কথাসাহিত্য ছোটগল্প বিশেষ সংখ্যা

এক রাত্রির বয়ান | শিল্পী নাজনীন | ছোটগল্প | উৎসব সংখ্যা ২০২৪

গল্প : শিল্পী নাজনীন | আলোচনা : শায়লা সুলতানা

মকবুল! এই মকবুল!
চৌকির থেকে খানিক দূরে, দরজার কাছ ঘেঁষে প্রায় দলামোচড়া হয়ে শুয়ে থাকা মকবুলের দিকে তাকিয়ে আতঙ্কিত গলায় মাঝরাত্তিরে চেঁচিয়ে ওঠে হেলি। এইমাত্র দেখা স্বপ্নটা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে পুরোপুরি। তরাসে বুক ধুকপুক করে তার। ক্ষণিকের জন্য তার মধ্যে তৈরি হয় বিভ্রম। নিজের ঘরটাকে খোলা ময়দান মনে হয়। ঘরে জ্বলা টিমটিমে হারিকেনটাকে মনে হয় নীলের হাতে জ্বলতে থাকা পাঁচ ব্যাটারির টর্চ। শোয়া থেকে লাফ দিয়ে উঠে বসে সে। দরজার কাছে শুয়ে থাকা মকবুলকে দেখে আশ্বস্ত হবে, না কি ভীত, ভেবে ঠাওর করতে পারে না কিছুতেই। সে তারস্বরে আবার চেঁচায়, মকবুল! এই মকবুল!
কিন্তু হারামজাদা মকবুল অন্যান্য রাতের মতোই মরার ঘুম ঘুমোয় আজও। প্রায় রাত্তিরেই জেগে থাকতে হয় বলে কোনো রাতে একবার ঘুমোনোর মওকা পেলে মকবুল মরার মতো ঘুমোয়, সহজে তাকে জাগানো যায় না আর। অগত্যা তাকে ডাকা বাদ দিয়ে ঘরের এককোণে উপুড় করে রাখা কাঁসার গ্লাসটা টেনে নিয়ে জগ থেকে পানি ঢালে হেলি। ঢকঢক খায়। পানি তো নয় যেন বরফ নামে গলা দিয়ে। জন্মের টালা। এবার শীতটাও পড়েছে জব্বর। হেলিকে কাঁপিয়ে দেয় পুরো। স্বপ্নটা তখনো মাথার ভেতরটা দখল করে রাখে, ভাবনায় তালগোল পাকিয়ে অস্থির করে তুলতে থাকে তাকে। গিলে ফেলতে চায় একদম। কিন্তু এই স্বপ্নটা কেন দেখল সে? এর অর্থই বা কী? ভেবে আরো আতঙ্ক ভর করে মনে। তার শত্রুর অভাব নাই এই এলাকায়, সে-কথা সত্যি বটে, হেলি নিজেও খুব একটা সহজ পথের যাত্রী নয়, সে-কথাও মানুষের মুখে মুখে রটে, তা বলে তাকে শাস্তি দেওয়ার সাহসই-বা কজন রাখে এই তল্লাটে! মাথার কাছে খুলে রাখা চায়না হাতঘড়িটা টেনে নিয়ে সময় দেখে হেলি। বারোটা বেজে দশ। শীতের দিনে গাঁওগেরামের মানুষ সন্ধ্যা নামতেই না নামতেই ঘুমোতে যায়। এই বিজন চরে হেলি ঘুমোয় আরো আগে। কালও সূর্য ডুবতে না ডুবতেই ঘুমিয়েছে সে। আজ তার ওঠার কথা রাত দুটোয়, আরো পাক্কা একঘণ্টা পঞ্চাশ মিনিট পরে। অথচ ফট করে এই নালায়েক স্বপ্নটা কি-না জাগিয়ে দিল তাকে। এখন আর তার চোখে ঘুম আসবে না সহজে। এখন ঘুমোলে আবার সময়মতো ওঠাও কঠিন হবে তার পক্ষে। মকবুলকে হাজার ডাকলে, এমন-কি তার ওপর দিয়ে ট্রাক্টর চালিয়ে দিলেও এখন উঠবে না বেকুবটা। বেত্তমিজটার দম দেওয়া শরীর। দুটোয় উঠতে হবে বলে ঘুমিয়েছে, ঠিক দুটোয়ই আচানক জেগে উঠবে সে। পোষা কুকুরের মত হেলির পায়ের কাছে বসে চোখ ডলতে ডলতে বলবে, চলেন উস্তাদ, যাই!
মকবুলের এই ব্যাপারটা ভারি আশ্চর্য লাগে হেলির। যত ভাবে, ততই আটাশ হয় সে। একজন মানুষ এমন দম দেওয়া পুতুল হয় কী করে, ব্যাপারটা তার মাথায় ঢোকে না একদম। হেলির নির্দেশের বাইরে এক পা নড়ে না মকবুল। দুটোয় উঠতে বললে ঠিক দুটোয়ই উঠবে সে ঘুম থেকে, তার আগে যতই ডাকা হোক তাকে, এমন-কি চোখও মেলবে না সে, কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমোবে, পৃথিবী ততক্ষণে রসাতলে গেলেও সে জাগবে না, উঠবে তো না-ই। যে নির্দেশ মাথায় নিয়ে ঘুমোতে যায় মকবুল, ঠিক সেই নির্দেশ মাথায় নিয়েই জেগে ওঠে সে। মধ্যবর্তী কোনো নির্দেশকে আমলে নেয় না তার অনুর্বর মস্তিষ্ক। হেলির বড় আজব লাগে এই মকবুলকে।
দলের বাকিরা আসবে দুটো বাজার পাঁচ/দশ মিনিট আগে। আজ তাদের মিশন আছে ক্রোশ তিনেক দূরের এক অজপাড়াগাঁয়ে, ক্যাসেট হাজীর বাড়িতে। ক্যাসেট হাজী নামটা জাঁহাই আগ্রহ জাগানিয়া। অল্প কদিনেই বিরাট জনপ্রিয়তা পেয়েছে নামটা তল্লাটজুড়ে। হজ্জে গিয়ে বেআক্কেল লোকটা নাকি তার বহুকালের হাউস মেটাতে ক্যাসেট কিনে দেশে ফিরেছে, ফলে তার নিজের বাপ-দাদার নামটা মুছে গিয়ে ক্যাসেট হাজী নামটাই চাউর হয়ে গিয়েছে পুরো এলাকায়। এখন তাকে সবাই চেনে ক্যাসেট হাজী নামে। নাম কয় আর আড়ালে মুখ টিপে হাসে লোকে। বেকুব লোকটার তবু অহংকারের চোটে মাটিতে পা পড়ে না প্রায়। লোকটা জীবনে টাকা-পয়সা কামিয়েছে ঢের, হাজী তকমাও বাগিয়ে ফেলেছে পয়সার জোরে, এখন আর তার অতিরিক্ত বিষয়-সম্পত্তির প্রয়োজন কী! মাসখানেক আগে হেলি তাই ক্যাসেট হাজীর বাড়ির ঠিকানায় উড়োচিঠি পাঠিয়েছে, দিন-তারিখ উল্লেখ করে তার বাড়িতে ডাকাতি করতে যাওয়ার আগাম খবর জানিয়ে রেখেছে। টাকা-পয়সা, গয়নাগাটি সব রেডি রাখতে বলেছে সে চিঠিতে, সেইসাথে পুলিশকে জানাতে পই পই করে নিষেধ করে দিয়েছে। পুলিশ খবর পেলে বড় ঝামেলা করে এসব কাজে। ফলে পুলিশকে একবারেই সহ্য হয় না হেলির। একদমই না-পছন্দ তার ওই খাকি পোশাক পরা বজ্জাতগুলোকে। সে ডাকাত, সে কথা সত্যি বটে, তবু তারও ধর্ম আছে। সমাজে যাদের অতিরিক্ত টাকা-পয়সা আছে, তাদের ঘরেই ডাকাতি করে সে, সেই অর্থেই তার দিন চলে ঘষে-মেজে। তাতে পুলিশের বাপের ক্ষতিটা কী? অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না, বেদরকারী জিনিসমাত্রই বেহুদা ঝামেলা, সেই ঝামেলাকে নিজের কাঁধে নিয়ে বরং সমাজের উপকারই করে চলে হেলি। কিন্তু বজ্জাত পুলিশগুলো বড়ই বেবুঝ। তারা খবর পাওয়া মাত্রই সরোষে হামলে পড়ে, বেহুদা হুজ্জত করে। হেলিকে চৌদ্দশিকের মধ্যে পুরে অতিরিক্ত ঝামেলা নিজেরা বগলদাবা করার মতলবে ফিকির আঁটে। ওসব দিগদারি মোটেই বরদাশত করতে পারে না হেলি।
আজ অমাবস্যা। অগ্রহায়ণের শেষাশেষি। হু হু উত্তুরে হাওয়া বয়। গাঢ় অন্ধকার এই শীতে কাঁপা চরটাকে কী যেন এক গভীর রহস্যময়তার চাদরে ঢেকে দিতে চায়। হেলির মনটা বড় চঞ্চল হয়ে ওঠে। কী যেন একটা কথা মনে পড়তে গিয়েও পড়ে না। আজ মাঝ-রাত্তিরেই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। আজ সদলবলে ক্যাসেট হাজীর বাড়িতে ডাকাতির উদ্দেশ্যে হামলা করবে তারা। কিন্তু দলের বাকি সদস্যদের আসতে এখনো ঢের দেরি। ততক্ষণ কী করবে ভেবেই পায় না হেলি। শীত শীত লাগে খুব। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করে ভীষণ। স্বপ্নটা আবারও খোঁচা দেয় ভাবনায়। মনের ভেতর কু ডাকে কেমন। এমন স্বপ্ন সচরাচর দেখে না সে। বেছে বেছে আজই কেন স্বপ্নটা দেখতে হলো তাকে? প্রশ্নটা নিজেকে করে নিজেই আবার বিরক্ত হয়ে ওঠে হেলি। ফস করে ম্যাচ জ্বালিয়ে কায়দা করে বিড়ি ধরায়। বারান্দায় গিয়ে বসে আয়েশ করে টানে। আকাশে আজ চাঁদ নেই, গাঢ় অন্ধকার। ঘোর অমাবস্যা। ইচ্ছে করেই আজকের তারিখটা ঠিক করেছে সে, এসব কাজে অন্ধকারই ভালো। যত অন্ধকার, তত লাভ। অন্ধকারকে মানুষের ভয় সেই আদ্যিকাল থেকে, মানুষ তার অন্তরের গভীরে নিজের অজান্তেই বহন করে চলে এই ভয়। অন্ধকার দেখলেই তাই মানুষ শিউরে ওঠে, ভেতরে ভেতরে আতঙ্কে অস্থির হয়ে যায়, তখন মানুষ হিসেবে ভুল করে, ছল করতে ভুলে যায়। তখন স্বাভাবিক বোধ, বুদ্ধি, যুক্তি কোনোটাই কাজ করে না তার মধ্যে। হেলির উদ্দেশ্যও তাই। মানুষকে ভয় পাইয়ে দেওয়া, মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা। তখন মানুষ ভয়ে দিশেহারা হয়ে হেলির আদেশমত কাজ করে। অনেকটা দম দেওয়া মকবুল হয়ে যায় তখন মানুষ। যেখানে যা সম্পদ থাকে, বের করে দেয় চাওয়ামাত্রই। বিশেষ করে যাদের বাড়িতে অবিবাহিত যুবতী মেয়ে থাকে, তারা ভয়ে আধমরা হয়ে আদেশ পালন করে মুহূর্তেই। যদিও হেলি ডাকাত হলেও বাঁধাধরা কিছু নিয়ম মেনে চলে কাজের ক্ষেত্রে। দলের প্রত্যেককে কড়া বার্তা দেওয়া আছে তার, কিছুতেই কোনো অপারেশনে গিয়ে ‘মেয়েছেলে’দের বেইজ্জত করা চলবে না। এ ব্যাপারে অত্যন্ত কঠিন নিয়ম চালু আছে তার দলে। ডাকাতি করতে গিয়ে কেউ ভুলেও কোনো নারীর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করলে কিংবা বেইজ্জতি কাজ করলে তাকে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়। প্রয়োজনে জীবন নিতেও কুণ্ঠা করে না হেলি। এ নিয়ে দলের উঠতি বয়সী সদস্যদের মধ্যে সে হালকা ক্ষোভ টের পায় বটে, কিন্তু ওসবের তোয়াক্কা বড় একটা করে না হেলি। আরো একটা নিয়ম চালু আছে তার দলে, নিজের গ্রামে, চেনা পরিচিত মানুষের বাড়িতে, কখনো ডাকাতি করতে যায় না হেলি, সে যত বিত্তশালী পরিবারই হোক।
এখন অগ্রহায়ণের শেষাশেষি। বড় রাত। নদীর বুকের ওপর সদ্য গজিয়ে ওঠা চরটায় শনের ঘরের অস্থায়ী আবাসে সে থাকে আজকাল। লোকালায় থেকে বহু দূরের নির্জন এই চরে একটামাত্র ঘর। চারদিকে ধূ ধূ বালুচর আর মরে আসা নদী। শীতের উত্তুরে হাওয়ায় ভাসা এই আবাসে সে আছে নিজের এবং দলের নিরাপত্তার জন্য। নদীতে পানি নেমে গেছে অনেকটাই। যতদূর চোখ যায় অসীম শূন্যতা, কোথাও কোনো শব্দ নেই, গভীর নির্জনতা, চরাচর জুড়ে ছড়িয়ে আছে এক অপার্থিব নৈঃশব্দ্য। থেকে থেকে উত্তুরে হাওয়া বইতে থাকে ধীরে। নদীতে কুয়াশার গাঢ় সর। খানিক দূরের দৃশ্যও অস্পষ্ট দেখায়, ঝাপসা। এবার এই অগ্রহায়ণেই শীত নেমেছে বেশ। তবু নদীর এই সদ্য গজানো চরেও রাতে বড় মশার উৎপাত। শনে ছাওয়া কুঁড়েটার বারান্দায় অন্ধকারে বসে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে পড়ে অগত্যা হেলি। শীতটাও কাবু করে তোলে তাকে। হাতের ফুরিয়ে আসা বিড়িটায় শেষ টান দিয়ে ছুড়ে ফেলে সে অদূরে। পা দিয়ে পিষে আগুনটা নিভিয়ে দেয় অভ্যাসবশে। আকাশে তাকায়। অন্ধকার। কালপুরুষ জ্বলছে আকাশের উত্তরকোণে। ছড়ানো ছিটানো একটা দুটো তারা অমাবস্যার আকাশকে উজ্জ্বল করতে পারেনি মোটেই, বরং অন্ধকারটাকেই যেন ঘন করে তুলেছে আরো। ঘরের বারান্দার নিচে, ডোয়ার ধারে ভুলু হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমুচ্ছে। নিশ্চিন্ত, নির্ভার। স্বপ্নটা মনে পড়ে আবার হেলির। স্বপ্নে ভুলুও ছিল। স্বপ্নে তারস্বরে চিৎকার করতে করতে তার দিকে ছুটে আসছিল ভুলু। অদ্ভুত। স্বপ্নটার অর্থ জানতে পারলে বেশ হত। কিন্তু এই রাতে কে আর স্বপ্নের অর্থ ব্যাখ্যা করতে আসবে তাকে, তারচেও বড় সমস্যা হলো, রাতের বেলা স্বপ্নের কথা নাকি কাউকে বলতে নাই, তাতে ঘোর অমঙ্গল হয়। তাছাড়া ভোর রাতের স্বপ্ন সচরাচর সত্যি হয় বলে শুনেছে সে, এখন মাঝরাত, এই মাঝরাত্তিরে দেখা স্বপ্ন সত্যি হওয়ার আশঙ্কা তাই একদমই নাই। কাজেই আপাতত স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানার আশা আর বুকের ভেতর হামাগুড়ি দিতে থাকা অস্বস্তিটা ত্যাগ করে অপারেশনে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে থাকে হেলি। ড্যাগারটা গুঁজে নেয় কোমড়ের একপাশের পোশাকের আড়ালে। অন্যপাশে ছুরি। ঘড়ি দেখে আবার। দুটো বাজতে খুব একটা দেরি নাই। দলের বাকিরাও অচিরেই এসে পড়বে একে একে। তিন ক্রোশ পথ ঘোড়ায় চড়ে যেতে বেশিক্ষণ লাগবে না তাদের। তাছাড়া এখন রাত অনেক বড়, কাজও বেশিক্ষণের নয়। চিঠি দেওয়া আছে, অভিজ্ঞতা থেকে হেলি জানে কোথাও কোনো গড়বড় হবে না, গিয়েই বাড়ির পুরুষ সদস্যদের শক্ত করে বেঁধে ফেলতে হবে। নারী আর শিশুদের একঘরে আটকে রেখে বয়স্ক একজনকে দায়িত্ব দিতে হবে যেখানে যা আছে, সব বের করে দেওয়ার। ঢালস্বরুপ একজন শিশু আর নারীকে নাগালের মধ্যে রেখে তাদের দিকে ছুরি তাক করে রাখতে হবে। দলের প্রত্যেকের মুখ থাকবে কালো কাপড়ে বাঁধা। কথা বলবে হেলি একা, যতটুকু না বললেই নয় ততটুকু, অপারেশন চলাকালে দলের আর কারো কথা বলার অনুমতি নেই।
আজকের অপারেশনে মোট ছয়জন যাবে তারা। হেলি তৈরি হওয়ার খানিক বাদেই একে একে দলের বাকি চারজন সদস্যও এসে পড়ে, দুটো বাজতে না বাজতেই মকবুলও তড়াক করে উঠে বসে দুচোখে গভীর বিস্ময় নিয়ে চোখ ডলে খানিকক্ষণ, তারপর হেলিকে উদ্দেশ্য করে বলে, চলেন উস্তাদ, যাই।
দলে ঘোড়া চারটে। একটা ঘোড়া দলনেতা হিসেবে হেলির দখলে। বাকি তিনটেয় ভাগাভাগি করে মকবুল আর অন্যরা সওয়ার হয়ে যায়। নদীর কোমরসমান জলে নেমে ঘোড়াগুলো তাদের পিঠে নিয়ে দিব্যি হেঁটে মৃদু স্রোত উজিয়ে ডাঙায় উঠে পড়ে। নদীর জলের মধ্যে ঘোড়ার চলার শব্দ রাতের নির্জনতাকে নিমেষে খুন করে ছন্দ তোলে দারুণ। অল্প পরেই নদী পেরিয়ে গাঁয়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে দলটা। গ্রামের মেঠো পথ ধরে টগবগিয়ে ছোটে। গাঁয়ের মাঝরাত্তিরের মগ্ন নির্জনতাকে চিরে দিয়ে ঘোড়ার খুরের টগবগ শব্দ ওঠে জোর। দলের সবাইকে যার যার ভূমিকা ভাগ করে দেওয়া আছে, ফলে কোনো উচ্চবাচ্য হয় না একদম। আগে থেকেই রেকি করা ছিল পুরো এলাকা। ক্যাসেট হাজীর বাড়ির কাছের ঘন জঙ্গলের আড়ালে ঘোড়াগুলো নিয়ে তাই থেকে যায় মকবুল। দলে তার একমাত্র কাজ ঘোড়া পাহারা দেওয়া। মকবুল তার কাজে লেগে যায়। বাকিরা পায়ে হেঁটে পৌঁছে যায় ক্যাসেট হাজীর বাড়ির ফটকে। পুরোনো আমলের কাঠের ফটক। হালকা ধাক্কা দিতেই ক্যাঁচক্যাচ শব্দ তুলে খুলে যায় অনায়াসে। হেলি তার দলবল নিয়ে সটান ঢুকে পড়ে বাড়ির চৌহদ্দির ভেতর। ভয়ডর নাই তার। এই লাইনে ভয়ডর থাকলে চলে না। বুকের পাটা যার যত চওড়া, এ লাইনে তার সাফল্য তত বেশি। আর আল্লার অশেষ মেহেরবানিতে এ তল্লাটে এ কাজে হেলির ধারেকাছেও কেউ নাই। মাঝে মধ্যে পার্শ্ববর্তী এলাকার নীল ডাকাত তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার চেষ্টা করে বটে, তবে ওই চেষ্টা পর্যন্তই। হেলিকে হারানো অত সহজ নয়, সে-কথা জানে নীল নিজে এবং তার লোকজন। যতটা সময় লাগবে ভেবেছিল, তারচে ঢের সহজে এবং কম সময়েই অপারেশন শেষ হয়ে যায় তাদের। ক্যাসেট হাজী এবং তার বাড়ির লোকেরা সব ভীতুর ডিম একেকটা। ভয়ে দিশেহারা হয়ে তারা চাওয়ামাত্রই সব বের করে দেয় হেলিদের হাতের নাগালে। ফলে প্রায় বিনাবাক্যব্যয়ে অপারেশন শেষ হয়ে যায় তাদের। উপার্জনও নেহাৎ কম হয় না এ যাত্রায়। নগদ টাকা আর গহনা মিলিয়ে একেবারে কম নয়। বেশ কিছুদিন ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাং তুলে আরামসে চলে যাবে। সুতরাং আর দেরি না করে তারা অপেক্ষারত মকবুল আর ঘোড়াগুলোর দিকে ঊর্ধশ্বাসে ছুট লাগায়। জঙ্গলের ধারে ঘোড়াগুলোর দেখা পাওয়ামাত্রই লাফিয়ে সেগুলোর পিঠে উঠে সপাং চাবুক বসায় জোরে। হেলিদেরকে পিঠে নিয়ে ঘোড়াগুলোও ফিরতি পথ ধরে টগবগিয়ে ছোটে আবার। অন্ধকার হলেও চেনা পথ, সমতল ভূমি। ফুরিয়ে আসে অল্পক্ষণেই। সামনেই কুয়াশায় ডুবে যাওয়া নদী, রাতের অন্ধকারে শরীর বিছিয়ে আছে, ঝাপসা, ধোঁয়াটে। আগের মতোই নদী পেরোয় তারা। নদী পেরিয়ে চরে ওঠে নির্বিঘ্নে।
তারপর কী যেন কী ঘটে যায় মুহূর্তেই। লহমায় পাল্টে যায় দৃশ্যপট। কুয়াশায় ঢাকা চারদিক, অল্প দূরের দৃশ্যও ঠাওর করা যায় না স্পষ্ট, তার মধ্যেই বিদ্যুদ্বেগে কোত্থেকে এলোপাথাড়ি গুলির শব্দ আসে, হেলি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘোড়া থেকে ছিটকে জলে আছড়ে পড়ে মকবুলসহ বাকি চারজন। ঘোড়াগুলো শূন্যে দু পা তুলে চিঁহিহি ডাক ছেড়ে এলোপাথাড়ি ছুট লাগায় সামনের দিকে। আকস্মিক এই দুর্গতিতে কাণ্ডজ্ঞানশূন্য হয়ে হেলি লাফিয়ে জলে পড়ার চেষ্টা করে তৎক্ষণাৎ, কিন্তু তার আগেই হঠাৎ তাকে ঘিরে ধরে জনাকয়েক কালো মুখোশে ঢাকা লোক, ঠিক স্বপ্নে দেখা নীলের পাঁচ ব্যাটারির টর্চের আলোর মতো তীব্র আলো এসে আছড়ে পড়ে তার চোখে, তাকে অন্ধ করে তোলে প্রায়। লোকগুলো নীরবে টেনে-হিঁচড়ে তাকে নামিয়ে ফেলে নিচে। নিচে ফেলেই হেলির হাত-পা বেঁধে ফেলে শক্ত করে। অন্ধকারে কাউকেই চিনতে পারে না হেলি। আচমকা আতঙ্কে জমে যায় সে। তখনই ভুলে যাওয়া স্বপ্নটা ঝুপ করে মনে পড়ে তার। চরের নির্জনতা চিরে সে চিৎকার করে ওঠে জোরে। ভুলুর গর্জনও হেলির কানে আসে তখনই। দূর থেকে ঘেউ ঘেউ করতে করতে ছুটে আসতে থাকে ভুলু। স্বপ্নটাও ঠিক এমনই ছিল। স্বপ্নে ভুলু চিৎকার করতে করতে তার দিকে ছুটে আসছিল, আর কতগুলো মুখোশধারী লোক তাকে ঘিরে ধরেছিল, তাকে জাপটে ধরে শক্ত কোনো আংটা চোখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে তুলে নিচ্ছিল তার দুটো চোখ। তীব্র আতঙ্ক নিয়ে বাস্তবে ফেরে হেলি। সে আবিষ্কার করে স্বপ্নটা আর স্বপ্ন নেই, সেটা এখন নিঃষ্ঠুর বাস্তবতা। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে জ্ঞান হারায় হেলি। রক্তাক্ত, জ্ঞানহীন হেলি পড়ে থাকে নির্জন নদীচরে। জনহীন সেই চরের সব নির্জনতার শরীরে কাঁপন ধরিয়ে ভুলু হেলিকে ঘিরে সমানে চিৎকার করে চলে। হঠাৎই উত্তুরে হাওয়া রাতের কুয়াশাকে নাড়িয়ে দিয়ে বইতে শুরু করে সবেগে।
মকবুল! এই মকবুল! চিৎকার করতে করতে আবার ঘুম ভাঙে হেলির। তীব্র শীতে কিংবা ভয়ে শরীর জমে আসে তার। দরজার কাছে কুকুরকুণ্ডলী পাকিয়ে মকবুলকে তখনো ঘুমোতে দেখে সে। মাথার কাছে রাখা চায়না ঘড়িটা নিয়ে সময় দেখে আবার হেলি। দুটো বাজতে দশ মিনিট বাকি। উঠে পড়ে হেলি। শব্দ করে বিছানা ছাড়ে। বাইরে গলাখাঁকারি দিয়ে বাকি সদস্যরা তাদের উপস্থিতি জানান দেয়। সেই শব্দে সচকিত হয় হেলি, সচেতন হয় অজান্তেই। মাথার কাছে রাখা ছুরিটা অতি সন্তর্পণে হাতে তুলে কোমরে গোঁজে সে। সাবধানের মার নেই। পৃথিবী কন্টকময়। বহুবিধ বিষাক্ত সরিসৃপ প্রতিনিয়ত হেঁটে চলে এখানে। কাউকে বিশ্বাস নাই। যে কেউ যে কোনো মুহূর্তে বসিয়ে দিতে পারে বিষাক্ত ছোবল। কাজেই সাবধান হয় হেলি। আজকের অপারেশন বাতিল করলাম, বাইরে গিয়ে দলের বাকি সদস্যদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় ঘোষণা করে সে। আচমকা তার এমন সিদ্ধান্তে আকাশ থেকে পড়ে উপস্থিত সবাই। বিস্মিত হয়ে এ ওর মুখের দিকে তাকায় তারা জিজ্ঞাসু চোখে। ততক্ষণে মকবুল উঠে পড়েছে। সে বেকুবের মতো চোখ ডলতে ডলতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে, হেলির দিকে তাকিয়ে বলে, চলেন উস্তাদ, যাই।

ছোটগল্প : এক রাত্রির বয়ান | গল্পকার : শিল্পী নাজনীন | আলোচক : শায়লা সুলতানা

গল্পটি পড়তে পড়তে কিশোরবেলার কোনো এক পড়ন্ত দুপুরের কথা মনে পড়ছিল। মায়ের পাশে শুয়ে মায়ের মুখে শোনা ঘটে যাওয়া এক সত্যিকারের ঘটনার দৃশ্যপট ভেসে উঠছিল চোখের সামনে। মায়ের কিশোরবেলায় ঘটেছিল সেই ঘটনা।

এক রাতে আমার নানাবাড়িতে একদল ডাকাত এসেছিল। তাদের সকলের মুখ বাঁধা ছিল কালো কাপড়ে। তারপর গল্পে বর্ণিত পন্থাটিই তারা অবলম্বন করেছিল। আরো মনে পড়ছিল আমার পরিচিত একজন স্বনামখ্যাত ডাকাতকে। ছেলেবেলায় আমরা যখন তাকে দেখতাম তখন তিনি বৃদ্ধ এবং ডাকাতি করার শক্তি নেই তখন। কিন্তু অভ্যাসবশত অথবা অভাবের তাড়নায় তিনি পরিচিত বাড়ি থেকে সুযোগ বুঝে টুকটাক চুরি করতেন। এমন অতীত এবং বর্তমান নিয়েও তিনি আমাদের কাছে শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। শুনেছি তিনি তার মাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করতেন। সবসময় বাইরে যাবার কালে মায়ের পায়ে সালাম করে যেতেন, এমনকি যখন ডাকাতি করতে বের হতেন তখনও।

একটি গল্প পাঠ করার সময় পাঠকের ভেতরে তার সুদূর অতীত এভাবে যে স্পষ্ট হয়ে উঠল, তার কৃতিত্ব নিশ্চয়ই গল্পলেখকের।

একজন ক্যাসেট হাজীর চরিত্রের মধ্য দিয়ে সমাজে বিরাজমান বিত্তশালী মানুষের চিত্তের যে দম্ভ, সে দম্ভকে বিচূর্ণ করে দিতে এমন ডাকাতেরই হয়তো প্রয়োজন হয়। পাঠক হিসেবে ক্যাসেট হাজীকে আমার কাছে দাম্ভিক পুঁজিবাদী ধনিক শ্রেণির একজন প্রতিনিধি বলে মনে হয়েছে। ডাকাত হেলির লক্ষ্য শুধু বিত্তশালীর কাছ থেকে জোরপূর্বক অর্থ নিংড়ে নিয়ে নিজের পেট চালানো। কাউকে খুন কিংবা নারীদের সম্ভ্রমহানি তার নীতিবহির্ভূত। আর একারণেই বোধকরি ডাকাতের তকমাধারী হেলির প্রতি পাঠকের সূক্ষ্ণ সহানুভূতি কাজ করবে, অন্যদিকে ক্যাসেট হাজীর প্রতি পাঠকের অনুভূতি বিপরীত স্রোতে প্রবাহিত হবে।

এই সমাজের উঁচুতে আব্রুহীন উচ্চ শিক্ষিত ডাকাতদের অবস্থান। তাদের নিয়ে পুলিশ বা আদালতের কোনো মাথাব্যথা নেই। এরকম সমাজে ডাকাতের মুখের কালোকাপড় যেন শিক্ষিত দুর্নীতিবাজদের জন্য শক্ত চপেটাঘাত।

শক্তি-সাহসের জোর থাকা সত্ত্বেও মানুষ তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে ভয় পায়। হেলি ডাকাতের কাছে তার প্রতিদ্বন্দ্বী নীল ডাকাতকে নিতান্ত তুচ্ছ মনে হলেও তার দুঃস্বপ্নের উদগাতা হয়ত নীল ডাকাতই। তবে অন্যায় পেশায় যুক্ত হেলির দুঃস্বপ্নটি যখন তাকে সেদিনের অপারেশন থেকে বিরত করে, তখন পাঠকমনে কিঞ্চিত আশার সঞ্চার হয় যে, হয়ত সে ভয়ংকর এবং ঝুঁকিপূর্ণ এই অন্যায় কাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবে। অন্যায়ের সাথে জড়িত থাকা মানুষের জীবনের করুণ পরিণতিরই ইঙ্গিত বহন করে হেলির দুঃস্বপ্নটি।

ডাকাতির কাজ সহজভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর হেলির উপর ভয়ঙ্ককর আক্রমনের বর্ণনা পড়তে পড়তে মনে হয়, যে-স্বপ্নটি দেখে তার মনে কু ডাকছিল, সেরকম একটি বাস্তব ঘটনাই বুঝি ঘটেছে। কিন্তু হেলি যখন মকবুলকে ডেকে ওঠে এবং পরে অপারেশন স্থগিতের ঘোষণা দেয়, তখন পাঠকের চমক ভাঙে। ঘটনাটি স্বপ্ন ছিল, বাস্তব নয়। এই স্বপ্ন ও বাস্তবের বিভ্রমকে গল্পকার চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এই গল্পে।

“স্বপ্নটাও ঠিক এমনই ছিল।”
“সে আবিষ্কার করে, স্বপ্নটা আর স্বপ্ন নেই। সেটা এখন বাস্তব।” এই বাক্য দুটো না থাকলে শেষ চমকটা পাঠকের কাছে নিঃসংশয় হত, একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে এমনটাই মনে হয়েছে আমার। ফলে, আমি পেছনে ফিরে গিয়ে গল্পটি আবার পড়েছি। আপনাদের মধ্যেও এরকম ঘোরলাগা একটা অবস্থা তৈরি হবে, পাঠক।

“আকাশের উত্তরকোণে ছড়ানো ছিটানো একটা দুটো তারা অমাবস্যার আকাশকে উজ্জ্বল করতে পারেনি মোটেই, বরং অন্ধকারটাকেই যেন ঘন করে তুলেছে।”

অমাবস্যার আকাশ, অন্ধকারের অনুষঙ্গ গল্পকে নতুন এবং শক্তিশালী মাত্রা দিয়ে সমৃদ্ধ করেছে। লেখক এখানেই সার্থক যে, গল্পটি পাঠ করার পর থেকে একটি ঘোরগ্রস্ততা কাজ করছে নিজের মধ্যে আর সেই সাথে দৃশ্যপটগুলো চোখের সামনে ভেসে ভেসে উঠছে।

ন্যারেটিভের দিক থেকে গল্পের জটিল বুনন, আকর্ষণীয় নিঃসন্দেহে।

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field
    X