গদ্য বিশেষ সংখ্যা

কবিতার জন্মান্তর | অগ্নি রায় | গদ্য | উৎসব সংখ্যা ১৪৩০

অগ্নি রায়

আমরা তো এটা জেনেই এই অলীক ঢেঁকিতে ধান ভানতে ঝাঁপিয়েছি যে এমন কোনও ত্রিপাদভূমি নেই যেখানে কবিতার ঈশ্বর পা রাখেননি বা আগামী দিনে রাখবেন না!

এমন একটা সন্ধি সময়ের মধ্যে দিয়ে এক বা একাধিক বার বোধহয় সব কবিতা লেখককে যেতে হয়। সে তিনি ছোটো বা মেজো, পুজিত বা পূজারি, স্তাবক বা বিচ্ছিন্ন যেমনই হোন না কেন।

সময়টা ঠিক কী?

তাঁর তো রক্তচাপ এমনিতেই ঠিক আছে, বাজারে দেনাও হয়তো পরিশোধযোগ্য। ঘুমের প্রবল সমস্যা কিছু নেই, পানশালার মৌতাত ফিকে হয়নি। কিন্তু তাও তাঁর মনে শান্তি নেই।

তাগিদা, চাহিদা, প্রেরণা, পাঠক, পাঠিকা, পেন, খাতা, ল্যাপটপ সব থাকা সত্ত্বেও সেই তিনি, বা ধরে নেওয়া যাক আপনি, আসলে একটি লাইনও লিখতে পারছেন না! আঁকিবুঁকি কাটছেন, অবান্তর শব্দ প্রসব করছেন, অথচ শেষপর্যন্ত কিছুই হচ্ছে না। এমন অবস্থা কারও এক হপ্তা চলতে পারে, কারও মাসাধিক, কারও বা বারবার। এমন ‘ব্লক’-এর শিকার হয়ে কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছেন এমন দৃষ্টান্তও বিরল নয়। বাস্তবগ্রাহ্য কোনও কারণ দেখিয়ে সরে পড়েছেন, একমুঠো বালি নিয়ে হাত থেকে গড়িয়ে ফেলা এবং আবারও জড়ো করার এই সিসিফাসিয় শ্রম থেকে।

এই নেতির দিক থেকেই যদি পাল্টা প্রশ্নটি রাখা যায়, যে ঠিক কোন সময়ে ধরা দিতে পারে বহু প্রয়াসসম্ভূত সেই পঙক্তিগুলি যা খুঁজে পাচ্ছিলেন না বলে আপনার খাদ্যে অরুচি পানীয়ে অনাসক্তিতে কেটেছে দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী? যার হীরকচ্ছটায় পাঠক তো অনেক পরের কথা, আপনি নিজেই স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে থাকবেন পাতা বা স্ক্রিনের শাদায়, কালো অথবা নীল অক্ষরের ঝাঁপ খাওয়ার দিকে। সেই কোনও এক ঐশ্বরিক মুহূর্তে নাক পর্যন্ত জলে বা কোহলে বা গ্লানি অপমানের দশটা পাঁচটা নামতায় ডুবে থাকা আপনি, তখন খপ করে ধরে নিতে পারছেন অপর-আপনার মনিবন্ধ। আপনার চিড় খাওয়া অস্তিত্ব একটি বড় ফাটলের জন্ম দিচ্ছে এবং সেখানে জন্মাচ্ছে রাইজোম, বিটপ গুল্মলতা। আপনি মশাই তখন সেই বিস্ময় নিয়ে প্রসব করা পঙক্তিগুলির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন, যেভাবে টবের মাটি দেখে মাধ্যাকর্ষণ অগ্রাহ্য করা সবুজ ক্রমদণ্ডায়মানতাকে!

এখন বিস্ময় হল, এই ফাটল ধরা আপনার সঙ্গে অপর-আপনার দেখাসাক্ষাৎ হওয়ার পূর্ব ইতিহাস, প্রেক্ষিত, ঘটনাক্রম থাকতেও পারে বা না-ও পারে, আপনি কিন্তু তা টের পাবেন না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি প্রাচীন লাইন মনে করুন, ‘নিছক বাস্তব নিয়ে কবিতা হয় না, শিল্পের নিজস্ব নিয়মে দৃশ্য বদলে যায়।’

কীভাবে কী বদলায়?

ধরুন আপনি একটি ঘরে বসে রয়েছেন। বসে রয়েছেন আর পাঁচজনও। কিছু অবজেক্টও রয়েছে ঘরে, যেমন থাকে আর কি। টেবিল ক্লক, ডেস্ক ক্যালেন্ডার, দেরাজ, মোবাইল চার্জার, আলমারি, বইয়ের তাক, টেবিল ইত্যাদি। কথাবার্তা ঘুরছে যেমন ঘোরে। সংঘ পরিবারের হিন্দুত্ববাদ থেকে এম এস ধোনির বুড়ো হয়ে যাওয়া হয়ে, বর্ষার ইলিশের দর বাড়া কমা পর্যন্ত। কিন্তু আপনি অবসন্ন ভি্তরে ভিতরে কারণ গত তিন, চার মাস বিভিন্ন সম্পাদক, পত্রিকার হুড়কো, মিষ্টি ইনবক্স-অনুরোধ সত্ত্বেও আহিত হওয়ার মতো একটি লাইনও মাথায় আসছে না। এ হেন ইসবগুলের বিজ্ঞাপন সদৃশ আপনি, হঠাৎই ভিতরে ভিতরে বদলে যেতে শুরু করলেন। কানাভাঙা যে সোফাটিতে বসে রয়েছেন সেটিকে সিংহাসন বলে মনে হতে লাগল। কারণ ওই ঘরেরই কোনও একটি আপাত প্রাণহীন অবজেক্ট (অন্তত তখনও পর্যন্ত) আপনাকে টানতে শুরু করেছে। সে এবং আপনি, যে যার নিজের মুদ্রাদোষে হয় একেশ অপরের জায়গা নিতে শুরু করেছেন অথবা ক্রমশ কাছাকাছি আসছেন। ধরুন ঘরের একটি পুরনো কাঠের টেবিলের সঙ্গেই ঘটছে এই নীরব যৌনাচারণ। আপনি চক্রের মধ্যে বসে কথা বলে যাচ্ছেন চলতি বাজেটের পর শেয়ারবাজার সাম্প্রতিক ওঠানামা নিয়ে, কিন্তু ভিতরে অস্থিরতা শুরু হয়ে গিয়েছে। কারণ আপনি বুঝতে পেরে গিয়েছেন আপনার অ্যান্টেনার ফাঁদে জাদু পাখিটি পড়ে ছটফট করছে! লিখিত হতে চাওয়ার লেবার পেন শুরু হয়ে গিয়েছে তার। আর আপনি ওই টেবিলের কাঠের প্রতিটি চিড় দাগের মানচিত্র ছাপিয়ে এক গভীর অরণ্যকেই দেখতে শুরু করেছেন তখন। বুঝতে পারছেন তার ইতিহাস এবং সামাজিক বিবর্তনের পটচিত্রকেও। পানকৌড়ি তখন ধীরে ধীরে মাছরাঙা হয়ে যাচ্ছে। গোটা বিষয়টি পথ বদলাতে বদলাতে এসে পড়ছে আপনার ভালনারেবল অস্তিত্বের একটা অজানা তটভূমিতে। যে নাব্য এলাকাটি তার আগে পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত ছিল নিজের কাছেই। অবশ্যই এই দুই পৃথিবীর মধ্যে যাতায়াত কোনও একটি বিশেষ সূত্র নির্ভর নয়। কোনও একটি বিশেষ নিয়মেরও তোয়াক্কা করে না তা।

অর্থাৎ যেটা বোঝাতে চাইছি তা হল আপনার লেখালেখির সঙ্গে আপনার যোগাযোগ ঘটে কোনও এক বাস্তব খন্ডচিত্র দ্বারা (আরও অনেকভাবেই নিশ্চয়ই হয়)। কিন্তু সেই বাস্তব অভিজ্ঞতা বা কনসেপ্ট এবং শেষ পর্যন্ত আপনার খাতার পাতে পড়ে থাকা সাহিত্য বা কবিতা এই দুইয়ের চলন কিন্তু একইভাবে হয় না। যদিও উভয়েই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হয়। কিন্তু এদের মেজাজ ভিন্ন। ধুসর আতাগাছ প্রবন্ধে উৎপলকুমার বসু যেমন বলেছেন, ‘কনসেপ্টের বিবর্তন ধীর সংহত এবং লিনিয়ার অর্থাৎ সরলরেখায় উঠে যাওয়া একটি গ্রাফের লাইন। সাহিত্যের বিবর্তন ধাক্কায় ধাক্কায় এগিয়ে চলা। তাই সাহিত্যের টাইম ঐতিহাসিক টাইম নয়। সাহিত্যের স্পিসে ভৌগলিক স্পেস নয়।’

অর্থাৎ ওই কাঠের টেবিলটির ইতিহাস ভূগোল অতীত এক সারবস্তু যাকে আপনি তার টাইম ও স্পেস থেকে অন্য এক ম্যাজিক টাইম ও ম্যাজিক স্পেসে নিয়ে ফেলছেন। জন্ম নিচ্ছে আরও একটি কবিতা। রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’ থেকে একদম শেষ বয়সের রচনাগুলি পর্যন্ত কবির-চোখে-দেখাকে তিনি অপরিহার্য অঙ্গ বলে মনে করছেন। তাঁর কথায়, ‘যাহা অশরীরভাবরূপে নিরাশ্রয় হয়ে ফেরে তাহাই যদি কবির কাব্যে মূর্তি পরিগ্রহ করিয়া সম্পূর্ণতা লাভ করিয়া থাকে—তবেই কাব্য সফল হইয়াছে এবং সেই সফল কাব্যই প্রকৃত জীবনী।’ আর তাঁরই কথায়, ‘এক টুকরো পাথর, একটা গাধা, একটা কাঁটাগাছ, একটা বুড়ি যাই হোক’— এই সামান্য যা কিছু ‘অভিজ্ঞতা’ থেকেই শব্দশিল্প তৈরি হতে পারে।

সব শেষে উৎপলকুমার বসুর একটি লাইন সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য বলে মনে করি। ‘শুধু লেখার খাতাটি নিয়ে/ সমুদ্র ও বনের দিকে চলে যাওয়া ছাড়া কোনো দরকারি কাজ নেই।’ বর্তমান শতাব্দীর যুবকবেলায় এসে এই অসমান্য পঙক্তিকে একটু সংযোজিত করে বলি, লেখার খাতাটিকে মাথায় রেখে যে কোনও জায়গায় যাওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ এক্ষেত্রে। কারণ আপনি সমুদ্রে গেলেন কি শেয়ারবাজারে, কবিতার সেটায় খুব একটা ফারাক পড়ছে না।

আমরা তো এটা জেনেই এই অলীক ঢেঁকিতে ধান ভানতে ঝাঁপিয়েছি যে এমন কোনও ত্রিপাদভূমি নেই যেখানে কবিতার ঈশ্বর পা রাখেননি বা আগামী দিনে রাখবেন না!

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field
    X