বলা হয়, শিল্পের জন্যে সাধনা প্রয়োজন। তা সে কবিতা, গান, চিত্রকলা কিংবা অন্য যে কোনো মাধ্যমই হোক। কিন্তু বৈশ্বিক অস্থিরতার চলমান এ সময়ে ততোধিক অবিন্যস্ত আমাদের এ নাগরিক জীবনে শিল্পের জন্যে সাধনার সুযোগ কতটুকু আছে? সময় যতো এগুচ্ছে জীবনের নিত্যপ্রক্রিয়া ততই জটিল ও কঠিন হচ্ছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি সহজিয়া সুরের ঠাঁই কোথাও কি আছে? কি ঘর কি বাহির সবখানেই যুদ্ধ, ত্রাস, লড়াইয়ে কম্পমান আমাদের সোনালি সংসার। বাঁচার লড়াই, অস্তিত্বের লড়াইয়ে কেবলমাত্র টিকে থাকার জন্যেই প্রাণপাত করতে হয় অতি মূল্যবান অজস্র মুহূর্তকণা।
তবে ছন্দপতনের বেড়াজাল আমাদেরকে যতই আষ্ঠেপৃষ্ঠে বাঁধুক, তাকে ছাড়িয়ে, তাকে মাড়িয়ে ঠিকই কেউ না কেউ স্রোতের বিরুদ্ধতা মেনেও শিল্পের জন্যে, মননের জন্যে সংগ্রাম অটুট রাখেন। পায়ে পায়ে পথ হাঁটেন শিল্পের সুষমা নির্মাণে। একাগ্রতায়, উদারতায় প্রাঙ্গণে ফোটান মনোলোভী ফুল। যার সুবাস চলমান পথিককে স্তব্ধ করে, উদাস করে। পথিক থমকে দাঁড়ান দুদণ্ড হলেও। সে দুদণ্ডের তৃষ্ণা মেটাতে আজকের বাংলা কবিতায় যে কজন নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন বলতে গেলে তাদের শিরোমণি কবি ওবায়েদ আকাশ। সময়ের হিসেবে নব্বইয়ের দশকে তার আত্মপ্রকাশ। সিকি শতাব্দীরও অধিক কাল ধরে তিনি লিখে যাচ্ছেন, সম্পাদনা করছেন, সংগঠন চালাচ্ছেন। একের পর এক সৃষ্টিবিভায় সকলকে চমকে দিচ্ছেন। এ জন্যে যে ধ্যান, যে নিষ্ঠা, যে একাগ্রতা এবং নিবেদন থাকা দরকার, ওবায়েদের চরিত্রধারায় সবকটিই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য মেনেই বিদ্যমান।
লেখার শুরুতেই বলেছিলাম, শিল্পের মগ্নতায় সময়ের প্রতিকূলতার কথা। কিন্তু ওবায়েদের দিকে তাকালে এসব জটিল-কুটিল সংসারজীবনকে অনেক দূরের মনে হয়। মনে হয় কবি ওবায়েদ আকাশ এসব কিছুর বাইরে বসে এক নিজস্ব তপোবন তৈরি করেছেন, করতে পেরেছেন। সেখানে তিনিই স্রষ্টা, তিনিই সেবক। ওবায়েদ অন্তর্লীন পথের দ্রষ্টা হয়ে নিঃশব্দে নির্জনতার পূজারী হতে পেরেছেন। আর তাই তপোবন ঘিরে দিন দিন লকলকিয়ে বাড়ছে তার সৃজিত সম্ভার। কেবল বন্ধুতার খাতিরেই নয়, একজন নিবিষ্ট পাঠক হিসেবেই তার এ নিখাদ সম্ভারে আমি মুগ্ধ।
এবারে কিছু কাকতালীয় মিলের কথা তুলে ধরি। ওবায়েদ ১৯৭৩ সালের ১৩ জুন জন্মেছেন। আমি একই বছরের অক্টোবরে। তিনি ১৯৯০ সালে জন্মগ্রাম ছেড়ে ঢাকায় এসেছেন, আমিও। ২০০১ সালে আমাদের উভয়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। আমার গ্রামের নাম রতনপুর, ওবায়েদের সুলতানপুর। জীবন-জীবিকা নিয়ে ওবায়েদকে অক্লান্ত সংগ্রাম করতে হয়েছে। খুব বেশি না হলেও আমাকেও যথেষ্টভাবেই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়েছে ও হচ্ছে। ওবায়েদ একজন গণমাধ্যমকর্মী, আমিও।
মিল-অমিলে এসব বিষয়ের আশ্রয় নিলাম এ কারণে যে, আজ এইসময়ে এসে ওবায়েদের সাহিত্যের গোলায় যে বিচিত্র শিল্পসম্ভারের ঢেউ, তা যে কারো জন্যেই ঈর্ষণীয়। এমনকি আমার জন্যেও। আমি অবশ্য ওবায়েদকে ঈর্ষা করছি না। কারণ, প্রথমত ওবায়েদ আমার বন্ধু। দ্বিতীয়ত, প্রকৃতিগত ভাবেই ঈর্ষা রিপুটি আমার ভেতরে কার্যকর কম। ওবায়েদের এ অবস্থানে আমি আনন্দিত এবং আনন্দিত। সত্যিকার অর্থেই।
সাধনাকে চলমান এবং জিইয়ে রাখা আরেক লড়াইয়ের নামান্তর। নিত্য দিনের কাঠিন্য ও জটিলতাকে মোমের রূপ দিয়ে একান্তে ধূপকাঠি পোড়ানো বড়ই নির্মম। নির্মম এ কারণে হিতাহিতের চিন্তা না করেই প্রতিনিয়ত আত্মক্ষরণকে উস্কে যাওয়াই একজন শিল্পপথিকের কাজ। তিনি আগুনে হাত রেখেই শিল্পের মস্কো আঁকেন। আমরা দূর থেকে তার প্রকাশটুকু দেখি। নিত্যক্ষরণের জ্বালা দেখি না। একজন প্রকৃত কবি সব ধরনের নির্মমতাকে আত্মায় ধারণ করে যে পথ হাঁটেন তাতে সহযাত্রী কেবল নিঃসঙ্গতাই। এই নৈঃসঙ্গ্যের জমিনেই তিনি ফুটিয়ে তোলেন বিচিত্র সম্ভার।
কবি ওবায়েদ আকাশ নিঃসঙ্গতার ভার বহন করে চলেছেন বহুকাল। যতদূর জেনেছি তিনি শৈশবেই কবিতা লেখা শুরু করেন। আজ অবধি লিখে চলেছেন। এ কাজে তার অন্তহীন প্রয়াস। তার সৃষ্টির পরিমাণও বিপুল। এ পর্যন্ত তার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা চল্লিশের অধিক। তিনি কবিতার পাশাপাশি গদ্য, অনুবাদ ও সম্পাদনাতেও সিদ্ধহস্ত।
কবি ওবায়েদ আকাশের সাহিত্যের পরিভ্রমণে নানামাত্রিক উদ্যম লক্ষণীয়। এসবের মধ্যে অনন্য ‘শালুক’। এটি একটি লিটল ম্যাগাজিন। ১৯৯৯ সাল থেকে তিনি এটি সম্পাদনার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। পত্রিকাটির সাথে প্রথম থেকেই যুক্ত থাকার মধুর স্মৃতি আমার সাহিত্য জীবনের এক অনন্য অনুভব। সেই ছোট্ট কলেবরের ‘শালুক’ আজ এতদিনে কতো বিশাল রূপ নিয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে কেবল আমার জন্যে নয় সাহিত্যমোদী সকলের জন্যেও গর্বের, আনন্দের।
বলছিলাম ওবায়েদ আকাশের গ্রাম সুলতানপুরের কথা। তিনি তার জন্মগ্রামকে ভালোবেসে লিখলেন ‘পৃষ্ঠাজুড়ে সুলতানপুর’। এটি ২০২০ সালে প্রকাশিত হয়েছে। আমি মনে করি এ তার অনবদ্য এক কাজ। গ্রামীণ শৈশব যারা পেয়েছেন তারাই কেবল বুঝবেন এর মর্মার্থ। শৈশব অভিজ্ঞতার মিলের কারণেই কেবল নয়, কাব্য-শিল্পের বিচারেও বইটি আমার পঠন অভিজ্ঞতায় বিশিষ্ট এক নজির হয়ে উঠেছে। জন্মস্থানকে ভালোবেসে জন্মঋণ স্বীকার করে স্বদেশ স্বভূমিকে ভালোবাসার ইতিবৃত্ত এই বই। বইটিতে কবির কাব্য অভিজ্ঞতার প্রকাশ চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে। অনেক সংহত, সাবলীল, আর চিত্ররূপময়তায় তিনি যে বাগবিস্তার করেছেন তা অনেক আকর্ষণীয় এবং শিল্পময়। শিল্পবিশ্বে নিত্য পরিভ্রমণের চমৎকার অভিজ্ঞতার আলোকরস রয়েছে ‘পৃষ্ঠাজুড়ে সুলতানপুর’ বইটিতে। কয়েকটি কবিতা তুলে ধরছি।
‘প্রযত্ন অঘ্রান’ কবিতায় তিনি বলছেন –
দেশ-বিদেশ ঘুরে-ফেরা শীতার্ত বেলুন
সারি সারি ঝুলে থাকে খেজুরের শাখায়
প্রতিবার বিকল্প মানুষ শ্বাসকষ্টে খেজুর বাগানে হাঁটে
মা তাকে শুশ্রূষা দেন
সুলতানপুর বসে থাকে বাতাসে সুগন্ধ চুল
অঘ্রাণে খোলা পিঠ রেখে
অথবা
‘একাকিত্ব আছে, একাকিত্ব নেই’ কবিতায় –
প্রতিদিনই সুলতানপুর একা হয়ে যায়
মুহূর্তমাত্র ঝিমুনির ভেতর দিয়ে
বেরিয়ে যায় হৃৎপিণ্ডে যৌথ বসবাস
অতঃপর একাকিত্বও একা হতে হতে
ফিরে আসে তুমুল নস্টালজিয়া
আবার প্রতিদিনই কেউ না কেউ
হৃৎপিণ্ডে বেঁধে নেয় সুলতানপুর, তুমুল অভিলাষ
আদতে সুলতানপুরের কোনো একাকিত্ব নাই
কখনো ছিল না
আমাদের অবিশ্বাস্য একাকিত্বে মাদুর পেতে বসে
একে ডাকে ওকে ডাকে – অভাবিত কোলাহলে
ফুরিয়ে দেয় বেলা
কিংবা
‘ঠিকানা’ কবিতায় –
কোথাও বেড়াতে গেলে
পাশাপাশি হাঁটে সুলতানপুর
জুতা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলে
বিনিদ্র পাহারা দেয় পাদুকা
চিরদিন প্রতিশ্রুত সে –
একদিন দেহ ফেলে কোথাও হারিয়ে যাই যদি
দেহখানা নিজের প্রযত্নে নেবে
আর আমি দেহ ফেলে যত দূরে যাই
একক ঠিকানা লিখবো ‘সুলতানপুর’
শেকড় সন্ধানী কবি ওবায়েদ দেশজ ভিতের ওপর দাঁড়িয়েই বইটিতে বিশ্বজনীনতার সূত্র ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তার কবিতায় যে বহুরঙ-শৈলী তা এই বইটিতে আরো সুচারু ও আরো সূক্ষ্মতার সঙ্গে পরিস্ফুট হয়েছে।
বাংলা কবিতার নিজস্বতা নির্মাণে নব্বইয়ের দশকের কবিদের যে ভূমিকা রয়েছে তাতে অগ্রগণ্য পথিক ওবায়েদ এ বইটিতে নিপুণভাবে চিত্রকল্পবাদ ও প্রতীকধর্মিতার সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন। সুলতানপুরই হয়ে উঠছে তার সামগ্রিক একক অস্তিত্ব। সুলতানপুরের প্রতি ভালোবাসা এবং তা স্বতন্ত্রভাবে প্রকাশের মধ্য দিয়ে তিনি শিল্পের প্রতি তার দায়বদ্ধতার শর্তগুলোও যেন পূরণে সচেষ্ট হয়েছেন। নিখাদ ভালোবাসার সাথে যখন সততার মেলবন্ধন ঘটে, তখন তা থেকে যে বিভা বিচ্ছুরিত হয় তাতেই নিরন্তর আচ্ছন্নতার পথ স্বচ্ছ ও রঙিন হয়ে ওঠে। ভালোবাসার হাহাকার, ভালোবাসার আর্তি সবই তখন কেবল নির্জন প্রান্তরের এক মোহময় গুঞ্জরণ। ‘পৃষ্ঠাজুড়ে সুলতানপুর’ যেন তাই। স্বভূমি আর স্বদেশকে ভালোবাসার এক উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে-ওঠা বইটি কীভাবে, কী বিষয়ে, কী প্রকাশধর্মিতা – সবদিক থেকেই ওবায়েদের ব্যতিক্রমী সৃষ্টি বলে আমার মনে হয়েছে।
যাহোক ওবায়েদকে শুভেচ্ছা জানাতে এসে বইটি নিয়ে তীব্র আগ্রহের কারণে কিছু ভাবনা তুলে ধরলাম। বইটি মূলত এককভাবে বিশদ আলোচনার দাবি রাখে। এখানে এই স্বল্পপরিসরে তা সম্ভব নয়।
কোনো এক সাক্ষাৎকারে পড়লাম, ওবায়েদ অমরত্ব চান না। যদিও সৃষ্টিশীল ব্যক্তিমাত্রই অমরত্ব প্রত্যাশী। কিন্তু তিনি চান কিংবা না চান তার সৃষ্টিসম্ভার যদি অগ্রসরমান সময়ের দাবি মিটিয়ে টিকে যেতে পারে, তবে অমরত্ব হয়তো ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। সেটা সময়ই বলতে পারবে। মহাকাল কাকে বাঁচিয়ে রাখবে আর কাকে রাখবে না, সেটা বলা দুঃসাধ্য।
তবে আপাত সসীম এ জীবনে ওবায়েদ সুস্থ থাকুক, সৃষ্টিশীল থাকুক – এই প্রত্যাশা।
জুনান নাশিত : নব্বইয়ের দশকের কবি
Leave feedback about this