রিজার্ভ-ফরেস্ট একটা ধারণা; কোনও একটা জায়গার গায়ে কয়েক’শো বছর ধরে, একটু একটু করে অভয়ারণ্যের ধারণা শ্যাওলার মতো বাসা বাঁধতে থাকে। সেখানে উড়ে আসা ধনেশ থেকে ঘুরে বেড়ানো হরিণ – সবার ভূমিকা থাকে সে-ধারণার পিছনে ।
ঠিক একইভাবে, অভয়ারণ্যের ছাপ মুছে যেতে দিনের পর দিন সময় লেগে যায়। সবাই বোঝে¬ – এই রিসর্ট, হোটেল, হাইওয়ে, একের পর এক বসতি, কমপ্লেক্স – ‘অভয়ারণ্য’ অভয়ারণ্য নেই আর। কিন্তু ওই রিজার্ভ-ফরেস্টের গন্ধ তার মাথার ওপর ঘুরতে থাকে। ছায়া ফেলে রাখে।
অভয়ারণ্য আসলে এক-সময়ের রেজিমেন্টেড পার্টির মতো; একদম নিচের স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত প্রত্যেকের ভূমিকা নিয়ে গড়ে ওঠা। ভেঙে পড়ার সময় সর্বোচ্চ স্তর থেকে নিচের স্তর পর্যন্ত দুর্বল হয়ে যাওয়া। কিন্তু যেহেতু রেজিমেন্টেড পার্টি তাই কেউ কেউ আশা করে থাকে, অপেক্ষা করে, সঙ্গত কারণেই বুক বেঁধে থাকে – আবার হয়তো একদিন ঘুরে দাঁড়াবে সে।
এ-অঞ্চলে চিতা শেষবার দেখা গিয়েছিল আঠারো-শো শতকে। সে কলকাতার ময়দান অঞ্চলেও সাহেব’রা ক্রিকেট খেলতে খেলতে একসময় ঘন গাছের আড়ালে রয়াল বেঙ্গলের জুলজুলে চোখ দেখতে পেয়েছিল। সুন্দরবন তখন চব্বিশ পরগনার সীমানা ছাড়িয়ে বিস্তৃত ছিল এখনকার মহানগর পর্যন্ত।
এ-অঞ্চলে যে আঠারো-শো শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চিতার দেখা মেলে এবং তারপর আর যে তাদের দেখা পাওয়া যায়নি তার স্বপক্ষে সব থেকে বড় প্রমাণ ‘চিতামঙ্গলকাব্য’। রুক্ষভূমি; টেরাকোটার কাজ করা বেশ কয়েকটি মন্দির, মসজিদ রয়েছে এখানে। বঙ্গে মারাঠা-আক্রমণের সময় এ-অঞ্চল ছারখার হয়ে গিয়েছিল। কারণ, সব থেকে বড় প্রতিরোধ এসেছিল এখান থেকেই। অনেক গবেষক মনে করেন, চিতামঙ্গলকাব্য এখানে রচিত হবার পিছনে রয়েছে এখানকার মানুষের এই দুর্ধর্ষ প্রাণশক্তি, স্বাধীনচেতা মনোভাব আর আবহাওয়া।
এ-মঙ্গলকাব্য সম্পূর্ণ পৃথক, কোনও কবির নাম পাওয়া যায় না। এর আবিষ্কারও বেশ রহস্যময় ও রোমাঞ্চকর। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর প্রতি সমস্ত শ্রদ্ধা জানিয়েও বহুবার বহু গবেষক এ-কাব্যের আবিষ্কারক’কে বাংলা-সাহিত্যে গবেষণার কাজে সব থেকে বড় ভূমিকা রেখে যাওয়া ব্যক্তিত্ব বলে উল্লেখ করতে পছন্দ করেছেন। এসি-ঘরে বসে কুলকুল করে ঘেমে উঠতে দেখা গেছে অনেক ইন্টেলেক্টচুয়াল’কে, কারণ বাংলায় যে এ-ধরনের মঙ্গলকাব্য রচিত হতে পারে সেটা ধারণা ছিল না কারও।
আঁখি হালদার আর কল্পোত্তম একটি সেমিনারে এসেছে গতকাল সকালে। বেশ কয়েক বছর বিভিন্ন সংগঠন এখানে সেমিনার করার দিকে ঝুঁকেছে। তার পিছনে কারণ’ও আছে; এক ঢিলে তিন-চারটি পাখি মারা যায়।
প্রথমত, শহর থেকে কিছুটা দূরে হবার কারণে বক্তাদের দু-তিনদিনের একটা আউটিং-এর সুযোগ দেওয়া যায়; যেটা অনেকেই পছন্দ করে। এটা অনেকটা রথ- দেখার সঙ্গে কলা-বেচার মতো ব্যাপার। দ্বিতীয়ত, মূলধারার মঙ্গলকাব্যগুলির বাইরে চিতামঙ্গলকাব্যের সমান্তরাল একটা জনপ্রিয়তা আছে। পৃথিবীর সর্বত্র রেবেল’দের আলাদা জনপ্রিয়তা থাকে। ক্ষমতাকে অস্বীকার করে কেউ বেঁচে আছে, দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে যাচ্ছে – এর একটা আবেদন আছে মানুষের কাছে।
আঁখি হালদার ও কল্পোত্তম (কল্পোত্তম নিজের নামের সঙ্গে জুড়ে থাকা পদবীটিকে বর্জন করেছে; একবার উত্তরবঙ্গের এক ইউনিভার্সিটি তার পদবী অনেক খুঁজেপেতে এনে কার্ডে ছেপে দিয়েছিল – কল্পোত্তম প্রতিবাদ করে চলে এসেছিল স্পিচ না-দিয়ে। হোটেলে যে যার রুমে বসে সকালের কাগজে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল। না-বোলালেও চলে যেত, তবু অভ্যেসের বশেই সেটা ঘটছিল।
এখানে বক্তারা এলে চিতামঙ্গলকাব্য নিয়ে দু’-চার কথা বলে; বিজ্ঞান থেকে শুরু করে সমাজতত্ত্ব-চিতামঙ্গল সর্বত্র উপস্থিত। ফলে, জনজাতি ইত্যাদি নিয়ে সারা পৃথিবীর বিশ্ববিদ্যালয়, সংস্থাগুলির যে নড়েচড়ে ওঠা সেখানে বিষয়গুলি ‘প্লেস’ করতে সুবিধা হয়।
কেউ কেউ, মানে রত্নেশ্বর ভট্টাচার্য’র মতো ক্লাসিক্যাল ভঙ্গিতে গবেষণা করা মানুষেরা অবশ্য বাঁকাচোরা কথাও বলেন; শেষ পর্যন্ত চিতামঙ্গলের খ্যাতিই আরেকটু বেড়ে যায়। এ-সময়ের টার্মে একে বলে ‘প্রাসঙ্গিক থাকা’। রত্নেশ্বর মাস-ছয়েক আগে তুলোধুনা করে বলেছিলেন, ‘মনে রাখা জরুরি – মাত্র কয়েকটা দশক আগেও, যতদিন এই চিতামঙ্গলকাব্য ‘কোট-আনকোট’ আবিষ্কার হয়নি, ততদিন মনসামঙ্গল কিন্তু মূলধারার বাইরেই একটা মঙ্গলকাব্য ছিল, সঙ্গত কারণেই ছিল। এখন অনেক আলোচকের ট্রেন্ড হয়ে গেছে অন্য মঙ্গলকাব্যগুলিকে মূলধারার মঙ্গলকাব্য হিসাবে একটা ক্যাটেগরি তৈরি করে চিতামঙ্গলকাব্যকে আলাদা একটা ক্যাটেগরিতে ফেলা। এতে ক্ষতি হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের, অবশ্য লাভ হচ্ছে কিছু শখের গবেষকদের। শখের বিপ্লবী হওয়া সহজ… এসব বিপ্লব’কে আমি পাত্তা দিই না…।’
অডিটোরিয়ামে পিছনের রো থেকে কেউ বলে উঠেছিল, প্রফেসর ভট্টাচার্যকে খোঁচাবার জন্য বলে উঠেছিল, ‘চিতামঙ্গলের আবিষ্কার’কে আপনি ‘কোট-আনকোট’ বললেন কেন?’ ক্রুদ্ধ শুনিয়েছিল তার স্বর। রত্নেশ্বর কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে কপালের ঘাম মুছেছিলেন, ভুরু কুঁচকে যতটা সম্ভব পিছনের রো-এর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তিনি ‘রেবেল’, এখনকার গবেষকদের মধ্যে তিনি প্রাচীণপন্থী; কিন্তু স্রোতের বিপরীতে হাঁটেন। একবার পাঁড়-রেবেল হয়ে উঠলে এই সমস্যা তাড়া করে বেড়ায়; রেবেল-সত্তাকে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হয় সচেতনভাবে। তিনি বলেছিলেন, ‘কোট-আনকোট বলেছি কারণ চিতামঙ্গলকাব্যের আবিষ্কার নিয়ে এখনও কোনও স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি… যতদিন-না অ্যকাডেমিক্যালি একটা আবিষ্কার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ততদিন তাকে ফ্যাক্ট বলে আমি মনে করি না…।’
পিছনের রো থেকে হইহই করে উঠেছিল বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়ে, এও চেনা ছক, চিৎকার করে বক্তাকে বলতে না-দেওয়া। এরাই ব্যক্তিস্বাধীনতা নিয়ে সব থেকে বেশি কথা বলে। চিৎকার শোনা যাচ্ছিল, ‘একটা প্রান্তিক জনপদকে আপনি অপমান করতে পারেন না… কথা উইথড্র করতে হবে… করতে হবে…।’
রত্নেশ্বর কেটে কেটে বলেছিলেন, ‘প্যারোকিয়াল-কার্ড খেলে লাভ নেই কিছু। চিতামঙ্গল নিয়ে প্রচুর ধোঁয়াশা আছে… বিতর্ক আছে… ছত্রে-ছত্রে এমন সব শব্দ আছে যার অনুপ্রবেশ, সন্ধান আমরা উনিশ’শো ষাট-সত্তরের আগে পাই না… মূল টেক্সটের নিরিখে সেগুলিকে প্রক্ষিপ্ত বলেও মনে হয় না…,’ হইহই করে অডিটোরিয়াম ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল ছেলেপুলের দল।
এখানে, এই লুপ্ত হয়ে আসা অভয়ারণ্য… যার বুকের ভেতর ফুটে উঠছে প্রায়-অ্যরিড অঞ্চল… সেখানে সেমিনার করার পিছনে তৃতীয় কারণ, সাবঅল্টার্ন শব্দবন্ধটির শ্যামল-ছায়া উপভোগ করা।
আরও বহুবিধ কারণ আছে; যেমন পলিটিক্যাল ঝামেলা নেই। পলিটিক্স আছে বিস্তর; সে-ঝামেলা এখানে ঢুঁ-মারতে আসা লোকজনের কাছ পর্যন্ত পৌঁছায় না।
উঠতি প্রোমোটার থেকে শুরু করে ট্র্যাভেল-এজেন্টদের স্পনসরশিপ শুকিয়ে যায়নি এখনও।
এসব কারণেই আঁখি হালদার ও কল্পোত্তমের মতো স্পিকারদের আনা গিয়েছে। অল্প বয়সেই দু’জনে অ্যকাডেমিক এরিনা কাঁপিয়ে দিচ্ছে, তাদের আর এসব খেপ খেলার বিশেষ দরকার পড়ে না। এ-লাইনে এসব মার্কামারা সেমিনারকে খেপ খেলাই বলে; নতুন নতুন অ্যকাডেমিশিয়ানরা এসবে এসে লাফালাফি করে। প্রতিষ্ঠিত, পুরানো-পাপীরা আড়ালে মুখ-টিপে হাসে, বলে, ‘আমাদের গ্রামের বাড়িতে বাছুরের এমনই লাফালাফি দেখতাম…।’
আঁখি হালদার ও কল্পোত্তম হোটেলের রুমে বসে খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিল, সকাল ন’টার দিকে ছুটে যাচ্ছে ঘড়ির কাঁটা। দু’জনেই সকালে হোটেলের এক-চিলতে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল কিছুক্ষণ। বেশিক্ষণ দাঁড়াবার উপায় নেই; সকালেই মাটি তেতে উঠতে শুরু করেছিল। আঁখি হালদার পাশের ব্যালকনি থেকে কিছুটা ঝুঁকে, ক্লিভেজ যথাসম্ভব আড়াল করে বলছিল, ‘কল্পো, আমি-না এখানে দাঁড়িয়ে জাস্ট হারিয়ে যাচ্ছিলাম কাল রাতে… সো ওয়ান্ডারফুল… আমাদের একটা বাড়ি ছিল শিমুলতলায়; ঠাকুরদার বানানো। একটা টিলার কাছাকাছি… ছোটবেলায় খুব যেতাম… ঘর-লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়ালে ঠিক এই ভিউ পাওয়া যেত… দিস ইজ ভেরি ওভারহেল্মিং…।’
কল্পোত্তম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিস্তীর্ণ প্রান্তর দেখছিল, ঢেউ খেলানো ভূমি। ভূমির ঢাল নেমে গেছে পশ্চিম থেকে পূর্বে। বোঝা যায় একদিন ঘন বন ছিল এখানে; এখন ক্রমশ ফাঁকা হচ্ছে। বনের ভেতর জনপদ, গ্রাম। বহুদূর পর্যন্ত দেখতে পাওয়ার কারণে সে সব বোঝা যাচ্ছে। কল্পোত্তম বলেছিলেন, ‘আঁখি, নস্টালজিয়া এক অদ্ভুত জিনিস… তাই না! আমারও মনে আছে, আমি বাবার হাত ধরে ওসব জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি… কিন্তু একটা বিষয় আমি নোটিশ করছি, এখানে চিতামঙ্গল লিখিত হবার সব থেকে বড় কারণ নিঃসন্দেহে এর ট্যেরেন… কী রমনীয় রুক্ষতা দেখো!’
আঁখি হালদার ব্যালকনি থেকে আরেকটু ঝুঁকে পড়েছিল, কল্পোত্তম বলে চলেছিল, ‘টক্সিক-নারীবাদী তুমি নও; তাই তোমার কাছে পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকার দরকার নেই। আসলে কী জানো, পুরুষালি একটা রুক্ষতা রয়েছে এখানে… মানে, বাংলার কমনীয়তার পাশে এ-রুক্ষতা জাস্ট অকল্পনীয়। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, সে রুক্ষতা কি আমাদের দেশে আর কোথাও নেই? আমার মত, আছে। কিন্তু রুক্ষতার সঙ্গে এমন সবুজ আর রমণীয়তা মাখামাখি করে নেই তেমন কোথাও…।’
কল্পোত্তম নিউরো-অ্যাস্থেটিক্স নিয়ে মেতে আছে কয়েক বছর; আঁখি হালদারের বেশি কথা বাড়াতে ইচ্ছা করছিল না; সে একবার কোনওক্রমে বলেছিল, ‘ইয়েস… একদম ঠিক বলেছ… এই অ্যরিডের সঙ্গে গ্রিনারি না-মিশলে চিতামঙ্গলকাব্য সৃষ্টি হতে পারে না… পারে না, পারে না, পারে না…।’
২
বেশ কয়েকদিন আগেই খবরটা ব্রেক করেছিল একটা লোকাল টিভি-চ্যানেল। বেশিরভাগ সময় নিখাদ কথার জাগলারি’তে লোক মজিয়ে এক-একটা স্লট দেখতে বাধ্য করা টিভি-চ্যানেলের কথা কেউ’ই বিশ্বাস করে না। কিন্তু ধীরে ধীরে কথাটা ছড়িয়ে পড়েছে, ‘প্রত্যক্ষদর্শীর’ বয়ান এসেছে। ফরেস্ট-ডিপার্টমেন্ট এসেছে; খাঁচা পাতা হয়েছে, টোপ দেওয়া হয়েছে। কাজের কাজ কিছু হয়নি।
প্রায় সব সংবাদপত্রই এখন কভার করছে ঘটনাটা; সরকারের নড়েচড়ে বসবার কারণ আছে। কোনও বনে লুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণীর ফিরে আসা মানে, সরকার ভাল কাজ করছে। বনের পশু যদি আনন্দে নাচতে নাচতে ফিরে আসে তা হলে মানুষ নিশ্চয় বহালতবিয়তে আছে। বেশ একটা অ্যাচিভমেন্ট বলে প্রচার করা যায় প্রাইম-টাইমে।
সবাই বাঘ-বিশারদ হয়ে উঠেছ; পাগ-মার্ক থেকে শুরু করে ফেরোমন শব্দগুলি সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় ছড়িয়ে রয়েছে। ব্যালকনি থেকে ঘরে ঢুকে নিজের ঘর বন্ধ করে, আঁখি হালদারের ঘরে ব্রেকফাস্ট দিতে বলে কল্পোত্তম ফ্রেশ হয়ে নিয়েছিল। লোকসংস্কৃতি তার বিষয়; সে একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল নোটসে। এগুলি গোপনেই করতে হয়; কেতকাদাস ক্ষেমানন্দর ‘মনসামঙ্গল’-এর আদলেই যে ‘চিতামঙ্গল’ লিখিত হয়েছিল সে নিয়ে সন্দেহ নেই। ‘মনসামঙ্গল’-এ লেখা হচ্ছে,
‘বলে দেবী বিশ্বমাতা শুন সুমঙ্গল কথা
আমার চরিত্র ইতিহাস।
যেই জন এক মনে এ সব কাহিনি শুনে
তাহার আপদ হয় নাশ।।
যখন ছিল না মহী তার পূর্ব কথা কহি
ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান।
প্রলয় যুগান্তকালে পৃথিবী ডুবিল জলে
একমাত্র ছিলেন ভগবান’।।
‘চিতামঙ্গল’-এ বিশ্বমাতা হয়ে গেছিলেন চিতা-মাতা; চিতার মা প্রবল শক্তিশালী এক চিতার জন্ম দিয়েছেন। সে-চিতা কোনও সাধারণ চিতা নয়; সে-চিতা ঈশ্বরের অভিশাপপ্রাপ্ত। তার লড়াই মানুষের সঙ্গে নয়; তার লড়াই ঈশ্বরের সঙ্গে।
এ-অঞ্চলে কোটি বছর আগে লাভা-স্রোত আছড়ে পড়েছিল। ফলে মাটি-ফুঁড়ে আগুন উঠছে ঈশ্বরের ক্রোধে – এমন একটা বিষয় মানুষের মুখে মুখ ঘোরে। সেটিও এসেছিল ‘চিতামঙ্গল’-এ।
কাহিনি’টি টানটান – জন্মের পর থেকেই চিতা-শাবকের অলৌকিক ক্ষমতা। পশুরাজ সিংহ পর্যন্ত তাকে ভয় পায়। কেউ কেউ অবশ্য বলেন, এ-অঞ্চল সিংহ দেখেনি কোনওদিন; তাই পশুরাজের চরিত্র-চিত্রণে বেশ কিছু ভুলভ্রান্তি আছে।
কল্পোত্তমের পর্যবেক্ষণ – এ কাহিনি’র প্রাচীনত্ব কত তা নিয়ে শেষ কথা বলার জন্য অনেক গবেষণা বাকি আছে; কিন্তু এ-মঙ্গলকাব্য যে ইউরোপিয়দের এ-দেশে আসার পর রচিত তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কারণ, ইউরোপের রেনেঁসাস-কালে ডেভিলের যে আরাধনা তার সঙ্গে চিতামঙ্গলের অদ্ভুত সাযুজ্য আছে। ব্যক্তিস্বাধীনতার বিকাশ উভয় ক্ষেত্রেই সব থেকে বড় ভূমিকা নিয়েছে।
আঁখি হালদার প্লেট থেকে এক-টুকরো শশা তুলে নিয়ে বলছিল, ‘আমার অবাক লাগে, এ-বিষয়টা… যখন এখানে চিতার সংখ্যা কমতে শুরু করল, একটা সময় বিলুপ্ত হয়ে গেল তখনই ‘চিতামঙ্গল’ রচিত হয়েছিল… দাঁত থাকতে মানুষ দাঁতের মর্যাদা বোঝে না… কী অদ্ভুত!’
কল্পোত্তম ব্রেকফাস্ট শেষ করে বালিশে হেলান দিয়ে মোবাইল স্ক্রল করে চলেছিল; একবার মুখ তুলে আঁখি হালদারের মুখ ও বুকের দিকে তাকিয়ে, চিবুক নেড়ে দিয়ে বলেছিল, ‘ঠিক তা নয়, আঁখি… যখন চারপাশে কোনও জিনিসের প্রাচুর্য থাকে তখন মানুষ তাকে শিল্পের উপাদান হিসাবে গণ্য করে না। একসময়, শোনা কথা, হাজার হাজার চিতা ছিল এখানে, তখন তারা আতঙ্ক। যে মুহূর্তে তারা সংখ্যায় কমে গেল সে মুহূর্ত থেকে তাদের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেল…।’
আঁখি হালদার শশার টুকরোটা গলায় চালান করে দিয়ে বলেছিল, ‘ঠিক যেমন তোমার চারপাশে যখন মেয়েরা গিজগিজ করত তুমি আমার দিকে ফিরেও তাকাওনি। দিনের পর দিন আমি অপেক্ষা করে থেকেছি; ভেবেছি তুমি ফিরে আসবে। ফেরোনি। এখন জীবন ঘেঁটে যাবার পর আমার সঙ্গে তুমি সেমিনারে আসছো, তাও বউকে আমার কথা গোপন রেখে…।’
আঁখির এ-অভিমানের যথেষ্ট কারণ আছে। আঁখি অপেক্ষা করেছিল, এটা সত্যি। এ-সময়টা চুপ করে থাকা ছাড়া কল্পোত্তমের কিছুই করার থাকে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করবার জন্য সে আঁখিকে একবার বুকের কাছে জড়িয়ে নিতে চেয়েছিল। সেটা হতে দেয়নি আঁখি, ‘আমার মুড নেই; সারাদিন বকবক করতে হবে। ইন্টার-অ্যাকটিভ সেশন আছে, রাত্রে ঘুম হয়নি…।’
সেমিনার বেশ ভালই হচ্ছে। একটি এনজিও’র তরফে আয়োজন করা হয়েছে; আজকাল গন্ধ শুঁকে কল্পোত্তম বলে দিতে পারে কোন সংগঠকদের কী ধান্দা। এখানে এসেই সে বুঝে গেছে এরা মূলত বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ ও সাস্টেনেবল ডেভলমেন্ট নিয়ে কাজ করে। ফলে, অভয়ারণ্যের ভেতর রিসর্ট তৈরি করা হাউজিং গ্রুপগুলি সব থেকে বেশি ঝাঁপিয়ে পড়েছে। একটা বনবস্তিতে আজও চিতামঙ্গল সুর করে গেয়ে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে চিতার পুজো হয়। সেখানকার মূল গায়ককে আনা হয়েছে; তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে। এখন লাঞ্চব্রেক। যে যার মতো বাফে-সিটেমে খেয়ে ঘুরছে। দু’-চারজন সাংবাদিক, মূলত কলকাতা থেকে দূরে পোস্টিং সারাজীবন, লম্বা-চওড়া কথা বলছে। একে বলে চমকে দেওয়া। যে কোনও ফিল্ডে আজকাল এ-চমকানো খুব চলছে। কেউ টেবিলে মাথা রেখে ন্যাপ নিচ্ছে। আঁখি হালদার বাথরুমে ঢুকে সিগারেট খাচ্ছে, কল্পোত্তম নিশ্চিত।
তবে রিসর্টের ডায়নিং-হল’টার ভেতর অদ্ভুত চাপা স্বরে গুনগুন চলছে। একটা কথা অনেকে মিলে অবিশ্বাস করলেও কথাটাকে উড়িয়ে দিতে না-পারলে যে গুনগুন তৈরি হয়, তেমন এক গুনগুন ভেসে চলেছে হলের মধ্যে। এক বয়স্ক লোক, স্থানীয় পঞ্চায়েতের কেষ্টবিষ্টু হাত-পা নেড়ে বলছিলেন,
‘চিতামঙ্গলে লেখা আছে –
‘দেখিয়া প্রথম রোদ পৃথিবীর বুকে
চিতার শাবক কহে আমি শত মুখে
করেছি ঘোষণা আজ, মধ্য কলি কালে
বিরাজ করিব পূর্ণ সূর্য-চন্দ্র ভালে’…
এখন দেখুন, এই সেই কলিকাল। আর তিনি বিরাজ করতে শুরু করেছেন… এখানকাল মাটিতে, এই জঙ্গলে এমন কিছু আছে যা আর কোথাও নেই… সব চ্যানেলে দেখাচ্ছে খবরটা… আমার কাছে বাইট নিতে আসবে টিভি। ফোন করেছিল, আমি সন্ধ্যায় সময় দিয়েছি।’
চিতাটিকে যে গ্রামের কাছাকাছি ধানখেতের ধারে দেখা গিয়েছে তার অকাট্য প্রমাণ রয়েছে। একটি ক্লিপিং ফোনে ফোনে ঘুরছে। ‘ভিডিও’র সত্যতা যাচাই করেনি আমাদের চ্যানেল। চ্যানেলগুলি ব্রেকিং-নিউজ করেছে বিষয়টিকে।
কল্পোত্তম বুঝতে পারছিল চিতামঙ্গলের নিজের দেশে এভাবে চিতার আগমন মিথ তৈরি করতে চলেছে। মিথের ঢেউ তৈরি করতে চলেছে।
আঁখি ও তাকে রাখা হয়েছে বেশ কিছুটা দূরের এক রিসর্টে। এ-রিসর্ট’টা বেশ নিরিবিলি। আঁখির রুমের বিছানায় আধশোয়া হয়েছিল কল্পোত্তম। তার ফোনে মিলির ফোন এসেছিল; ধরেনি কল্পোত্তম। বেজে দিতে দিয়েছিল। মিলির ফোন এভাবে বেজে গেলে বেশ খুশি হয় আঁখি। তার মাথার চুল ঘেঁটে দেয়। পিলো-ফাইটিং শুরু করে, এবং তারপর তার ঠোঁটে ঠোঁট বসিয়ে দেয়। আঁখির ঠোঁট থেকে ভেসে আসে সিগারেটের গন্ধ।
ভাইরাল হচ্ছিল চিতার ভিডিও, একাধিক ভিডিও।
এই নির্জনে কান পাতলে অনেক দূর থেকে মানুষের সমবেত শব্দ শোনা যায়। পঞ্চাশ-ষাট বছর আগের গল্প-উপন্যাসে দূর বনবস্তি থেকে আদিবাসীদের নাচগানের শব্দ ভেসে আসার কথা দেদার পাওয়া যেত। রাত্রি হতো অবধারিতভাবে পূর্ণিমা। ধামসা-মাদল এখন আর তেমন শোনা যায় না; শোনা যায় ঢিকঢিক করে বেজে যাওয়া ডিজে-বক্সের আওয়াজ। আর মাঝে মাঝে সমবেত চিৎকার, কারা যেন এক ভয়ার্ত প্রাণীকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার রক্তঝরনার দিকে।
আঁখির বুকে কান পেতে শুয়ে সে-শব্দ শুনতে পাচ্ছিল কল্পোত্তম। বহুদূর থেকে ভেসে আসা শব্দ। ধিকধিক করে কিছু যেন একটা পুড়ে যাচ্ছে কবে থেকে।
ডিনার দিতে আসা ছেলেটা নিঃশব্দে টেবিলের ওপর খাবার রেখে চলে গিয়েছিল। সে চলে যাবার পর দরজা দিতে দিতে আঁখি আবিষ্কার করেছিল চিতাটি সত্যিই ঘুরে বেড়াচ্ছে কাছেপিঠে; মানে, তারা জাতীয় সড়ক দিয়ে আসার সময় যে ছোট নদীটার কাছে নেমে মিনিট-দশেক দাঁড়িয়েছিল; যেখানে ভূতের মতো সঙ্গিহীন অবস্থান করছে একটা টাওয়ার, সেখানেই ধানখেতের ধারে ঝিমাচ্ছে চিতাটি।
ক্লিপিংয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সে-টাওয়ার, নদীর পাড়। নদীর বুকে জলহস্তীর মতো পড়ে থাকা বড় বড় পাথর। গুগল দেখাচ্ছে সব থেকে কাছের যে-বনে চিতা থাকার কথা তা অন্তত পাঁচ-শো কিলোমিটার দূর। পাশের রাজ্যে। মাঝখানে বড় বড় শহর। এতটা পথ পাড়ি দিয়ে চিতাটির এখানে আসা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। কল্পোত্তম আঁখির বুকে আরও একবার মুখ গুঁজে দিয়ে বলেছিল, ‘বাঘিনীও নিশ্চয় আছে কাছেপিঠে… না-হলে চিতা এতটা কষ্ট করত না।’ ইঙ্গিতপূর্ণ কথায় হেসে উঠেছিল আঁখি।
ক্লিপিং’টা আবার চালিয়ে দিয়েছিল আঁখি হালদার, কল্পোত্তমের বুকের ওপর শুয়ে। বলেছিল, ‘দেখো, চিতাটা তোমার মতই ঝিমাচ্ছে এখন, কত কাছাকাছি চলে গেছে ছেলেপুলের দল… কিছুই বলছে না… মেরেকেটে একশো-ফুট… চিতাটা কিন্তু মাথা গুঁজে শুয়ে রয়েছে… তোমার মতই টায়ার্ড…।’
৩
দু’-দিনের সেমিনারের শেষ দিনের কর্মসূচি বাতিল হয়ে গেছে। চিতামঙ্গলকাব্যের ভূমি এখন খবরের শিরোনামে। ক্যামেরা নিয়ে পড়ে আছে টিভি-চ্যানেলগুলো। দেড়-দিন ধরে বাঘটা একইভাবে শুয়ে রয়েছে, মাঝে একটু উঠে কিছুটা হেঁটে আবার শুয়ে পড়েছে। মব্ আটকানোর মতো পুলিশ নেই। বেশ কয়েকজন বিপজ্জনকভাবে চিতার কাছাকাছি চলে গিয়েছিল মোবাইল হাতে। সেলফি-জোনের মতো একটা জায়গা তৈরি হয়েছে চিতার কাছাকাছি।
রিসর্টের নিচের তলার লনে একটি সিলিং-ফ্যানের নিচে আঁখি হালদার আর কল্পোত্তমের মুখোমুখি বসেছিল দিবাকর মাঝি। বয়স মধ্য-চল্লিশ। শাদা-জামার ভেতর থেকে পেটের শক্ত চর্বি ফেটে বেরোতে চাইছিল। দিবাকরের হাতে ঘন রোমের মধ্যে শুয়ে ছিল একটা গোল্ডেন ডায়ালের ঘড়ি। গাঁক গাঁক করে কথা বলা তার স্বভাব; কাল থেকে চিনে-জোঁকের মতো লেগে রয়েছে তাদের সঙ্গে। কেন লেগে রয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। দিবাকর হাসতে হাসতে টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ছিল, মাঝে মাঝে ফুর্তিতে হালকা ঘুঁষি মারছিল টেবিলে, ‘শালা, এমন চিতা আমি বাপের জন্মে দেখিনি… কী বুঝলেন!… আমার গ্রামের একটা ছেলে দিয়েছে চিতার ইজ্জত ফুটো করে… প্রথমে চিতার লেজ ধরে টেনেছিল… তারপর চিতাকে দু’পায়ের মাঝখানে নিয়ে, ছাগলের মতো করে পিঠে চড়েছিল… গ্রামে বাচ্চারা ছাগল নিয়ে এমন খেলা করে…।’
দিবাকর চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে বিশাল শরীরটাকে মেঝের কাছ বরাবর ঝুঁকিয়ে একটা কল্পিত চিতাকে দু’পায়ের মাঝখানে নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিল বিষয়টা।
গ্রামবাসীর চিতার পিঠে চড়ে বসার ক্লিপিংটাও ভাইরাল হয়েছে। চিতামঙ্গলকাব্য’র নিজের ভূমিতে হাসিমুখে চিতার পিঠে চড়ে বসছে মানুষ।
আঁখি’র কপালে ঘাম দেখে দিবাকর চিৎকার করে কোল্ডড্রিংস অর্ডার করেছিল। রিসর্টের কিচেনের কাছে রাখা ফ্রিজ থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে এসেছিল ঠান্ডা-পানীয়ের বোতল। শাদা, সরু সিগারেট ধরিয়ে কল্পোত্তমের দিকে প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়েছিল দিবাকর। তারপর প্যান্টের জিপারের কাছে হাত বোলাত বোলাতে একবার ওয়াশ-রুম থেকে ঘুরে এসে চিৎকার করে বলেছিল, ‘শালা বাথরুমে ফিনাইল দিস না কেন?’ ফিনাইলের বোতল হাতে ছুটে এসেছিল একটা ছেলে।
দিবাকর জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আপনারা ওই ছাগল-চিতার মাঠের দিকে যাবেন? দেখে আসবেন একবার রগড়?’
আঁখি, কল্পোত্তমের চোখে চোখে কথা হয়ে গিয়েছিল, ক্যামেরা আর মিডিয়ার সামনে ঘোরাঘুরি করার কোনও মানেই হয় না।
‘ওই ফালতু রগড় দেখতে আর ইচ্ছে করছে না; কাল একজন বলছিল বনের কোথায় যেন চিতামঙ্গল গেয়ে পুজো হয় প্রতি-বছর। ওখানটা ঘুরে আসা যেতে পারে…,’ আঁখির কথা শুনে আবার হো হো করে হেসে উঠেছিল দিবাকর।
‘নো-প্রব্লেম… সবই আমাদের এলাকা। আমার গাড়ি রয়েছে; এক ঘণ্টা লাগবে টোটাল ঘুরতে… কাছেই তো,’ দিবাকর শাদা-শার্টের হাতাটা একটু গুটিয়ে নিয়েছিল।
একটা গাছের নীচে কয়েকটা জন্তুর মাটির মূর্তি। তারা চিতাবাঘ থেকে শুরু করে ঘোড়া – যা কিছু হতে পারে। গাছের নিচু-ডালে মনস্কামনার সুতো আর ঢিল বাঁধা। রাঢ়ের নির্জন গাছের নিচে বহু জায়গায় এ-ধরনের মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। দিবাকর গাছের চারদিকে একবার ধপ-ধপ করে ঘুরে নিয়েছিল।
দূরে একটা শহিদবেদি; এত নির্জন জায়গায় শহিদবেদি সাধারণত থাকে না। আঁখি এক-দৃষ্টিতে চেয়েছিল কিছুক্ষণ। দিবাকর মাঝির চোখ চরকির মতো ঘুরছে; চিতামঙ্গল-থান যে তাদের খুব একটা টানেনি সেটা না-বোঝার মতো বোকা সে নয়। কিছু একটা দেখানো দরকার; আঁখির চেয়ে থাকা তার সমস্যার সমাধান করে দিল।
থপ-থপ করে বেদির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দিবাকর, সঙ্গে আঁখি আর কল্পোত্তম।
কালো বর্ণগুলো ঝরে গেছে, ক্ষয়ে গেছে। কিছুই পড়া যাচ্ছে না। আঁখি আর কল্পোত্তম ফিরে যাবার জন্য উশখুস করছিল। দিবাকর বলতে শুরু করেছিল, ‘এ-শহিদবেদিও আমাদেরই… এখানকার মানুষরা এক-একটা চিতা… আমার বাবার নামে এই শহিদবেদি…।’
কিছুক্ষণ চুপ করেছিল দিবাকর। চারদিক থমথম করছে।
‘আমরা তা হলে একজন শহিদের ছেলের সঙ্গে এতক্ষণ ঘুরেছি!,’ আঁখি’র হাতে পশমের মতো রোম খাড়া হয়ে উঠতে দেখেছিল কল্পোত্তম।
‘বাবা বিল্পবী পার্টি করত… তবে মানুষ মারার কলে ছিল না… শোনা কথা, বাবার লাইন ছিল আলাদা। এই যত জমি দেখছেন সব আমাদের… বাবা গ্রামের লোকদের বিলিয়ে দিয়েছিল। বাবা সারজীবনে একটাও খুন করেনি; তবু তাঁর নামে সারা জেলায় মুনাফাখোররা কাঁপতো,’ দিবাকর মাঝির চোখ চকচক করে উঠেছিল।
‘তা আপনার বাবাকে মারল কারা?’ কল্পোত্তম সিগারেট ধরিয়েছিল।
হো-হো করে হেসে উঠেছিল দিবাকর, ‘বাবার আসলে ঘরে-বাইরে শত্রু বেড়ে গিয়েছিল। এক তো জোতদাররা; আর উলটো দিকে দলের অনেকেই বাবার লাইন মেনে নিতে পারেনি… তারা মনে করত বাবা ইচ্ছাকৃতভাবে আন্দোলন দুর্বল করে দিচ্ছে। একদিন মিটিংয়ের নামে ডেকে খুন করে দেয় এখানে… এই এখানেই…,’ পায়ের কাছে একটা জায়গায় আঙুল নির্দেশ করেছিল দিবাকর।
‘আপনি চিনতেন তাদের?’ আঁতকে উঠেছিল আঁখি।
‘চিনতাম মানে? এখনও চিনি, আলবৎ চিনি… পরে পরে তারাই দল বদলায়… আমার কাজ-কারবারের জন্য এখন তাদের সঙ্গে পার্টিতে বসতে হয়… খানাপিনাও চলে… কিছু কিছু জমি রিকভার করেছি, আরও বিঘে-তিরিশেক জমি বেহাত হয়ে আছে। এবার ভোটের পর সব চলে আসবে হাতে,’ আরেকটা সিগারেট ধরিয়েছিল দিবাকর।
দু’টান দিয়ে সিগারেটের বাট্ জুতো দিয়ে মাড়িয়ে গাড়ির ডানদিকের দরজা খুলে স্টিয়ারিং ঘুরিয়েছিল দিবাকর। কম গতি’তে গাড়ি চালাতে চালাতে বলছিল, ‘উঁচু মহলে আপনাদের অনেক হাত… আমাকে দাদা সব বলেছেন… এ-গ্রামের মানুষের মধ্যে এক-একটা চিতা আছে। জেলা পরিষদ ম্যানেজ করে একটা প্লট নিয়েছি, কন্সট্রাকশন করব… এটা আমার ড্রিম-প্রজেক্ট… কাউকে চটাতে নেই আমাদের কারবারে, আপনাদের রিপোর্ট দেবার কথা নয়, তবু যদি রিপোর্ট-ফিপোর্ট দেন তো আমার প্রজেক্টটা বাঁচিয়ে যা-খুশি দেবেন… ওইইইই ওখানে আমার জমি…।’
চার-হাত পাঁচিল তোলা একটা বিরাট চত্বর, ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে এসে বসছে।
একবার কাঁচ নামিয়ে দ্রুত তুলে দিয়েছিল কল্পোত্তম; দিবাকর একটা-দু’টো কথা বলছিল, ‘এটাও শোনা কথা – বাবা বেঁচে থাকলে না কি কয়েক বছরের মধ্যে এ-অঞ্চলের মানুষের হাল বদলে যেত… বাবাকে ওরা মেরে ফেলেছিল, শেষ ফাইটটা আর দেওয়া হয়নি বাবার।’
এসি চলছে গাড়িতে, তবু বেশ বোঝা যাচ্ছে লাল, পাথুরে মাটির ভেতর থেকে আগুনের তাপ ছিটকে উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে।
রিসর্টে ফিরে এসে জামাকাপড় গুছিয়ে একটা টি-শার্ট আর ট্র্যাকশ্যুট পরেছিল আঁখি হালদার। আঁখিকে স্পোর্টি-লুকে সব সময়েই ভাল লাগে কল্পোত্তমের, বাইরে পৃথিবী পুড়ছে।
আঁখির পোশাক খুলে নিজেকে তার শরীরে মিশিয়ে দিয়েছিল কল্পোত্তম। তারপর এসি’টাকে আরও কমিয়ে চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলেছিল, ‘আজ তোমার ‘ম্যাড’ আর উন্নয়ন নিয়ে বলা সবার মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে… দারুণ ধরেছো্… ওই মিউচুয়ালি অ্যাসিওরড ডেস্ট্রাকশন কনসেপ্ট’টা অনেকেরই অজানা…।’
বাইরে পৃথিবী পুড়ছিল, আঁখি একবার চোখ খুলে কল্পোত্তমের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘এই যেমন তুমি আমাকে ডেসট্রয় করছ, আর আমি তোমাকে…।’
অর্থহীন হাসি ঘুরে বেড়াচ্ছিল রিসর্টের ঘরে।
চিতামঙ্গলের নিজস্ব ভূমিতে, শহিদবেদির কাছ থেকে মুখ ফেরানোর সময় পায়ের নিচে সিগারেটের বাট্টা পিষে ফেলেছিল দিবাকর মাঝি।
আঁখির ফোন এক পাশে রাখা, চিতার নতুন একটা ক্লিপিং ফুল ভল্যুয়মে চালিয়ে দিয়েছিল সে, চিতাটিকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
সাব-ডিভিশনাল অফিসার বাইট দিচ্ছিলেন, বাইট দিচ্ছিলেন এক প্রাণী-বিশেষজ্ঞ। তিনি বলছিলেন, ‘সম্ভবত চিতাটি চোটগ্রস্ত… আরেকটি সম্ভাবনার কথাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না, অনেক সময় চিতার জটিল স্নায়বিক বিকার ঘটে… তখন সে তার নিজের আইডেনটিটি ভুলে যায়, সে নিজেকে চিনতে পারে না… আর-পাঁচটা নিরীহ প্রাণীর মতো ঘুরে বেড়ায়… এ-চিতার ক্ষেত্রেও তেমনই কিছু ঘটে থাকতে পারে… আমাদের নজরে রাখতে হবে… থ্যানকফুলি, এক্সটারনাল ইনজুরি দেখতে পাওয়া যায়নি… বাকিটা আটচল্লিশ ঘণ্টা না-কাটালে, ডিটেলস ইনভেস্টিগেশন না-করে কিছু বলা যাবে না… তবে, একটাই আশার কথা, রাজ্যের পর্যটন-শিল্পের জন্য এটা আশার কথা… এ-অভয়ারণ্যে, আপনারা সবাই জানেন, আজ থেকে দু’-আড়াই’শো বছর আগে শেষবার চিতা দেখা গিয়েছিল।… সম্ভবত এ-চিতা’টি তার আইডেনটিটি ভুলে গেছে…।’
Leave feedback about this