তুমুল আড্ডা হচ্ছে কোনো রেস্তোরাঁয়, ধরা যাক শরিফ মিয়ার ক্যান্টিন। গাল-গল্প, হাসি-ঠাট্টায় মশগুল স্থানীয় কয়েকজন তরুণ লেখক। চা আসছে দফায় দফায়। আড্ডা তখন তুঙ্গে। হঠাৎ এর ভেতর থেকে একজন ঝটিতি উঠে দাঁড়ালেন, চলি বলে আর মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে গেলেন হন হন করে। ক্যান্টিনে বসেই দেখা যায় আবুল হাসানকে নিয়ে রিকশা চলতে শুরু করেছে। অনেকে অবাক হয়। কথা নেই, বার্তা নেই এ কিরকম ব্যাপার! পুরনো বন্ধুরা চোখে চোখে বলেন, হাসানের অই স্বভাব।
অপর এক রেস্তোরাঁ। অন্য কোনদিন। হাসান তাঁর সদ্য লেখা কবিতাটি পড়ে শোনাচেছন তরুণতর কোনো কবি বন্ধুকে। ঝাঁঝাঁ দুপুরে ব্রিটিশ কাউন্সিলের শীতল পাঠকক্ষে বইয়ের পাতায় ডুবে আছেন আবুল হাসান। খুনসুটি করছেন কোনো বন্ধু কবির সাথে। সামান্য কথায় কারো ওপর অভিমান করে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে আসছেন প্রেসক্লাব থেকে। জার্মানি থেকে ফিরে আসার পর পর স্বাস্থ্যোজ্জ্বল, প্রাণময়তায় ঝলোমলো তার চোখ-মুখ। ক্রমশ ফ্যাকাশে, মত্যুবর্ণ হয়ে আসছেন তিনি পিজি হাসপাতালের বেডে। সবশেষে ২৬শে নভেম্বর হিমঘুমে আচ্ছন্ন সাদা কাফনে আবৃত আবুল হাসান।
এরকম কিছু খণ্ডস্মৃতি আজকাল আমাকে হানা দেয়। তাঁকে নিয়ে লিখতে বসে কলম আটকে আসে, লেখা বন্ধ করে নিঝুম বসে থাকি। আলো অন্ধকার ঢাকা নগরীতে শীত-গ্রীষ্ম বর্ষাচছন্ন অসংখ্য স্মৃতির প্যানোরমা ভেঙে ভেঙে যায়, হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো বর্ণ-গন্ধ-শব্দসহ ভেসে আসে তাঁর মুখ। খুব বন্ধুর জন্য বেদনা ও ক্ষোভ জানাতে গিয়ে নিজেদের অক্ষমতা ছাড়া আমরা আর কী প্রকাশ করতে পারি?
মাত্র তিনটে তন্বী কাব্যগ্রন্থ, নানা কাগজে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বেশ কিছু কবিতা, কয়েকটা অমূল্য ছবি হলুদবর্ণ চিঠি, এইতো ওই নিয়ে এখন বেঁচে আছেন আবুল হাসান, থাকবেন আরো বহুদিন। আর আছি আমরা, কোনো কোনো মুহূর্তের দুঃসহ স্মৃতিতাড়িত তার ক’জন বন্ধু।
পুরানো ঢাকার জীর্ণ গলিঘুজি থেকে আধুনিক রাজধানীর সুরম্য এভিন্যু বাই এভিন্যু – তাঁর কাব্যচর্চার দশটি বছর তিনি নিজেকে এভাবে ক্রমশ বিস্তৃত করে দিয়েছেন ঢাকার প্রতিটি প্রান্তে। শহরের প্রতিটি এলাকায় তাঁর বন্ধু-বান্ধব, কোন না কোনো সুহৃদ নয়তো ভক্ত। শয্যাশায়ী হয়ে পড়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন এভাবেই।
আজ কায়েতটুলিতে অমুক বন্ধুর মেস, কাল মগবাজারে আরেক বন্ধুর নিভৃত বাসা, দু’দিন পর আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো হল।
তাঁর প্রিয় ঢাকার কোনো জায়গাই তাঁকে বেশীদিন ধরে রাখতে পারেনি, সব সময় একটি দুঃসহ অস্থিরতা তাড়িয়ে ফিরেছে তাঁকে। হাসান স্বভাবত অস্থির ছিলেন এবং এই অস্থিরতা থেকেই তাঁর রক্তে স্থায়ী বাসা করে নিয়েছিল এক আত্মনাশক বোহেমিয়ানিজম।
আবুল হাসান স্থায়ীভাবে সুন্দর, ছিমছাম একটি বাসা অবশ্যি নিতে পারতেন, সেই সঙ্গতি তাঁর ছিল। প্রকট অর্থাভাব তাঁর কোন সময়েই ছিল না। বিভিন্ন কাগজে সাংবাদিকতা করেছেন, রেডিও টেলিভিশনে নিয়মিত প্রোগ্রাম করেছেন, লেখার সম্মানীর টাকাতো আছেই। আসলে মধ্যবিত্ত মানসিকতার মানুষ ছিলেন না তিনি, শৃঙ্খলিত জীবনযাপন সম্পর্কে আলাপ তুললে তাঁকে বারবার বিরক্তই হতে দেখেছি। তাহলে কেন ছিল এই অস্থির জীবনযাত্রা? হয়তো কবিতা, শুধু কবিতার জন্যই হাসান কোনোদিন স্থির হতে পারলেন না, পারলেন না সবার মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে বাড়ির ছেলের আদর্শ দায়িত্ব পালন করতে। এককথায় হাসান বাংলা কবিতার প্রথম শহিদ, শহিদ তিনি। কারণ, শুধু কবিতার জন্যই গত দশটি বছর যাবতীয় নিয়ম বন্ধন তুচ্ছ হ’য়ে তিনি ওষ্ঠে তুলে নিয়েছিলেন আত্মক্ষয়ের হিরন্ময় গরল। তাঁর জীবননাশী হৃদরোগের মূলেও ছিল এই কবিতা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। ১৯৬৫ সালে মফস্বলে কলেজজীবন শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নালু, জগতে ঢোকার সাথে সাথে আর দশজন তরুণ শিক্ষার্থীর মনে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যে রংধনুর রং ছড়িয়ে পড়ে, হাসানও তার বাইরে ছিলেন না। তাঁর সামনে তখন অন্য কোনো স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভিন্নতম নক্শা। কিন্তু পড়াশোনো তাঁর ভাগ্যে ছিল না, তিনি পারলেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন শেষ করতে। অজ্ঞাত কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার আকস্মিক ছেদ টানতে হয় তাঁকে। তাঁর জীবন তীব্র একটা মোড় নেয় সেই সময়। বেশ কিছুদিন তাঁর মন খারাপ স্বপ্নভঙ্গের তীব্র বেদনার ছায়া তাঁর চোখে-মুখে। অবশ্য অল্পদিনের মধ্যেই তিনি পেলেন সমস্ত অস্তিত্বকে শিল্পের প্রচণ্ড বেদীতে সঁপে দেয়ার চরম মধুর মাধ্যম কবিতা। কবিতা, শুধু কবিতার জন্যই ছিল তাঁর জন্ম, তাঁর আত্ম নির্যাতন।
অস্বাভাবিক বুদ্ধিমান ছিলেন তিনি, ইচ্ছে করলে সমস্ত মনমেধা নিয়োগ করতে পারতেন বৈষয়িক সাফল্যের পেছনে, চারদিকে প্রলোভনের অভাব ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি থেকে গেলেন কবি, যাঁর একমাত্র অবলম্বন কলম, একটুকরো কাগজ আর সামান্য নিভৃতি।
সাতাশ বছর একজন কবির জন্য খুবই সংক্ষিপ্ত সময়। বিদেশে অনেক বিখ্যাত কবি এ বয়সে লিখতে শুরু করেছেন। হাসানও গভীরতর অর্থে সবে শুরু করেছিলেন। সবে তাঁর কবিতার নিমগ্ন জগত ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছিল বাইরের পৃথিবীতে, তাঁর কবিতায় ভীড় করে আসছিল সমসাময়িক বৈশ্বিক দ্বন্দ্ব টানাপোড়েন। প্রথম বই ‘রাজা যায় রাজা আসে’তে আমরা আবুল হাসানকে দেখি নিসর্গছায়াচ্ছন্ন, রোমান্টিক, প্রেমকাতর। দ্বিতীয় বই ‘ষে তুমি হরণ করো’ তাঁর দ্বিধা, ক্রোধ ও তাঁর মনোযন্ত্রণার বিশ্বস্ত চিত্র। শেষ বই ‘পৃথক পালঙ্ক’-এ এসে তিনি অনেকটা স্থির, সংহত, আসন্ন মৃত্যুচিন্তা থেকে উৎসারিত এক লঘু ব্যর্থতাবোধে জর্জরিত কোনো কোনো কবিতা। এ বইয়ে বেশ কিছু কবিতার বিষয় তাঁর অসুস্থতা। জার্মানি থেকে ফিরে আসার পর লেখা অধিকাংশ কবিতাই তিনি রেখেছেন এ বইয়ে। তাঁর সুদূর ইউরোপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতার ছায়াও পাওয়া যায় বেশ কিছ কবিতায়, আর আছে প্রেম। একেক সময় মনে হয় প্রেম ও কবিতার তীব্র দ্বন্দ্বে হাসান চূর্ণবিচূর্ণ, রক্তাক্ত স্থির করতে পারছেন না তাঁর অস্তিত্বের সার্থকতা ধরে আছে প্রেম না কবিতা।
মৃত্যুর মাসখানেক আগে তিনি পরিকল্পনা নিয়েছিলেন একটি স্কেচের প্রদর্শনী করবেন। ইচ্ছে ছিল হঠাৎ করে চমকে দেবেন সবাইকে। সে জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন গোপনে। কবিতার পাণ্ডুলিপির ওপর আঁকিবুকি করার অভ্যাস ছিল তাঁর অনেক সময় মুগ্ধ হয়ে দেখেছি অইসব অঁচড় থেকে কিভাবে ফুটে আসছে, একেকটি বিস্ময়কর স্কেচ। চিত্রকলায় তাঁর কোনো পদ্ধতিগত শিক্ষা ছিল না, কিন্তু ছিল শিল্পীর বোধ ও অফুরন্ত কল্পনাশক্তি।
তাঁর প্রিয় ছিল ভোরের নীলচে আলো, শ্যামল গাছপালা, সুন্দর মুখশ্রী, জল, পাখি। তিনি ভালোবাসতেন গান, ভালোবাসতেন রিলকে ও ফ্রস্টের কবিতা। তীব্রভাবে রোমান্টিক মেজাজের একজন কবির যে বিষয়গুলোতে দুর্বলতা থাকে হাসানের তাই ছিল।
তিনি তখন অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক গণবাংলার সহকারী সম্পাদক। ছাপা হচ্ছিল প্রথম বই ‘রাজা যায় রাজা আসে’। সে নিয়ে তাঁর সে কি উত্তেজনা। একদিন আমাকে সারা দুপুর ধরে দেখালেন তাঁর কবিতার প্রুফ। ক্যান্টিনে বসেই চা খেতে খেতে তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রুফ কাটলেন, জিজ্ঞেস করলেন বার বার কী আমার হবে তো। আরেক দিন দেখালেন বইয়ের প্রচ্ছদ বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে বন্ধুবান্ধব অনেককেই দেখালেন তিনি, নাহ্, তাঁর চোখ ভরতে না, বড্ড খুঁতখুঁতে মন রাস্তাঘাটে পরিচিত
কাউকে দেখলেই প্রচ্ছদটি দেখিয়ে প্রশ্ন, ‘দ্যাখোতো রংটা ঠিক এসেছে কিনা? লেটারিংটা কি খুব ভাল মনে হচ্ছে?
প্রায়ই দেখতাম কোনো আড্ডার এক কোণায় তন্ময় হয়ে লিখছেন হাসান, ঘামে সমস্ত শরীর ভিজে যাচ্ছে, চারদিকে হৈ চৈ চীৎকার তাঁর খেয়াল নেই কোনোদিকে – স্বপ্নতাড়িতের মতো তিনি কাগজে একের পর এক বসিয়ে যাচ্ছেন অক্ষর।
এভাবেই তিনি লিখতেন। কবিতা লেখার জন্য কোনো বিশেষ জায়গা তাঁর ছিল না – হঠাৎ কোনো সুন্দর লাইন পেয়ে গেলে আলগোছে সরে যেতেন তিনি অপেক্ষাকৃত নিভৃত কোনো জায়গায়। কাগজ থেকে চোখ ভুলতেন না তখন। কবিতাটি শেষ না হওয়া অবধি কবিতা ছিল তাঁর দর্শন তাঁর ধর্ম। এ ব্যাপারে ফাঁকি বা কোনো রকম শটকাটের কল্পনা করা ছিল তাঁর কাছে মহাপাপ।
উৎস : বিচিত্রা, ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪