বাঙলার কাবা বাঙলার ইতিহাসের মতোই প্রাচীন এবং নবীন। প্রতিটি দিনে, প্রতিটি মাসে প্রতিটি বছরে বাঙলার ইতিহাস পুরোনো খোলস পরিত্যাগ করে, নতুন রূপে, নতুন বেশে সাধারণের দৃষ্টিতে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। তা ঘটছে কখনো দ্রুত কখনো বা বিলম্বিতলয়ে। সব সময়ে এই পরিবর্তনের সূত্রগুলো সকলের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না। অথবা সাধারণের দৃষ্টি কার্যকারণ সূত্রের পরস্পরা অনুসরণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার মতো যথেষ্ট পরিমাণে তীক্ষ্ণ নয়। আজকে কিংবা বৃটিশ আমলে যে ভৌগোলিক চৌহদ্দীর অন্তর্ভুক্ত এলাকাকে বাঙলা দেশ বলতে অভ্যস্ত আমরা, তার পূর্বে বাঙলার মানচিত্র ঠিক এমনটি ছিলো না। তারও পূর্বে অন্য রকম ছিলো। এই যে বার বার সীমানা বদল হচ্ছে, বা হয়েছে তাতে তো নিসর্গের কোনো হাত নেই। জীবন্ত মানুষের মিছিলের মিলন, বিরোধ, সংগ্রাম, সংঘাতের মধ্য নিয়েই বাঙলা ভাষাভাষী বাঙলা দেশের জন্ম।
[দুই]
কাব্য মানুষের সামাজিক জীবনের সরল-জটিল চেতন-অর্ধচেতন এবং অবচেতন নানা সম্বন্ধ, স্বপ্ন এবং বাসনার ঘনীভূত প্রকাশ। বাঙালির প্রথম ছন্দোবদ্ধ বাণী কি? যা উত্তর পুরুষের চেতনায় সঞ্চারিত হয়েছে—এ নিয়ে অতীত বিশারদ পণ্ডিতগণের নানা মতপার্থক্য রয়েছে। চর্যাপদ না অন্য কিছু এ বিষয়ে স্থির নিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্তে আসার অবকাশ নেই। তবে এ কথাটা সত্য ইতিহাসের অমোঘ নির্দেশে পাক-ভারত উপমহাদেশের এ প্রত্যন্ত প্রদেশেও নানা জনগোষ্ঠীর মানুষ প্রভুত্ব বিস্তার করেছে। আপনাপন রাজা সাম্রাজ্যের শাসনের সুবিধার দিকে দৃষ্টি রেখে পুরোনো সীমানা ভেঙে, নতুন সীমানায় বিজয় গৌরব চিহ্নিত করেছে। সীমানার রদবদল শুধু পাললিক উর্বরা মৃত্তিকার উপর হয়নি, হয়েছে মানুষের মনের উপরও। প্রতিটি নতুন শাসনামলে শাসক শ্রেণীর কৃষ্টি-কালচার শিল্প-সংস্কৃতি শাসিতজনের একাংশের মানসসংগঠন কিছুটা বদলে দিয়েছে। বাঙলা কাব্যের ইতিহাস শুধু ভাষা-ধ্বনি, ছন্দ, উপমা উৎপ্রেক্ষার মধ্যে অনুসন্ধান করলে তাতে মানব চৈতন্যের ঊর্ধ্বে উড্ডীন যে অবস্থা থেকে কাব্যের সৃষ্টি তার উপর অবিচারই করা হবে। রাজ্য ও রাজার বদল হয়েছে বার বার কিন্তু এ প্রাচীন পাললিক ভূমি স্বভাবসঞ্জাত উর্বরতা হারায়নি। নতুন নতুন শাসনামলের সঙ্গে সঙ্গে নয়া ভাবধারার প্লাবন যুগে যুগে বাঙলার সমাজ সংগঠনের মধ্যে জন্ম দিয়েছে নতুন বিপ্লব উপবিপ্লবের। সামাজিক আদর্শ নিয়ে বেধেছে মরণপণ সংঘাত। এই বিরোধের নিঃসরিত ভাববহ্নিই বেরিয়েছে সুন্দর কবিতা হয়ে। অক্ষয় গৌরবে কালের কণ্ঠে দুলছে ইন্দ্রমনির হারের মতো। নতুন ভাবধারার বিপ্লব যেমন নতুন কাব্যধারার জন্ম দিয়েছে, আবার তেমনি বিপ্লবের পাল্টা প্রতিবিপ্লবী সম্প্রদায় প্রাচীন আদর্শকে অন্তরের সহস্র ব্যগ্র বাহু দিয়ে আলিঙ্গন করে অটুট রাখতে চেয়েছে। তাতেও ফলেছে কবিতা। বাঙালির সৃজনশীলতা বিপ্লবী প্রতিবিপ্লবী এই দুই ধারাতেই প্রকাশ লাভ করেছে। বাংলার মাটি যেমন কোনোদিন উর্বরতা হারায়নি বাঙালির মন ও সৃষ্টি চেতনাও রহিত হয়নি কোনোদিন। পাক-ভারতের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় বাঙালি মনেরও এই প্রভেদটুকু সহজে চোখে পড়ার মতো।
[তিন]
আজ থেকে প্রায় সাতাশ বছর আগে জনাব হুমায়ুন কবির বাংলা কাব্যের চারিত্র্য এবং প্রকৃতির বিবর্তনের স্থূল সূক্ষ্ম রেখাগুলোর পরিচিতি নিরূপণ করে নাতি ক্ষুদ্র গ্রন্থ ‘বাঙলার কাব্য’ প্রথম প্রকাশ করেন। এই সংস্করণের ভূমিকায় লেখকের একটি বিনীত অনুরোধের প্রতি দৃষ্টি দিলে দেখা যায়—লেখক এটিকে পরবর্তীকালের বাঙলা কাব্যের কোনো গবেষকের সাধনার নির্দেশিকা হিসেবেই রচনা করেছিলেন। যতোগুলো ভাবস্রোত বাঙালি মনে আবেগ সঞ্চার করেছে আর বাংলা কাব্যে দিয়েছে বেগ, চুম্বকে সবগুলো আলোচনা করেছেন। এর মধ্যে কাজের ধারা প্রধান, কতেক অপ্রধান। মনীষার কর্ষণে এবং সামাজিক সত্যের সমর্থনে জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছে চিত্তহারী কাব্য। আর অপ্রধান ধারার কাব্যে নতুন জীবন ভাষ্য কেন ব্যঞ্জিত হয়ে উঠলো না—সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিশ্বাসযোগ্য কারণগুলো বের করে দেখাতে চেষ্টা করেছেন। তার জন্য পাণ্ডিত্য, কাব্যবোধ, ইতিহাস সম্পর্কিত ধারণা এবং আধুনিক নৃতাত্ত্বিক জ্ঞানের প্রয়োজন ছিলো— জনাব হুমায়ুন কবির ঐ সকল বিষয়ে শিক্ষিত ছিলেন। বাংলার কাব্যের স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে যেয়ে তিনি ঐ সমস্ত জ্ঞান প্রয়োগ করেছিলেন সচেতনায়—তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো আদি থেকে আধুনিক যুগ অবধি বাংলা কাব্য প্রবাহের মূল ধারাটি কি এবং সহায়ক ধারাগুলোও বা কি কি—তা স্পষ্ট করা। এ এক ধরনের সত্যানুসন্ধিৎসা। গোঁজামিল বা বিদ্বেষের একপেশে ভিত্তির বদলে একটি বিজ্ঞানসম্মত বুদ্ধিগ্রাহ্য ভিত্তির উপর ‘বাঙলার কাব্য’ আসীন হোক তিনি এই কামনা করেছিলেন।
যেহেতু তাঁর দৃষ্টি ছিলো সামনে, তাই অতীত ঘেঁটে জঞ্জাল যেটুকু বাদ দিয়ে তার ভেতরের প্রাণপ্রবাহের ইশারাটুকুই তিনি গ্রহণ করেছেন। বাঙলা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলীর বিকাশের মূলে দীপ্তধারার সভ্যতা ও ইসলামের প্রভাবের কথা যখন উচ্চারণ করেছেন, তাতেও তাঁর মুসলমান পরিচয়কে ছাপিয়ে সত্যদ্রষ্টা মনের পরিচয়ই অধিক প্রকাশ পেয়েছে। ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব সম্বন্ধে জ্ঞান না থাকলে এমন অবলীলায় এমন নিস্পৃহভাবে এরকম সামাজিক সত্যের উচ্চারণ সম্ভব হতো না। পূর্ব বাঙলার সংগ্রামী জীবনচেতনা, বৈরী নিসর্গই কাব্যের শরীরকে অধ্যাত্মবাদের প্রভাব থেকে মুক্ত রেখেছে—পক্ষান্তরে পশ্চিম বাঙলার প্রকৃতির মধ্যে যে জীবন ভোলানো মায়া মরীচিকা তা কাব্যের প্রাণেও মাখিয়ে দিয়েছে অতীন্দ্রিয়তার আমেজ। মুসলিম রাজপুরুষদের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘বাঙলার কাব্য” ধর্মের খোলস থেকে এলো বেরিয়ে, কাহিনীর জটিল মধুচক্রে রসিকজনের চিত্তহরণ করলো—এ হলো বাইরের কথা। নতুন রাজশক্তিকে আশ্রয় করে, নতুন ভাবনার বিদ্যুত স্পর্শে দেশের মনে নতুন রসসম্ভোগের ভিত্তি গড়ে উঠছিলো, কার্যকারণ পরম্পরা ব্যাখ্যা করে মাত্র অল্প কথাতে তার পরিচয় দিয়েছেন। পুঁথি সাহিত্য যা কিনা অনেক উন্নাসিক কাব্য সমালোচকের চোখে ঠেকেনি বললেই চলে, ইংরেজি শিক্ষিত কাব্য সমালোচকেরা এর উল্লেখ মাত্র করতে যেখানে কুণ্ঠিত হতেন, জনাব হুমায়ুন কবির দেশের একটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর রসপিপাসা নিবারণের যোগানদার হিসেবে, ইহলৌকিক ও পারলৌকিক প্রশ্নরাজির পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলন বলে ধরে নিয়ে একে যথাযোগ্য স্থান দিয়েছেন। তাই বলে কোনো রকমের সাম্প্রদায়িক আত্মশ্লাঘা তাকে আচ্ছন্ন করেনি। পুঁথি সাহিত্যে জীবনের যে বলয়, প্রত্যেকটি স্রষ্টার মধ্য দিয়ে কার্বন কপির মতো বার বার অঙ্কিত হয়েছে তাতে না মিলতে পারে বৃহত্তর মহত্তর জীবনের ইশারা, না থাকতে পারে অপর্যাপ্ত জীবন ঘনিষ্টতার ছোঁয়া। কিন্তু তা একটি সম্প্রদায়ের প্রাণের জিনিষ—প্রাণ দিয়েই সৃষ্টি করেছে। এতে কাব্যিক উৎকর্ষের অভাবের জন্য স্রষ্টা যতোটা দায়ী তারও চাইতে বেশি দায়ী সমাজ সংগঠন। বৃটিশ আমলের পূর্বের যে বাঙলা সাহিত্য তাতে যে নানা ধারার সমন্বয় ‘বাঙলার কাব্যে’ যেভাবে ইতিহাস প্রবাহের নিরিখে আলোচনা করা হয়েছে, অন্যত্র তা দুর্লভ। এ অংশ পড়ার পরে বাঙলার প্রকৃতি, লোক সাধারণের বৈশিষ্ট্য, প্রতিটি বিদেশাগত ধারার প্রভাব পরিপূর্ণ রূপে পাঠকের চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
[চার]
আধুনিক বাঙলা সাহিত্যের সৃষ্টি ইউরোপীয় চেতনার অভিঘাতে। নব্য বঙ্গের গোড়াপত্তনের যুগে যে দেশ, যে সমাজের ছবি তৎকালীন মনীষীবৃন্দের চোখের সামনে ছিলো তা কিছুতেই পূর্ণাঙ্গ নয়। বৃটিশ এবং ভারতীয়—মাঝখানে যে ইসলাম এদেশে এসেছিলো, একটা পরাক্রান্ত রাজশক্তি এই আদর্শকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে টিকিয়ে রেখেছিলো তার ফলে এদেশীয় সমাজ সংগঠনের জলঅচল কুঠুরীগুলোতে প্রবল একটা আলোড়ন জাগিয়ে তুলেছিলো—তাদের দৃষ্টিতে তা যেন একটা প্রচণ্ড দুঃস্বপ্ন। ইতিহাসকে ইতিহাস হিসেবে গ্রহণ করতে না পারার জন্যেই বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়ের মতো শক্তিশালী প্রাগ্রসর চিন্তার অধিকারী শিল্পীর তুলিতে ইতিহাস বোধশক্তি লাঞ্ছিত হয়েছে। নেহায়েত সাম্প্রদায়িকতার দৃষ্টিকোণ থেকে কেউ একথা বললে সম্প্রদায় বিশেষের অসন্তোষের কারণ ঘটতো। হুমায়ুন কবিরের বেলায় তেমনটি হয়নি, কারণ তিনি বঙ্কিমকে দেখেছেন একটি বিশিষ্ট যুগের, বিশিষ্ট চেতনার প্রতিভূ হিসেবে। তাঁর বিরুদ্ধে যখন অভিযোগ করেন, তখনও শিল্পী বঙ্কিমের প্রতি কোথাও শ্রদ্ধার হানি ঘটেনি। মাইকেলের সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য বিদেশী কাব্যের প্রতি প্রচণ্ড অনুরক্তি এবং ধর্মান্তর গ্রহণ, কাব্যের বিদ্রোহী চেতনার সহায়ক হয়েছিলো। শ্রী মধুসূদন এবং মাইকেল মধুসূদনের মধ্যে বাঙলা কাব্যে কে প্রবল, কে হৃদয়গ্রাহী, কে সুন্দর এই জবাবে তিনি মাইকেলেরই পক্ষ নিয়েছেন। প্রায় তিনযুগ আগের উচ্চারিত বক্তব্য এযুগের সমালোচকেরা গ্রহণ করছেন।
উদার বিশ্বের সংস্পর্শে এসে আধুনিক যুগের বাঙলা কাব্য সাহিত্য একূল-ওকূল দু- কুলপ্লাবী গঙ্গার আকার পেয়েছে। রবীন্দ্র প্রতিভার আশ্রয়ে বাঙলা কাব্যের অভাবনীয় উন্নতি ঘটেছে। একজন ব্যক্তির সাধনায় একটি প্রাদেশিক ভাষা রাতারাতি আদিম সাজগোজ পরিত্যাগ করে ঝকঝকে দীপ্তি নিয়ে বিশ্বের বিদ্বজ্জনের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায় করে নিলো। অন্য কোনো ভাষা এবং সাহিত্যের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেনি। বিশাল সম্রাট পুরুষ রবীন্দ্রনাথের সম্বন্ধে ইঙ্গিতে যা বলেছেন—তাতে অতিশয়োক্তির পরিমাণ নেহায়েত স্বল্প | প্রতিভার অলৌকিক দাবী স্বীকার করে নিয়েও রবীন্দ্র প্রতিভার উন্মেষ বিকাশের সূত্রগুলোর বুদ্ধিগ্রাহ্য বিশ্লেষণ খাড়া করেছেন।
[পাঁচ]
রবীন্দ্র পরবর্তী বাঙলা কাব্য সম্বন্ধে তাঁর যে বক্তব্য তা হতাশাব্যঞ্জক। তার কারণ উত্তররৈবিক সাহিত্যে মধ্যবিত্তেরই প্রাধান্য। এ শ্রেণীটির সঙ্গে দেশের মাটির কোনো সংযোগ নেই। এ শ্রেণী মানবিক চেতনার বদলে স্নায়বিক যন্ত্রণাকেই বেশী দাম দেয়। সহজ স্বাভাবিক মানবিক অনুভূতির বদলে মধ্যবিত্তসুলভ নানা প্রবণতার চটকদার মোড়ক নির্মাণেই এ শ্রেণীর সাহিত্য প্রয়াস নিঃশেষিত হয়। সচেতনভাবে যাঁরা অনুভব করেন, তারা মন এবং আবেগের কাছ থেকে সায় পান না। সে কারণে তাদের সাহিত্য বক্তব্যে স্তর থেকে সাহিত্যের ব্যঞ্জনায় কদাচ উন্নীত হয়। সে যুগটি এখনো চলছে বাঙলা সাহিত্যে। মধ্যবিত্তের বিকৃত ক্ষুধা এবং ততোধিক বিকৃত ভোগলালসার বিবরণই হালের বাঙলা সাহিত্য। অবশ্য তাতে যে দু’একটি ক্ষীণশক্তি ব্যতিক্রম চোখে পড়ে না তা নয়। তা নিয়ে সাহিত্যে গোটা জাতির চিত্তস্ফূর্তির স্পন্দন সঞ্চারিত হওয়া সম্ভব নয়। পশ্চিম বাংলার সৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক নিয়মে অবসিত হয়ে এসেছে, খুব বড়ো রকমের একটা সামাজিক পরিবর্তন ব্যতীত পশ্চিম বাঙলা থেকে উন্নত রুচির, প্রসারিত জীবনবোধের সাহিত্য আশা করা যায় না। অথচ পূর্ব বাংলায় ক্ষেত্র ছিলো, সুযোগও ছিলো। এখানকার সাহিত্যসেবীরা সে সুযোগগুলো কাজে লাগাবার মতো নিজেদেরকে যোগ্য করতে পারলেন না এ বাস্তবিকই পরিতাপের বিষয়।
[ছয়]
মুসলমান সম্প্রদায়ের সাহিত্যকীর্তি, তাদের মনন-মানসের যে পরিচয় পাই—তাতে বেদনা না বোধ করে উপায় নেই। যে সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁর জন্ম সে সম্প্রদায়ের মানসিক শোথ রোগ সম্বন্ধে যখন বলেন, তাঁর কণ্ঠে বেদনার একটা করুণ আভাস ফুটে উঠে। মীর মুশাররফ হোসেন, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদদীন প্রমুখ বিখ্যাত মুসলিম স্রষ্টার মধ্যেও কোনো সংহত চেতনার পরিচয় পাওয়া যায় না। সাহিত্যের প্রভাবে সমাজে রূপান্তর আসে, ধ্যান ধারণায় ঘটে পালাবদল। কিন্তু এ সম্প্রদায়টি এতো জড় এবং এতো তামসিকতায় আচ্ছন্ন, কোনো কিছুকে পূর্ণাঙ্গভাবে নিজের করে গ্রহণ করার ক্ষমতা নেই বললে চলে। অথবা আধাঁর এতো অগভীর অল্প গ্রহণেই শুরু হয় মানসিক উল্লম্ফন ক্রিয়া। রাজনীতি সমাজনীতি শিল্পসংস্কৃতি সবকিছু সম্বন্ধে এই একই কথা প্রযোজ্য। তিনযুগ আগে হুমায়ুন কবির যেমন পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, অবস্থার এখনও বিশেষ হেরফের হয়নি। যুগ-যুগান্তরে যে মানসিক মেদ জমেছে, স্বাধীনতা উত্তরকালেও গলন ধরেনি তাতে। ধর্মীয়—সামাজিক অনেক ক্ষেত্রেই যে অনেকগুলো বিদ্রোহের প্রয়োজন রয়েছে, কোনো সৃজনশীল স্রষ্টার সৃষ্টিতে তার আভাসটুকুও মিলছে না। শিল্পীরা যেনো জীবনবিনাশী অন্ধকারের জগদ্দল পাথরকে এড়িয়ে যেতে চান। যেনো এড়িয়ে গেলেই মুক্তি পাওয়া যাবে। এ কাপুরুষতার মুক্তি এখনও ব্যাপকহারে অনেক আলোকিত ব্যক্তিও অনুসরণ করছেন। আমাদের ধর্মীয় অন্ধকারকে অস্বীকার করতে হবে, পালিয়ে গিয়ে নয়—সামনাসামনি মোকাবিলা করে। তার একটা হাওয়া ইতিমধ্যে যেনো বইতে শুরু করেছে। চাপ চাপ অন্ধকারের অতলে যুক্তি এবং উন্নত জীবন ভাবনার রেখাগুলো উঁকি দিচ্ছে।
পূর্ব বাঙলার এই যুগসন্ধিকালে ‘বাঙলার কাব্য’ গ্রন্থটি এদেশ থেকে পুনরায় প্রকাশিত হচ্ছে। এটি এমন একজন মানুষের লেখা, পূর্ব বাঙলার মুসলমান সমাজে যার জন্ম, যিনি আবহমান কালের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী বলে দাবী করতে পারতেন এবং আধুনিক পৃথিবীর নানা আলোকিত মতবাদের সঙ্গে সুপরিচিত ছিলেন। রাজনীতিতে জড়িয়ে থেকেও নানা বিষয়ের উপর রচিত গ্রন্থে পরিশীলিত রুচি এবং মননশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি তাঁর মাতৃভাষা এবং পিতৃসম্প্রদায়কে যে চোখে দেখেছিলেন, তার সঙ্গে কারো কারো দৃষ্টি মিল হতে পারে এখনও।
Leave feedback about this