কথাসাহিত্য ছোটগল্প বিশেষ সংখ্যা

খালেদ হামিদী | খোকা ও শোশা খালা | ছোটগল্প

নিজের গলায় তিনটা ভাঁজ চোখে পড়ে খোকার। চিকন, লম্বা কেবিনেটের গায়ে-সাঁটা আয়নার সামনে, ফ্লোরে বসতেই, শিথিল হয়ে-পড়া ত্বকের এই অবস্থা সে দেখতে পায়। খালি গায়ে লুঙ্গি পরে সিঙ্গল খাটে হেলান দিয়ে প্রায়ই সন্ধ্যার পরে এভাবেই বসে খোকা। কিন্তু আজ আরেকটু মনোযোগী হতেই নিজের গলার ভাঁজগুলিকে ভাঁজ নয়, খাঁজরূপেই আবিষ্কার করে। শুধু তা-ই নয়, গলায় আরও দুটি মৃদু কাটা দাগের মতো রেখা সে খেয়াল করে। আর, নিজেকেই বলে :
আরব দেশে পাঁচ বছর থাইকা আসছি বইলাই কি এই পাঁচটা দাগ এইভাবে বুকের ভিতর থিকা গলায় উইঠা আইল?

জবাই হওয়ার মতো এই চিহ্নগুলি ক্ল্যাবিক্যাল বোন বা কণ্ঠাস্থির এক ইঞ্চি উপর থেকে ওর থুতনির প্রায় দুই ইঞ্চি নিচে পর্যন্ত দৃশ্যমান। বয়স্কতার এই প্রমাণগুলি তাকে মুহূর্তের মধ্যে নিয়ে যায় পঁচিশ বছর আগের সেই প্রবাসে। খোকা তখন সাতাশ-আটাশ বছরের যুবক। শত দমন-পীড়ন সত্তে¡ও যৌবনের বেপরোয়া হতে চাওয়ার উত্তুঙ্গ কাল। দেশে-বিদেশে ভীরু বলে পরিচিত খোকা কি গোপনে কোনও সুযোগ নেয়? তার শান্ত স্বভাব এই ধরনের কোনও ভাবনার সুযোগ অবশ্য কাউকেই দেয় না। সে নিজেও কারও সাথে প্রাণ খুলে মেশে না। মিশতে চায় না তাও অবশ্য না।

রিডিং কাম গেস্ট রুম থেকে উঠে সে মাস্টার বেড রুমের থাই গ্লাসে ঢাকা গ্রিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। উত্তরমুখি নয় তলা দালানের টপ ফ্লোরের ফ্ল্যাট থেকে সে দেখে পূর্ব দিকের টাওয়ারটা বারো তলা পর্যন্ত উঁচু হয়েছে। শোনা যায় সেটা সতেরো তলা হবে। একই ভূমি-মালিকের উত্তরের বিল্ডিংটা চার তলা পর্যন্ত উঠেছে, হবে বারো তলা। দুটোরই নির্মাণ কাজ চলছে। রাত-দিন নানারকম আওয়াজ শুনতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে এলাকাবাসী। কিন্তু ধপাস-ধপাস শব্দে কী কথা, কার কথা মনে পড়ে খোকার? প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে সঙ্গী বলছে :
আস্তে কোপা! আওয়াজে ভিলার কারও ঘুম ভাইঙ্গা গেলে দুইজনই ধরা খামু কিন্তু! আমি বাদশাকে মাথা দিতে চাই না!
জবাবে সে বলে :
আমিও তা চাই নাকি! চুপ কর! আমারে কাম সারতে দে!
খোকা ভাবে :
কাউরে ক’ন যায় না এমন ঘটনার কথাগুলা ডায়েরিতেও লিখতে পারি না, শালা! এমন রাখঢাক কইরাই হায়াত ফুরাইয়া যাইব!
ভাবনার এক পর্যায়ে, সে এখন একা বিধায়, হঠাৎ সাহসী হয়ে ওঠে। সমস্ত শক্তিযোগে জেগে ওঠে উরুসন্ধি থেকে। তারপর এই রুমেও স্থাপিত দীর্ঘ আয়নার সামনে সটান দাঁড়িয়ে নিজেকে সাহায্য করতে শুরু করে সে। অনেকদিন যাবৎ স্ত্রীকে ওর একান্তে পেতে বাধা হয়ে আছে মধুমেহ। কিন্তু স্বমেহনে আজ সে রাজা। বিনিয়োগহীন, মুনাফাশূন্য স্বনির্ভর প্রেমের বিজয় অনুভব করে খোকা। কিন্তু শেষে নিজেকেই প্রশ্ন করে:
সেখানে ধরা খাইলে মাথা কাটা যাইত বইলাই কি আমার গলায় এত দাগ! তাই বইলা কোপাকুপি তো পাঁচবার হয় নাই! লগেও থাকে নাই পাঁচজন! তাছাড়া হেরা তো কল্লা কাটে কান্ধে কোপ দিয়া!

এরও পরে ‘এইসব ওলটপালট ভাবনা ক্যান আইতাছে মাথায়!’
বলেই সে আবার পুব দিকে তাকায়। নির্মীয়মাণ দালান দুটির মাঝখানে একক পাহাড়ের উপর হলুদ দেয়ালের এক বিশাল একতলা বাড়ি দেখতে পায়। হ্যাঁ, সেটা ছিলো এক শিল্পপতির মলিন প্রাসাদ, বহু আগের এক ব্রিটিশ মালিকের কাছ থেকে কেনা। সেই প্রাসাদের দ্বিতীয় রানি খোকার খালা। ওর মায়ের ফুফাতো বোন। খোকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের মনেই বলে ওঠে :
কী অদ্ভুত, তাও ছিলো শোশা খালার দ্বিতীয় সংসার! আরও আশ্চর্য লাগে তাঁর ভাগ্যের কথা মনে পড়লে। ওনার প্রথম সংসারও ছিলো আরেকটা পাহাড়ের উপর আরেক ঝকঝকে রাজবাড়িতে। সেই রাজঘরে আম্মার লগে কতবার যে গেছি! পেছনের উঠানে খরগোশের লাফালাফি আর লম্বা বারান্দার মতো অংশের শোকেসগুলাতে রাখা দামি দামি জিনিসগুলার দিকে আমি হা কইরা তাকাই থাকতাম। আর শোশা খালা আমার দুই গালে আর গলায় চুমা দিতেন। বয়সে তিনি আম্মার বড়। আহা, আজ দুনিয়াতে নাই!
স্বগত সংলাপের এক পর্যায়ে নিজের গলায় হাত দিয়ে সে কহে :
এই তো আমার খালার চুমার দাগ! না, আর কোনও কাটা দাগ নাই!
আরও কত কথা যে মনে পড়ে খোকার! ছোডকালে হুনছি, পরে জানছি, শোশা খালার প্রথম স্বামী নাকি একদিনের জন্য প্রেসিডেন্ট হইছিলেন। সত্তর/পঁচাত্তর বছর বা তারও আগের কথা। তিনিও নাকি ব্রিটিশদের থিকা মাত্র দুই টেকায় রাজবাড়িডা কিনছিলেন। আমার খালার সন্তান আছিল না। সেই বাদশা স্বামী আছিল তাঁর আপন খালাতো ভাই। আম্মায় কইতেন হের কী দাপট, ঠাট, কী জোশ! কিন্তু একাত্তরে আমগো মুক্তিযুদ্ধের সময় উনি, ওনার পুরা পরিবার শত্রুর পক্ষে খাড়াইছিল! ওনার বড় ছেলে মুক্তিযোদ্ধাগো ধইরা আইনা হেগো রাজবাড়ির বিরাট বসার ঘরে মারধর করছে, খুনও করছে!

খোকার মা ও মামারা স্বাধীনতার পর থেকে তাদের শোশা বুবুকে দেখতেও সেই পাহাড়ে আর ওঠেননি। এরও ঢের আগে থেকে শোশা প্রয়াত সতীনের শিশু-কিশোর চার ছেলে ও দুই মেয়ের লালন-পালনে দ্বিধা করেননি। তাদের কোনোদিন পর ভাবেননি। বেড়ে ওঠার পর সেই ছেলে-মেয়েরাই তাঁর সাথে, বিশেষ করে, স্বাধীনতার বছর দেড়েকের মধ্যে, বিমাতাসুলভ আচরণ শুরু করে। তাদের আপত্তি, ‘মা তার বাপের বাড়ির আত্মীয়দের এনে এনে রাখে। আমরা কি এখানে লঙ্গরখানা খুইলা রাখছি!’ তাদের অমন সব বিরক্তি ও অপমান অসহ্য হয়ে ওঠায় শোশা একদিন ওই প্রাসাদ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। ঠিকই একদিন সেই সন্তানদের অগোচরে, একটা স্যুটকেস ও আরেকটা ব্যাগে শুধু পরিধানের কিছু কাপড় আর গয়না নিয়ে, তিনি পাহাড় থেকে নেমে আসেন। গাড়ির রাস্তায় নয়, প্রাসাদের এক পাশের সিঁড়ি বেয়ে পাহাড় থেকে নামেন। রিকশায় চলে আসেন অদূরে, তাঁর মেজ মামার, খোকার নানার, ভাড়া বাসায়। মামা বিধবা ভাগনিকে আশ্রয় দেন নির্দ্বিধায়। কয়েকদিন পর পাঠিয়ে দেন গ্রামের বাড়িতে থাকা তাঁর বিধবা ছোট বোনের কাছে। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে মা-মেয়ের আকাশচেরা সে কী আর্তনাদ! এ-খবর পরে অন্যদের কানে আসে। আরও পরে খোকার নানাই শোশা খালাকে আরেক পাহাড়ে বিয়ে দেন। এই খালু মানুষটা ধনকুবের, কিন্তু, রাজা-বাদশা নন, সাধাসিধা মাটির মানুষ।

প্রবাসে খোকার বেশি মনে পড়তো শোশা খালার মুখে শোনা দীনহীন বেশে প্রাসাদ ছেড়ে আসার গল্প। দ্বিতীয় বিয়ের আগে সেসব বলার সময় তিনি অঝরে কাঁদতেন। স্বামীর লিখে দেয়া কত বক্তৃতা কত দেশে যে তিনি দিয়েছেন সেসবের সঙ্গে সেই অলিখিত ত্যাগের কত অমিল! সেদিন রিকশায় তিনি ডুকরে ডুকরে, কিন্তু, নিঃশব্দে কাঁদেন। তখন তাঁর মনে হয়, এতিম, বিধবা এবং গরিব নয়, নিঃসন্তান নারীরই আসলে কেউ নাই, কেউই থাকে না এই পৃথিবীতে! মামার বাসায় ঢুকে মামীকে বুকে চেপে তাই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন সশব্দে। কিন্তু খোকার নানা ছিলেন আত্মীয়বৎসল, উদার মানবপ্রেমী।

খোকা এখনও চমকে ওঠে খালার প্রথম সংসারের বড় মেয়ে ও সেজ ছেলে কীভাবে তাদের নানির গায়ে হাত তুলতে পেরেছে ভেবে। দ্বিতীয় বিয়ের পর শোশা খালা তাঁর মায়ের কাছে বেড়াতে যাওয়ার দু’দিন পর তারা প্রাইভেট কারে সেখানে যায়। ওরা আসছে শুনে খালা ও-বাড়ির পেছনে বেরিয়ে পড়েন। লুকিয়ে পড়েন পুকুরপাড়ের ঝোপে। এদিকে তাঁকে না পেয়ে মারমুখো দু’জন তাঁর মায়ের উপর এলোপাতাড়ি হামলা চালায়। শুধু কিল-ঘুষি-লাথি নয়, তারা বৃদ্ধার চুলও কেটে দেয়। ‘মায়েরে আবার বিয়া দিছস ক্যান! আমাগো ইজ্জত নাই মনে করছস্!’ বলতে বলতে তারা ওই নির্যাতনে মাতে। প্রতিবেশিরা শুনতে পেলেও নানিকে উদ্ধারে সক্ষম হয় না। দরজা-জানলা বন্ধ করেই তারা তাণ্ডব চালায়। অন্য ঘরের যুবকেরা ওদের গাড়িটা কাছের ডোবায় ঠেলে ফেলে দিতে চায়। ড্রাইভার হর্ন বাজাবে বলে ভয় দেখিয়ে তাদের থামায়। একজন ইউনিভার্সিটি-পড়ুয়া যুবক বলে ওঠে :
একাত্তরে পরাজয়ের প্রতিশোধ কি তারা এভাবে নিচ্ছে!

খোকাদের বাসার পুব দিকের নির্মীয়মাণ দুটি টাওয়ারের মাঝবরাবর থাকা শোশা খালার সেই রাজঘরও আর নেই। মাস ছয়েক আগে ভেঙে ফেলা হয়। ওনার স্বামীর ছেলেরা ডেভেলপার কোম্পানিকে দিয়েছে পুরো বাড়িসহ চারপাশের জায়গা। ওদের মা-বাবা আর বিবাহিত একমাত্র বোনও আর নেই। শোশা খালা তো চলে যান খোকার পরবাসকালেই। এই সংসারের তরুণ-যুবক ছেলেদেরও তিনি চুমুতে-চুমুতে আদরে ভাসাতে দ্বিধা করতেন না। মায়ের চিঠিতে শোশা খালার মৃত্যু-সংবাদ পড়ে খোকা স্তব্ধ হয়ে পড়ে।

ওদিকে ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে আবার আয়নার সামনে এলে গলার খাঁজগুলি ফের চোখে পড়ে খোকার। প্রবাসে শিরশ্ছেদ হতে পারতো যেসব গোপন ঘটনায় সেগুলোতে বুঝি সে আবার ফিরে যায়। সেখানে কে কাকে অগোচরে কোপায়? বরং যে দু’বার সে কুপোকাত হয় সেই দুইবার ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে ভিলার ব্যাক ইয়ার্ডে চড়ুইদের সমাবেশ দেখতে পায়। এসি-চালিত এয়ার টাইট রুমে ভেসে আসে ওদের কিচিরমিচির আলাপন। খোকা ফের আনমনে বলে ওঠে :
তিনজন খুশিতে আমার কোপ খাইয়াও ’কিছুই হয়নি’ মতো স্বাভাবিক আছিল। আমার ক্যান মনে হয় যে আমি শোশা খালার মতো হয়া গেছি। চক্ষু ফাইট্যা কান্দন আহে। মনে আছে, খালায় একবার মায়েরে একলা পাইয়া কইছিল, আমি পাশের ঘর থিকা হুনছি :
আমি কিন্তু বাঞ্জা না। বয়স আর লেখাপড়া কম ছিল বিধায় তখন বুঝি নাই। প্রেসিডেন্ট সা’ব বিদেশে আমার একটা অপারেশন করাইছিল। মনে হয় ডাক্তাররে দিয়া আমার জরায়ু ফালায়া দিছে! বইন, স্বামীরা আমারে বিছানায় শুধু কোপাইয়া গেল! কিছুই দিল না!

খালেদ হামিদী

কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। জন্ম : ২৪ জানুয়ারি ১৯৬৩। প্রকাশিত গ্রন্থ : কাব্য (০৮টি), গল্পগ্রন্থ
১টি, প্রবন্ধ ৩টি, অনুবাদ ১টি। পুরস্কার : চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন মহান একুশে স্মারক সম্মাননা পদক ২০১৯ এবং শালুক বিশেষ সম্মাননা পদক ২০১৯।

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field
    X