আমাদের ছোটগল্পের পৃথিবীতে যদি হঠাৎ করে মৃত প্রেমিকের চুলের ভেতর থেকে একটা গল্প বেরিয়ে আসতে শুরু করে কিংবা একটা বড় বাঁশির ছিদ্রপথ দিয়ে যদি মানুষের প্রাণবায়ু বের হওয়ার গল্প আমরা শুনতে পাই, তখন প্রতিদিনের অভ্যস্ত পাঠরুচি থেকে খানিকটা সরে এসে আমরা ভিন্নতর উপায়ে নিজেদের মনোজগতকে সাজিয়ে নিতে বাধ্য হই।
এমনতর গল্প হয়তো নিত্যযাপনের রুটিনে অহরহ দেখতে পাই না। কিন্তু মানুষের বিবিধ বিভ্রম ও বিরহের বাস্তবতাগুলো আড়াল ও ছায়ার ভেতর থেকে সশরীরে সত্যিই কখনো কখনো বেরিয়ে আসতে পারে বৈকি। ফলে আমাদের গল্পের ভাষা ওয়াজি বক্তার গলা চড়ানো নিত্য নাটুকেপনা কিংবা রাজনৈতিক নেতাদের হাত উচিঁয়ে চালিয়ে যাওয়া অন্তঃসারশূন্য কথামালার মতো সরব ও মেকি না হয়ে ভিন্ন এক রাস্তা তৈরি করে নিতে চায় সযত্নে।
কেমন তাদের গল্প? কেমনই বা গল্পের বিষয় ও ভাষা?
তাইবা তুলবির ‘জন্ম থেকে মৃত’ নামক গল্পে প্রেমিকের খোঁজে পাঠককে নির্জন বনে নিয়ে যাওয়ার গল্প শোনানোর কথা বললেও বস্তুত সেই বন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। চোখে পড়ে না ব্যাঙ, বানর কিংবা হরিণ লাফিয়ে পড়ার কোনো দৃশ্য। তারপর আমরা আঁকাবাঁকা লতার সুঘ্রাণে, গা ছমছম করা থ্রিলারের ভেতর দিয়ে বনের ভেতর থেকে মাটি খুঁড়ে প্রেমিকের কঙ্কাল বের করি। মূলত গল্পের উদ্দেশ্য একটা নিরস কঙ্কালের সন্ধান নয়, এমনকি পুনরায় মৃতকে মাটিতে কবর দিয়ে কেবল প্রেমিকের চুলগুলো নিয়ে ফিরে আসাও নয়। শূন্য নির্জন বনে যে প্রেমিকের বসবাস, তার অস্তিত্ব আসলে অন্য কোথাও। আমাদের বিভ্রমের ভেতর সেই প্রেমিকের বসত।
যদি আব্দুল আজিজের গল্প ‘কুকুর চুরির রাত’ গল্পে ঢুকি, তখন দেখি কোথাও কুকুর চুরির গল্প নেই। কাঁসারি পাড়ার গ্রামীণ থুত্থুরে বুড়ি মহিলাদের গল্পের ভেতর দিয়ে এমন একটি গল্প বেরিয়ে আসে, যেখানে মানুষ বসবাস করে একটা বাঁকানো বাঁশির ভেতর। গল্পের ভেতর বৃ্দ্ধার গল্প কিংবা সুজনি কাঁথার নকশা ছাপানোর গল্প পাই। আরও পাই তাদের হাতে মাটির চুলা বানানোর গল্প কিংবা তামার বিশাল হাড়ির ভেতর জ্বিনের সাথে লড়াই করা দাদার গল্প। আরও অনেক অনুক্ত গল্পকে ছাপিয়ে মূলত বাঁশির ছিদ্রপথ দিয়ে কারও দেহ বেরিয়ে যাওয়ার মতো আপাত অবাস্তব গল্পটাই যেন পাঠককে তাড়িত করে।
সুবন্ত যায়েদের ‘নিঃসঙ্গ করতলে’ গল্পটি মানেুষের বিবিধ শূন্যতা ও নিঃসঙ্গতার বিবৃতি। গল্পকার গল্পের চরিত্র ইন্দুদের ছাদবাগানের অভিজাত হাওয়ার গল্প শোনাতে চাইলেও সেখান থেকে বেরিয়ে এসে তিনি জিকো মাস্টারকে গল্পের মূল চরিত্র হিসেবে হাজির করেন। জিকো মাস্টারের গল্পের মধ্যেই ইন্দুর কাজিন অহির গল্পটাও তুমুল বর্ষায় কাঁপিয়ে দেয় পাঠককে, যে কি না স্বেচ্ছামৃত্যুর আগে কিছু পাহাড়ি ফুল আর একটি চিরকুট রেখে যায়। সেখানে লেখা থাকে “নিঃসঙ্গতা আমাকে ক্রমশ ক্ষয় করে দিলো। তবু আমি মূলত পাখিদের ইচ্ছামত উড়ে কোথাও চলে যাওয়ার ক্ষমতাকে ঈর্ষা করি। কিন্তু আমি পাখি নই, অথবা ভীষণ নিঃসঙ্গ ডানাভাঙা এক পাখি। সুতরাং ডানাবিহীন উড়াল দিলাম।”
সাদিয়া সুলতানার গল্প ‘একচোখা নিরঞ্জন’ এমন একটি চরিত্র যার চোখের দৃষ্টিসীমায় দাঁড়ালে ফালা ফালা হয়ে যায় দেহ। এমনকি মাংসপেশী বিদীর্ণ করে ঐ দৃষ্টি অন্তরাত্মার গভীরে পৌঁছায়। ধুমেরকুটি গ্রামের একচোখওয়ালা নিরঞ্জন ও আইজুদ্দিনের গল্পের ভেতর থেকে যে গল্পটি শেষমেশ উঠে আসে তা বড় করুণ, পাঠক সন্ধান পায় একাত্তরের রাজাকার মগা তালুকদারের হাতে নিরঞ্জনের চোখ হারানোর আখ্যানের।
আজাদ মণ্ডলের ‘কদম ফুলের কান্না’ গল্পটি বৃষ্টিস্নাত কদমফুলের সৌন্দর্য বর্ণনা করেনি। গল্পের চরিত্র সবজি বিক্রেতা কাশেম আলীর মাদক পাচারের সংশ্লিষ্টতা আছে কি না তা নিয়ে গল্পের কথক ও গোয়েন্দা সংস্থার লোক রাজীব সাহেবের কথাপকথন গল্পের মূল উপজীব্য হলেও গল্পের সমাপ্তিতে কাশেম আলীর ছোট্ট মেয়ের সোনার প্রতিমার মতো এক মুখচ্ছবির সাথে গল্পকার আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন, যেখানে মূল বিষয়কে ছাপিয়ে মানুষের সম্পর্কের ভিন্ন এক বাস্তবতা গল্পের মূল অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে।
জাহেদ মোতালেবের ‘এই পৃথিবীর মরা ঘাসে তবুও মুক্তির ফুল ফোটে’ গল্পেও কথক ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে আপন সন্তানের হাত ধরে হেঁটে আসতে আসতে আমাদেরকে জাল টাকা নিয়ে ধরাপড়া যুবকের গল্প শোনান। গল্পের শেষে অন্য এক বাবা ও তার ছোট্ট শিশু ফাতেমার গল্পই পাঠকের সামনে মূল আখ্যান হয়ে ওঠে। গল্পের ভেতর ঝুলে পড়া স্তন ও এক বুড়ির গল্প আছে, ধনী-গরিব বৈষ্যম্যের যাতনা ও ক্ষোভ আছে, কিন্তু সেগুলোকে ছাপিয়ে শিশু ফাতেমার নষ্ট হয়ে যাওয়া চোখটিই পাঠককে অধিক বেদনার্ত করে।
ইলিয়াস বাবরের ‘তালতল আবাসিকের স্বপ্ন-বৃত্তান্ত’ গল্পে যে চরিত্রগুলোর দেখা পাই, সেখানে রেদুমামা নামক চরিত্রটিই অধিক মনোযোগ নিয়ে পাঠককে ধাবিত করে। স্বপ্নে ঐশ্বরিয়া রায় আসার গল্প কিংবা সেই স্বপ্নাবিষ্ট রেদুমামার বিবিধ অনুষঙ্গ ও রস পাঠকেকে আন্দোলিত করে।
হুসাইন হানিফ ‘রাক্ষসের মত সেই কবিকে’ গল্পটি দালাই লামা ও একটি শিশুর গল্প দিয়ে শুরু হলেও গল্পের পরিণতিতে ভিন্নতর শিহরণ জাগানিয়া এক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয় পাঠককে। যে সত্য ও বাস্তবতা সচরাচর অনুক্ত থাকে আমাদের সমাজে, তেমন এক ছায়া ও আড়ালকে গল্পকার তুলে ধরেন। ধর্মভীরু কিশোরের আবেগ ও শ্রদ্ধার জায়গাটিকে চুরমার করে দিয়ে একদিন মাদ্রাসার প্রিয় হুজুর যেভাবে যৌনবিকারগ্রস্ত নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তার ফলে যে মনোজাগতিক পরিবর্তন কিশোরকে মোকাবেলা করতে হয়, তা পাঠককে ভাবিত করে।
মুয়িন পারভেজের ‘বেশটমেটো’ গল্পটি স্যাটায়ার ও বিবিধ অনুষঙ্গের মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষের সামজিক জীবনযাপনের দৃশ্যপট তুলে ধরেছে। বেশটমেটো একটি চরিত্রের নাম, যে নামের শানে নুজুল দিতে গিয়ে গল্পকারকে অভিনব স্যাটায়ারের মাধ্যমে পাঠককে মোহিত করার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু দিনশেষে এটি উদ্বাস্ত হয়ে আসা মানুষের গল্প। রাজনৈতিক নৈরাজ্যের মধ্যে সংগ্রামরত প্রান্তিক মানেুষের যাপিত-জীবনের গল্প।
শোয়ায়েব মুহামদের ‘রুয়েলিয়া, রুয়েলিয়া’ গল্পটি অন্য গল্পগুলো থেকে খানিকটা ভিন্ন এই অর্থে যে, তিনি সীমিত পরিসেরে শুকতারা, রেজা ও শাহেদ নামক চরিত্রের মধ্য যে মানুষের প্রণয়, কাম ও ভালোবাসার আলো-আধাঁরকে খানিকটা উন্মোচিত করার চেষ্টা করেছেন।
সাইদুল ইসলামের ‘সাদা ফ্রক’ গল্পটি প্রতীক ও ভাবানুসঙ্গের ছায়ায় একটা অনুক্ত ও রুদ্ধ বাস্তবতার গল্প এঁকেছে পাঠকের জন্য। ছাদে শুকোতে দেওয়া সাদা রঙের ফ্রকটি উত্তুঙ্গ বাতাসে কোথায় উড়ে যায়? ফ্রকের বুকের দিকটায় দুপাশে দুটি ফুল কেন আঁকা থাকে? পাঁচ-ছয় মাস বয়সী কোনও বাচ্চার ফ্রকটি উড়ে উড়ে রাস্তায় যে লোকটির পায়ের কাছে এসে পড়ে, সে লোকটি সম্পর্কে গল্প থেকে কিছু জানা যায় না। তবু পাঠক অনেককিছু গল্পের ভেতর আবিষ্কার করার রসদ খুঁজে পায়।
খালেদ হামিদীর ‘খোকা ও শোশা খালা’ গল্পটি কেবল একজন নারীর ভাগ্যবিড়ম্বিত জীবনে ছায়া ফেলেছে তা শুধু নয়, উঠে আসে নারীর সামাজিক মর্যাদার সংকট ও নিপীড়নের বিষয়গুলোও। সেই নারী এমন মানুষের কাছে নিপীড়নের শিকার হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন, যারা তার পরম আশ্রয় ও পরিবার হওয়ার কথা ছিল। গল্পের চরিত্র শোশা খালা সতীনের সন্তানদের আপন করে নিলেও শেষপর্যন্ত তাদের কাছেও নিগ্রহের শিকার হন। গল্পের কথক যেভাবে শোশা খালার চরিত্রকে বর্ণনা করেছেন, তার ভেতর দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে এদেশের একশ্রেণির প্রতারণার বিষয়সহ আরও নানান অনুসঙ্গ উঠে আসে।
মূলত ছোটগল্পের যে পৃথিবীতে বারোটি গল্পের মাধ্যমে পাঠক প্রবেশ করে, সেসব গল্পের আাঙ্গিক, চিন্তা ও দর্শনের পৃথিবী আলাদা। তাদের গল্পের চরিত্ররা আলাদা পথে হাঁটে, কিন্তু সবার উদ্দিষ্ট গন্তব্য যেন এক। আর সেই গন্তব্য সম্ভবত মানুষের মুক্তি ও কল্যাণের পথে নিজেদেরকে বারবার ফিরে ফিরে দেখা।
ফজলুল কবিরী
জন্ম ৯ অক্টোবর, ১৯৮১। কথাসাহিত্যিক ও সাহিত্যসমালোচক। লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ততা দুই দশকের। তিনি বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন ছোটকাগজ, দৈনিক পত্রিকা ও ওয়েবজিনে লেখালেখি করেন। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : ১. বারুদের মুখোশ, ২. ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া গল্প, ৩. ডোরাকাটা ক্যাডবেরি। উপন্যাস : ঔরসমঙ্গল। প্রবন্ধ : লেখকের বুদ্ধিবৃত্তিক দায় ও দর্শনের খোঁজে।