গণঅভ্যুত্থান সংখ্যা
মঙ্গলবার ১৬ জুলাই। কোটাবিরোধী আন্দোলন হঠাৎ করে স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানলে রূপ নিল। একটি যৌক্তিক, অরাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন রূপ নিল সংঘাতপূর্ণ, রক্তাক্ত আন্দোলনে, পেল রাজনৈতিক চেহারা। এর আগের রাতে আগুনে ঘি ঢেলেছিল কিছু নেতার দায়িত্বহীন ও উসকানিমূলক মন্তব্য এবং আন্দোলনকে পেশিশক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রণের ভুল পদক্ষেপ। অতীতে সুবিধাভোগী এই পেটোয়াবাহিনী এবার আর সফল হলো না। বিক্ষোভ ও সংঘর্ষে সড়কে প্রাণ ঝরল ৬ তাজা তরুণের। পুরো দেশ শোকে স্তব্ধ। বুধবার কাটল সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ, গায়েবানা জানাজা, কফিন মিছিলে। সৌভাগ্য, সেদিন নতুন কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। পরদিন বৃহস্পতিবার কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা সারাদেশে কমপ্লিট শাটডাউন বা সোজা বাংলায় হরতালের ডাক দিলে পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর রূপ পরিগ্রহ করে।
অমন উত্তপ্ত দিনের সকালে শান্ত ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে গেল ওর মর্নিং শিফটের ডিউটি পালন করতে। নিজের কাজে অত্যন্ত দায়িত্বশীল সে, মা-বাবার কথা শুনল না, আকুতি বুঝল না। মিরপুর থেকে মেট্রোতে চড়েই গেল এবং হাসপাতাল থেকে জানাল সে নিরাপদে পৌঁছেছে। এদিকে দিন যত গড়ায় তত টেলিভিশনের পর্দা ভরে ওঠে বিক্ষোভ-সংঘর্ষের ছবি ও খবরে। ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের কর্মী ও পুলিশবাহিনী যত আগ্রাসী হলো, সাধারণ ছাত্ররা ততই সাহসী হয়ে উঠল। ত্রিমুখী লড়াইয়ে তরুণদের সাহস দেখে অবাক হলাম। তবে একের পর এক মৃত্যুর সংবাদে চমকে উঠে ব্যথিত হতেও সময় লাগল না। উপলব্ধি হলো ক্ষমতাসীনরা লক্ষ লক্ষ তরুণের শক্তিও সাহসকে নিদারুণভাবে অবজ্ঞা করেছিল; সে-অবজ্ঞার পরিণতি এই সহিংসতা। এর মাঝে খবর এলো আগারগাঁও থেকে উত্তরা পর্যন্ত মেট্রো চলাচল বন্ধ। পরে জেনেছি এর কারণ, মিরপুর ১০ সার্কেলে আন্দোলনকারীদের পুলিশ বক্স পুড়িয়ে দেওয়া আগুন উপরের ফুটওভার ব্রিজে ছড়িয়ে পড়ে। মেট্রোরেলের পথ এর উপরেই। আমরা উদ্বিগ্ন হলাম শান্ত আসবে কী করে? শান্ত জানাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেট্রো চড়ে আগারগাঁও এসে সেখান থেকে সিএনজি বা মোটরবাইক নিবে।
সারা ঢাকা শহরে তখন যুদ্ধ চলছে। আমাদের স্বস্তি দিয়ে শান্ত জানাল, সে দুপুরে আসবে না। অনেক চিকিৎসক ডিউটিতে আসেনি, যারা হাসপাতালে ছিল তাদের উপর ডাবল ডিউটি পড়েছে। শান্ত ইভনিং শিফটের ডিউটি করে রাতে আসবে। আমরা ভাবলাম দিনের উত্তাপ রাতে শান্ত হয়ে আসবে।
সারাদিন টেলিভিশনের সামনে বসে আছি। এই একদিনে যত ঘণ্টা টেলিভিশন দেখলাম বহুদিন তত দেখিনি। একদিকে উদ্বেগভরা সব খবর, মৃত্যুর কাহিনি, অন্যদিকে অমন তাণ্ডবের মাঝেও বেনিয়া কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন পণ্যের লাগাতার, পৌনঃপুনিক বিজ্ঞাপনের অত্যাচার। দেখি আর ভাবি আন্দোলনকারীদের আলোচনার টেবিলে এনে যে আন্দোলন শান্তিপূর্ণ উপায়ে, সহজে সমাধান করা যেত, তাকে ঠেলে দেওয়া হলো রক্তাক্তপথে, ধারণার বাইরে এক ধ্বংস ও মৃত্যুর যজ্ঞে। যেসব মায়ের বুক খালি হলো তাদের প্রতি মায়া অনুভব করি আর কায়োমনোবাক্যে প্রার্থনা করি শান্ত যেন ভালোভাবে ফিরতে পারে। প্রতিটি মা-বাবাই, যাদের সন্তান কাল বাইরে ছিল, উদ্বিগ্ন থেকেছে। আর যেসব লড়াকু তরুণ-যুবক রাজপথে মিছিলে, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায়, রাবার বুলেট আর ইটবৃষ্টির ভেতর ছিল তাদের পিতা-মাতার আত্মা তখন ছিল খাঁচাছাড়া। কেবল ঢাকা নয়, সারা দেশজুড়ে লড়াইয়ের খণ্ডচিত্র, দুপক্ষের তাণ্ডব বিমূঢ় করে রাখছিল দেশবাসীকে। যেন এক দাবানল বনের এক অংশ থেকে ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বনে।
বিকেলে এলো আরও উদ্বেগের খবর। আন্দোলনকারীরা আক্রমণ করছে বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা, রামপুরা টিভি ভবন তাদের দখলে, মহাখালির সেতুভবন, দুর্যাগ ব্যবস্থাপনা ভবনে হামলা হয়েছে। তখন মনে হলো শুধু কোটা সংস্কার নয়, সরকার উৎখাত করতে চায়। তাণ্ডবলীলা ও প্রাণসংহারের হার দেখে সরকার আপোষ মীমাংসার প্রস্তাব দিল, আন্দোলনকারীদের আলোচনার বৈঠকে ডাকল, আপিল বিভাগের শুনানি ৭ই আগস্ট থেকে এগিয়ে নিয়ে এলো রবিবার। সরকারকে এই প্রথম যুক্তিবাদী হতে দেখলাম, শুনলাম নরম সুর। আমরা আশা করলাম আন্দোলনকারীরা সরকারের প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে আলোচনার টেবিলে বসবে। কিন্তু তখন বোধহয় কোনকিছুই সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই।
টেলিভিশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে চিত্র দেখলাম তাতে তাকে একটি মৃতপুরী বলে মনে হলো। সরকারের ঘোষণায় হল ছেড়ে গেছে সকল ছাত্র-ছাত্রী, ক্যাম্পাস জনমানবহীন। অমন জনশূন্য এলাকা দিয়ে যেখানে উড়ে আসছে বেগানা বুলেট – সেই ভীতিপ্রদ জায়গা দিয়ে কী করে আসবে আমার ছেলে? এদিকে ইন্টারনেট পরিসেবা বন্ধ। দিনভর ডাটা স্লো ছিল বা কাজ করছিল না, চালু ছিল শুধু ওয়াইফাই। ডাটা সেন্টার পুড়ে যাওয়ার কথা বলা হলেও, সেখানে কী হয়েছিল, কিছুই জানা গেল না। শান্তর সাথে যোগাযোগের একমাত্র উপায় তখন মোবাইল টেলিফোন। ও বলেছিল রাত ৮টার দিকে একজন বড়ো ভাইসহ মিরপুর ফিরবে। মেট্রোরেল তখন পুরোপুরি বন্ধ। ওয়াইফাই ও ইন্টারনেট যে বন্ধ হয়ে গেছে তা তো আর জানে না প্রবাসীরা। শান্তর জমজ ভাই প্রান্ত অস্ট্রেলিয়া থেকে ভাইকে মেসেঞ্জার বা হোয়াটসঅ্যাপে না পেয়ে অস্থির হয়ে উঠল। আমরা শান্তকে পরামর্শ দিলাম, ’তুমি আজ নাইট ডিউটিও করো, হাসপাতাল থেকে বের হয়ো না।’ শান্ত রাজি হলো।
লুবনা পরিকল্পনা করল, আমি শেষরাতে গাড়ি চালিয়ে গিয়ে যেন শান্তকে নিয়ে আসি। সারাদিন সে একথাই বলেছে, আমি গিয়ে ছেলেকে নিয়ে আসি। শান্ত এ-প্রস্তাবে রাজি হলো না। ওর উদ্বেগ বাবাকে নিয়ে, মায়ের উদ্বেগ শুধুই তার ছেলেকে নিয়ে। ভোরবেলা কলবেল বেজে উঠলে ধরফর করে বিছানা থেকে উঠে তরিৎ দরোজা খুলি আর দেখি জগতের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য! চৌকাঠ জুড়ে আমার চিকিৎসক পুত্র শান্ত দাঁড়িয়ে। ওর পরিধানের নীল শার্ট নীল আকাশের মতো মহৎ, ওর প্রশস্ত বুক স্বদেশের মতো বিস্তৃত। বুকে জড়িয়ে ধরি শান্তকে। ছুটে আসে ওর মা, সন্তানের নিরাপত্তা উদ্বেগে যে কাল রাতে ঘুমাতে পারেনি। লাবনা ও আমি শান্তকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকি, যেন এইমাত্র আমরা বিশ্বকাপ জিতেছি, আর ধরে রেখেছি বিশ্বজয়ের ট্রফি।
যে-সব শান্ত ছেলে কাল অশান্ত ময়দান থেকে ঘরে ফিরে আসতে পারেনি তাদের জন্য সারাদিনই হা-হুতাশ করেছি আর উপলব্ধি করেছি যার গেছে কেবল সে-ই জানে কী অপরিসীম ক্ষতি হয়ে গেছে জীবনের। বুকের মাণিক রাজপথে লাশ হয়ে শুয়ে পড়েছে দয়ামায়াহীন ঘাতকের নির্মম বুলেটে। সকল মৃত্যুই এড়ানো যেত শুধু বুদ্ধিমত্তার সাথে শুরুতেই আলোচনায় বসলে।
দম্ভ নয়, মানবিকবোধই পারে সুসময় আনতে। এখন সেই সুসময়ের অপেক্ষা করছি। আলোর পাখিরা উড়ুক আকাশে।
ঢাকা
১৭ আগস্ট, ২০২৪
Leave feedback about this