ভেবেছিলাম অর্ধাঙ্গিনী সিনেমা নিয়ে নিজের ফেসবুকে একটি লম্বা পোস্ট দেব। খুব কৌতুহল এবং আগ্রহ নিয়ে দেখলাম সিনেমাটি। আমাকে ভাবিয়েছে এবং পুরোপুরি এনগেজড করে রেখেছে। প্রথমেই বলি অর্ধাঙ্গিনী ভালো লেগেছে, অভিনয় (যেমন সবাই বলছেন) খুবই ভালো হয়েছে, তেমনি তিনটি প্রধান চরিত্রই নিজ নিজ জায়গায় প্রভাবসঞ্চারী ছিল।
মুভিটা নিয়ে আমার সমালোচনা আছে, কিন্তু সেটি গঠনমূলক দিক থেকে করছি। সিনেমাটি গভীর এবং চিন্তা উদ্রেক করে। একটি পরিণত বিষয়কে কেন্দ্র করে নির্মিত – সম্পর্ক, সম্পর্কের ভাঙন, পুনরায় সম্পর্ক স্থাপন এবং সম্পর্কের রেশ। কি কি থেকে যায় কি কি থাকে না – সেই থিমের কথা বলা হয়েছে। যেমন দ্বিতীয় স্ত্রী মেঘনা একটি অতি সুন্দর ছোট্ট ডায়লগে বলে, সুমনের মগজের অর্ধেক জুড়ে আছে তার প্রথম স্ত্রী অর্থাৎ তার অতীত। দ্বিতীয় স্ত্রী অনাগত অনিশ্চিত সময়, যে সময় বা জীবন সুমনের ভবিষ্যত সেই অংশের প্রতীক। এ কথাগুলি বলা হয়েছে যখন সুমন গভীর কোমায় অচেতন পড়ে রয়েছে। আর আমরা জানি, একটি কোমায় পড়ে থাকা মানুষকে ফিরিয়ে আনার জন্য তার অতীত এবং বর্তমান দুটোকেই জাগ্রত করতে হয়। অর্থাৎ অতীত বর্তমান ভবিষ্যত, এই তিনটি কাল একটি মানুষের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, এবং সেই তিনটি কালে যেসব তাৎপর্যপূর্ণ সম্পর্ক সব একে অপরের মধ্যে প্রোথিত। কখনোই পুরোপুরি ছিন্ন করা যায় না। তেমনি শুভ্রা এবং মেঘনা শুধু সুমনের অর্ধাঙ্গিনী নয়, একে অপরেরও পরিপূরক। দুজনকেই প্রয়োজন কোমায় থাকা লোকটিকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য। সুতরাং সিনেমার থিমটি মৌলিক, বহুস্তরিক আর পরিণত।
তবে কিছু প্রশ্ন আমার মাথাতে এসছে, যেমন, এটা ভেবে পাইনি যে দুজন নারী একজন পুরুষকে (যে কিনা প্রাক্তন স্বামী বা বর্তমান স্বামী) এত প্রশ্নাতীতভাবে ভালোবাসল কেন? কি গুণের জন্যে? যেখানে আলোচ্য ব্যক্তি অর্থাৎ সুমন অনেক আঘাত প্রথম স্ত্রীকে দিয়েছে – ডিভোর্স দিয়ে, রূঢ় ব্যবহার করে এবং স্ত্রী সম্পর্কে বন্ধ্যত্বের মিথ্যা কুৎসা রটিয়ে। তারপরেও শুভ্রার মনে এতটা ভালোবাসা বলুন উদ্বেগ বলুন, এলো কি করে? বলা যেতে পারে যে এটি মানবিক আচরণ অথবা দীর্ঘকাল একসঙ্গে থাকার যে-টান সে-টানের প্রকাশ। বা একসময় ভালবাসতো বা সব ছাপিয়ে একটা মানুষের প্রতি যে অনুভূতিটা থেকে যায় তারই বহিঃপ্রকাশ। কে জানে।
এবার আসা যাক মেঘনার নিরঙ্কুশ ভালোবাসার প্রশ্নে। ভেবে নিতে হয় সে পাগলের মতো প্রেমে পড়েছিল। এছাড়া তার এত জলদি বিয়ে করার কারণ এবং এত উতলা ভাবে স্বামীকে বাঁচানোর চেষ্টা পরিষ্কার হবে না।
মেঘনার এই ডেসপারেট ভাবে স্বামীকে বাঁচাতে চাওয়া এবং তার স্বামীর পিতৃপরিচয় সন্তানকে তুলে দেয়ার অবশ্য আরো একটা যুক্তি কাজ করতে পারে। সেটা হলো, যদি সন্তানটি তথাকথিত বৈধ না হয় অর্থাৎ প্রেমিক এর সন্তান, স্বামীর নয়। তাহলে সেসব পরিষ্কার করে দেওয়া উচিত ছিল। সম্ভবত আজও সমাজে কোন মেয়ে তার সন্তান পিতৃপরিচয়বিহীন থাক, চাইবে না। এটা মেঘনার হবু মা হিসেবে অস্তিত্ব রক্ষার স্বাভাবিক উদ্বেগ। তবে পরিচালক সবকিছু পরিষ্কার না করে হয়তো দর্শকের উপর অনেক প্রশ্নের উত্তর ছেড়ে দিয়েছেন।
মাঝখানে মনে হচ্ছিল যে শুভ্রা মহান এক দেবীর মতো, এটা বিশ্বাসযোগ্য একটি চরিত্র? একটু বেশি যেন বড় মনের চরিত্র তার! মোটকথা কৃত্রিম মনে হচ্ছিল। কিন্তু পরিচালকের মুন্সিয়ানা সিনেমার শেষ অর্ধেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন শুভ্রা অতি মানবিক চেহারায় আত্মপ্রকাশ করল। মেঘনার দিকে বিষাক্ত বাণ ছুড়ে মারে। অর্থাৎ মেঘনার সাজানো ভালোবাসার চিত্রটা যে কল্পিত হতে পারে, তার সুখ-স্বপ্নের ভিত্তি নড়বড়ে, পুরুষের অহমের উপর দাঁড়িয়ে, এই অতি মারাত্মক বাস্তবতা শুভ্রা মেঘনার সামনে তুলে ধরে। পুরুষের অহম ছাড়া আর কিছু নেই এইরকম একটি ধ্বংসাত্মক তীর ছুড়ে মারায়, শুভ্রার পুরো চরিত্রটিতে অসম্ভব বাস্তবতা আরোপ করতে সক্ষম হয়েছেন পরিচালক কৌশিক গাঙ্গুলী। এখানে না বলে থাকতে পারছি না, মুভিটা দেখতে দেখতে রবীন্দ্রনাথের মালঞ্চ উপন্যাসের কথা মনে পড়েছিল। সেখানে শেষের দিকে অসুস্থ নীরজা তার স্বামী আদিত্যকে আরেকটি নতুন নারীর হাতে তুলে দিতে পারল না, ঈর্ষাকে জয় করতে পারল না শত চেষ্টা সত্ত্বেও।
এই সিনেমাটিতেও শুভ্রাকে দ্বান্দ্বিকতার ছাঁচে ফেলতে পেরেছেন পরিচালক। মেঘনাকেও একই জটিল চরিত্র রূপে প্রকাশ করায় নিজের মুন্সিয়ানার প্রমাণ দিতে পেরেছেন পরিচালক। মেঘনার জটিল মানসিক অবস্থার কথায় আসি। মাঝে মাঝেই তার একটা আক্রমণাত্মক আগ্রাসী বৈশিষ্ট্যৈর পরিচয় পায় দর্শক। একটি দ্বান্দ্বিক চরিত্র হিসেবে সে উপস্থিত হয়। প্রথমে সুন্দর একজন শিল্পী, নম্র, অসহায়, সরল এক অবলা নারী হিসেবে উপস্থিত করেছেন পরিচালক। কিন্তু তার ফাঁকে ফাঁকে মেয়েটির নিজস্ব একটা পার্সোনালিটিও প্রকাশ পেয়েছে। মেঘনার এই আক্রমণাত্মক অস্তিত্ব রক্ষায় উন্মুখ প্রবণতা দেখে মনে হবে সে শুধু রূপসী অসহায় নারী নয়, তার মধ্যে একটি নিষ্ঠুর স্বার্থ সচেতন চরিত্রও রয়েছে। সেজন্যই সে শুভ্রাকে চরম আঘাত হানতে পেরেছে এই বলে যে, সে যা দিতে পারেনি (সন্তান) মেঘনা তা পেরেছে। কিন্তু এর মধ্যেও শুভ্রার চরিত্রটিতে একটি মাহাত্ম্যোর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সে মেঘনার স্বপ্ন নষ্ট করে, কিন্তু তাকে ধ্বংস করে না। কেননা সামাজিকভাবে সত্যটা উন্মোচন না করলে মিথ্যা বন্ধ্যাত্বের ক্রুশ শুভ্রাকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে, তা সে জানতো। এখানে আরও একটি জিনিস স্পষ্ট। সূক্ষ্মভাবে এক নারীর প্রতি আরেক নারীর যে সহানুভূতি এবং সাহায্যের হাত বাড়ানো – যেটা শুভ্রার সুন্দর চরিত্রের মধ্যে পরিস্ফুট হয়েছে। ভগ্নি-ভাবাদর্শের চিহ্ন বহন করছে তার চরিত্রটি।
এবার আসা যাক দেহর বা ঠাকুরপো ভূমিকা নিয়ে। কেউ কেউ বলছেন এই এপিসোডটি একটা কমিক রিলিফ, কেউ কেউ আরোপিত বলছেন, সেটা বুঝতে পারছি। আমার নিজের কাছে মনে হয়েছে এটা বেশ বিশ্বাসযোগ্য ভাবেই এসেছে। যে মেয়েটি একটি কট্টর, বনেদি পরিবারের চৌকাঠে পা পর্যন্ত রাখতে পারবে না, তার পক্ষে অনুপ্রবেশ করা ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়েই ঘটবে। দেবরকে দিয়ে কাগজগুলি হয়তো বের করানো যেত, কিন্তু বোধহয় এখানে অন্য এক উদ্দেশ্য কাজ করছিল। শুভ্রা এবং ঠাকুরপোর মনের মধ্যে নিশ্চয়ই এরকম একটা ভাবকল্প ছিল যে নতুন স্ত্রীকে ওই বাসায় গ্রহণ করাতে হবে, এতে সেই পরিবারের মঙ্গল। এরকম একটা কার্যসিদ্ধি করতে হলে একটা ষড়যন্ত্র করেই ঢোকার কথা। যেহেতু মেঘনা কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের রীতি-নীতি আচার অনুষ্ঠান, বনেদি পরিবারের চাল-চলন, রীতিনীতি সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ, তাকে ‘বড় দিদি’ এবং দাদা হিসাবে গাইড করতে হবে, আড়ালে থেকে। এতে শুভ্রার মনের পরিধির পরিচয় মেলে। সেটাও অবশ্য একটি পরিবারের সঙ্গে সে বহু বছর জড়িয়ে গিয়েছিল এবং শ্বশুর বাড়িতে খুব সমাদৃত ছিল, তার জন্য। সুতরাং সে সেই বাড়ির মঙ্গল কামনা করবে, বোঝাই যায়।
ব্লুটুথ ইত্যাদির ব্যবহারটা আমার কাছে বেমানান লাগলো না। আজকাল তো এভাবেই সবকিছু চলছে, কিভাবে জীবন ডিজিটাল-নির্ভর হয়ে গেছে, যদিও মূল্যবোধগুলি পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি।
শেষে বলি, কৌশিক গাঙ্গুলিকে আমার প্রাচীনপন্থী মনে হয়নি। তিনি বহুমাত্রিক চরিত্র এবং বহুমাত্রিক বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন। শেষ দৃশ্যে একটি অনবদ্য মুহূর্ত ছিল। শুভ্রা ও মেঘনা যখন শপিংমলে হঠাৎ করে মুখোমুখি হয়ে যায়, তারা একে অপরকে চিনবে, সেটা ঘটেনি পূর্বচুক্তি অনুযায়ী। কিন্তু একঝলকের জন্য দুজনেই দুজনের দিকে ফিরে তাকালো এবং সেই একটি দৃশ্যের মধ্য দিয়েই নারীর সঙ্গে নারীর যে বন্ধন, পারস্পরিক বোঝাপড়া, গোপন কথোপকথন, কৃতজ্ঞতা – সবকিছুই যেন প্রকাশ পেয়ে গেছে।
সিনেমাটিতে দুটি বাস্তবতা ফুটে উঠেছে। মেঘনা সিদ্ধান্ত নেয় মিথ্যার উপরেই তার জীবন প্রতিষ্ঠিত করবে, এগিয়ে যাবে সংসার-সন্তান সনাতন পিতৃতান্ত্রিক যে লক্ষ্য সেই দিকে। অন্যদিকে শুভ্রা একজন স্বাধীন, পোড়খাওয়া, বিবর্তিত, মীমাংসিত নারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। আমরা সিনেমার শেষে দেখতে পাই শুভ্রা আধুনিক চিন্তাশীল এবং সংবেদনশীল একটি চরিত্র।
অবশেষে পুরুষ ও নারী, কত রকম কথা বলতে পারে তাদের বহু দিনের সঙ্গী সম্পর্কে – এ নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নাই। দাম্পত্য বা পার্টনারশিপের নানা দিক একটি তৃতীয় ব্যক্তির কাছে উন্মোচন করাটা বাস্তবতা বহির্ভুত নয় মোটেই। নারী পুরুষের সম্পর্ক এত জটিল, তার এত দিক থাকে যে, সেটা অন্য অনেক জায়গায় ছায়া ফেলে, নানা দিকে গড়িয়ে যায়। স্বামী বা স্ত্রী বা নর ও নারী যে তাদের সম্পর্কের কোন কিছু শেয়ার করবে না অন্য কারুর কাছে, সেটা ভাবার তো কোন কারণ নেই।
শেষ কথা
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অর্ধাঙ্গী প্রবন্ধ লিখেছিলেন যেখানে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের অর্ধাঙ্গী হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। ভাষায় কোন লিঙ্গভিত্তিক পরিচয় রোকেয়া গ্রহণ করেননি। এক শো বছর পর সমাজে সেই শব্দটি অর্ধাঙ্গিনী হয়ে গেছে! এটি নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে কিছুটা হলেও বিস্ময়কর। নাকি পরিচালক অতি কৌশলে বোঝাতে চাচ্ছেন পিতৃতন্ত্র বহাল তবিয়তে বিরাজ করছে এবং নারী অর্ধাঙ্গী নয় অর্ধাঙ্গিনী থেকে যাবে। তবে এই মুভির শেষ দৃশ্যটি আবার একটি বলিষ্ঠ নারীবাদী মেসেজ দেয় চমৎকার ভাবে। লিফটের দরজায় বুদ্ধের একটি আঁকা ছবি এবং শুভ্র যে কিনা সত্যি স্বাধীন এবং মুক্ত হতে পেরেছে, সে সেই লিফটেই হারিয়ে যায়, সেখান থেকে পৃথিবীটা অবলোকন করে। তার মুখে নানান অভিব্যক্তি : হারানোর, বিষাদের, সহমর্মিতার।
সোনিয়া আমিন
লেখক, ইতিহাস ও শিক্ষাবিদ। বালাদেশ চেয়ার, হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়, জার্মানি।
Leave feedback about this