সুইসাইডাল পার্টনারের ব্যাপারে বক্তব্য কী?
আমার সোনার বাংলা, এমন একটা গান কোথাও বাজতেছিল না। কিন্তু এইরকম একটা ভ্রম মাথার ভেতর চমকায়া দিচ্ছিল। মিরকাত বাসার ভেতরে আরামসে শুয়ে থাকতেছিল তখন। কিন্তু আমার সোনার বাংলা- এইরকম একটা গান মেলোডির মর্জি নিয়া কেন বাজতেছিল বোঝা যাচ্ছিল না। আরো জানা যাচ্ছিল না আমার সোনার বাংলা’র পরের লাইনগুলো কেন প্রায় না দেখার মতো ঝাপসা হয়ে আসতেছিল। চিরদিন প্রাণে বাঁশি বাজার মতো কোনো আকাশ কি দেখা যাচ্ছিল?
তবে চিৎকার আসতেছিল টিকটক থেকে, ক্রমাগত আসতেছিল। জেবা নামক আইডির ভেতরে এক সুশ্রীমুখ উঁকি দিচ্ছিল। সে আত্মহত্যার জন্য চিৎকার করে একজন বিশ্বস্ত পার্টনার খুঁজতেছিল। সেই ক্ষণে সোনার বাংলা উধাও হলে মেলোডি বিষয়ক গানের মোহ ছুটে গেল। বিবিধ অস্পষ্টতার ভেতরে সে বোধ হয় এমন এক ঘোষণার অপেক্ষাই করছিল। কিন্তু নিঠুর শ্রোতামণ্ডলি তার ডাকে কেন সাড়া দিচ্ছিল না! মানুষের এই পৃথিবীতে নিঠুরতা দেখার মতো কোনো আহ্লাদ বাকি থাকতে পারে কিনা সে ভাবল। তারপর সে এভারেস্ট ভঙিতে উৎরাই ও চড়াই পার হয়ে জেবা নামক মেয়েটিকে বার্তা দিল। আর মেয়েটি পাঠিয়ে দিল এক মনোরম ইন্টারভিউ লেটার।
তুমি কি ইশারাবাদী?
তুমি কি গর্তজীবী?
দুঃখের সময় প্রাইভেসি পাচার কর?
যৌথ মরণের পর যৌথ জীবন বিশ্বাস কর?
সুইসাইডাল পার্টনারের বিশ্বস্ততার ব্যাপারে তোমার বক্তব্য কী?
যেভাবে ক্ষমা চাও, সেভাবে ক্ষমা কর?
কিন্তু মনোরম ইন্টিারভিউ সে ডিঙাতে পারল না। ইন্টারভিউয়ের তলা ফেটে সে তলায়া গেল। ঘামের নহর ছোটা দুপুরের রোদে তবু তারা মুখোমুখি হলো।
জেবা বলল, প্রাণের মতো ওয়েদার। বাতাসের কারখানা বন্ধ।
মিরকাত সংশয়ে ভেটকাল। সে দেখল অপরিমিত হাওয়া। কেবল গায়ে লাগতেছিল না। যেভাবে সে ব্যাংকে অগাধ পয়সা দেখে। সেভাবে সে হাওয়া শরীরের দিকে টানতে পারতেছিল না। একটু টানতে পারলে ফুরফুরা এক জীবন হতে পারত।
জেবা বলল, তোমার থেকে বয়সে আমি বড়। মরণের গাঁট বাঁধতে পাছে কোনো আফসোস হবে না তো?
মিরকাত চুপচাপ হাসল। হাসির ভেতরে সম্মতির ইশারা আছে সে বোঝাল।
তারপর বলল, কিন্তু আমি তো ফেইল করেছি ইন্টারভিউয়ে। আমার সাথে কি গাঁট বাঁধা যায়?
আমি তো ব্যর্থর সঙ্গেই গাঁট বাঁধতে চাই। সফল’-এর সঙ্গে সুইসাইডাল গাঁট বাঁধার কোনো যুক্তিই তো নাই।
মিরকাত ব্যাপারটা বুঝল। ব্যর্থ বলেই সে মরণের মুখোমুখি হয়েছে শরীরফাটা ঘামের দুপুরে।
তারপর তারা পরিকল্পনাহীন হাঁটতে থাকল। হাঁটতেই থাকল। দুপুর গড়াল।
জেবা বলল, দারুণ একটা লোকেশন আছে কিন্তু। সেখানে জলের ওপর বিকেলের রোদ এসে পড়ে। আমরা তো আর সাঁতরাতে পারি না।
এই বলে তারা যখন মনোরম সে রোদের মহলে পৌঁছাল, তখন জল হাতছানি দিতেছিল।
জেবা বলল, আমার একটা কথা ছিল। কথাটা হলো, আমি কিন্তু সত্যিই মরতে আসি নাই। আমি আসলে আমার মতোই একটা পার্টনার খুঁজতেছিলাম। যার সঙ্গে মরণের পথে হেঁটেও আবার বেঁচে ওঠা যায়। কী, যায় না?
মিরকাত তখন পানির কিনারে। সেখানে আলো ঝলকাচ্ছিল। চোখে ধাঁধাঁ পড়তেছিল। সে টুপ করে পড়ে যেতে যেতে ভাবল, আড়ালে শেষ পর্যন্ত সবই প্রবঞ্চক, নিঃসঙ্গ করে দেবার মতো ফেইক স্বপ্নদ্রষ্টা।
আমার গল্প লেখা
১
যখন একটু ফুরসত পাই, দেখি সহজেই শৈশব চলে আসে চোখের সামনে। এখন ভাবতে গেলে মনে হয়, সে যেন আলাদা কোনো সভ্যতা। এখনকার সঙ্গে সামান্য মেলে না। অথচ এই তো সেদিনের কথা। আমাদের উৎসব, দুরন্তপনা, বিনোদনের উজ্জ্বল অনেক ক্ষেত্র, সেসব তো অর্গানিক ছিল। আমাদের মেকি কোনো জগৎ ছিল না। সেজন্যই কি, এখনকার বাচ্চারাও ছবি আঁকতে গিয়ে গতশতকের জনজীবনের প্রেক্ষাপট নির্বাচন করে অনায়াসে! এবং আমার গল্পভাবনার বড় অংশ আমার শৈশব দখল করে আছে। আমার মূল প্রেরণা ও শক্তি বোধহয় সেখানে। সেখান থেকে প্রেরণা ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র জীবনে, মানুষ্য সভ্যতার অলিতে গলিতে।
২
কিংবা আয়নার কথা মনে পড়ে। সমস্ত দিন নিজের সঙ্গে কাটিয়ে, দিনশেষে আমরা আয়নার সামনে দাঁড়াই। নিঁখুতভাবে দেখি, পর্যালোচনা করি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। তেমনিভাবে, আমার সমস্ত দিনের, কিংবা জীবনের ঝাঁপি খুলে বসে লেখার টেবিলে। আমার চেনা দৃশ্যগুলো আরো উজ্জ্বল হয়ে, অথবা ঝাপসা হয়ে ভিন্ন ভিন্ন স্বরে উঠে আসে। আমি মূলত দেখাতে চাই আমাদের অন্তর্লোক। যে ব্যথা আমরা লুকাতে চাই, ছুঁয়ে দিতে চাই সে ব্যথার ক্ষতস্থান।
এভাবে একটা জীবনকে ধরতে চাইছি বিভিন্ন গল্পের ভেতর। কিংবা ধরতে চাইছি একটা জন্মকে। সে জন্ম হয়ত শুধু মানবের না, আরো অনেক কিছুর। এটা হয়ত নিজের জীবনকে জুয়ার আসরে যাচাই করে করে নেবার মতো।
একটা জন্মকে স্বীকৃতির খাতায় নাম লিখিয়ে, মৃত্যু ও প্রেমের বিভোর কোলে প্রাণটাকে লালন করে একটু একটু গড়ে তুলছি নিজেকে। কখনো ভাঙছি বটে, কিন্তু গড়ার জন্য সমৃদ্ধ এক মগ্নতা আছে।
২
ছোটগল্প নিয়ে ভাবতে গিয়ে ইন্তিজার হুসেইনের কথাও মনে পড়ে। আরো পঞ্চাশ বছর আগে তিনি উপলব্ধি করেছেন, ছোটগল্পের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। বিষয় হলো, অন্ধকার কেন? কোন ঘটনায় এমন বোধের জন্ম হল?
ইন্তিজার হুসেইন এমন এক পৃথিবী দেখছেন, যে পৃথিবীতে মানুষ ছাড়া কিছু নাই। পৃথিবীতে মানুষ যত বাড়ছে, গাছ তত কমছে। মানুষ ছাড়া পৃথিবীতে যখন আর কিছু নাই, সে পৃথিবীতে সাংবাদিকতা হতে পারে, গল্প হতে পারে না। গল্পের জন্ম হয়েছে মানুষ আর না মানুষের মিথস্ক্রিয়া থেকে। গল্পের জন্ম তো সেই সময়ে, যখন পৃথিবীতে মানুষ ছিল কম গাছ ছিল বেশি। রাত নামলে আগুন ঘিরে কিছু মানুষ থাকত। আর বাইরে বিশাল পৃথিবী ঘন অন্ধকার, গভীর রহস্যময় অন্ধকার। বিষয় হল, সৃজনশীল কাজ তো ধ্যান ও ভাবনার চর্চাই? একদম প্রকৃতি থেকে উঠে এসে এসব ধ্যান ও চর্চা যখন ঢুকে পড়ে চার দেয়ালে, অট্রালিকার জঙ্গলে, নাভিশ্বাস ওঠা কলকারখানায়, বৃক্ষ ও রহস্যময়হীন উন্নয়নে, তখন তার পরিণতি কী হয়?
বিষয় হলো, ইন্তিজার হুসেইনের এই উপলব্ধির পর পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেছে। এই সময়ে পৃথিবীতে যে দ্রুততায় আগ্রাসী পরিবর্তন হয়েছে, যে পরিবর্তনে মানুষষের জীবনধারা পুরো উল্টে গেছে, এমন এক জটিল সময়ে তাহলে ছোট গল্প কেমন হতে পারে? অথবা কেমন হওয়া উচিত? এই চিন্তা আমাকে সবসময় তাড়া করে।
Leave feedback about this