গণঅভ্যুত্থান সংখ্যা
“পানি লাগবে, পানি?” মুগ্ধ চিৎকার করে ডেকে ডেকে সবাইকে পানি খাওয়াচ্ছিল। সাদিক ও মুগ্ধ মিছিলে হাঁটছিল পাশাপাশি। হঠাৎ পুলিশ গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে এলো। এদিক-সেদিক দৌড়াচ্ছে সবাই। সাদিক দৌড়ে কিছুদূর যেতেই মুগ্ধকে না পেয়ে পেছন ফিরে তাকাল। একটু খোঁজাখুঁজির পর সাদিক দেখতে পেল মুগ্ধ পথে পড়ে আছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে সে। হঠাৎ শ্লোগান থেমে গেল! বাতাস স্তব্ধ। রক্তস্রোতে ধূসর হয়ে গেল চারপাশ।
সময়টা মাঝদুপুর। শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত রাজপথ। উত্তরায় আজমপুর। শতশত ছাত্র-ছাত্রীর কোটা আন্দোলনে সমস্ত এলাকাটা বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে আছে কয়েক দিন।
সাদিক মুগ্ধর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আগের দিন রাতে ফোনে কথা হয়েছিল দুজনের।
“মুগ্ধ, যাবিনা মিছিলে?”
মুগ্ধ বলে, “যাবতো অবশ্যই। তুই বাসায় চলে আয় সকালে। একসঙ্গে বের হবো।”
সাদিক বলল, “আচ্ছা আমি সকালেই চলে আসছি।”
মিছিল নিয়ে মুগ্ধর সঙ্গে তিথিরও কথা হয়েছিল গতরাতে। তিথি খুলনা থেকে রোজ কয়েকবার মুগ্ধর সঙ্গে ভিডিও চ্যাট করে। কয়েক মাস আগের কথা। মুগ্ধ যেদিন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে ঢাকায় আসবে, ঠিক তার আগের দিন তিথি ক্যাম্পাসেরই প্রায়ান্ধকার একটা নির্জন জায়গায় জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল। মুগ্ধর মুঠোতে একহাত শক্ত করে চেপে ধরা, আরেক হাত মুগ্ধর কাঁধের উপর। কারণটা কিছুই না, মুগ্ধর একই ডিপার্টমেন্টের পড়ুয়া তিথির তখনও ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরুতে দুই বছর লাগবে। এই দুই বছর তিথি একা, একাই তো, মুগ্ধ না থাকলে সে একাই, ক্যাম্পাসে কী করে থাকবে? অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে তিথিকে সেদিন শান্ত করেছিল। “আমি তো মাঝে মাঝে চলে আসবো, তুমি এত ভাবছো কেন? আর তাছাড়া ভিডিও কল তো আছেই।” মুগ্ধ বলে। তারপর ছয় মাস কেটে গেছে। ঢাকার ব্যস্ততা ফেলে মুগ্ধ খুলনায় যেতে পারেনি মুগ্ধ। তবে প্রতিদিন অন্তত ছয়-সাত বার তিথি ফোন করে। রাতে তো কয়েক ঘণ্টা। তিথিটা সত্যি পাগল। পাগলের মতোই মুগ্ধকে ভালোবাসে।
গতকাল রাতেও তিথি যথারীতি কয়েক ঘণ্টা কথা বলেছে।
“জানিস, আমরা এখানেও আন্দোলন করছি। তোদের ঢাকা আর কী, ফুঃ, দেখতিস যদি আমাদের আন্দোলন। একটা কিছু হতেই হবে।”
“হুম, বীরাঙ্গনা তুমি, চালিয়ে যাও।”
তিথি ভীতু প্রকৃতির মেয়ে। একবার ক্যাম্পাসে ঘাসের মধ্যে বসে গল্প করছিল। কামিজে কী করে যেন একটা লাল পিঁপড়ে উঠেছে। সঙ্গে সঙ্গে তিথির সে কী লম্ফঝপ্ম। পাক্কা ১০ মিনিট লেগেছে তিথির ধাতস্থ হতে। আরেকবার একটা কাঠবিড়ালি দেখেই ধরতে যাবে, কিন্তু ভয়ে কাছে ভিড়তেই পারল না। কাঠবিড়ালি এদিকে চম্পট দিয়েছে। সেই তিথি, মিছিলে? যে কোনদিন ডিপার্টমেন্টের কোনো ছেলে তোমাকে সুন্দর লাগছে বললে, কথার জবাব দিতে পারে না। রাগে লালমুখ করে যত অনুযোগ মুগ্ধর কাছে এসেই করে। রাতে তিথির সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হলো, খুলনায় যেতে বললো ওদের আন্দোলন দেখতে, ওর মিছিলে সবার সামনে থাকার গল্পও শুনলো মুগ্ধ। একসময় তিথির গলাটা ধরে এলো, “এই শোন, তোর তো ভয়ডর কিচ্ছু নাই। তু্ই মিছিলের আগে আগে থাকবি না, বলে দিচ্ছি।” মুগ্ধ আর কী বলে। হুঁ, হা করে কথা শেষ করে ঘুমায়।
২
সাদিক যথারীতি মুগ্ধর বাসায় পৌঁছে গেছে। আসতে আসতে দেখেছে কী সুন্দর সকাল, আলোয় আলোয় চারদিক ঝলমল করছে। কী চমৎকার একটা দিন। মুগ্ধ দরোজা খুলতেই সাদিক দেখে মুগ্ধর বারান্দায় বসে নাস্তা খাওয়ার আয়োজন। টেবিলে চা। সূর্যের আলো তীর্যকভাবে বারান্দার উপর এসে পড়েছে। মুগ্ধকে কিছুটা বিষণ্ণ আর চিন্তিত লাগছে। সময়টা কী খুব উত্তেজনায় কাটছে? না কী তিথির জন্য মন খারাপ?
উচ্ছল, প্রাণচঞ্চল মুগ্ধ একজন ফ্রিল্যান্সার। বহুবার বলেছে, বন্ধুদেরই বলতো, একটাই জীবন, অর্থবহ করে তুলতে হবে। সাদিক শুনেছে আর বন্ধুকে সাবধান করে দিয়েছে, “এমন কিছু করিস না মুগ্ধ যাতে তিথির কষ্ট হয়। আঙ্কেল আর আন্টির কথা বলাই বাহুল্য।”
“চা খাবি? নাস্তা খেয়ে এসেছিস তো?” মুগ্ধ সাদিককে জিজ্ঞেস করে।
“নাস্তা খেয়ে এসেছি। চা খাইনি। দে, যদি পারিস, খাই এককাপ।”
“দাঁড়া, বুয়ামনিকে বলছি।” বুয়ামনি বলায় সাদিক হেসে ফেলে। মুগ্ধ বুয়াকে কেন বুয়ামনি বলে একদিন সেটা ব্যাখ্যা করে বলেছিল।
“বাচ্চাদের আমরা আদর করে কী বলি, বল? নামের সঙ্গে মনি বলি তো? আমিও আমাদের বুয়াকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য না করে আদর করে বুয়ার সঙ্গে মনি জুড়ে দিয়ে বুয়ামনি বলি। বুয়া খুব খুশি এতে। মুগ্ধ যে কতটা মানবিক, মানুষকে কতটা ভালোবাসে, এই কথাতেই বুঝেছিল সাদিক। বন্ধুর দিকে সাদিক এবার গভীরভাবে তাকায়। সাদিকের তাকানো দেখে মুগ্ধ বলে, “তুই বোস, আমি রেডি হয়ে আসি।”
অন্যদিন একটু সময় নেয়, কিন্তু আজ মুগ্ধ বেশ তড়িঘড়ি কাপড় বদলে রেডি।
“চল, যাই। আরেকটু দাঁড়া, আরেকটু।”
বসার ঘর থেকে মুগ্ধ আবার ভেতরে যায়। হাতে একটা পলিব্যাগ। ভাঁজ করতে করতে প্যান্টের ব্যাকপকেটে ঢোকায়।
“এ দিয়ে কী হবে?” সাদিকের কৌতূহলী জিজ্ঞাসা।
“কাজ আছে, দেখবি পরে। আগে চল।”
দুই বন্ধু পথে নামে। বাসার কিছুটা সামনেই একটা টংঘর। মুগ্ধ সেখানে থামে।
“মন্টু মামা, এককেস পানি দেন তো।” মন্টু মিয়া একটা পলিব্যাগে প্লাস্টিকের পানির বোতলগুলি ভরে দেয়। মুগ্ধ বলে, “আমার কাছে আরেকটা পলিব্যাগ আছে, দুইটা পলির মধ্যেই দেন, তাহলে ছিঁড়ব না।” দোকানি মন্টু মামা মুগ্ধর অনেক দিনের চেনা। হেসে ফেলে, বলে, “দেন।” তারপর বলে, “কিন্তু এত সকালে এত পানির বোতল নিয়া কই যাইতাছেন?”
“মিছিলে”, মুগ্ধর উত্তর।
“মামা, আইজ কিন্তু দিনটা ভালো মনে হইতাছে না। শুনলাম, আজ অবস্থা আরও খারাপ হইবার পারে। আপনি বরং আজ মিছিলে যাইয়েন না।”
“তা কী আর হয় মামা। সবাই যাবে আর আমি ঘরে বসে থাকবো? আমি তো কাপুরুষ না। কিচ্ছু ভাববেন না, আমার কিছু হবে না। আর হলেই বা কী…”
কথাগুলো শুনে সাদিক ধমক লাগায়। “চল তো, বাজে কথা রাখ।”
মুগ্ধর হাতে পলিব্যাগে পানির বোতল। বেশি কিছু করতে না পারলেও পানি তো সে দিতে পারবে। পাশ দিয়ে কয়েকজন যেতে যেতে মুগ্ধর কাছ থেকে কয়েকটা পানির বোতল চেয়ে নিল। মুগ্ধও হাত বাড়িয়ে দিল। একবার ছেলেগুলার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখল। কী অবাক কাণ্ড, কাউকেই সে চিনতে পারলো না। সাদিককে বললো,
“এই উত্তরাতে এত দিন ধরে আছি, কিন্তু কাউকেই চিনতে পারছি না।”
“পারবি কেমনে, আমরা কি কখনও এভাবে একসঙ্গে রাস্তায় নেমে এসেছি? আমরা তো আবার থাকতাম খুলনায়। এই এলাকার কারুর সঙ্গেই তো দেখাট্যাখার বিষয় ছিল না।”
“ঠিক তাই, কিন্তু দেখ, আজ আমরা কত কাছে চলে এসেছি। একটা আন্দোলন আমাদের কতটা কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। কেউ কাউকে চিনি না, জানি না, তাও কত আপন।”
“হুম, দেশটা যেন এরপর এমনই হয়। সবাই সবার আপন। আত্মীয়। সম্পর্কটা যেন সুন্দর হয়। হানাহানি না থাকে। বৈষম্য একেবারেই চাই না। এরকম একটা দেশই তো আমরা চাই। পাবো কি এমন দেশ, কোনদিন?”
ক্লান্ত শিক্ষার্থীদের হাতে মুগ্ধ পানি দিয়েই যাচ্ছে। হঠাৎ তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। ভালো করে তাকাতে পারছে না। কী হলো? পুলিশ শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য সাউন্ড গ্রেনেড ছুঁড়ছে। চোখে হাত দিয়ে মুগ্ধ তবু হাঁটছে। তবে ধীরে। চোখে প্রচণ্ড জ্বালা। তবু বলে চলেছে, “পানি লাগবে, পানি?”
বেশিদূর যাওয়া গেল না। সাদিক বললো, “চল, এখান থেকে সটকে পড়ি। পুলিশ গুলি করছে।” সাদিক বন্ধুর হাত ধরে টান দিল। কিন্তু সেও তখন চোখে কিছু দেখতে পারছে না। দৌড় দিয়ে অনেকখানি পিছিয়ে গেল। হঠাৎ খেয়াল হলো, মুগ্ধর হাত, মুগ্ধ তো সঙ্গে নেই। গুলি, আরও গুলি চালালো পুলিশ।
কিন্তু মুগ্ধ গেল কোথায়? সাদিক অস্থির হয়ে এদিকওদিক তাকালো। কিন্তু কোথাও মুগ্ধকে দেখতে পেল না। মনে হলো, মুগ্ধ বোধহয় পিছিয়ে আসতে পারেনি। কিন্তু সাদিক মুগ্ধকে রেখে যায় কী করে। যেদিক থেকে গুলি করতে করতে পুলিশ আসছিল সেদিকেই সে এগিয়ে গেল। মুগ্ধ তো থাকলে ওদিকেই থাকবে।
পুলিশ আর ছাত্রদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলছে। এরই মধ্যে চোখে পড়লো মুগ্ধ চোখে হাত দিয়ে বসে পড়েছে। বন্ধুর দিকে এগিয়ে যেতেই আবার গুলি। মুগ্ধ সাদিককে দেখে পিছিয়ে আসতেই উঠে দাঁড়ালো, আর তখনই তীক্ষ্ণ একটা ধাতব শব্দ। গুলি!
সাদিক তাকিয়ে দেখল, মুগ্ধ পথের উপর লুটিয়ে পড়ছে।
“মু গ্ধ…” সাদিকের চীৎকার।
গুলিটা মুগ্ধর কপালে লেগেছে। কপাল থেকে মাথার ডান দিক দিয়ে বের হয়ে গেছে। সাদিক দেখল রক্তে ভেসে যাচ্ছে পথ। মুগ্ধর মাথার ঘিলু বের হয়ে গেছে। হাতে ধরা মোবাইল ফোনটা বাজছে। কিন্তু সেদিকে তাকানোর সময় নেই সাদিকের।
সাদিক, একেওকে ডাকলো, “ভাই, একটু ধরেন না ভাই।” একসঙ্গে সাত-আট জন ছাত্র এগিয়ে এলো। তারা তখনও পুলিশকে ধাওয়া দিচ্ছে। সাদিকের ডাকে একজন একটু দূরে দৌড়ে গিয়ে রিকশা ডেকে আনলো। সাদিকের তখন ভীষণ উদ্ভ্রান্ত অবস্থা। মুগ্ধ প্রায় নিথর নিস্তব্ধ। ফোনটা বেজেই যাচ্ছে।
রিকশায় মুগ্ধ সাদিকের কোলের উপর ঢলে পড়ে আছে। রক্তে সাদিকের শার্ট-প্যান্ট ভিজে গেছে। “তাড়াতাড়ি চলো ভাই। আমার বন্ধুকে বাঁচাতে হবে। সামনে যে হাসপাতাল পাবে সেখানেই চলো।” রিকশাওয়ালা এমনিতেই জোড়ে চালাচ্ছিল। সাদিকের কথা শুনে আরও জোড়ে চালানো শুরু করল। তারও কী প্রাণান্তকর চেষ্টা। মুগ্ধকেও সাদিক বলছে, “ঘুমাবি না, একদম ঘুমাবি না তুই।” কিন্তু মুগ্ধর শরীর ঠান্ডা, নিথর।
রিকশা কিছু দূর এসে ক্রিসেন্ট হাসপাতালের সামনে দাঁড়ালো। ইমার্জেন্সি, সেখানেই নিয়ে যেতে হবে মুগ্ধকে। কয়েকজন অ্যাটেনডেন্ট ছুটে এলো। ওরা যেন প্রস্তুতই ছিল। আসলে এরকম অনেকেই আসছে। তাই তারা প্রস্তুতই থাকছে। রিকশামামাও হাত লাগালো। এরপর স্ট্রেচার, স্ট্রেচারের চাকার কর্কশ শব্দ, সাদিক শুধু মুগ্ধকে সেই রিকশায় বসা থেকে বলে আসছে, “তুই, তুই ঘুমাবি না মুগ্ধ, এই মুগ্ধ, তোকে বাঁচতে হবে, ঘুমাবি না, একদম না… ।”
ডাক্তার নার্স ছুটে এলো। একজন ডাক্তার পালস্ ধরেই বললেন, “সরি, হি ইজ নো মোর। ভেরি সরি, ভাই।” মাথার দিকটা দেখে বললেন, মাথায় গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে মারা গেছে। এরকম ক্ষেত্রে সেটাই হয়।
মুগ্ধ মৃত। মৃত! সাদিকের বিশ্বাস হয় না। দেয়ালে মাথা ঠুকে সে চীৎকার করে উঠল। “মুগ্ধ নেই, মুগ্ধ রে…” অন্য পাশ থেকে আরেকজন কেঁদে উঠলে সাদিক থামে।
হাসপাতাল থেকে একটা অ্যাম্বুলেন্স দেয়। সাদিক অ্যাম্বুলেন্সে নীরবে বসে থাকে। স্তব্ধ। শরীরের যেন কোনো শক্তি নেই। হাসপাতাল ছাড়ার আগে মুগ্ধর জমজ ভাইকে ফোন করে কান্নাভেজা কণ্ঠে সব বলে। অ্যাম্বুলেন্স ছুটতে থাকে মুগ্ধদের বাসার দিকে।
ফোনটা কিছুক্ষণ আগে থেমে আবার বেজে উঠল। এবার ফোনের দিকে সাদিক তাকিয়ে দেখে স্ক্রিনে লেখা – “পাখি আমার”। সাদিক জানে এটাই তিথির দেয়া মুগ্ধর নাম। তিথি অস্থির হয়ে ফোন করছে। সাদিক ফোন ধরে। সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে তিথির কণ্ঠ, “এই পাখি, ফোন ধরিস না ক্যান? কি হইছে তোর?” সাদিক কী বলবে, বুঝতে পারে না। শান্ত হয়ে বলে, “তিথি, আমি সাদিক।” তারপর সব খুলে বলে। ওপাশ থেকে একটা আর্ত চীৎকার শোনা যায়। তারপর ধুপ করে একটা শব্দ। সাদিকের মনে হলো, তিথির হাত থেকে বোধহয় ওর ফোনটা মেঝেতে পড়ে গেছে। এরপর আর কোনো সাড়াশব্দ নেই।
বৃষ্টি হচ্ছে। সারারাত বৃষ্টি। লবণছড়া রোডের যে দিকটায় গ্লোরি অ্যাগ্রো প্রজেক্ট সেখান থেকে রূপসা নদীর দিকে গেলেই তিথিদের বাড়ি। তিথির বাবা ওই অ্যাগ্রো ফার্মেই কাজ করেন। নদীর পাশটা একটু ঢালু বলে তিথিদের বাড়ির উঠোনের পানি রূপসার দিকে নেমে যায়। অন্যসময় হলে তিথি এরকম দৃশ্য উপভোগ করত। কিন্তু সন্ধ্যায় সাদিকের কাছ থেকে মুগ্ধর মৃত্যুর খবরটা শোনার পর তিথি নিজের ঘরে গিয়ে সেই যে শুয়ে আছে, ওঠার নাম নেই। মা দুইবার ডেকে ওঠেনি দেখে টেবিলে খাবার রেখে গেছে। তিথির চোখ ভিজে যাচ্ছে বারবার।
চারিদিকে এত অন্ধকার কেন! তিথি বিস্মিত। মা তো আলো জ্বালিয়েই রেখে গেছে। তিথিও শুয়েছে আলো জ্বালানো অবস্থাতেই। তাহলে এত অন্ধকার কেন! কে আমার পিছু নিয়েছে? সঙ্গে মুগ্ধও কী আছে? না মুগ্ধ তো নেই! মুগ্ধ নেই কেন? তিথি আরও বিস্মিত। সে কিছুটা বুঝতে পারে কী হয়েছে। কে যেন তাকে তাড়া করছে। তাড়া খেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে অন্ধকারের ভেতরেই সে তলিয়ে যাচ্ছে। মুগ্ধ নেই, কিন্তু মুগ্ধর মুখটা ভাসতে থাকে, শূন্যে। তিথির বুক ফেঁটে যাচ্ছে, তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। তবু তাকে দৌড়াতে হবে। পানি, পানির খোঁজ চাই তার। সামনেই দেখতে পায় পানির ফোয়ারা। কিন্তু দুহাত দিয়ে পানি তুলতেই দেখে, এতো পানি নয়, রক্ত, আহ্ রক্ত, এত রক্ত কেন! সমস্ত রাজপথে রক্তের স্রোত। এটা কোথায়? তিথি বুঝবার চেষ্টা করে, কিন্তু বুঝে উঠতে পারে না। এ কী ক্যাম্পাস, নাকি ঢাকার উত্তরা?
কোনো প্রিয়জনের মৃত্যু দেখার অভিজ্ঞতা তিথির ছিল না। রক্ত দেখে স্পষ্ট করে কারো মুখ ভাবতে তিথির ভয় লাগে। মুগ্ধর মুখটা আবার ভেসে ওঠে। মুগ্ধ বেলিফুল খুব ভালোবাসতো। যতবার দেখা হতো, বেলিফুলের মরশুম এলেই মুগ্ধ কোত্থেকে যে বেলিফুলের মালা নিয়ে হাজির হতো, হদিস মিলতো না। একবার বলেছিল, তু্ই দেখিস, আমি কোনদিন যদি মরে যাই, তোর কাছে বেলিফুল হয়ে ফিরে আসবো।
আবার যন্ত্রণা। কী এক ভয়ানক যন্ত্রণা। তিথিকে শেষ করে দিচ্ছে। তার ঠোঁট শুকিয়ে আসে। স্বপ্নগুলো কী এভাবেই মরে যাবে, আমাদের? কে উত্তর দেবে? মুগ্ধ কোথায়? তিথি ঘেমে ওঠে। তার দম বন্ধ হয়ে আসে। পাশ ফিরতে গিয়ে দেখে বালিশটা ঘামে ভিজে গেছে। অন্ধকার মিলিয়ে গেছে। আলো ফুটেছে। এতক্ষণ তাহলে কী সে স্বপ্ন দেখছিল! তাইতো মনে হচ্ছে।
জানালার বাইরে বৃষ্টিধোয়া সকাল। বিছানা থেকে উঠে ঘরের জানালা খুলে দেয়। ছোট্ট উঠানে পা রাখে। উঠানের একদিকে ছোট্ট একটা বাগান। কত কত ফুলের গাছ। সখ করে বাবা লাগিয়েছেন। জবা হাসনাহেনা আর পাতাবাহারের গাছ। হঠাৎ চোখে পড়লো একটা বেলিফুলের গাছও আছে! এটা তো আগে দেখিনি। কবে লাগালেন, বাবা? ফুলও ফুটেছে। তিথির বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠল। বেলি? বেলি মানেই মুগ্ধ। তিথি আরেকটু এগিয়ে গাছটার খুব কাছে চলে আসে।
এখন শুধুই স্পর্শের ব্যবধান। তিথি বসে পড়ে। গাছটাকে ছোঁয়। সুঘ্রাণ, কী দারুণ। ফুলগুলোকে ছুঁতে গিয়ে তিথির শরীরে বিদ্যুৎ চমকের মতো শিহরণ খেলে যায়। মুখটা ফুলগুলোর কাছে নুয়ে আসে। চিবুক বেয়ে টপটপ করে কয়েক ফোঁটা অশ্রু ফুলগুলোকে ভিজিয়ে দেয়।