কথাসাহিত্য ছোটগল্প বিশেষ সংখ্যা

শাহমুব জুয়েল | অন্ধ ও পকেটমার | অণুগল্প সংখ্যা

অন্ধ ও পকেটমার

বাম পকেটের কাপড়টা কুকুরের জিবের মতো ঝুলছে মকর আলীর। কুকুর ঢুকে গেছে পকেটে। কী সর্বনাশ! শহরের কোণে বসা কুকুর মকর আলীর পকেটে কেন? জায়গা বে-জায়গায় কুকুরের উৎপাত। কুকুর শেষ পর্যন্ত মকর আলীর পকেটে। আহা! বেচারা দৃষ্টিশক্তিহীন। দেখতে পায় না বলে কুকুর ঢুকবে- ঠিক পকেটে। তাও আবার মকর আলীর পকেটে! কী অসম্ভব! তবুও ঘটে গেছে। পেটে খিদে মকর আলীর। মাথায় আবোলতাবোল চিন্তা ভিড় করে। দু’পয়সা পেতে বসুমতি এক্সপ্রেসে ওঠে সে। বাম পা অসার তবুও সোজা হয়ে দাঁড়ায়। হাত নেড়ে কয় – চোখে দেখে না, হাতের কব্জিটা চিকন, কাজ ধরতে পারে না। পায়ের নিচের অংশটা সোনালু কাঠের মতো, মেদ কম- খাড়া হতেও কষ্ট। চালমান বলতে কেবল মুখটা আছে- টনটনে আওয়াজ। মুখ উঁচিয়ে কয়, বাজান, কেউ দু’পয়সা দেবেন অভাগারে? খোদা, ভগবান আপনাগোরে দয়া করব। ঘরে-বাইরে শান্তিতে রাখব।

শান্তির দরবার বন্ধ, অশান্তি বাসা বাঁধছে সর্বত্র, কী ঘর, কী বাহির!

বাসের তিন-চার সারি পরে মেহজিন। জানালার পাশে বসে বৃষ্টি দেখছে। ভরদুপুরে ভারি বৃষ্টি হচ্ছে। রোদখেলা দুপুরে বৃষ্টি, শীতল করে দেয় পুরা নগর। শরীরের রিপুগুলোও স্বস্তি পেয়েছে। থেমে থেমে বাস চলছে, ফাঁকে ফাঁকে রিকশা। হুডওয়ালা রিকশায় যুগলের খুনসুটি দেখে মৃদু মৃদু হাসে মেহজিন। অবাধ্য চুলগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ছে ডানপাশের সিটে বসা রুমির কাঁধের ওপর। অপরিচিত দুজন। মেয়েদের গায়ের গন্ধ রুমির ভাল্লাগে। বাসে উঠে মেয়েদের পাশে বসা তার পুরানো অভ্যেস। কথায় আছে- মনের খোঁজ, ভাগ্যের দোষ। চুলের ওড়াওড়িতে বিরক্ত হয় না; সিটে হেলান দিয়ে মুখটা বামদিকে রেখে আরামসে বসে থাকে সে। দারুণ উপভোগ্য ভ্রমণ।

বাসটা ফাঁকা রাস্তা পেয়ে ছুটতে থাকে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে। নিচের রাস্তাটাও খানাখন্দভরা। গাড়িটা দ্রুত যাচ্ছে। রুমি শতচেষ্টা করেও ঠিক রাখতে পারছে না গা-গতর। বাঁপাশের বাহু বারবার মেহজিনের গায়ের ওপর হেলে পড়ছে। বারকতেক পর মেহজিন ভ্রু কুঁচকে তাকায়। অভদ্র নাকি! ধমকে ওঠে মেহজিন। রুমির চোখভরা লজ্জা। বিব্রত হয়ে বলে, আপু মাফ করবেন। রাস্তাটা কী বাজে- সরকারও কী? এসব উন্নয়ন-টুন্নয়ন কী দরকার? একটা ডিম চৌদ্দ টাকা? আরে বাবা পেটে সয় না রুচি রোগ। কী বলব ব্যাচেলর লাইফ! ডিমের জোরে বেঁচে আছি তাতেও বাজারে হাত লাগান যায় না।

মকর আলীর হাতভর্তি টাকা। এক দুই তিন সিট পরে মেহজিনের সিটের কাছাকাছি দাঁড়ায়? তাজা ঘ্রাণ লাগে নাকে। নারী শরীর? গন্ধ শুঁকে আন্দাজ করে পুরুষ না মেয়ে। জানাকথা মেয়েদের মন নরম, ফিরাবে না – আওয়াজ দিয়ে ওঠে। আপা কয়টা টাকা দ্যান, পেটে খিদে- সারাদিনেও খাইনাই, তলপেটে আগুন উড়ছে। টি-শার্টের নিচটা উঁচিয়ে ধরে মকর আলী। ভাঁজপড়া পেট, মনে হচ্ছে শেকলবাঁধা। গরিবের পেটে শেকলটানা থাকে। মনে কষ্ট পায় মেহজিন।

মুঠের ভেতর ১০০ টাকা নেয় মেহ্জিন। বলে, পঞ্চাশ টাকা দাও! মকর আলী পকেট হাতায়, বাম পকেটে হাত দিয়ে জিবে কামড় দেয়। ডান-বাম, ডান-বাম পকেটে, পেছনের পকেটটা ঘনঘন হাতড়াতে থাকে। চুপ হয়ে যায় মকর আলী। চোখের কোণে গাঢ় জল জমে, ঝপাঝপ জলের ফোঁটা ঝরতে থাকে।

বৃষ্টি থেমে গেছে। রাস্তায় অফিস-ফেরত মানুষের ভিড়, গাড়িভর্তি মানুষ, তবুও কন্ট্রাক্টর কয়-সিট খালি, সিট খালি! এবং হাতের ঢেউ দেখায়। মানুষ মনে করে এ্লিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। সব মিছা, খালি আর কই, গাদাগাদি মানুষ, মাথা গোনা মুশকিল। তবুও কয় আর চেঁচায়, মানুষও ওঠে আর নামতে থাকে। সিটের কোণে হাত ঠেকিয়ে মাথা নিচু করে কাঁদে মকর আলী। সিটেবসা যাত্রীদের চোখ সরে না; অনুতাপ জমে।

কুত্তা! ওরে কুত্তা! বলে চিৎকার করে মকর আলী। রুমির মনটা ভেঙে যায়। দুহাতে তাকে ধরার চেষ্টা করে এবং বলে, ওই কুকুর কোথায়?
পেছনের সিটে বসা কিসিঞ্জার টাইপের লোকটা কয়, কুকুরেরা দল বেঁধে সমুদ্রে গেছে। গরমে কুকুরের শরীরও তেতে উঠেছে। শহরে কুকুর নেই। পকেটের কাপড়টা টেনে টেনে মকর আলী কয়, ক্যামনে এমন হইলো। দু’চারজন তার পকেটে টাকা দিতে চেষ্টা করে, সে বারবার নিষেধ করে তবুও জোর করে কেউ কেউ।

গাড়িটা থামে তারগাছ স্টেশনে। গাছের নাম দেখে রুমি গাছ খুঁজতে থাকে। কোথাও গাছ নেই কিন্তু হরেকরকম তার পেঁচিয়ে পথের খাম্বাগুলো পাতার মতো ঢেকে গেছে। লোকেরা ধরে নেয় জায়গাটার নাম তারগাছ। শহরে গাছ কম খাম্বাগুলোই একেকটা গাছ। কারণ মানুষের আবাসস্থলে আলো-হাওয়া পৌঁছাতে এগুলোর বিকল্প নেই।

গাড়ির গতি কম। নিচে একটা উদোম ছেলে জানালার পাশঘেঁসে হাঁটছে। দৃষ্টি মেহজিনের দিকে। মেহজিনের সেলটা তখন কানে, কল করেছে তনু। সে তারগাছ স্টেশনে অপেক্ষা করছে। নুহাশ পল্লী যাবে দু জন। কতদিন গল্প হয়নি দুজনের। কথাগুলো জমে জমে শুকিয়ে যাচ্ছে। এদিকে, এদিকে, বলে চেঁচাচ্ছে মেহজিন কিন্তু তনুর দেখা নেই। কে শোনে কার কথা, বাসের লোকজন বিরক্ত, মেয়ে মানুষের গলা। একইসঙ্গে কয়েকজন বলে ওঠে, চেঁচাও ক্যান, যত্তসব!

জানালার পাশে হাত বাড়ায় ছেলেটি, রুমির নজর পড়ে ছেলেটির ভাঁজপড়া কব্জির দিকে। মোবাইলে হাত বাড়াতেই রুমি ‘কুত্তার বাচ্চা’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে। বাসের যাত্রীরা একযোগে আবার পেছনে তাকায়। মেহজিন ঘনঘন হাঁফাচ্ছে, হাত নাড়ছে, ছটফট করছে। রুমির হাতে জলের বোতল, অর্ধেকটা খেয়ে বাসে উঠেছে সে। মেহজিনের হাতে বোতলটা দিতেই জানালা বরাবর দাঁড়ায় তনু। কত বাসের জানালা পরীক্ষা করেছে সে। কমন পড়ছে না; এবার ঠিকাছে। দৃশ্যটি তাকে আহত করে, সন্দেহের চাকা ঘুরতে থাকে। পেছনে হাঁটতে থাকে তনু। কোমড়ে দুহাত রেখে ঘনঘন ভ্রু কুঁচকায়, ভাঁজ পড়ে কপালের ওপর। একসেকেন্ডও অপেক্ষা করে না আর। মেহজিন মায়া হাতে ইশারা করছে, কিন্তু তনু না দেখার ভান করে এবং দ্রুত এড়িয়ে যায়। মানুষের ভিড়ে তনুর জুতাগুলো দেখা যায়। শাদাজুতা বৃষ্টিজলে কিছুটা আবছা, কিন্তু অচেনা নয়- চেনা মানুষের পা। তনু খুব চেনা মানুষ, চলে গেল… চলে যায়…

রুমি বিব্রত হয়ে বাসের দরজার দিকে ছুটে যায়। কী অদ্ভুত! এজন্যই আজকাল মানুষের উপকার করে না মানুষ। একটু ধন্যবাদও দেয় না; আজিব মেয়ে। দু-হাত এগিয়ে আবার পেছনে তাকায়। মেহজিনের চোখে জল টলমল করছে। নিজের কাছে লজ্জা লাগে- পুনরায় জিজ্ঞেস করে। আপনি ঠিক আছেন? আগুনচোখে তাকায় মেয়েটি। কী ঘোর বিপদ মেয়েটির! বাসের শেষ যাত্রী রুমি ও মেহজিন। বাসটি ঘুরবে কন্ট্রাক্টর বারবার তাড়া দিচ্ছে। রুমি বাম পা দিতেই হেলপার মুখ নাড়ে- কী মামা? শেষমেশ কাঁদিয়ে ছাড়লেন।

মেহজিন ততক্ষণে পঞ্চাশ গজ ধেয়ে যায়। রুমি চমকে তাকায় কিন্তু মেহজিনের চিহ্নও দেখতে পায় না। গাড়িটা মোড় নিতেই হেলপার নিজের পকেটটা বারবার চাপ দিতে থাকে, কিন্তু পকেটটা বারবার ফুলে ওঠে আরো। রুমির কানে আসে, যাহ্ শালা!

রুমির প্যান্টটা ততক্ষণে ঝুলে গেছে। যাত্রীর ভিড়ে কিছু ঠিক থাকে না; টান দিয়ে হাঁটতেই সম্মুখে পা বাড়ায় অগত্যা…

আমার গল্প লেখা

জীবনই একটা দীর্ঘগল্প। চলার পথে হরেকরকম মানুষের সঙ্গে দেখা হয়-কথা হয়। সুখ-দুঃখ জোড়কাহিনির মধ্যে দুঃখের কাহিনি বেশ মনে থাকে। আঁচড় কাটে দেহের শিরা উপশিরায়। রক্তবিন্দুতে ঝড় ওঠায়। নিজেকে দমিয়ে রাখা হয় কারণ সহজ জীবনে জটিলতার বসত থাকা স্বাভাবিক। গল্পরা যদি না ভিড় করে তাহলে কালি ও কলমে বিঁধব কী? পুঁজি করব কী? এভাবেই জীবনের বাঁকে বাঁকে বহুগল্প জমা হতে থাকে। ভাবনার উদ্রেক হতে থাকে। প্রথম যখন লেখার জন্য কলম ধরেছিলাম তখন কবিতাচর্চা করতাম, যা ছিল প্রথম সাহিত্যচর্চা। চারপাশে সঙ্কট, সমস্যা, পরিবেশ ও সামাজিক দীনতা দেখে হঠাৎ মনে হলো কবিতাগুলো মানুষের হয়ে উঠছে না; কাঁচাকথায় পর্যবসিত হচ্ছে মাত্র। কালসীয় মানা নানান জটিলতায় পূর্ণ। মাটি ও মানুষের জীবন নিয়ে ভাবা দরকার। ভাবতে ভাবতে একদিন মনে পড়ে ব্যাক বেঞ্চের বালিকার কথা। যে মেয়েটি আমার সহপাঠী, তার বাবা সামান্য শিক্ষক। গ্রামীণ জনপদে বেড়ে ওঠা সংসারে আয়ের স্বল্পতা তার জীবন স্বপ্নকে বাধাগ্রস্ত করেছে। যেনতেনভাবে সংসার চলত তাদের। ঠিক আমাদের সংসারটা যেমন টানাপোড়েনের মধ্যে ছিল। মেয়েটি এখন ভালো কিছু করছে। শহরে বাস করে। শিক্ষাবিভাগের কর্মকর্তা। ভালো ফলাফল করেছিল মেয়েটি কিন্তু সামনের সারিতে কখনো তাকে দেখা যেত না; বিপর্যস্ত জীবনের জন্য লজ্জা পেত। তবু সবকিছু ছাপিয়ে ভালো ফলাফল করে মেয়েটি। ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। পড়াশোনা শেষে আজ সফল মানুষ। এ আমার বাস্তবে দেখা কাহিনির অংশবিশেষ। তা দিয়ে গল্প লিখতে শুরু করি। আমাদের চারপাশে এমন কাহিনি অপ্রতুল। খ্যাতি চড়ানোর চেয়ে মানুষের কথা উপস্থাপন করা বেশি প্রয়োজন। জীবন ছোট, এখানে বৃহৎ কাজ রেখে যাওয়াই উদ্দেশ্য। লেখক একটি প্রতিষ্ঠান, যাতে বহুমানুষের চিন্তা, রুচি ও বোধের সমাবেশ ঘটে। চারিত্রিক দৃঢ়তা রেখে দেশীয় জনগোষ্ঠীর জীবন-আখ্যান তুলে ধরে সাহিত্য নির্মাণ প্রধান বৈশিষ্ট্য মনে করি। সবসময় নৈতিক ও মানবিক দিকটিকে গুরুত্ব দেই। এ বিষয়ে অবিরাম সরব থাকার চেষ্টা রয়েছে। সরব ও সত্য উচ্চারণ লেখকের ধর্ম হলেও সাম্প্রতিক সময়ে তা কোণঠাসা।

নানা পথ তৈরি হয়ে বহুধারায় বিভক্ত। সে-কারণে লেখকদের অবস্থান ও সম্মান কম। লেখাকে, যুক্তিকে সত্যকে নির্বাসন দিলে লেখার মুক্তি ঘটে না; কলম নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। যে দেশে চিন্তা ও কলম নিয়ন্ত্রিত হয় সে দেশে আগাছা বৃদ্ধি পায়। ভবিষৎ সঙ্কট ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। আছড়ে পড়ে সভ্যতা ও জ্ঞানের এ্যাপার্ট। লেখকের চিন্তাজগৎ থাকবে মুক্ত ও স্বাধীন। নিরপেক্ষভাবে জনজীবনের উপাদান সংগ্রহ করে বদলে যাওয়ার বাণী শোনাবেন লেখক। গল্পভূমিতে আমার উপস্থিতির স্বাক্ষর রাখার ইচ্ছে ও আত্মবিশ্বাস তীব্র। চেষ্টা করছি শক্ত গল্পজমিন তৈরি করার, ভূমি-সংলগ্ন মানুষের জীবন নিয়ে খুব সময় দিচ্ছি। রাবীন্দ্রিক চিন্তা, বিভূতিভূষণের জনপদ ধারণা আমাকে তাড়া করে তবে আমার গল্পের সমীক্ষা হিসেবে মানিকীয় ভাবধারাকে বেশি অনুধাবণ করি। প্রসঙ্গত শিল্পসৃষ্টির প্রধান বিষয় স্বাতন্ত্রবোধ, এমন ভুবন নির্মাণে আমি প্রয়াসী।

গল্পেভরা জীবনে গল্পরা ভিড়তে শুরু করে। শব্দ পারদর্শিতা দিয়ে মানবজীবনের স্বরূপ সন্ধানে সময়ের সাক্ষী হওয়ার ইচ্ছে প্রবল হয়ে ওঠে। রক্তেমাংসে মানুষ ও প্রকৃতির সঙ্কট, সামাজিক অবক্ষয়, অস্তিত্ব সংগ্রাম, মানস বিদ্রোহ, বাংলার প্রাকৃত জীবনাচার, মানবকৃতী, সমাজ দর্পণের প্রতিবিম্বিত চেহারা অনুধাবন করা লেখক চরিত্রের প্রধানতম নেশা। গল্পের মাঝে সীমাবদ্ধ না থেকে বৃহৎগল্প ভাবনার ক্ষেত্রে উপন্যাসে পরম্পরাগত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। উপন্যাসের ক্যানভাস বিশাল, এখানে বহুচরিত্র দিয়ে সাজানো যায় জীবনের আভাস। মূলত এই দিকটি নিয়েই অগ্রসর হব।

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field
    X