পড়তে সময় লাগবে ৫ মিনিট
সম্পাদকীয় নোট
এই প্রজন্মের অন্যতম শীর্ষ কথাশিল্পী নাহার মনিকা। ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনায় তাঁর দক্ষতা শিখরস্পর্শী। ‘বিসর্গ তান’ তাঁরই লেখা একটি অনন্য উপন্যাস। এই উপন্যাসের ঘটনা, চরিত্রায়ন ও ন্যারেটিভ যেমন আকর্ষক তেমনি দৃষ্টি-উন্মোচক ও গভীর। প্রাবন্ধিক উপন্যাসটি নিয়ে চমৎকার আলোচনা করেছেন। দ্রষ্টব্য : এই সংখ্যাতেই আমরা নাহার মনিকার একটি নতুন গল্প প্রকাশ করেছি। গল্পটির নাম “অন্ধ চোখে, বন্ধ চোখে”। পাঠক পড়ুন এই গল্পটি। নাহার মনিকার রচনা সৌকর্য়ের সঙ্গে নতুন করে আবার আপনার পরিচয় ঘটবে।
কথাসাহিত্যে নাহার মনিকা একটি উজ্জ্বল নাম। তার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ছয়। প্রথমটি কবিতাগ্রন্থ – চাঁদপুরে আমাদের বর্ষা ছিল ( ২০০৮)। তারপর তিনটি গল্পগ্রন্থ : পৃষ্ঠাগুলি নিজের (২০১১), জাঁকড় (২০১৩) ও দখলের দৌড় (২০১৯)। লিখেছেন দুটি উপন্যাস : ‘বিসর্গ তান’ (২০১৫) এবং মন্থনকূপ (২০১৮)। পত্র-পত্রিকা এবং অন-লাইন সাহিত্য পত্রিকাগুলিতে নিয়মিত লিখে চলেছেন মনিকা। তিনি পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানে। পরে লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স এবং স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন। গবেষক, কর্পোরেট এক্সিকিউটিভ, এনজিও কর্মকর্তা – এমন বিবিধ পেশার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। বর্তমানে কর্মরত আছেন কানাডার কুইবেক সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগে।
‘বিসর্গ তান’ বেঙ্গল পাবলিকেশনস থেকে প্রকাশিত উপন্যাস। মনিকার লেখালেখির সঙ্গে যারা পরিচিত তারা অবশ্যই স্বীকার করবেন যে, গভীর পর্যবেক্ষণ আর প্রতিভাদীপ্ত অন্তর্দৃষ্টির দ্বারা মনিকা ব্যক্তিমানুষ, সমাজ, রাষ্ট্র এবং বৈশ্বিক জনগোষ্ঠীকে বিশেষভাবেই দেখেন। ‘বিসর্গ তান’ মনিকার এই দেখার ব্যাপ্তিকে ধারণ করেছে। তার এই দেখা বিষয়য়ের অতলান্তে গিয়ে সবটা দেখা, যা পাঠককে ঋদ্ধ করে।
‘বিসর্গ তান’কে কাহিনি আর চরিত্রের সন্নিবেশে গড়পড়তা উপন্যাস বললে এর প্রতি সুবিচার করা হবে না। যদিও উপন্যাসটি আমাদের চেনা পরিবারগুলোর যে কোনো একটির কাহিনি। কিন্তু কাহিনিরও প্রেক্ষাপট থাকে, সেই প্রেক্ষাপটের কার্যকারণ থাকে। মনিকা তার লেখক-দৃষ্টির প্রখরতায় এই উপন্যাসে একটি পরিবারের স্কেচ আঁকলেন, যে পরিবারটি হতে পারত আর দশটি পরিবারের মতোই আপাতসুখী। পরিবারটির বিপর্যয়ের কিছু কারণ মনিকা বললেন, কিছু কারণ না বলে রহস্য রেখে দিলেন পাঠকের জন্য। এতে করে উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে পাঠককে কল্পনাচারী হতে হয়। ‘বিসর্গ তানে’র ফ্ল্যাপে লেখা আছে, ‘ভালোবাসার জন্য আকুল প্রাণ নিয়ে শৈত্যদিনের গাছের বাকল খসে পড়ার মতো করে নিজের বলয়ে একা হতে থাকে নিধি নামের মেয়েটি।’ ‘বিসর্গ তানে’ নিধি নামের মেয়েটির জন্ম, বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা, চাকরি তারপর বিদেশবাস এসব কিছুই দেখানো হয়েছে। দেশে নিধি চারুকলায় পড়াশোনা করেছে। কানাডার মন্ট্রিয়াল মিউজিয়াম অব ফাইন আর্টসে দু’সপ্তাহের ওয়ার্কশপে এসে একেবারে থেকে যায় নিধি। শেকড়চ্যুত নিধির জন্য বিদেশ বিভূঁইয়ের একাকীত্ব কোনো সমস্যা না। বাড়ির রঙমিস্ত্রি নিকোলাসের সঙ্গে নিধির সুন্দর প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। নস্টালজিক নিধি শৈশবের বিড়ালের নামেই কানাডায়ও তার বিড়ালের নাম রাখে মিহিলতা। কানাডায় অবস্থান করলেও নিধি বুকে লালন করে শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি-বিজড়িত বাংলাদেশকে। অতীতের টানেই নিধি দেশে ফিরছে। কাহিনির শুরু এখানেই। উপন্যাসে মনিকা প্রায়ই ফ্ল্যাশব্যাকে অতীতে চলে গেছেন। অতীতকে বর্তমানের প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন। অতীত ও বর্তমানের মধ্যে যাতায়াতকে এক সূতোয় বাঁধতে চেয়েছেন মনিকা।
‘বিসর্গ তানের’ কাহিনি নিধিকে ঘিরে আবর্তিত হলেও নিধির মা বীণা এই উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু। মনিকা নান্দনিক এই নারীকে অসাধারণ কুশলতায় সৃষ্টি করেছেন। ফলে কাহিনি বয়নের সুতো পরম দক্ষতায় ব্যবহৃত হয়ে বুননের কাজটি শৈল্পিক পর্যায়ে চলে গেছে। “বীণা দাদির দূর-সম্পর্কের বোনের মেয়ে, সুতরাং বেশি খোঁজখবর করতে হলো না। মুন্সিগঞ্জে আদি বাড়ি হলেও বাবার চাকরিসূত্রে বড় হয়েছে বিভিন্ন মফস্বল শহরে, তাই অত গাঁইয়া না। মেয়েটির বাবা হঠাৎ করে স্ট্রোক করায় তারা ফিরে গেছে পৈতৃক ভিটায়। বড় ভাই ওদের বাবার চাকরিটা পেয়ে গেছে, সুতরাং সংসারের অর্থনৈতিক ভিত অত নড়বড়ে হয়নি। বড় বোনেরও বিয়ে হয়েছে উপযুক্ত ঘরে। বীণা তাদের ছোট মেয়ে, ইডেন কলেজে বাংলায় অনার্স দিল, মাস্টার্স শেষ করেনি, কম বয়স, মানে উপযুক্ত বয়স। আর তার জোড়া ভ্রু, বাঙময় চোখের তারা, কোমর ছাপানো চুল (পৃ-৩৭)।”
“এই হলো নিধির মা, সবসময় একটু আলাদা। শাড়ি কোমরের কাছে আলতো গুঁজে দিয়ে পিঠ ঢেকে দিলে একটা সম্ভ্রান্ত ভাব চলে আসত। সাজত এমন যে মনে হয় সাজেইনি, কিন্তু দেখতে অপূর্ব লাগত (পৃ-৪৫)।”
সৌন্দর্য আর মেধার সমন্বয়ে চমৎকার ব্যক্তিত্ব বীণার। আদি বাসস্থান মুন্সিগঞ্জ হলেও বাবার চাকরিসূত্রে বিভিন্ন স্থানে তার থাকা হয়েছে। ফলে তার মানস-গঠনে বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতির সন্নিবেশ এবং পরিবেশ পরিস্থিতি ভূমিকা রেখেছে। সাহিত্য অধ্যয়নের ফলে পরিশিলিত মনন তাকে মানবিক করেছে। সঙ্গীতপ্রিয় স্বামীর সঙ্গে তার বোঝাপড়া মন্দ নয়। নিজের জগতে সুখী হবার চেষ্টা সে করেছে। যাপিত জীবনের বঞ্চনাকে খুব বেশি গুরুত্বও সে দেয়নি। বরং সাধ্যের মধ্যে সুখী হবার চেষ্টায় চরিত্রটি উজ্জ্বল।
নিধির বাবা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে জুট পারচেজারের চাকরি পায়। গান তার জীবনজুড়ে ছিল। গুরু সুশীল বড়ুয়া, গান যার কাছে প্রার্থনার মতো, তার স্ত্রীর ছোট বোন সুলেখা বড়ুয়া। খুব স্বাভাবিকভাবেই সুলেখার সঙ্গে নিধির বাবার প্রেম ছিল। কিন্তু ধর্মের বাধা আর বাবার আদেশে বিয়ে করতে হয়েছে বীণাকে। বিয়ের পর স্বামীর কাছ থেকেই বীণা সবটা জেনেছে, কিন্তু তখন মেনে নেয়া ছাড়া পথ ছিল না। স্বামীকে গ্রহণ করতেই হয়।
“সুতরাং গ্রহণ করল নিধির মা, বলা যায়, গলাধঃকরণ করল, আকণ্ঠ কষ্ট হয়েছিল শুরুতে, ঠান্ডা ভাতের দলা পানি ছাড়া গিলতে যেমন হয় (পৃ- ৬১)।”
আমাদের দেশের মধ্যেও মাইগ্রেশন আছে। বিশেষ করে নদীভাঙন এলাকার মানুষ এবং চাকরি বা ব্যবসাসূত্রেও কিছু মানুষ নিজের জেলা ছেড়ে অন্য জেলায় যেতে বাধ্য হয়। এই মাইগ্রেশন যে সব-সময় সুখের হয় তাও না। তবে নিধির বাবার দাদা আকামত আলী মুন্সিগঞ্জ থেকে উত্তরবঙ্গের ভোমরাদহে গিয়ে যে থিতু হয়েছিল, তা সুখেরই ছিল।
“খেয়ে না খেয়ে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে আকামত আলী লিচুগাছের দুর্দান্ত কলম করা শিখে ফেলল। তার চেষ্টা আর দুরদর্শিতায় আজকে চল্লিশ একরের লিচু বাগান, সুখের স্থিরচিত্র। লিচুর সিজনে পাইকারদের লম্বা লাইন পড়ে যায় তার বাগানের মুখে (পৃ-৪০)।”
তবে একটা সময় স্থানীয়রা অন্য অঞ্চল থেকে আসা মানুষদের ‘ভাটিয়া’ বলে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইত। বিয়েসাদি পারতপক্ষে ভাটিয়াদের সাথে তাদের হতো না। আকামত আলী কিন্তু ঠিকই স্থানীয় একজনকে বিয়ে করে ভোমরাদহে শেকড় প্রোথিত করে ফেলে। পরবর্তী সময়ে আকামত আলী তার মা-মরা ছেলেকে মুন্সিগঞ্জে গিয়ে মুন্সিগঞ্জের মেয়ে বিয়ে করায়।
“বউয়ের পানপাতা মুখ, ফর্সা গায়ের রং। ভোমরাদহের মানুষগুলোর কাছে এই বউ বিদেশি ভাটিয়া, স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে হাঁটে। বাটা মশলা দিয়ে তরকারি পাক করে। মিষ্টি পোলাও তার মুখে রোচে না, বড় বড় মাছের কথা এমন করে বলে, মনে হয় রূপকথার গল্প। দাদি সম্পর্কে বাবা বলে, তার মা ভোমরাদহে নিজেকে প্রোথিত করতে পারেনি। তার শেকড় গজায়নি। সারাজীবন মুন্সিগন্জ মুন্সিগঞ্জ করে কাঁদল। অথচ তার মৃত্যু, কবর হয়েছে সেখানেই (পৃ-৪১)।”
সন্তানসম্ভবা বীণা বাবার বাড়ি মুন্সিগঞ্জে যায়। নিধি জন্মাবার খবর তার বাবা তিন-চার দিন পর পায়। সপ্তাহখানেক পর এসে নিধিকে প্রথম দেখে। যোগাযোগ ব্যবস্থার ধরন বলে দেয় সময়টা ষাটের বা সত্তরের দশক। নিধির বাবার পোস্টিং তখন উত্তরবঙ্গের পাটগ্রাম নামক স্থানে। জুটপারচেজারে বদলির চাকরি। নিধির বাবা হিলি বর্ডারের কাছে বদলি হলে, নিধির মার আবদারে দাদা রাজি হওয়ায় ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে স্কুল শুরু করে নিধি। বাবা মাসে দু’বার আসে। আর আসে দাদার পাঠানো বস্তাভর্তি চাল, আনাজপাতি। সব ঠিক চললেও স্কুল থেকে একদিন জানতে চাইল, ছোটবেলায় নিধির মারাত্মক ধরনের টাইফয়েড হয়েছিল কি না। নিধি বর্ণমালা ঠিকমতো চিনতে পারে না। সংখ্যা গণনায়ও ভুল করে। নিধির জ্বরজারি হলেও টাইফয়েডের কথা নিধির মা মনে করতে পারে না।
“ক্রোধান্ধ বাবা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চায় – স্ত্রীর বাপের বাড়িতে জন্মের পর শিশুকন্যার যত্নের কী কী ত্রুটি ঘটেছিল! নিধির মা এসব শুনে হু হু করে কাঁদে (পৃ-৪৭)।”
নিধির বাবার চাকরি এবার মথুরাপুর নামক স্থানে। নিধিকে নিয়ে বীণা স্বেচ্ছায় মথুরাপুরে চলে আসে। মথুরাপুরে অনুপ-তমালিকা আখ্যান এই উপন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নিধির বাবাকে অফিসিয়াল কাজে মাঝে মাঝেই সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট অনুপের কাছে যেতে হয়। সেই সূত্রে পরিচয়। অনুপ কবিতা লেখে। তা হলেও প্রশাসনের লোকজন নিজের মধ্যে কতোটা ব্রাহ্মণ্যভাব বজায় রাখে, মনিকা এই আখ্যানে নিপুণভাবে তা দেখিয়েছেন। অনুপের অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রী তমালিকার অ্যাবরশনের সময় স্বামীর অমতেই নিধির মা তমালিকাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ায় এবং তা জানাজানি হওয়ায় অনুপ স্বরূপ প্রদর্শন করে ফেলে। “হাসপাতালে না নিলে তমালিকা মরেও যাইতে পারতো” – নিধির মায়ের এ কথায় অনুপ নির্দ্বিধায় বলতে পারে, “মরলে আমার বউ মরত, আপনের কী? অনুপ প্রায় হুঙ্কার দিয়ে ওঠে – আমারই ভুল হইছিল, আপনারা মেলামেশার উপযুক্ত না, জাতের মানুষ না আপনারা (পৃ-৭০)।”
মথুরাপুরে কাহিনি বাঁক নেয়। এখানে নিধির পরিবারে আসে আবেদা। গৃহকর্মে সাহায্য করে এবং নিধিকে দেখাশোনা করে সে। আবেদার স্বামী মজনু, যে দিনে রিক্সা চালায় রাতে পাটগুদাম পাহাড়া দেয়। সব মিলিয়ে দিন বেশ কাটছিল। নিধির বাবা এলাকায় শিল্পী হিসেবে খুব নাম করেছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার নিমন্ত্রণ পায়। নিধির মা সে সব অনুষ্ঠানে কখনো যায় – কখনো যায় না। যেদিন যায়না, সারা সন্ধ্যা টেবিলে বসে চিঠি লেখে। কাকে লিখছে নিধি জিজ্ঞেস করলে মা বলে, তোমার বাবাকে লেখি। এই চিঠি ‘বিসর্গ তানে’ বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। এক রাতে পাটের গুদামে আগুন লাগে। আগুনে পুড়ে মৃত্যু হয় আবেদার স্বামী মজনুর। সেই লেলিহান-দৃশ্য নিধির শিশুমনে স্হায়ী ছাপ ফেলে। নিধির মাও সেই আগুনে পুড়ে আহত হয়। চিকিৎসার জন্য তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তারপর আর নিধির সঙ্গে তার মায়ের দেখা হয়নি। পরবর্তী সময়ে এই ঘটনায় নিধির মাকে নিয়ে গুজবের ডালপালা অনেক ছড়ায়। মনিকা অবশ্য আসল রহস্য উদ্ঘাটন করেননি। খোলাসা করেননি চিঠির রহস্যও। পাঠকের কল্পনাকে উস্কে দেওয়ার নীরিক্ষা আছে এই উপন্যাসে।
এরপর নিধি ফিরে এলো ভোমরাদহে আবেদাকে সঙ্গে নিয়ে। এখানে আছে তার দাদা-দাদি, আজমত চাচা আরো অনেকে। নিধি স্কুলেও ভর্তি হলো। কিন্তু কিছুতেই নিধির মন লাগে না। শিশু-মনস্তত্ত্ব সাধারণ মানুষের কাছে গুরুত্বই পায় না। প্রায় সকলেই নিষ্ঠুর প্রশ্নবাণে নিধির বাবা-মার সম্পর্কের হদিশ জানতে চায়। নিধির দাদিও এমন অনেক প্রশ্ন নিধিকে করেছে।
“মানুষের চোখ আর ফিসফিসানি , তারা কারণে-অকারণে নিধির কাছে তার মার প্রসঙ্গ তোলে (পৃ-৮০)।”
ঘটনাক্রমে আবেদা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে জানা যায় এর জন্য দায়ী নিধির দাদা। পক্ষাঘাতগ্রস্ত দাদিকে রেখে যৌবনবতী আবেদাকে বিয়ে করে দাদা। পরে আবেদার দুটি ছেলেও হয়। দাদির অসহায়তা আমাদের সমাজে নারীর অবস্থান স্পষ্ট করে।
আবারো নিধি ঢাকায়। এবার ফুপুর বাসায়। ফুফুর একমাত্র ছেলে অয়ন। না চাইতেই সব পেয়ে গেছে বরাবর। মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও জীবনে সফল হতে পারেনি। নিধির প্রতি এক রকম টান ছিল। নিধি তা উপেক্ষা করেছে। চারুকলার ছাত্রী নিধির হলজীবন শুরু হয়। কুমকুম খানের মতো ধনাঢ্য পিতার কন্যা সঙ্গী হিসেবে জুটে যায়। কুমকুমের মাধ্যমে এনজিওর কাজের যোগাযোগ হয়। নিধির মা বীণার শিল্পিত এবং মানবিক মননের প্রভাব পড়েছে তার উপর। নিধি সৃষ্টিশীল হয়েছে। বন্ধু ইউসুফের উৎসাহে প্রতিযোগিতায় ছবি জমা দিয়ে প্রথম হয়েছে। নিজের খরচ নিজে চালানোর জন্য এনজিওর কাজসহ বিভিন্ন কাজ করেছে। ইউসুফকে মনে ধরলেও “রাজনীতি নিয়ে অনর্গল বকতে থাকা ইউসুফকে মনে মনে খারিজ করেছিল নিধি, রিক্সায় বসেই (পৃ-১১৩)।” নিধির মনে হয়েছে ইউসুফ তার জন্য যথাযথ নয়। মনিকা এই উপন্যাসে হলজীবন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আশির দশকের রাজনীতি, এনজিওর কর্মকাণ্ড সব মিলিয়ে এমনসব চিত্র এঁকেছেন যে, পাঠক সেই সময় এবং সমাজকাঠামোকে অনুধাবন করতে পারবেন অনায়াসে। ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব বলে, অবচেতন স্তরে যন্ত্রণা, ক্ষোভ পরবর্তী সময়ে মানুষকে নেতৃত্ব দিতে, বলিষ্ঠ মত প্রকাশে বাধাগ্রস্ত করে। সবার সঙ্গে মিশতেও তাদের সমস্যা হয়। তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অন্তর্মুখী হয় বলে অসম্ভব মেধাবীও হয়।
“নিধির আড়ষ্ট লাগে আর নিজের ওপরে বিরক্ত হয়। কোথাও কেন সহজ লাগে না তার। না ব্রিটিশ কাউন্সিলের সিনেমা সন্ধ্যায়, না এই ঘোর গ্রামের বউ-ঝিদের সামনে ( পৃ-১২৩)।”
‘বিসর্গ তানে’ রাজনীতি এসেছে প্রাসঙ্গিকভাবেই। ছাত্রনেতা ইরফান ভাইকে নিধি শৈশবে আজমত চাচার সঙ্গে দেখেছে। ইউসুফের মাধ্যমে ঢাকায় আবার পরিচয় হয়। ইরফান ভাই আজমত চাচাকে কমরেড বলে সম্বোধন করে। কয়েকটি স্টাডিসার্কেলে গেলেও পড়াশোনা আর বাড়তি কাজের কারণে নিধি কুমকুম কথিত ‘বাঁশি হারমোনিয়াম পার্টি’তে অনিয়মিত হয়ে যায়। এই ইরফান ভাইকে নিধি এক সময় আবিষ্কার করে টরন্টোর বাংলা পাড়ায়।
“আগের সেই দৃঢ়প্রত্যয়ী দেশ বদলের অঙ্গীকারে আবদ্ধ ছাত্রনেতাটি স্বামী-পিতার ভূমিকার আড়ালে কোথায় লুকিয়ে গেছে ( পৃ-১৩১)!”
‘বিসর্গ তান’ উপন্যাসে মনিকা ভাষা ব্যবহারে বিশেষ দক্ষতা দেখিয়েছেন। কিছুদূর পড়লেই পাঠক এই ভাষার স্বকীয়তা অনুভব করতে পারবেন। চিত্রকল্পের মায়াজাল বুনেছেন মনিকা। কথামালার নক্সীকাঁথা বুননের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য মনিকার ভাষায় রয়েছে। জীবনঘনিষ্ঠ উপমা-রূপক ভাষায় বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে। “পরিপক্ব আনাজের মতো ফুফুর এই মনোভাব সে চেনে (পৃ-১৩)।”
শব্দ ব্যবহারে অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছেন মনিকা। বহুল পরিচিত শব্দের সঙ্গে অপরিচিত শব্দও তিনি ব্যবহার করেছেন অনায়াসে। সংলাপে বিক্রমপুর অঞ্চল এবং উত্তরবঙ্গের ডায়ালেক্ট ব্যবহার করেছেন নিপুণভাবে।
“আরো পাঁচ ভাই-বোন নিয়ে মায়ের সঙ্গে *কোলায় ধান আর কলই তুলত, ঘোর বর্ষায় নাও বেয়ে বড় বড় জ্যান্ত ইলিশ ধরে নোনামাছ বানানোর জন্য জাগ দিত (পৃ-৩৮)।” *বাড়ির পাশের পতিত জমি। সব্জির চাষও হয় কখনো কখনো।”
“মনে ধইরল মজনুক, ওয় হইল ওই বাড়ির আরেক বুয়ার ছোড ভাই। হামাগের সাগাই পাতানি সমানে সমান। বুয়ার ভাইয়ের সঙ্গে আরেক বুয়ার সম্বন্ধ (পৃ-৬৬)।”
ভাষার ব্যবহার এই উপন্যাসে কোথাও কোথাও ধ্রুপদ পর্যায়ের মনে হয়েছে – “তবুও বুকের ভেতর থেকে নদীর কুহক ডেকে যায়। জীবন তার এক পিঠে রোদ মেখে বসে থাকে আর উল্টোদিকে বৈঠাভোলা নাও ভাসিয়ে অপাঙ্গ আকাশ মেঘে ঢেকে দিয়ে যায় কেউ। খুব ইচ্ছে হয়, অচেনা কোনো বন্দরে চলে যাই, মধ্যরাতের আকাশে আলোর বর্ষা ছুঁড়ে দেওয়ার সাহস দেখাই! একটা নাতিদীর্ঘ পাহাড়েও যেতে ইচ্ছে করে, যেখানে বসে অকিঞ্চিৎকর ঘাসের ওপরে শিশিরের অস্পষ্ট উবে যাওয়া দেখতে পাব। কত কী যে দেখতে সাধ হয়, কত জায়গায় যেতে ইচ্ছে করে। অথচ মৃত্যুর মতো ধ্যানমগ্ন বাতাস সেই কবে দেখা হয়ে গেল (পৃ-২৪)।”
জীবনাচরণ, রীতি-পদ্ধতি, আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি সমস্ত কিছুর সূক্ষ্ম অনুষঙ্গ মনিকা বিশদেই বর্ণনা করেছেন এই উপন্যাসে। সন্তান-সম্ভবা বাঙালি নারী চুলার পোড়ামাটি খায় কেউ কেউ। নিধির মা বীণাও খেয়েছে।
“বাড়িভর্তি ফল-ফলাদির গাছ, হাত বাড়ালে তরতাজা শিম, লাউপাতা, জিয়ল শিং-মাগুরের দৈনিক জোগান আর তার পুত্রবধূ কি-না চুলার পোড়ামাটি চিবিয়ে খাচ্ছে (পৃ-৪২-৪৩)!”
অতিথি আপ্যায়নের চিত্র অঙ্কনে মনিকা বড়ই মনকাড়া বর্ণনা দিয়েছেন,
“বাবা পদ্মার টাটকা ইলিশের ডিমের পাতুড়ি, ঘরে-পাতা দই, ছানামুখি মিষ্টি, ফজলি আম আর বিলাতি গাবের স্বাদে ছুটি শেষ করে ফিরে যায় (পৃ-৪৪)।”
“তমালিকার ঘরে তৈরী কেরামেল পুডিং আর মুচমুচে পেঁয়াজুর সুখী ঢেকুর তুলতে তুলতে তারা গল্প করে (পৃ-৫৫)।”
“নিধির মা মন ঢেলে রেঁধেছে। টাটকা পাওয়ার সুযোগ নেই, বরফাচ্ছাদিত ইলিশের পাতুড়িতে জিভে জল আনা স্বাদ আনতে চেষ্টার ত্রুটি করেনি। এই রান্নাতে সামান্য আদা বাটার ব্যবহার শাশুড়ি তাকে শিখিয়েছিল (পৃ-৫৮)।”
‘বিসর্গ তানে’ গান-পাগল নিধির বাবার চরিত্রটি প্রতিষ্ঠিত করতে মনিকা কত রকম গানের প্রসঙ্গ যে এনেছেন! পাঠকমাত্রই বুঝতে পারবেন, মনিকা গানের সমঝদার। সঙ্গীত সম্পর্কে ভালো না জানলে গান প্রয়োগের এই দক্ষতা সম্ভব হতো না। উপন্যাসটির নাম ‘বিসর্গ তান’, অলক্ষ্যে শুরু থেকেই একটি করুণ সুরের মূর্চ্ছনাও পাঠক শুনতে পাবেন।
“নিধির বাবার গলা উদারা-মুদারা, তারায় খেলতে থাকে (পৃ-৫৯)।”
“সিডি প্লেয়ারে মৃদু ভলিউমে গান বাজছে, কণ্ঠ মৃদু নয়, মনে হচ্ছে কারো বুকের কাছটা মুচড়ে কষ্ট নিংড়ে নিচ্ছে কেউ, গানগুলো তারই উদ্দেশ্যে। নিধি বসেছে সিডি প্লেয়ারের কাছাকাছি। সিডির মোড়কটা হাতে তুলে নেয় – নিনা সিমোন (পৃ-১১৮)।”
শব্দ দিয়ে মনিকা অসংখ্য ছবি এঁকেছেন এই উপন্যাসে। মনিকা আঁকার বিষয়টিও ভালো বোঝেন। নিধি চিত্রশিল্পী। “খসড়া খাতা থেকে না, একরাতে ক্যানভাস নামিয়ে সরাসরি রঙ-তুলি দিয়ে অগ্নিকাণ্ডের ছবি এঁকেছিল নিধি। একটা বাজার পুড়ে যাচ্ছে। আগুনের মুখ আধ-খাওয়া বাজারের দিকে ধেয়ে আসছে। লাল আর কালো দিয়ে ধকধক আর দগদগে শেডের আলো-ছায়া ফুটিয়েছিল (আসলে যন্ত্রণা ফোটাতে চাইছিল)। ধৈর্য ধরে সময় নিয়ে কাজ করছিল সে আর তার আশ্চর্য রকম ভালো লাগছিলো। ‘অগ্নি মনোরথ’ – নামটার জন্যও ইউসুফকে সাধুবাদ দিতে হয়। (পৃ- ১৪১-৪)।”
চিঠি বিষয়ক একটি ধাঁধা এ উপন্যাসে শুরু থেকেই পাঠককে উৎসুক করে রাখে। নিধির মার লেখা চিঠিগুলোর জন্য পাঠকও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। বৈরাগ্য আর গৃহস্থালী যে মানুষের ভেতরে বাস করে আসলেও তার দোটানা একজীবনে শেষ হয়না।
‘বিসর্গ তান’ উপন্যাসের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে উত্তরবঙ্গ। উত্তরবঙ্গের মানুষ, তাদের জীবনচিত্র। তেভাগা আন্দোলনের প্রসঙ্গ যেহেতু উপন্যাসে এসেছে, ইলা মিত্র প্রসঙ্গও আসতে পারত উপন্যাসে। উপন্যাসটির পরিসর আরো একটু বড় হলে পাঠক তৃপ্ত হতো। নারীর ক্ষমতায়ন নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে ‘বিসর্গ তানে’র গুরুত্ব অনস্বীকার্য। পুরো উপন্যাসে ছাপার ভুল খুব কম। নেই বললেই চলে। ঝকঝকে ছাপা। ইঙ্গিতবহ প্রচ্ছদও বলে দেয় উপন্যাসটি মাথা-নত-না-করা এক নারীর জীবনালেখ্য।
মেহেরুন্নেসা মেরী
প্রাবন্ধিক ও গবেষক। অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ইডেন মহিলা মহাবিদ্যালয়।
Leave feedback about this