… অবসর কাটাতে। ঠিক যেমন করে পিয়া তার জারে থাকা কই মাছটার গতি চুপচাপ বসে দেখতে থাকে তার নিজের অবসর কাটাতে।

ফুটফুটে কমলা রঙের জাপানি কই মাছটা পিয়া অনেকদিন ধরে পুষছে। প্রায় সময় সেলিম আকাশে বাতাসে বলে বেড়ায়, ‘ওর মাছটা আমি বিক্রি করে দিব। ওকে বলো, ওটাকে পুকুরে ভাসিয়ে দিতে, না হয় আমি বিক্রি করে দিচ্ছি! যথেষ্ট বড় হয়েছে, ভাল দামও তো পাওয়া যাবে।’
পিয়ার মা পরী কথাগুলো নীরবে শোনে আর পরে একাকি সেলিমকে বুঝিয়ে বলে— ‘একটা মাছই তো। থাকুক ও ভাল আছে ওর মতন। তুমি চিৎকার কোরো না ওর উপর।’

সেলিমের এসবে গুরুতর আপত্তি। মানুষের পাশাপাশি কোনো প্রাণি থাকাটা সে মেনে নিতে পারে না।

মাছটা এখন প্রায় দুই কেজি সমান। যখন কিনেছিল তখন রাখত ছোট্ট জারে। এখন কইটাকে ড্রয়ারের উপর বড় জারে রাখতে হয়। নীল সৈন্যসম দেয়ালগুলো পিয়াকে যখনই চারপাশ থেকে শ্বাসরুদ্ধ করে দেয়, সে হিসফিসিয়ে কইয়ের সাথে কথা বলে হালকা হয়—আমার ঘরটাও এখন পুল; তোর মতন। তুই নামবি এখানে? যদি কখনো নামতে পারিস, সেদিন কি যে হবে! একসাথে সাঁতরাব; আবার নিজে নিজেই বিরতি নিয়ে পিয়া আপন মনে বিরবির করে যায়, ‘কিন্তু আমি তো সাঁতার জানি না।’

একটু পর ভেবে বলে ফেলে, ‘আচ্ছা, তুই শিখিয়ে দিবি?’ পিয়ার কথা শুনে কই মাছটা লেজ দুলিয়ে তলা থেকে উল্টেপুল্টে আবার উপরে ভেসে ওঠে।

একদা গ্রীষ্মে স্কুল থেকে ফিরে এসে পিয়া আনমনা, চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। খাট থেকে তার চোখ নির্ভয় চেয়ে আছে উপরের সিলিং এর দিকে। উপরে একই জলের আলো খেলা পিয়া দেখতে পায় যে দৃশ্যটা প্রথমদিন তাকে অজ্ঞান করে দিয়েছিল।

কিন্তু আজকের দৃশ্যে সিলিংয়ে কোনো কাঁপা জল নেই, আজকে পিয়ার চোখের ভেতরে ঢেউ খেলছে তার নিজের চোখভরা ঝিলিমিলি অশ্রু।

পিয়ার দীর্ঘদিনের অভ্যাস বিছানায় সাবধানে কাঁৎ হয়ে শোয়া। উপরে দ্যাখা এড়িয়ে যেতে বারবারই ধীরে সুস্থে শুতে যেত সে। তবে সত্যি বলতে আজকেও অন্যথা হয়নি, আজকেও তার দৃষ্টি সিলিংয়ে নেই—এই দৃষ্টি দেখতে দুঃসাহসিক মনে হলেও সম্পূর্ণ অন্য খেয়ালে মগ্ন।

পিয়া ভাবতে লাগল স্কুলে আজ তাকে উত্যক্ত করা ভেংচিগুলো। পিয়া যে পুলের তলায় থাকে এটা সবাই জেনে গেছে। কিন্তু কে বলেছে? কিংবা দেখেছে? পিয়া জানে না।

হলঘরে মাছের ব্লক মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে শ্রমিকগোছের কিছু লোক। কিছু বাক্স টানা হেঁচড়ার শব্দ এবং হাঁকাহাঁকি শোনা যাচ্ছে হল জুড়ে। ভাবনায় নীরবে হারাতে হারাতে নিজেকে আরও বেশি করে সমুদ্রের প্রাণী ভেবে নেয় পিয়া। আর ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু চোখের কোণ বেয়ে নেমে আসে ঝুলন্ত গাল হয়ে পুলের কারপেটে।

জলজ কইটা পিয়ার কাছে যেতে পারে না। সে তার নীরবতা ভাঙতে শুধু ঝপাস ঝপাস শব্দ করে গেল জারের ভেতর।

বেশকিছুদিন এভাবে ধ্রুব কাটল।

ইদানীং পিয়ার কাছে আয়নায় নিজের চেহারাটা কেমন মাছ-মাছ লাগে। বিশেষ করে ঠোঁটটা—মাছের ঠোঁট যেমন পানির ভেতর হাপুসহুপুস করে ঠিক তেমন আকারের; যেন বাইরের দিকে বেরিয়ে আসছে দিনদিন। চোখগুলোও যেন বন্ধ কম খোলা থাকতে চায় বেশি।

সেদিন রাতের বেলা পিয়া চাদর ঝেড়ে খাটে শুয়ে পড়ল। সাবধানে সে কাঁৎ হলো একপাশ করে। একটামাত্র পাথরের কোণে তার কইটাও নিশ্চিন্তে ঘুম।

তখন রাত তিনটার কাছাকাছি—হঠাৎ দুঃস্বপ্নের মতন পুলের রিটার্ন জেটগুলো সব একে একে খুলে গেল। গলগল করে জল বেরিয়ে আসতে শুরু হলো দু’পাশের আড়াআড়ি দেয়ালগুলো থেকে সরু নল ধরে।

কোনো শব্দ নেই; নীরব গতিময় বারি যেন ঘুমন্ত প্রাণি দু’টির অগোচরে খুব দ্রুত দ্রুত কাজ সারতে চাইছে। মাত্র কয়েকমিনিটে কারপেট চুপসে ভিজিয়ে, জল পুলের দেয়াল ধরে উচুঁতে উঠতে শুরু হলো।

তিনটায় হলঘরের ঘড়িটা বাজলে কইটা আবারও পাখনা টেনে ঘোরা দিল। একটা সময়ে পিয়ার শীত শীত লাগলে সে নিষ্পাপ জেগে উঠে আবিষ্কার করল চারিদিক অন্ধকার—কোত্থাও একবিন্দু আলো নেই। কেবল হলঘরের বড় ঘড়িটার টিকটিক শব্দ শোনা যাচ্ছে বিশাল মহল জুড়ে। যেন যমদূতের বুকের বকবকানি!

কিসের জন্য এত শীত শীত লাগছে বোঝা গেল না। পিয়া মোবাইল ফোনটা অন্ধকারে খুঁজতে হাত ফেলাল এবং ঝপাস করে শব্দ হলো। বুঝল, পুরো পুল পানিতে ভরে আছে এবং ফোনটাও মাত্র ডুবেছে। পিয়া তৎক্ষণাৎ খাটের উপর উঠে দাঁড়াল। পায়ের বুড়ো আঙুল ডুবিয়ে চারিদিকে পানির ফাঁদ অনুধাবন করল। ভাবল—সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে তাকে এই যম কালো পানিতেই নামতে হবে। কিন্তু খাট তো তার যথেষ্ট উঁচুতে। এর নিচেও হবে তার এক বুক।

ভাবতে না ভাবতেই পানি আরও উঁচুতে উঠতে শুরু হলো; দ্বিগুনেরও বেশি গতি নিয়ে পানি প্রবেশ করছে। পিয়া কয়েকবার চিৎকার করে সবাইকে ডাকল। কিন্তু মধ্যরাত! তাছাড়া সেলিম-পরীর কামরাটাও করিডোরের শেষ প্রান্তে। তাদের গভীর ঘুমাচ্ছন্ন কানে কোনোরকম সাড়া গেল না; কেউ শুনতে পেল না।

পিয়া একটু একটু করে ডুবতে লাগল। অচিরে ছোট্ট নিমগ্ন শরীর ঠক্ঠক্ করে কাঁপতে লাগল যখন, তখন ঠাঁই না পেয়ে অস্থূল হেডবোর্ডের উপর কোনোভাবে ভর দিয়ে সে উঠে দাঁড়িয়েছে।

এরপর বেশি সময় লাগল না, ‘পূর্ণ বিশ মিনিট’ শেষ সময় দিয়ে সমুদ্রসম হাতগুলো পিয়ার গলা চেপে ধরল পুরোপুরি। যেন এতদিন দাঁড়িয়ে থাকা সৈন্য মতন দেয়ালগুলো থেকে এমন ভারি ভারি হাতগুলো বেরিয়েছে।

পিয়ার মুখ থেকে কোনো আওয়াজ বোরোলো না। শেষে গোলগাল মুখটাও ডুকডুক করে ডুবল; পা থেকে সরে গেল খাটের নকশা করা হেডবোর্ড।

ড্রয়ারের উপর থেকে কইটা কিছুক্ষণ আগে জার মুক্ত হয়ে পুলে বেরিয়েছে। এবার ছুটে এসে ডানে-বামে মাথা ঘুরিয়ে সে পূর্ণ গতিতে ঘোরাঘুরি করতে লাগল পিয়ার চারপাশ; সে যেন পিয়াকে দেয়া প্রতিশ্রুতিমত তাকে সাঁতার শিখিয়ে দিচ্ছে।

ডুবে যেতে যেতে পিয়ার ছোট্ট মাছটার পাশে নিজেকে আবারও একটা মাছ মনে হলো। তার মনে পড়ল, তার বাবা সেলিম একজন মাছ ব্যবসায়ী। চুরি করে দেখা সেই মাছগুলোর ছবিও তার স্মৃতিতে ভেসে উঠল যাদের সবগুলোর সবটাই ছিল ভয়পূর্ণ, বিকট। পিয়ার প্রত্যেকটা কেশ দুলে উঠল; শ্বাস নেবার জন্য আপ্রাণ হাঁসফাঁস করল। কিন্তু কোনোভাবেই ভেসে থাকা যাচ্ছে না। ক্লান্ত হাত-পা সবটা শক্তি হারিয়ে যখন সমস্ত চেষ্টা ছাড়ল তখন ধবধবে সাদা হয়ে গেছে পিয়ার কিশোরি কোমল চর্ম; চুলগুলো রেশমি সুতোর মতন নরম হয়ে সানন্দে খেলছে পুলের জলে।

সমস্ত মহল অন্ধকার থেকেও অন্ধকার—এই ঘন কালোর মাঝে তার ক্ষুদ্র শরীরটা যেন এক টুকরো ধকধকে দ্যুতিপিণ্ড। পিয়ার শরীর পুলের তল পাওয়ার আগে দু’চোখ অন্ধকারে তলালো।

শেষবার সে ভাবল, সকাল বেলা যখন কেউ উঁকি দিবে, তার মুক্ত কই মাছটা নিশ্চয়ই খেলা করে বেড়াবে। বাবা হয়তো মাছটাকে এবার বিক্রি করেই দেবে।

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field