লেখাটি পড়তে সময় লাগবে ৫ মিনিট
সম্পাদকীয় নোট
উপন্যাস ‘বিসর্গ তান’ : একটি বিশদ পাঠ | মেহেরুন্নেসা মেরী | প্রবন্ধ
অন্ধ চোখে বন্ধ চোখে
পান্নার আব্বা মুখলেসউদ্দীনের বুদ্ধিতে তার অফিসে চাকরি পেয়েছিল রাহাত।
খেলোয়াড় কোটায় তার নাম লিস্টের প্রথমে রাখার জন্য খেলাধুলায় পাওয়া মেডেল, কাপ আর পুরস্কারের তালিকা দিলেও তদবির এমনি এমনি হবে না। বিনিময়ে যে একটা কিছু দিতে হবে তা যে কেউ বুঝবে।
মুখলেসউদ্দীনের সঙ্গে পরিচয় সিনেমার মতো ঘটনা ছিল।
হালকা পলকা মধ্যবয়েসী মুখলেসউদ্দীন একদিন রাস্তায় মাথা ঘুরে পড়ে গেলে রাহাত ছো মেরে রিক্সা করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। জ্ঞান ফিরলে, পরিবারের সবাই চলে এলেও পান্নার আব্বা তাকে ছাড়লো না। রাহাত তখনো হিসাব বিভাগের কেরানির মাথার সূক্ষ্ণ হিসাব-নিকাশ বোঝেনি।
রাহাত অন্যদের যেমন বলে, তেমনই বলেছিল যে চাকরি-ফাকরি করবে না। একটা ব্যবসা খোলার স্বপ্ন দেখে, একটা জিমনেশিয়াম। আধুনিক সব যন্ত্রপাতি থাকবে, হাই হর্স পাওয়ারের ট্রেডমিল, বাইক, ইলেপ্টিক্যাল মেশিন ইত্যাদি ইত্যাদি। সঙ্গে সুইমিংপুল। ভালো হয় কোন বড় শপিং মলের কাছে জায়গা পাওয়া গেলে (এরকম জিম সে চোখে দেখেছে দু’একবার। সদস্য হবার কথা ভাবতে পারেনি)।
রাহাতের ঘরের ভেতরে মুগুড়ভাজা পেশী, আর ইউটিউবে দেখে দেখে সাধা শরীর কিন্তু চোখ-মুখের সারল্য (বোকাসোকা) দেখে মুখলেসউদ্দীন অভ্যাসের হাসি হাসলো – বললো, ’তুমি যা বলতেছ তা মঙ্গলগ্রহের দুইটা চান্দের একটায় হাত দেওয়ার মতো ব্যাপার। আসো বাবা, আমরা মাটিতে দাঁড়ায় কথা বলি।’
মঙ্গলগ্রহে যে দু’টো চাঁদ এটা না জানা থাকায় রাহাতের হাম্বড়া ভাবে একটু চিড় ধরলো।
তার যেহেতু সিএনজি ভাড়ার পয়সা পকেটে নেই, মুখলেসউদ্দীনই দিল।
অতএব, রাহাত সেদিন পান্নাকে দেখলো। পুরোটা দেখলো না। পান্নার তিনভাগের একভাগ জুড়ে তার জিম খোলার স্বপ্ন, আরেক তিনভাগের একভাগ শরীরচর্চারত পান্না, আর অবশিষ্টতে নিশ্চিত একটা ন’টা-পাঁচটা রুটিনের চাকরি।
একদিন দু’জনে বাইরে গেল। পান্না চাইনিজ খাওয়ার বিল দিল। রিকসায় বসতে যাতাযাতি হলে রাহাতের অস্বস্তি হচ্ছিল, কিন্তু পান্নার তেমন হেলদোল হয়নি, যেন সে জুড়ে থাকতে জানে। বিকেলের হাওয়ায় রাস্তার হৈ-হট্টগোলের মধ্যে গুনগুন করে গান ধরলো – ‘দিল হি ছোটা সা, ছোটি সি আশা, চাঁদ তারো কো ছুঁনে কি আশা, আসমানো সে উড়নে কি আশা…।’ রাহাতের অস্বস্তিবোধ লক্ষ করে লাজুক গলায় জানালো যে এটি তার প্রিয় গান।
অস্বস্তিটা রাহাতকে কিছুদিন কাবু করে রাখলো। রোজ সকালে ডন-বৈঠক দেওয়ার সময় রিক্সায় আঁটোসাঁটো হয়ে বসার কথা মনে পড়ে।
মা’কে নিজের দোনোমনা ভাবটা বলতে গিয়ে চোখে পড়ে যে তার মা উদাস হয়ে বসে আছে। ভাইয়ের কাছ থেকে বরাদ্দ টাকা এখনো ভাবীর হাত দিয়ে তাদের কাছে এসে পৌঁছায়নি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখ মুছলে নিজের তেলতেলে কালো চেহারা দেখে ‘ধুসশালা’ বলে রাহাত মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
মেয়ে পছন্দ হয়েছে শুনে রাহাতের মা বেশ আশ্চর্যই হয় যেন। সম্পূর্ণ, ভালো করে দেখ – এ ধরনের দু’একটা শব্দ বলতে গিয়েও থেমে যায়। জীবনের অভিজ্ঞতায় তার ধারণা যে-কোন ভালো কিছুর পেছনে লু হাওয়ার মতো একটা খারাপ কিছুও হাজির হয়। একটা নিশ্চিত চাকরির পেছনে তেমন কিছু তো আসতেই পারে।
পান্না অবশ্য কাউকেই কোন ভ্যাজালে ফেলেনি। শ্বশুরবাড়িতে এসে পরদিন ভোর থেকে রান্নাঘরে ঢুকে গিয়েছিল।
আর রাহাত চাকরিতে জয়েন করার দিন তার হাতে নতুন কিনে আনা সাদা শার্ট আর ছাইকালো রং প্যান্ট দিলে রাহাতের মনে হলো এসব পরলে আজকে থেকে তার হাঁটুর জোর দেখানোর সুযোগ কমে যাবে না তো! অফিসে। পান্নার কাছেও, যে নাকি প্যান্টটাকে নিজের কোমরের কাছে বিজ্ঞাপনের ভঙ্গিতে ধরে রেখেছে। মনে হছে ধূসর গোয়ার একটা তাবু গ্রাস করতে আসছে রাহাতকে। তবু সে পরলো, কালো চকচকে জুতাও।
++++
প্রথম প্রথম রাহাত রাতে বিছানায় শুয়ে অন্ধকারের ভেতর নিচু স্বরে কথা শুরু করতো পান্না। রাহাত কিছু দেখতে পেতো না তবুও সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে ফেলতো। সে তার কল্পনার পান্নাকে দেখতো। গলার স্বর এই পান্নার, হাত পা শরীর এই পান্নার, কিন্তু অস্তিত্বটি সেই পান্নার, যে হাই জাম্পে বারান্দার রেলিং টপকে যায়, গরমে বেধড়ক ঘেমে হাঁসফাঁস করে না। সেই পান্নাকে ভেবে বন্ধ চোখের হাসিতেও তার ত্বকে টান লাগে।
রাহাতের মা কয়েকদিন চুপ করে ছিল, কিন্তু দিন কয়েকের মাথায় পান মুখে দিয়ে গজগজ করে, তাও রাহাতের খাওয়ার সময়। কি, না, বউয়ের মুখ চলে সারাক্ষণ। কথায় না, খাওয়ায়। মানে পান্না বেশি খায়! খায় না, চাবায়। ওর না কি দাঁত সুলায়। সারাদিন এটাসেটা মুখে দিচ্ছে। মুড়ি শেষ, চালের কৌটায় হাত ঢুকিয়ে দিল।
’স্বাস্থ্যটা একটু ভালোর দিকে। দরকার একটু রুটিন। বাবার বাড়ির আদরযত্নে আল্লাদে…। নিজের সংসারে কাজকর্ম শুরু হইলে…’ – মুখলেসউদ্দীন এইসব নয়ছয় বলে দিলেও মনে হয় যে মা তার ছেলের বউকে বিষনজরে দেখছে।
তা যে অসঙ্গত না, রাহাত বোঝে। নিজের স্ফীত মধ্যদেশ লুকানোর কোন চেষ্টা, ইচ্ছে কোনটাই নেই পান্নার। আর তার বমি হওয়ার সংগত কারণও তো এখনি শুরু হওয়ার কথা না। স্ত্রীর সঙ্গে মানসিক ঘনিষ্ঠতা তৈরি করার মতো বাকপটু সে নয়। কথা পান্না একা একাই বলে।
ছোটবেলায় পান্না যে রোগা দুবলা ছিল তার প্রমাণ হিসেবে স্টুডিওর ব্যাকড্রপের সামনে তোলা একটা ছবি ঘরের দেয়ালে রেখেছে সে। তার মাথায় রাজকুমারীর মতো টায়রা। অস্তমিত সূর্যের লাল রং কেমন ম্যাড়ম্যাড়ে। তখন ফটো স্টুডিওতে প্লাস্টিকের ফুল, চওড়া ব্যান্ডের হাতঘড়ি (কাঁটা ঘুরতো না), হ্যাট, টাই এসব নানা জিনিস মজুদ থাকতো।
তো, পান্না মা বাবার সঙ্গে গিয়ে সেই ফটো তোলার বহুবছর পরেও সে দোকান চালু না থাকলেও বিদ্যমান ছিল। সেই একই ব্যাকড্রপ, সামনে একটা সাদা রেলিংঅলা সিঁড়ি, পেছনে বেখাপ্পা আকাশে বকপাখি উড়ে যাচ্ছে, অল্প দূরে লালচে ঢেউতোলা পানি। এই দৃশ্যের সামনে এই মোবাইল ক্যামেরার যুগেও ছবি তুলতে যেত পান্না। স্টুডিওর মালিক পিতার বদলে পুত্র শ্যামল তার প্রক্সি দিত। গ্যারান্টি দিয়ে বলতো- এই দৃশ্য ছবিতে সম্পূর্ণ অন্যরকম হয়ে আসে। মনে হবে কাশ্মীরের কোন জায়গা।
স্মৃতি, কূঁচ গেঁথে শোল-বোয়াল মাছ মারার মতো মোক্ষম বিষয় (এভাবে মাছ ধরতে পান্না দেখেছে। অল্প কাদা পানিতে গা মুচড়িয়ে ঘুরেফিরে বেড়ানো জিয়ল মাছ)। কোন দৃশ্য, ঘটনা কিংবা গান একবার স্মৃতির মোক্ষম সিন্দুকে ঢুকে গেলে চেরাগের দৈত্যের মতো হয়ে যায়। এমনিতে ঘুমিয়ে থাকে, কিন্তু ওই রকম কিছুর ছোঁয়া পেলে ভুর ভুর করে বেরিয়ে আসে।
তাদের রাতের গল্পে ডিমলাইটের আলোয় পান্না যখন এসব বলে, প্রদীপের নিচে ভারী জ্বালানি তেলের মতো গম্ভীর হয়ে চোখ বন্ধ করে রাহাত শোনে। তার মনে হয় যে এই গল্প সেই পান্নার। তার সামনে বসা এই পান্নার হতেই পারে না।
রাহাতের আছে কসরত, সে তাদের ছাদ থেকে লং জাম্পে প্রতিযোগীর মতো লাফ দিয়ে পার হয়ে পাশের বিল্ডিংয়ের সমান্তরাল ছাদে পৌঁছে বিজয়ীর ভঙ্গিতে তাকায়, যেন সে পান্নার বলা গল্পের সঙ্গে পাল্লা দেয়। পান্না যখন বলে যে, এক বিকেলে সে স্টুডিও ঝিলিক-এর বারান্দায় উঠে ছায়াছন্ন প্রবেশপথের বিপরীতে তীব্র ফ্ল্যাশলাইটের সামনে হকচকিয়ে গিয়েছিল, রাহাত তখন অদৃশ্য নানচাকু হাতে এক পা গুটিয়ে মনে মনে ঘূর্ণিপাকের মতো ঘোরে।
স্টুডিওটা একটা সরলরেখা দিয়ে দু’ভাগ করা। ছায়ার দিকে গা শিরশির করা ঠান্ডা, উল্টো দিকে ব্যাকড্রপের সামনে আলোতে গা-ঘামানো গরম। নার্ভাসনেস থেকে গরম লাগতো পান্নার। শ্যামলকে তাদের পাড়ার কোন কোন মেয়ে ভালো চিনতো, ঠাট্টা ইয়ার্কি করে পছন্দসই ছবি তুলিয়ে নিত। পান্না স্থুলকায় এবং কম পাত্তা পাওয়া। মৃদু ধমক দিয়ে শ্যামল তার থুতুনি আর মাথা ধরে ভঙ্গি ঠিক করে দিতে এলে বুকের ভেতর ধরাস ধরাস শুরু হতো, গলা শুকিয়ে কাঠ, গাল-কপাল ঘামে তেলতেলে। চিত্রগ্রাহক তখন আন্তরিক গলায় বলত – ‘এহ, চেহারায় এত তেল, রুটি ভাজলে পরোটা হইয়া যাইবো।’
শুনে রাহাতের নানচাকু ঘূর্ণি থেমে গিয়ে মনে হয় – পান্না খাবারের উপমা ছাড়া কথা বলতে জানে না।
পান্না বলে, সেইসব তেলতেলে ছবি আনতে গেলে আবারও দুরুদুরু বুক। স্টুডিওর পেছনে ডার্করুম রহস্যেমোড়া এক জগত। কদাচিৎ দরজা আলগা হলে ভেতরের গা ছমছমে অন্ধকার বাইরে ছলকে আনতো পানির শব্দ, আধিভৌতিক নেগেটিভ।
ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে রাহাতের সঙ্গে এসব গল্পে হঠাৎ পান্না চঞ্চল হয়ে উঠত। ঢলে পড়া সূর্যের ঘন আলোর দিকে চেয়ে বলে উঠতো – ‘আজকে একদম সেই ফটো স্টুডিওর ব্যাকড্রপের মতো সূর্য ডুবে যাচ্ছে!
রাহাতের বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠতো। দু’এক মুহূর্ত মুগ্ধ চোখে দেখে পরক্ষণেই সংবিৎ ফিরতো। তার ভীষণ ইচ্ছে করতো চোখ বন্ধ করে যে পান্নাকে পাওয়া যায়, তাকে খোলা চোখেও দেখতে।
মাস ছয়েকের সময়ের আগেই পান্নার বড়সড় শরীর থেকে যে সন্তানটি ভুমিষ্ঠ হলো তাকে দেখতে হাসপাতালের যাওয়ার কথা রাহাতের মনে থাকল না। সে তখন তাদের ছাদ থেকে পাশের ছাদে ক্রমাগত লং জাম্প দিতে ব্যস্ত ছিল। আর রাহাতের মা আছাড়ি-পিছাড়ি কান্নার আয়োজন করে হঠাৎই থেমে গিয়েছিল, এই বাচ্চা কার!
++++
সেদিন বিকেলটা কেটে যাওয়া ঘুড়ির মতো পড়ন্ত হবে, রাহাত জানে।
কালেভদ্রে ঘটার মতো রাহাতের ইচ্ছে হবে পান্নাকে একটু ডন বৈঠক দেখায়। এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে যাওয়ার লং জাম্পও।
পান্না কিন্তু আসবে বেশ অনেকক্ষণ পর। তার পরনের ম্যাক্সিতে শিশুদুগ্ধের ঘ্রাণ, চোখের কোণে ক্লান্তি। দেখে রাহাতের মসৃণ কপালে সূতি কাপড়ের মতো ভাঁজ জমবে, ভাববে, যে পান্নাকে ডেকেছে সে কেন এলো না?
রাহাত প্রশ্নটা নিজেকে করবে? না কি পান্না ছাদে এলে তাকে করবে – এই নিয়ে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হলে ছাদের কোণায় একটা নয়নতারার ঝাড়ে চোখ যাবে তার। ফুলে বোঝাই, কেউ পানি দিয়ে গেছে, সবুজ পাতারা গাঢ় করে চেয়ে আছে, পান্নার শিশুপুত্রের মুখের মতো, দেখলে মন নরম হয়ে আসে। রাহাতেরও মন রোদের তাপ লাগা পানির মতো নাতিশীতোষ্ণ হয়ে উঠবে। কিন্তু তখনই সে চোখ বন্ধ করে ফেলবে।
এবার বন্ধ চোখে সেই পান্না এই পান্না কাউকে না, সে দেখবে একদল বৃহন্নলা তাদের দরজায় হাততালি দিয়ে নাচছে। হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমন্ত শিশুটিকে বিছানা থেকে তুলে রাহাতই তো দরজার কাছে কতগুলো বাড়ানো হাতে তুলে দেবে।
সামনে দাঁড়ানো পান্নাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে চোখ সরিয়ে ছাদ দেখবে রাহাত। ছাদের ওপাশে আরেকটা ছাদ, চৌকোণা আরও একটা তারপরে। একটুখানি সরু গলির ফাঁকটা সামান্যই বোঝা যায়। তারপরে যে ছাদ সেখানকার পানির পাইপ, সিমেন্টের এবড়োথেবড়ো দূর থেকে মসৃণই দেখায়, পান্নার চিবুক কিংবা রাহাতের বাহুতে প্যাঁচানো পেশীর মতো।
‘বাবুকে ছাদে এনে ছবি উঠাবো?’ বন্ধচোখের রাহাতের দিকে ঝুঁকে এসে প্রশ্নটা করতে চাইবে পান্না। উত্তর না পেয়ে তার মুখে একটা ছাইবর্ণের ছায়া, কিছু বলতে গিয়ে মুখ খুলবে, বলতে নেয়া কথা পান্না গিলে ফেলছে দেখতে দেখতে রাহাতের তখন ইচ্ছে করবে ছাদ ভাসিয়ে বৃষ্টি নামুক, তখন চিৎকার করে বলতে পারবে, ‘আমার কাছে কি ওই ফটোগ্রাফারের কাছে যাও, ওইখান থেকে নেগেটিভ পজেটিভ করে আনো!’
বৃষ্টি নামছে না, এই নিয়ে মুহূর্তের মনক্ষুণ্ণতা কি এই পান্নার চোখে পড়বে? নিজের ওপর আস্থা ঝপ করে খানিকটা কমে আসবে রাহাতের! না কি পান্না তখন বড়সড় গাদাফুলের সঙ্গে সব দাঁত মেলে হাসবে। বলবে, ‘একটা ছবি উঠায় দাও, হাফ তুলবা কিন্তু!’
রাহাত মনে মনে মেজাজ করবে, ’হাফই তো, ফুল তুলতে গেলে ক্যামেরায় জাগা হইব না।’ কিন্তু মুখে কিছু না বলে পান্নার বাড়ানো মোবাইল টেনে নেবে।
ছবি তোলা হলে পান্না কাজল-আঁকা চোখ বন্ধ করে গুনগুন করবে, ‘দিল হি ছোটা সা, ছোটি সি আশা, চাঁদ তারো কো ছুঁনে কি আশা, আসমানো সে উড়নে কি আশা…।’
ছাদের ওপর দিয়ে আড়িপাতা মানুষের মতো বাতাস ঢুকে ধরা পরে যাবে। বাতাসে পান্নার খোলা চুল সামান্য দোল খাবে। রাহাত দাঁড়িয়ে থাকবে। তার পেশীবহুল বাহুর মতো তার চুলও স্থির, খর্বকায়। হেলদোল নেই।
গানের লাইনগুলো এতদিনে রাহাতের মুখস্থ হয়ে গেছে। চোখ বন্ধ করলে তার নিজের পান্না অবশ্য বুঝিয়েছে যে এই পৃথিবীর কেউ নেশার ঊর্ধ্বে না। কিন্তু তার নেশা যে কোনটা তা কখনো খুলে বলে না, একটু পাক খেয়ে শরীর ঘুরিয়ে চলে যেতে যেতে এই গানটাই গায়।
রাহাত তখন দুই পান্নাকে খানিকটা গুলিয়ে ফেলে। চোখের চাউনি, কোমরে জড়ানো আঁচলের সঙ্গে, ঝমঝমিয়ে বাতাস ভারী করা হাসির ভেতর একাকার হয়ে যায় সে। সেই পান্নার হাত ধরে টান দিলে এই পান্নার মাংসল কব্জি এসে ধরা দেয়। গানটা শুনে সে ভাবে কী বিপরীতধর্মী লিরিক! তোমার দিল ছোট, আশা ছোট, আর তুমি কি না চাঁদ তারা ছুঁয়ে আকাশে উড়তে চাও! শখের তোলা জানি কত করে? আর এই পান্না উড়বে? তাহলেই হয়েছে। আকাশ ওকে নিয়ে ভেঙে পড়বে। সে তো শুধু ডুবন্ত সূর্যের ব্যাকড্রপের সামনের রং দিয়ে আঁকা আকাশ চেনে।
অথচ রাহাত কতভাবেই না চেষ্টা করে। কথায় কাজ হয় না, সেকথা প্রথম কয়েক দিনেই বুঝে গেছে। যে কথাই সে বলুক না কেন, এই পান্নার একটা নিজস্ব যুক্তি আছে, থাকে। সে যুক্তির যে ওজন বেশি, সেকথা প্রতিষ্ঠা করতে যত কথা আছে সে বলে। তখন কথার ওজন তার নিজের ওজনের চেয়েও বেশি হয়ে পড়ে।
কালকে রাহাত স্থির করেছে রাগ, বিরক্তি কোনটাই প্রকাশ করবে না। একসঙ্গে দু’শো বুকডন দেয়ার ধৈর্য্য আর ক্ষমতা যখন তার আছে, তখন এ তো খুব সামান্য বিষয়। সে শান্ত কণ্ঠে গলিতে পরে থাকা পান্নার মাথার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে বলবে, ‘দৌড় দিয়া ছাদে গেছিলা, ভালো কথা। এক্কেরে ছয়তলায়, সেইটাও খারাপ আইডিয়া না। সিঁড়ি দিয়া উঠার ব্যায়াম হইলো। কিন্তু লাফটা দিলা ক্যান, আর দিলাই যদি এক ছাদ থেইকা অন্যপাশে পার হইতে পারলা না ক্যান?’ লংজাম্পে স্কুলের পোলাপানেও এর চে বেশি পা ছড়ায়া লাফ দেয়!’
রাহাতের কথার কোন উত্তর আসবে না।
পান্নাকে তুলে ঘরে আনলে স্পীডে ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানের বাতাস বাইরের হাওয়ার দিকে মুখিয়ে থাকবে। জানালার পর্দাগুলো উড়ে কোনদিকে যাবে বুঝে উঠতে পারবে না। রাহাতের কপালের ভাঁজ আড়াল করে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমবে, যেমন পান্নার বানানো ফালুদার গ্লাসের গায়ে জমতো। রাহাতের সামনে এনে ঠকাস করে রাখার পরে ওর চোখমুখ উপচে উচ্ছাস বেরুতো।
‘আমারে সবাই লাফ দেওয়া শিখাতে চাইছ, দড়ি লাফ, সিঁড়ি লাফ। তুমি দেখাইছ কেমনে এক ছাদ থেইকা আরেক ছাদে লম্বা লাফ। কিন্তু কেউ আমারে মাপ দেওয়া শিখায় নাই। ঠিক মতো মাপতে শিখলে কি ওই চিপার মইধ্যে পইড়া যাইতাম!’
পান্নার বলা কথাগুলো ঘরের ভেতর ঘুরতে থাকলে রাহাতের শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা দাড়াশের মতো স্রোত বয়ে যাবে! স্রোতের রং লালচে কালো রক্তের মতো।
Leave feedback about this