সব্যসাচী মজুমদার
‘বান্ধবনগরে কবিতা সন্ধ্যা’ উদযাপিত হলো গত ২৪ জুন। বান্ধবনগরের পাঁচটি নতুন কবিতার বই উদ্বোধন করলেন শ্রদ্ধেয় জয় গোস্বামী। পাঁচ তরুণ কবির প্রকাশিত বইগুলো হচ্ছে – সতীন্দ্র অধিকারীর সহজ পাঠের ঈশ্বর, ধৃতিরূপা দাসের বউল, অরিত্র দ্বিবেদীর যে জায়গাটায় জ্যোৎস্না পড়েছিল, রঙ্গন রায়ের উড়ে যায় পানকৌড়ি এবং শাম্বর অন্নদা।
বইগুলো প্রসঙ্গে বললেন শ্রীসুমন গুণ। কবিতা পাঠ করলেন স্বাগতা দাশগুপ্ত, তন্ময় মণ্ডল, পৌষালী চক্রবর্তী, শাশ্বতী সান্যাল, বেবি সাউ, ঝিলম ত্রিবেদী, অভিষেক মুখোপাধ্যায়, পীযূষ সরকার। গান শোনালেন পায়েল বসু। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন মেঘ বসু এবং অনুষ্ঠানটির পরিকল্পক ছিলেন সুদীপ চট্টোপাধ্যায় ও সব্যসাচী মজুমদার।
কলকাতা শহরে গোয়াবাগান স্ট্রিটের ধর ভিলায় ওই দিন সন্ধ্যে ৬টা থেকে ৮টা, বিরতিহীন এই অনুষ্ঠানে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বলা যায় শ্রোতাদের উপস্থিতি। শুরুতেই তাঁদেরকে এবং সকলকেই বান্ধবনগরের পক্ষ থেকে স্বাগত জানান সব্যসাচী মজুমদার। এরপর সকলে মাননীয় পায়েল বসুর গানে আমন্ত্রিত হলেন। মঞ্চ আলোকিত করলেন শ্রী গোস্বামী, সুমন গুণ, প্রসূন ভৌমিক ও পার্থ রায়। তরুণ কবি দেবীপ্রসাদ ঘোষ মালবেরি গাছ দিয়ে বরণ করলেন গোঁসাইকে। এরপর উদ্বোধন পর্বের সূত্রে শ্রী গুণ সমৃদ্ধ করলেন বান্ধবনগর ও তার বই প্রসঙ্গে কিছু কথা বলে। বান্ধবনগরের মূল লক্ষ্য তরুণ মুহূর্তের কবিতাকে স্পর্শ করা এবং এই লক্ষ্যেই এক ফর্মার উল্লিখিত বইগুলো গত দুবছর যাবত প্রকাশের স্পর্ধা দেখাতে পারছে বলে জানালেন তিনি। সঙ্গে জানালেন কীভাবে পাঠক,যাঁরা বইগুলোকে স্পর্শ করছেন, তাঁদের আগ্রহ, উত্তেজনা বান্ধবনগরকে প্ররোচিত করছে। প্রসঙ্গত এল জয় গোস্বামী প্রণীত ‘ঔরস’ কাব্যগ্রন্থের কথা। বান্ধবনগর পত্রিকাটি প্রতিমাসে প্রকাশের প্রেরণাও বান্ধবনগর পাঠকের কাছ থেকেই পাচ্ছে বলে জানালেন সম্পাদক সুমন গুণ। পাঁচটি বই প্রসঙ্গে বললেন, “আনন্দের কথা বইগুলো বারবারই ছাপতে হচ্ছে। এখানে কবিবন্ধুরা আছেন যাঁরা ছাপাছাপির সঙ্গে যুক্ত তাঁরাও খুব উৎসাহিত।” ঘরভর্তি শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে তিনি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন।
এরপর শুরু হলো কবিতার বইগুলো থেকে কবিদের নিজস্ব উচ্চারণ। কবি সতীন্দ্র অধিকারী তাঁর বই ‘সহজ পাঠের ঈশ্বর’ থেকে পড়লেন, “…কিছুই পারিনি আমি!/ রাত হয়/ আর ভোর/ দেখি বর্ষায় জলে ভিজতে ভিজতে আমার সাথে / খেলা করছেন সহজপাঠের একাকী ঈশ্বর।” ধৃতিরূপা দাস শোনালেন তাঁর প্রথম বই ‘বউল’ থেকে, “লগা বাড়িয়ে প্রসাদ নিতে পারছি না পিতা।/ মাঝে মাতাল দালাল শুয়ে, লিঙ্গ অবশ ঘুমে,/ দেখলে মায়াই লাগে, কৃপা পরবশ/ তার মাথার তলায় টাকা চাপা দিয়ে আসি/ যাতে হারিয়ে না যায়।” শোনা গেল কবি অরিত্র দ্বিবেদীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জায়গাটায় জ্যোৎস্না পড়েছিল’ থেকে, “সেঞ্চুরি সেঞ্চুরি পার হয়ে যাই/ ভেঙে পড়েনি পুরনো বাড়ি ফিরে আসা/ তুলেও রেখেছি তাকে—তুমি অ্যালিবাই/ সংসার পরম ধর্ম… কবিতা সর্বনাশা।” রঙ্গন রায় পড়লেন ‘উড়ে যায় পানকৌড়ি’ থেকে, “রথের মেলায় যদি হারিয়ে যাই, বিশ্বাস ছিল,/ সবচেয়ে লম্বা মহিলাটিই আমার মা/ যত্ন করে গাছ লাগাই এখন, জল দিই, গাছের চেয়েও লম্বা হতে হবে/ মা খুঁজে পেলে, আদর করে কিনে দেবে টমটম গাড়ি।” শাম্বর কবিতা তাঁর ‘অন্নদা’ বইটি থেকে, “তুমি না হরির ধ্বনি, ডোমেদের সতী,/ পোড়া পাটকাঠি তুলে লিখেছ চিঠিটি—/ নোনা কপালের ফুলে ব্যাঙের প্রণয়ে/ আলো ভরে ফণা তোলে চাঁদের খড়িশ!”
কবিতা পাঠের রেশ ধরেই পরবর্তী পর্যায়ে আমন্ত্রিত কবিদের কবিতা পাঠ শুরু হলো। স্বাগতা দাশগুপ্ত, তন্ময় মণ্ডল, পৌষালী চক্রবর্তী, শাশ্বতী সান্যাল, বেবি সাউ, ঝিলম ত্রিবেদী, অভিষেক মুখোপাধ্যায়, পীযূষ সরকারকে শুনতে পেলেন শ্রোতারা।
অবশেষে জয় গোস্বামীর কিছু কথা। বললেন প্রবাদপ্রতিম শম্ভূ মিত্রের কবিতা পাঠের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে, “নবীন কবিদের কবিতা শুনব বলে আমি তো তাঁর মতো বলতে পারিনা ‘আজ এই গৃহের দ্বারে দেবতারা এসে দাঁড়িয়েছেন’, বলতে পারি আমার মনকে ‘তুমি একাগ্র হও।’ বান্ধবনগরের কাছে তাঁর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললেন, একেবারে নবীন কবির কবিতা বইয়ের উদ্বোধনের এ আয়োজনে থাকতে পেরে তিনি সম্মানিত। তাঁর কথায় এলেন রবীন্দ্রনাথ, লুইজি পিরানদেল্লো, এল থিয়েটার নিয়ে ব্রাত্য বসুর কবিতা প্রসঙ্গ, কীভাবে প্রণামকে তিনি নিজে গ্রহণ করেন এবং শাসক ও কবির দ্বন্দ্ব-সমাস। ভূয়সী প্রশংসা করলেন, যেভাবে বান্ধবনগর পত্রিকা প্রতিমাসে নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রবন্ধ এবং সঙ্গে অসংখ্য তরুণের কবিতা একযোগে প্রকাশ করে চলেছে,তার। বললেন, “আমার যে ধারণাটা হয়েছিল গত ৩৫-৪০ বছরে যে নিজের কবিতাপাঠ না থাকলে কবিরা অন্যের কবিতাপাঠ শুনতে সাধারণত যান না। অবাক হয়ে গেলাম আজ দেবজ্যোতি রায় বা শমিত মণ্ডলের মতো কবিদের দেখে যে এঁরা এতো সিনিয়ার কবি অথচ এসেছেন নতুনদের কবিতা শুনতে এবং এঁরা কেউই কলকাতাবাসী নন, এসেছেন অনেক দূর থেকে। এই যে আমার একটা ভুল ধারণা ভাঙল, আমার বিশ্বাস দৃঢ় হলো, আমি একটা নতুন জিনিস জানলাম এখানে এসে।” উল্লেখ্য যে, অনুষ্ঠানের শুরুতেই তরুণ কবিদের কবিতার বই তাঁর হাতে তুলে দিয়ে প্রকাশিত হবার পর তাঁকে অনুরোধ করা হয়েছিল কিছু বলবার জন্য, তিনি তখন জানান পরে বললেন। পরে তরুণ কবিরা তাঁদের সদ্য প্রকাশিত বই থেকে কবিতাপাঠ শেষ করলে তখনও তিনি মৌন রইলেন। জানালেন, আমন্ত্রিত কবিদের কবিতা পাঠের পরে কথা বলবেন। আমন্ত্রিত কবিদের কয়েকজনের কবিতাপাঠ শেষ হলে মাঝপথে চা-বিরতির অনুমতি চাইলেন সঞ্চালক, তিনি জানালেন, না, চা-বিরতির প্রয়োজন নেই, কবিতাপাঠ চলুক। অবশেষে সমস্ত কবির কবিতা পাঠের শেষে, প্রায় আড়াই ঘণ্টার নিস্তব্ধতা ভেঙে তিনি বলতে উঠলেন। কেন অনুষ্ঠানের প্রায় শেষ লগ্ন পর্যন্ত তিনি নির্বাক রইলেন? অনুষ্ঠানের শেষে এসে তার প্রণিধানযোগ্য ব্যাখ্যা দিলেন। জানালেন, এই কথাহীন নিশ্চুপ বসে থাকার মধ্য দিয়ে তিনি নিজের মনকে ক্রমাগত কবিতা শোনার অনুকূল করে তুলছিলেন। এ প্রসঙ্গে পরে বান্ধবনগরের সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যতম সুদীপ চট্টোপাধ্যায় আমাদের জানালেন, “একজন শিল্পগ্রাহককেও শিল্প গ্রহণের যোগ্য হয়ে উঠতে হয়। এই সত্তর বছর বয়সে যিনি নিজেই হয়ে উঠেছেন বাংলা কবিতার প্রতিমূর্তি, সেই তিনি আজও প্রস্তুতি নেন নিজেকে যোগ্য করে তোলার – তাঁর থেকে তিরিশ, চল্লিশ বা পঞ্চাশ বছর পরে লিখতে আসা তরুণ কবিদের কবিতা শোনেন! আজও এরকম ভাবেন তিনি এবং ভাবান, প্রতিপদে শিক্ষিত করে তোলেন আমাদের।”
অনুষ্ঠান শেষে বান্ধবনগরের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন শ্রী গুণ ও সব্যসাচী মজুমদার। এরপর বইগুলো যে টেবিলে হলের বাইরে তরুণ কবি বিধান ঘোষের দায়িত্বে রাখা হয়েছিল, জয় গোস্বামী এবং সকলেই এলেন সেখানে বিদায় পর্বে। প্রথম থেকে শেষ গ্রুপ ছবিটি পর্যন্ত ক্যামেরাবন্দীর দায়িত্ব পালন করলেন বান্ধবনগরের বন্ধু কৌস্তভ সাহা। শেষ হলো একটা চমৎকার কবিতা-সন্ধ্যার।
Leave feedback about this