উপন্যাসের পটভূমি
উপন্যাসের স্থান : আমেরিকা।
ঘটনাকাল : সিভিল ওয়ার (১৮৬১-১৮৬৫) পরবর্তীকাল
আমেরিকার সবচেয়ে জঘন্য প্রথাটি ছিল দাসপ্রথা। কালোদের ওপর যে নির্য়াতন চালানো হয়েছে, মানব ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায় ছিল সেটি। এই দাসত্বপ্রথা আরও চলবে কি না, সিভিল ওয়ার বা গৃহযুদ্ধটা ছিল তাই নিয়ে। কিন্তু একসময় এই যুদ্ধ শেষ হলো। কালোরা মুক্ত হলো।
উপন্যাসের পাত্রপাত্রী ও কাহিনি : কালো জনগোষ্ঠী। তারা মুক্ত, কিন্তু তারপর তাদের যে নতুন পরিস্থিতি মুখোমুখি হতে হচ্ছে, এই উপন্যাসের কাহিনি সেটাই। মুক্তির পথে তারা এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কীভাবে?
লেখক হাওয়ার্ড ফাস্ট কালোদের মুক্তির পথে এগিয়ে যাওয়ার গল্পই বলেছেন এই উপন্যাসে। মার্কিন ইতিহাসের জঘন্যতম ও চিত্তাকর্ষক গল্প এটি। উপন্যাসটিও বিশ্বজুড়ে আলোচিত একটি বিখ্যাত উপন্যাস।
ঔপন্যাসিকের উপক্রমণিকা
যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। দীর্ঘ রক্তঝরানো সেই যুদ্ধ। এ্যাতো বড় যুদ্ধ বোধহয় আর দেখে নি পৃথিবীর লোক। সে যুদ্ধ শেষ হলো শেষ পর্যন্ত। নীল পোশাক পরা লোকেরা ফিরে এল ঘরে। ধূসর পোশাক পরা লোকেরা হতবাক দৃষ্টি আর ক্ষরিত হৃদয় নিয়ে তাকিয়ে রইল তাদের বিস্তীর্ণ ভূমির দিকে। দেখল যুদ্ধ কি করতে পারে।
এ্যপোম্যাটোক্স কোর্ট হাউজে জেনারেল লী তার অস্ত্র সমর্পন করলেন আর অবসান হল এই যুদ্ধের। উষ্ণ দক্ষিণ দেশে চব্বিশ লক্ষ কালো মানুষ মুক্ত হল। বড় কষ্টে পাওয়া এই স্বাধীনতা, বড় মূল্যে কেনা। একজন মুক্ত মানুষের কাছে তার গতকাল আর আগামীকাল দুটোই একান্ত নিজের। সে দুটোরই হিসাব রাখে। ক্ষিদেয় পেট জ্বলছে, কিন্তু কোনো প্রভু নেই তোমার মুখে খাবার তুলে দেবার, তবে দ্রুত পা ফেলে হেঁটে গেলেও তো কেউ নেই যে বলবে, আস্তে হাঁটো। এই কালোদের মধ্যে দু’শ হাজার ছিল প্রজাতন্ত্রের সৈন্য। তাই যখন যুদ্ধ শেষ হলো অনেকেই ঘরে ফিরে এল হাতের বন্দুক সাথে নিয়ে।
গিডিয়ন জ্যাকসন ছিল তাদেরই একজন। দীর্ঘ মজবুত দেহে ক্লান্তি, হাতে বন্দুক, গায়ে রংচটা নীল পোশাক, সে ফিরে এল ক্যারোলাইনার মাটিতে, কারওয়েল জমিদারিতে (প্ল্যান্টেশনে)। বিশাল সাদা বাড়িটা যেমন ছিল তেমনি দাঁড়িয়ে আছে ওর মনে পড়ল। যুদ্ধে তার কিছুই হয় নি। কিন্তু মাঠে আর বাগানে আগাছা, জঙ্গল। কারওয়েলরা চলে গেছে, কেউ জানে না কোথায়। মুক্ত মানুষেরা ফিরে এসে তাদের পুরোনো দাস কোয়ার্টারগুলোতে আবার জীবন শুরু করল, যারা কোথাও যায় নি তাদের সাথে। যতই মাস যেতে লাগল কারওয়েল জমিদারিতে আরও আরও মুক্ত মানুষেরা ফিরে আসতে লাগল, উত্তরের ঠান্ডা ভূমি থেকে, যেখানে তারা স্বাধীনতা খুঁজতে গিয়েছিল, ইউনিয়ন সেনাবাহিনী থেকে যেখানে তারা লুকিয়ে ছিল, পাইনের বনে অথবা জলাভূমিতে। সব জায়গা থেকে মুক্ত মানুষের দল ফিরতে লাগল। পুরোনো জীবনে ফিরে গভীর বিস্ময়ের সাথে ওরা দেখল যে ওরা এখন স্বাধীন।
পর্ব ৪
তৃতীয় অধ্যায়
কিভাবে গিডিয়ন জ্যাকসন চার্লস্টনে গেল এবং এই অভিযানে কি কি ঘটল, যতই দিন যেতে লাগল তেমন কিছুই ঘটছিল না বলে ওর সম্মেলনের প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়াটা এক সময় খুব সাদামাটা একটা ব্যাপার হয়ে উঠল। এমনও হতো যে দু’তিন দিন চলে যেত ও ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতও না। আসলেই তো, ও যে একজন প্রতিনিধি তার কি প্রমাণ আছে? প্রথমে যখন ব্রাদার পিটার ভোট নিয়ে তাঁর লম্বা বক্তৃতাটা দিয়েছিলেন তখন তো মনে হয়েছিল নির্বাচনের সময় যারা উপস্থিত ছিল তারা সবাই বুঝি ওর পক্ষে। পরেও কেউ বলে নি যে ওর বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবে ও আর ব্রাদার পিটার ধরেই নিয়েছিলেন ও-ই প্রতিনিধি হয়েছে। কিন্তু ভোট তো হয়েছিল গোপনে। ওদেরকে বলা হয়েছিল যখন ভোট গোণা হবে প্রতিনিধিদের জানানো হবে, তারপর তারা কাগজপত্র পাবে। কিন্তু দুই সপ্তাহ তো হয়ে গেল। আশা-নিরাশার দোলায় দুলতে দুলতে মাঝে মাঝে নিজের মনে গিডিয়ন প্রশ্ন করত, একজন ভাল গণকের পাঁচ ছ’শো ভোট গুণতে কত দিন লাগতে পারে? পরে ও এ ব্যাপারটাকে মন থেকে ঝেড়েই ফেলল। কোনো সুস্থ মাথার ইয়াঙ্কি বুদ্ধু কালা আদমিদের প্রতিনিধি হতে ডাকবে না।
শীত পড়তেই ওকে ব্যস্ত করে ফেলার মতো ম্যালা বিষয় এসে গেল। গরমে তো বেঁচে থাকাটা সোজা, জীবন অনেক আরামের। শীত আসার শুরু থেকেই সবাইকে চিন্তা-ভাবনা শুরু করে দিতে হয়। এক সপ্তাহ ধরে গিডিয়নকে লোক দিয়ে যেটাকে ‘লোয়ার সেকশন’ বলে সেখানে কাঠ কাটিয়ে নিতে হলো। পুরোনো দিনগুলোতে যখন ওভারসিয়ার এসব দেখাশোনা করত, তখন পরিস্কার দিকটা থেকে কাঠ কেটে নেয়া হতো। কিছুই বাকি থাকত না। কেবল দুই ফুট উঁচু একটা গাছের গুঁড়ি সারাবছর ধরে পচত। গিডিয়ন সেকথাই ভাবছিল। এ বছর ও প্রস্তাব দিল ওরা গুঁড়িশুদ্ধ গাছটা কেটে মাটিটা সমান করে ফেলবে।
‘দ্বিগুণ খাটুনি, কিন্তু কেন?’
‘গুঁড়িশুদ্ধ গাছটা ওপড়ানো সহজ গাছ বাদ দিয়ে গুঁড়ি ওপড়ানোর চেয়ে।’
‘গুঁড়িটা আবার কে ওপড়াতে যাবে?’
‘সেটা তো আমরা জানি না’, গিডিয়ন বলল, ‘জমিটা যে কার? একদিন হয়ত তুমি বা আমি এটার মালিক হব।’
‘সে যখন হবে তখন দেখা যাবে।’
ওরা হয়ত এটা নিয়ে তর্ক করেই অর্ধেক দিন কাবার করত যদি না গিডিয়ন হঠাৎ উদ্দীপ্ত হয়ে প্রস্তাব দিত যে এ নিয়ে ভোট হয়ে যাক। এমনকি যখন ও বলল তখনো ও নিশ্চিত ছিল না এতে কাজ হবে। কাঠ কাটার মতো রোজকার কাজের ছোট্ট একটা ব্যাপারে এমন রহস্যময় একটি নীতি প্রয়োগ করা যাবে কি না, সেটা নিয়ে ভাবনা ছিল। কিন্তু কথাটা সবার মনে ধরল, সবার নীরব সম্মতিতে ও হ্যাঁ-না ভোটের পদ্ধতিটা কাজে লাগাল। যদিও এসব লোকেরা সম্মেলনের জন্যে ভোট দিয়েছিল তবু পুরো ব্যাপারটা তো নতুন আর বৈপ্লবিক। আগে ওদেরকে ঠিক করে নিতে হলো একজন লোক কি কেবল হ্যাঁ বা না ভোট দেবে নাকি হ্যাঁ-না দুটোই দিতে পারবে। শেষ পর্যন্ত ভোটের নীতিটাই প্রয়োগ করা হলো, আর তাতে কাজও হলো। গুঁড়িশুদ্ধ গাছ উপড়ে ফেলার জন্যে গিডিয়নের প্রস্তাবটাই অনেক বেশি ভোটে জিতে গেল।
আবার যখন ষাড়ের মতো শক্তিশালী ও বড়সড় মানুষ ট্রুপার প্রতিবাদ করে বলল যে ও যা ব্যবহার করবে তার তিনগুণ বেশি কাঠ চেরাই করছে, যেখানে হ্যানিবালের মতো ছোট্টখাট্ট মানুষ তার অর্ধেকও করছে না, তখন আবার গিডিয়ন ভোটের কথা তুলল। কেবল একটা নতুন বিষয় এবারে দেখা গেল, সবাই নিজেদের যন্ত্রপাতি নামিয়ে রেখে পারষ্পরিক সহযোগিতার কথা বলল। ওভারশিয়ারের সেই দিনগুলোতে একসাথে কাজ করাটাই ওদের দ্বিতীয় স্বভাব হয়ে গিয়েছিল। এখন যখন ওরা এই সত্যটা জানতে পারল যে ওরা মুক্ত, ওদের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কেন ওরা প্রত্যেকে নিজের জন্যে কাজ করবে না? মুক্তির মানে যদি তা না হয় তবে এর মানে কি?
ব্রাদার পিটারের এই প্রস্তাবটি ভোটে দেয়ার আগে অনেক চিন্তা-ভাবনা করা হলো। হ্যানিবাল ওয়াশিংটনের ছোট্ট মুখটি রাগে শক্ত হয়ে উঠল। ও ট্রুপারকে বলল,‘ দেখ, তুমি তোমার একার কাঠই কাট। তাতে আমরা যে কাঠ কাটছি তার সমান ভাগ হতে কোনো অসুবিধা হবে না। আমাকে ঠাট্টা করছ কেন? তুমি নিজে তো একটা কাল কাকের বড় মাংসের টুকরো বই নও।’
ট্রুপার ওর কুড়াল উঁচিয়ে এল। গিডিয়ন আর অন্যেরা ওদের আলাদা করে দিল, ব্রাদার পিটার চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ছি ছি ছি, এমন একটা ব্যাপারের জন্যে যারা রক্তারক্তি ঘটায় তাদের জন্যে লজ্জা হয়!’
প্রায় ঘণ্টাখানেক উচ্চকণ্ঠে আলোচনা চলল। এবারে কিন্তু খুব সামান্য ব্যবধানে ও জিতল। পরে ব্রাদার পিটারকে গিডিয়ন বলল, ‘আমরা আর ঝামেলামুক্ত থাকতে পারব না।’
‘মানুষ যে কেন এমন করে?’
‘যাকগে, আমার মাথাব্যাথা করছে, এইভাবে লোকগুলো বাচ্চাদের মতো চেঁচামেচি আর ঝগড়াঝাটি করছে দেখে।’
‘গিডিয়ন ওরা একসাথে কাজ করা বা একা কাজ করা এসবের কিছুই বোঝে না। ওরা এখন বাচ্চাদের মতো একটা বা দুটো গরমকাল মাত্র গেছে দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়েছে। সময় বড় আস্তে চলে।’
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আরো ঝামেলা দেখা দিল। ভোটের ব্যাপারটা ছিল উজ্জ্বল তীক্ষ্ণ সূর্যালোকের মতো। তারপর কিন্তু আর কিছুই ঘটছিল না। জীবন আগের মতই চলছিল। গিডিয়ন লক্ষ করছিল, আজকাল প্রায়ই লোকেরা বড়ো জমিদার (প্ল্যানটেশন) বাড়িটার জানালা দিয়ে উঁকি-ঝুঁকি দেয়। বাড়িটা নানা রকম সুন্দর সুন্দর জিনিসে ভর্তি, সেসব নিয়েও খুব বেশি কথাবার্তা হচ্ছে। সেসবের ভেতরে গিডিয়নের বিরুদ্ধেও কিছুটা অসন্তোষের সুর থাকে। কারণ বছর খানেক হয়ে গেল দক্ষিণ ক্যারোলাইনার দলছুট সৈন্যরা এসে বিশাল বাড়িটার তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে ওদের ইচ্ছেমত সব নিয়ে গেছে, আর বাদবাকি যা কিছু ছিল, ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে রেখে গেছে। গিডিয়ন সেই সব কিছু আবার আগের মতো গুছিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়েছিল। যখন ওরা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কেন?’ ও বলেছিল, ‘এগুলো তো আমাদের জিনিস না।’
‘আমরা যে কাপড় পরি, যে বাড়িতে থাকি ওগুলো কিভাবে তার চে আলাদা?’
‘একটা দরকারি, অন্যটা নয়’, গিডিয়ন উত্তর দিয়েছিল।
এখন ও মার্কাসের হাতে একটা রুপোর চামচ দেখতে পেল যেটা ওই বাড়ি ছাড়া আর কোথাও থাকতে পারে না।
সেটা কিভাবে হলো? মার্কাস ওই বাড়িতে ঢুকেছিল। বিশাল ছড়ানো ছিটানো একটা বাড়ি। একশটা ঢোকার আর বেরুনোর পথ আছে, এটার ভেতরে ঢোকা কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। কিন্তু এই প্রথম গিডিয়ন কিভাবে বাচ্চাদের বড়ো করবে তা ভেবে একটা অনিশ্চয়তা বোধ করল। এটা নিয়ে ভাবতে গিয়ে ওর মনে হলো যে, এতদিন ও কেবল জানত একটা বাচ্চাকে নিয়ে কি করতে হয়। নিজের অজ্ঞতা সম্পর্কে বিশাল এক ভয় ওকে ঘিরে ধরল। প্রতি রাতে ও আগুনের পাশে বসত ব্রাদার পিটারের লেখা শব্দগুলোর তালিকাটা নিয়ে। পুরুষ, নারী, মেয়ে, তুমি, নিগ্রো, চওড়া, এমনি সব শব্দ, সব মিলিয়ে যেন তথ্যের এক পাহাড় যা ওকে হতবুদ্ধি ও সন্ত্রস্ত করে তুলল। ওর কাছে ভুল ও শুদ্ধের ধারণা, খুব দৃঢ় না হয়ে ক্রমশই নমনীয় হয়ে উঠছিল। মার্কাসকে শাস্তি না দিয়ে ও অনিশ্চিতভাবে জিজ্ঞেস করল, ‘মার্কাস ওই বড় বাড়িটায় ঢুকলে কি করে?’
‘আমি ওখানে যাই নি।’
তার মানে মার্কাস মিথ্যে বলছে। ‘ও তো একটা ভাল ছেলে’, গিডিয়ন ভাবল। সমস্যা আর ধাধাঁগুলো যেন সীমা ছাড়াচ্ছে।
‘তুমি এই চামচটা কোথায় পেলে?’ গিডিয়ন জানতে চাইল।
‘কুড়িয়ে পেয়েছি।’
‘তুমি ওটা পাও নি মার্কাস, আমাকে সত্যিকথা বল।’
‘পেয়েছি।’
‘তাহলে বল কোথায় পেলে ওটা।’
মার্কাস অপ্রস্তুত অবস্থায় ধরা পড়ে গেছে। ধীরে ধীরে একটু একটু করে গল্পটা জানা গেল। রান্নাঘরের নীচের দিক দিয়ে ওরা ওখানে ঢুকেছিল। অন্য ছেলেরা অনেক জিনিস নিয়েছে, সিল্ক, রুপো, সেগুলো লুকিয়ে রেখেছে। গিডিয়ন ওকে চাবুক মারতে পারল না। ও কখনো বাচ্চাদের কাউকে মারে নি, ওর লোকেরাও মারে নি। চাবুকের ব্যাপারটা সাদাদের ওপর ছেড়ে দেয়াই ভাল, ও জানে পিঠের ওপর চাবুক কেমন লাগে।
গিডিয়ন একটা সভা ডাকল, সেখানে সবার সামনে মার্কাসকে দাঁড় করালো। প্রত্যেকটা শব্দ যেন ছেলেটাকে ছুরির মতই আঘাত করল, ও বলল কি ঘটেছিল। ব্রাদার স্টিফেন জানতে চাইল,‘আর কতদিন ঐ বাড়িটা এমন দাঁড়িয়ে থাকবে ভাই গিডিয়ন?’
‘হয়ত শেষ বিচারের দিন না আসা পর্যন্ত।’
‘কালোরা নোংরা ভাঙা চালাঘরে থাকে, আর ঐ বিশাল বাড়িটায় কেউ থাকে না।’
‘হাশরের দিন আসুক’, গিডিয়ন জেদি স্বরে বলল।
সেই রাতে র্যা শেল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ব্যাপারটা তুলল, ‘কি করে তুমি ছেলেটার সাথে এমন করতে পারলে?’
‘যা করার আমি তাই করেছি।’
‘সবার সামনে এভাবে ওকে লজ্জা দিলে।’
‘ও একটা খারাপ কাজ করেছে।’
‘মনে হচ্ছে সেই ভোটের বিষয়টার পর থেকে সবই খারাপ কিছু হচ্ছে।’
‘কি বললে?’
‘সেটাই তো তোমাকে চার্লস্টনে নিয়ে যাবে, আর এখানে লোকেরা রাগে গজগজ করছে, কিছুই হচ্ছে না, কিচ্ছুই ঠিকঠাক চলছে না।’
গিডিয়ন ঘুমিয়ে পড়ার ভান করতে র্যা শেল চুপ করে গেল। ওর ফোঁপানোর শব্দ শোনা যেতে লাগল।
পনের বছর বয়সে জেফ যেন ওর বাঁধনগুলো সব টেনে ঘষে খুলে ফেলতে চাইছিল। বুনো জানোয়ারের মতো মাথা গরম আর শক্তপোক্ত ছিল ও। ওর কাছে গিডিয়ন একজন বয়স্ক লোক আর ব্রাদার পিটার বুড়ো ভাম। ওরা চারপাশের দুনিয়াটাকে ওর গলা-ঘিরে ফাঁসের মতো এঁটে দিতে চায়। ও বন্দী হয়ে আছে আর এই দাসত্বের শেকল ভেঙে ও মুক্ত হতে চায়।
এই ছোট্ট সমাজটায় যেখানে কেউ লেখাপড়া জানে না, সেই সুযোগ পায়ও না, যেখানে কোনোদিন কোনো পত্রিকা যায় না, সেখানে সময় রাবারের মতো আদিম স্থবির একটি ব্যাপার হয়ে ওঠে যেমন ছিল হাজার বছর আগে। একটি ঘড়ি পর্যন্ত নেই, সূর্যটাই মাথার ওপরে ঝুলছে যেন একটা বড় কমলা রঙের টেবিল ঘড়ি, ঋতুর ধীর মন্থর গতিই সহজে এখানে দিনপঞ্জির কাজ করে।
এখন জেফের বয়স পনেরো। যুদ্ধের আগের দিনগুলোর স্মৃতি ওর মনে ফিকে আর ঝাপসা হয়ে এসেছে। এই যে মুক্তি আর দাসত্ব নিয়ে সারাক্ষণ এত কথাবার্তা হচ্ছে, সেসব ওর মনে সামান্যই দাগ কাটে। মনে হয় যেন ও জন্মেছিল একটা বিশৃঙ্খলার ভেতরে আর ওর সারা ছোটবেলাটা জুড়ে সেই বিশৃঙ্খলা আর নৈরাজ্যই চলছে।
(চলবে)
মোবাশ্বেরা খানম বুশরা
জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, বেড়ে ওঠা ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরোজি বিভাগে স্নাতক, মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন। টেলিভিশন নাটকের নাট্যরূপ দিয়েছেন। মৌলিক নাটকও লিখেছেন। জীবনসঙ্গী : বরেণ্য চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন নাটক নির্মাতা সাইদুল আনাম টুটুল (প্রয়াত)। প্রকাশিত অনূদিত গ্রন্থ : মার্ক টোয়েনের আত্মজীবনী (মূল : মার্ক টোয়েন), নারীর ভাগ্য জয়ের অধিকার (মূল : ম্যারি উলস্টোনক্রাফট), নারী এবং ক্রমবিবর্তিত সভ্যতা (মূল : উইনিফ্রেড হন্টবি), শৈশব, কৈশোর ও যৌবন (মূল : লিও তলস্তয়), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি (মূল : এ জি স্টক)। স্মৃতিচারণ : পাতার কুটির।