সম্পাদকীয় নোট
নিজের উপন্যাসের প্রধান চরিত্রই গায়েব! হ্যাঁ, ঔপন্যাসিক সাদিক হোসেন মনে হয় এরকম এটা মতলব নিয়ে এই উপন্যাসটা লিখতে চাইছেন। তাঁর প্রধান চরিত্রের কোনো ছাপ যাতে উপন্যাসে না লাগে, সেই পথে তিনি এগুতে চেষ্টা করছেন। প্রধান চরিত্রকে প্রান্তিকতম চরিত্রের দিকে ঠেলে পাঠানোই যেন তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু এইটা করতে গিয়ে তিনি অদ্ভুত সব ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছেন। প্রথমেই একটা বিজ্ঞ বেড়ালের উপস্থিতি ঘটছে। এরপর একজন ফরাসি লেখক কোনো কারণ ছাড়াই চলে আসবেন কলকাতায়। কিন্তু কেন তিনি আসবেন? কলকাতায় এদিকে চলতে থাকবে নাটক – ফ্যাসিবিরোধিতার নাটক। এইসব ঘটনা আর নাটকই যেন জীবনের অনিঃশেষ গল্প এই উপন্যাসের : ‘সাজিদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই’। কিন্তু সত্যিই কি নেই? সেই রহস্য উন্মোচনের জন্যে এবার প্রকাশিত হলো উপন্যাসটির তৃতীয় পর্ব।
পর্ব ৩
সাজিদ গায়েব হয়ে গিয়েছে!
উপরের বাক্যটি পড়ে সত্যিই কি আমাদের মনে কোনোরকম অনুভূতি জাগতে পারে? তাকে যদি না-ই জানি, তবে তার থাকাটা যেমন – না-থাকাটাও তো তেমনি। তাও জেএনইউ-এর ক্যাম্পাস থেকে নাজিবের গায়েব হয়ে যাবার পেছনে রাজনৈতিক হিংসার ষড়যন্ত্র পেয়েছিলাম আমরা। বস্তুত সেই ষড়যন্ত্রটুকুই আমাদের ক্ষোভ, শোক বা রাগের কারণ হয়ে উঠেছিল। সেখানে নাজিব ছিল কতটুকু? কতটুকুই বা আমরা সেই রক্তমাংসের নাজিবকে নিয়ে ভেবেছিলাম?
নাজিবকে বুঝতে গিয়ে, কিংবা তার উপর হওয়া অত্যাচারের বিবরণ বা ভয়াবহতা বোঝাতে গিয়ে আমরা বারবার ‘সহনাগরিক’, ‘সংখ্যালঘু’ শব্দদুটো দিয়ে উল্লেখ করেছি। আমাদের নাগরিকতার মধ্যে, দৈনন্দিতার মধ্যে কোথাও ‘সহনাগরিকে’র স্থান নেই। যার অস্তিত্ব সম্পর্কে, বেঁচে থাকা সম্পর্কে আমারা উদাস হতে শিখেছি, যাকে স্বীকার করি না, যার অধিকার অর্জনের লড়াইকে আমরা সহজেই প্রতিক্রিয়াশীল হিসাবে চিহ্নিত করার সফল প্রয়াস চালিয়েছি – তার মৃত্যু বা হত্যা যদি হঠাৎ আমাদের সুকুমার প্রবৃত্তির পরিধির মধ্যে চলে আসে – তখনই আমরা ‘সহনাগরিক’ শব্দটিকে ব্যবহার করে ফেলি। এটা অপরকে কাছে টানার জন্য ব্যবহৃত হয় না। অপরের উপর হওয়া অত্যাচার যখন আমাদের জীবনচর্চার অঙ্গ হয়ে ওঠে, তখন সেটা থেকে নিজেদের আড়াল করবার জন্য এটা আমরা পর্দার মতো ব্যবহার করি।
কোমোডে পায়খানা করবার পর ফ্লাশ করে মলকে চেম্বারে পাঠিয়ে তারপর আমরা স্বচ্ছ জলের দিকে তাকাই। এটাই সভ্যতা। নাগরিকতা। নিজের বর্জ্যকে গোপনে চালান করবার ধারাবাহিক ইতিহাস।
সুতরাং, সাজিদকে আর কোথাও পাওয়া গেল না।
প্রথমিকভাবে তার বাড়ির লোক ভেবেছিল এর পেছনে শুভ্রার হাত রয়েছে। কিন্তু সাজিদ আর শুভ্রার সম্পর্ক কি এতোটাও ঘনিষ্টতায় পৌঁছুতে পেরেছিল যেখানে গায়েব হয়ে যাবার মতো ঘটনা ঘটে যেতে পারে? তাছাড়া শুভ্রার ব্যাপারে নিমরাজি হলেও সাজিদের আব্বা-মা ঠিকঠাক বুঝতে পেরেছিল কোনো পরিস্থিতিতেই ছেলের মতের বিপক্ষে থাকা সম্ভব নয়। কিংবা বিপক্ষে থাকলেও একটি-দুটি দরজা খুলে রেখে দিতে হবে।
দরজাটি খোলাই ছিল। রাত ১টা বাজল। রাত ২টা বাজল। ভোর হয়ে গেল। তবু সাজিদ ফিরল না।
সাজিদ কোথায়?
অফিসে ক্লাইন্টের সঙ্গে প্রেজেন্টেশন ছিল। আগের দিনই সে স্লাইডগুলোর ডিজাইন এপ্রুভ করে নিয়েছিল। প্রেজেন্টেশনে তার থাকার দরকার নেই। তাও লাস্ট মিনিট চঞ্জেসের জন্য তাকে আসতেই হল।
সাজিদ এল না।
রঞ্জন ফাঁকা চেয়ারের দিকে তাকিয়ে আভিকে জিজ্ঞেস করল, চাচাকে কনট্যাক্ট করতে পারলে?
অভি হাসল।
রঞ্জনের চোখ চলে গেছিল শুভ্রার দিকে। আশ্চর্য, সেও এবসেন্ট রয়েছে।
রঞ্জন প্রেজেন্টেশনের কর ক্লান্ত। চেয়ারে বসে কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলল, ভালোই চলছে। –
অভির কাজ বাকি ছিল শুভ্রার থেকে। সে মনিটরের দিকে তাকিয়ে বলল, হুম।
– কী হুম।
– হুম।
– ধুর। রজত কফিটা নিয়ে করিডর ধরে হাঁটতে শুরু করে দিল। এখন তার সিগারেট দরকার।
পরের দিন সাজিদ এলো না। কিন্তু শুভ্রা এল।
রজত আভির দিকে তাকিয়ে ইশারা করল।
অভি শুভ্রাকে দেখে বলল, হুম।
রজত শুভ্রাকে জিজ্ঞেস করল, চাচার খবর কী? ফোন তুলছে না। কাল থেকে ট্রাই করে যাচ্ছি।
শুভ্রা তখনো সিস্টেম অন করেনি। রজতের দিকে না তাকিয়েই বলল, তা আমি কি করে জানব।
– না মানে সবাইকে জিজ্ঞেস করছি।
– এক কাজ করুন। ফোন তো তুলছে না। আপনি ওর বাড়ি থেকে ঘুরে আসুন। তাজা খবর পাবেন। আমাদেরও জানিয়ে দেবেন।
রজত আর কথা বাড়াল না।
তিন-চারদিন পরও সাজিদ যখন এল না, রজত ভেবেছিল শালা মাইনেটা নিয়ে কেটে পড়েছে। এমনিতে তাদের কোম্পানিতে জয়েন করেছে মোটে আট মাস আগে। এই ক’মাসের এক্সপেরিয়েন্স দেখিয়ে কোনো লাভ নেই। বরঞ্চ দেখালেই হাজারটা কোশ্চেন জুড়ে দেবে। কেন এতো তাড়াতাড়ি শিফট করছ? কিভাবে বুঝব তুমি এখান থেকেও ছেড়ে যাবে না? রেসপন্সিবিলিটি নিতে পারবে? ধুর। তার থেকে মাইনে নিয়ে জাস্ট অন্য জায়গায় ঢুকে পড়েছে হয়ত। আগের এক্সপেরিয়েন্স দেখিয়ে বলেছে এই কয়মাস ফ্রিলান্স করছিল। কেন ফ্রিল্যান্স? এটার উত্তর সহজ। বাবা বেড রিডেন। বাড়িতে থাকতেই হত। এখন তিনি সুস্থ। বলে রেগুলার জবে কোনো অসুবিধা নেই।
কিন্তু শুভ্রা কিছু বলছে না কেন?
অভি বলল, জানে।
– তালে আমাদের বলছে না কেন? আমরা কি ব্যাগরা দেব?
– প্ল্যান আছে বোধহয় কিছু।
– কী প্ল্যান?
– তা আমি জানব কীভাবে?
– যা শালা।
সেদিন করিডরে তাকে দেখেই যেন জোরে হাঁটা লাগাল শুভ্রা। রজত সেদিকে তাকিয়ে পকেটে হাত দিল। আজ সে লাইটার আনতে ভুলে গেছে।
চার নম্বর ব্রিজ থেকে রোজ বাসে ওঠে সাজিদ। সেদিন হল কী – তার সামনে থেকে পরপর দুটো বাস চলে গেল। কিন্তু সে একটাতেও উঠতে পারল না।
যেন সে পা বাড়াচ্ছে, এই দৌড়চ্ছে, বাসের পাদানিতে পা দেবে এখুনি – কিন্তু হুস করে বাসটা তার চোখের সামনে দিয়েই চলে গেল। বাসস্ট্যান্ডে হুড়োহুড়িতে সে ধাক্কা খেল দু-বার। কাকে গালও দিল। কিন্তু লোকটা ভাবলেশহীনভাবে চলে গেল। তার দিকে ফিরেও তাকাল না।
ছোটোবেলা থেকেই আমাশার রোগ। বাইরের খাবার খুব কমই খায়। পিঠের ব্যাগে লাঞ্চবক্স আর জলের বোতল। একটু জোরে হাঁটলেই ঢকঢক আওয়াজ হয়। ঢকঢক আওয়াজ হল। সে দেখল একটা এসি-বাস প্রবল গতিতে ছুটে আসছে।
সাজিদ আর দেরি করল না। স্লাইডিং ডোরটা খুলতেই ভেতরে ঢুকে পড়ল।
এই পর্যন্ত এসেও সে অনুমান করতে পারেনি পরমুহুর্তে কী ঘটতে চলেছে।
প্রথমে খটকা লাগল টিকিট কাটতে গিয়ে। সে টকাটা বাড়িয়ে ছিল কিন্তু কন্ডাক্টর পাশের হাত থেকে টাকা নিয়ে টিকিট দিল।
ব্রেক কষলে সে আরেক দফা ভ্যাবাচাকা খেয়েছিল। পড়ে যেতে যেতে আঁটকে গেছিল একজনের কাঁধে। তারপর সোজা হতে গিয়ে লক্ষ করল পেছনের অ্যাটাচিটা তার দু-পায়ের মাঝখানে ঢুকে পড়েছে। নামবার আগে অব্ধি সে আর খাড়া হতে পারল না।
কিন্তু নামার পর সে খানিক ধাতস্থ হল। এসি-তে এতক্ষণ থাকবার ফলে তার চশমার কাচ ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। সে ফুটপাথে সরে এসে খানি আয়েশে চশমাটা মুছছিল। বাসটা টেনে চালিয়েছে। তার হাতে মিনিট দশেক রয়েছে। তখনি তার চোখ পড়ল সামনে পার্ক করা গাড়িটার দিকে। উইন্ডো মিররে চোখ পড়তেই সে চমকে উঠল। প্রায় দৌড়ে গেল আয়নাটার সামনে। ঝুঁকে পড়ল। সরে এল। আবার ঝুঁকে পড়ল। কিন্তু নিজেকে দেখতে পেল না!
সে আশপাশে তাকাতে থাকল। মনে হল লোকজন যেন তাকে ফুঁড়ে হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে যাচ্ছে। সে চেঁচাতে গেল। আয়নায় ঘুষি মারতে গেল। কিন্তু কিছুই স্পর্শ করতে পারল না।
সে ফুটপাথে বসে পড়ল। নিজেকে চায়ের ছাকনির সঙ্গে তুলনা করল। কাঁদল। ভাবল তুলনাটা ঠিক হল না। সে ছিল; কিন্তু এখন নেই – শুধু এইটিই যেন সত্য।
সে বুঝতে পারল এই জগতে কেউই তাকে আর দেখতে পাচ্ছে না।
সে হাওয়া!
(চলবে)
সাদিক হোসেন
১৯৮১ সালের ১১ই ডিসেম্বর দক্ষিণ ২৪ পরগণার মহেশতলায় জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ইনফর্মেশন টেকনলজি নিয়ে পড়াশোনার শুরু। কিন্তু এই পড়াশোনা ব্যবহারিক অর্থে বৃথা যায়। পরবর্তীকালে মাল্টিমিডিয়া চর্চা করে বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করছেন।
ইতিমধ্যে অনেকগুলো বই বেরিয়েছে সাদিক হোসেনের। প্রকাশিত গ্রন্থ : দেবতা ও পশুপাখি (কবিতা সংকলন, ২০০৭) সম্মোহন (গল্প সংকলন, ২০১১), মোমেন ও মোমেনা (উপন্যাস, ২০১৪), গিয়াস আলির প্রেম ও তার নিজস্ব সময় (গল্প সংকলন, ২০১৪), রিফিউজি ক্যাম্প (গল্প সংকলন, ২০১৭), মোন্দেলা (উপন্যাস, ২০১৯), হারুর মহাভারত(গল্প সংকলন, ২০১৯), আনন্দধারা (গল্প সংকলন, ২০২১)।
পুরস্কারও অর্জন করেছেন তিনি। ‘সম্মোহন’ বইটির জন্য পেয়েছেন সাহিত্য আকাদেমি যুবা পুরস্কার (২০১২) ও ডলি মিদ্যা স্মৃতি পুরস্কার। ‘গিয়াস আলির প্রেম ও তার নিজস্ব সময়’ বইটির জন্য পেয়েছেন নমিতা চট্টোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার (২০১৫)।