কথাসাহিত্য ছোটগল্প বিশেষ সংখ্যা

আজাদ মণ্ডল | কদম ফুলের কান্না | ছোটগল্প

লোকটি রুমে ঢুকেই স্মিত হাসি দিয়ে ‘কেমন আছেন?’ জিজ্ঞেস করাতে আমি অবাক হলাম। তাকে আমি চিনি না। বিস্ময়ের ব্যাপার আরো যে, উত্তর না শুনেই সে চেয়ারের হাতলে থাকা গামছা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ল।
আমি মনে মনে লোকটির মুখমণ্ডল কল্পনা করে দীর্ঘদেহী বলশালী পরিচিত কারো অবয়ব দেওয়ার চেষ্টা করলাম। ব্যর্থ হলাম কারণ অতি স্বল্প দেখা আমার মস্তিষ্কের মেমরি সেল লোকটির চেহারা কপি করতে পারেনি।
কিছু পাওয়ার আশায় আগন্তককে নিয়ে আমি ব্যাক ক্যালকুলেশন করতে লাগলাম। বর্ষার সকাল। কিছুক্ষণ আগেও বৃষ্টি ছিলো না। এখন হচ্ছে। মূল রাস্তার সাথে লাগোয়া আমার বাসা। আশপাশে আর কোনো বাসা বা দোকানপাট না থাকায় সে বৃষ্টি ফোঁটা থেকে রক্ষা পেতে আমার বাসায় ঢুকেছেন। বাথরুমে সে গেছে দুই কারণে : এক. কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি যে মাথায় পড়ছে গামছা দিয়ে সেটা মুছতে। দুই. জরুরি ভিত্তিতে প্রকৃতির ডাক সাড়া দিতে। আর ‘কেমন আছেন’ বলছেন মূলত সৌজন্যতা বশত, আসলে সেও আমাকে চেনে না।
আমি জানালা দিয়ে বৃষ্টিস্নাত কদমফুলের হলুদ-সাদার কম্বিনেশনে মনোনিবেশ করলাম। কিন্তু, পরক্ষণে মনে হলো ‘সামথিং রং’। আগন্তককে নিয়ে আমার ক্যালকুলেশন সঠিক হয় নাই। আমি থাকি ফার্স্ট ফ্লোরে, লোকটির বাথরুমজনিত জরুরিভাব যদি হয়েই থাকে তাহলে সে গ্রাউন্ড ফ্লোরেই কারো রুমে গিয়ে কাজ সারতে পারতেন। এইটা ব্যাচেলর বাসা। গ্রাউন্ড ফ্লোরে পাঁচটা এটাচড্ বাথরুম আছে, লোকটি সেখানে না গিয়ে সিঁড়ি ভেঙে দোতালায় আসছে কেন?
লোকটিকে নিয়ে আমার মনোসংকোচ বাড়তে লাগল। পরিচয় জানার পর যদি ধরা পড়ে অনুমতি না নিয়ে গামছা নিয়ে বাথরুমে যাওয়া পর্যায়ের পরিচিত তিনি, তখন কি হবে? লজ্জা পাবো?
তবে, লজ্জা আমাকে পেতে হলো না। বাথরুম থেকে লোকটি মাথা মুছতে মুছতে বের হয়ে যখন বলল, ‘সরি জহির সাহেব, পরিচয় না দিয়ে আর পারমিশন না নিয়েই আপনার বাথরুম ইউজ করেছি। আসলে প্রকৃতির ডাকে কঠিন চাপ ছিলো।’
লজ্জা না পেলেও দ্বিধা আমার গেলো না। লোকটি আমার নামও জানে? লোকটিই ক্লিয়ার করলো যে তাকে আমি চিনি না, তবে আমার নাম জানার ব্যাপারটায় আমার দ্বিধা রয়েই গেলো। আমি সেটা কাটানোর জন্য জিজ্ঞেস করলাম, নো প্রোব্লেম। সত্য যে, প্রকৃতির কাছে মানবসৃষ্ট নিয়ম কানুন এমনকি সৌজন্যতা ভদ্রতার কোনো দাম নাই। কিন্তু, আপনি আমাকে চিনেন কিভাবে বলবেন?
আমার কথা শোনে লোকটি সাথে সাথে কিছু বলল না। চেয়ারটা টেনে আমার সামনা সামনি বসল। এই প্রথম লোকটির মুখ আমি ভালোভাবে প্রত্যক্ষ করলাম উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের তবে চোখ দুটো মুখের আকারের তুলনায় ছোট। সে একটি সিগারেট ধরিয়ে আরেকটি আমার দিকে বাড়িয়ে প্রায় চোখ বুঝে কথা বলল,
জহির সাহেব, আমার পরিচয়টা পরে দেই। তার আগে বলুন, কাশেম আলীকে আপনি কিভাবে চিনেন?
লোকটির নিজের পরিচয় না দিয়ে যেভাবে শেষের প্রশ্নটা করলেন তাতে অবাক হলাম। সে প্রশ্ন করছে আদেশের সুরে। লোকটির বাথরুমে যাওয়া আগের আর পরের আচরণের হিসেব আমি মিলাতে পারলাম না। বুঝতে পারলাম কদম গাছের সবুজ পাতার ডালে গোলাকার মাংসল পুষ্পাধার আর তার থেকে বের হওয়া সরু হলুদ পাপড়ির মুখে সাদা অংশ আজ আর দেখা হবে না। আর কাশেম আলী কে? তাকে তো চিনতে পারছি না। আমি লোকটির প্রতি বিরক্ত প্রকাশ করে বললাম,
বুঝলাম না আপনি আদেশের সুরে কথা বলছেন কেন? কে আপনি?
লোকটি হাসল তবে এবারের হাসিটা স্মিত নয় শুষ্ক। সে মুখভর্তি ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল,
উত্তেজিত হবেন না। আমার নাম রাজীব চৌধুরী, গোয়েন্দা সংস্থায় আছি। এই আমার আইডি কার্ড। আপনার কাছে এসেছি একটি মাদক মামলার তদন্তের প্রয়োজনে। কাশেম আলীর সাথে আপনার সম্পর্ক কী? ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে নয় প্রশ্নের সহজ সরল উত্তর দিবেন। মনে রাখবেন জটিলতা যত কম তত ভালো।
আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। সত্যিই গোয়েন্দা সংস্থার লোক। কিন্তু আমার কাছে কেন? কোম্পানির চাকরি করি। সেই সূত্রে আমার এই উপশহরে অবস্থান। স্ত্রী সন্তানসম্ভবা গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে এই ব্যাচেলর বাসায় উঠেছি। আমি যতটা পারি জীবনের জটিলতা এড়িয়ে চলি। নেশার মধ্যে আছে শুধু সিগারেট। তাও ইদানীং ছাড়ার চেষ্টা করছি। এর মধ্য মাদক মামলার তদন্তের জন্য সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার লোক আমার কাছে আসবে কেন? আর কাশেম আলী নামের কাউকে তো আমি মনে করতে পারছি না। অধিক উত্তেজনায় আমি রীতিমতো ঘামতে লাগলাম। আমতা আমতা করে বললাম,
কাশেম আলী? চিনতে পারছি না।
রাজীব চৌধুরী হাসল, তবে এই হাসির মানে আমি মিথ্যা বলছি। ছাইদানিতে সিগারেটের ছাই ছাড়তে ছাড়তে সে বলল,
জহির সাহেব সিগারেট ধরান। যারা ধুমপানে আসক্ত মানসিক উত্তেজনার সময় রক্ত তাদের কাছে নিকোটিন চায়।
আমি সিগারেট ধরালাম না। কিন্তু মানসিক উত্তেজনা আমার বাড়তে লাগল। আমি কাশেম আলীর নামটি মনেপ্রাণে মনে করার চেষ্টা করতে লাগলাম।
রাজীব সাহেব, আবার কথা বললেন,
আপনার মাথা ঠিক মতো কাজ করছে না। আমরা জানি স্নায়বিক উত্তেজনায় অতি নিকটজনের নামও অনেক সময় মনে থাকে না। আপনিও এখন সেই গ্যাঁরাকলে পড়ে কাশেম আলীকে মনে করতে পারছেন না। আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি, আপনি এই এলাকায় যেখান থেকে বাজার করেন, সেই বাজারে ঢোকার আগের মোড়ে সবজি বিক্রিতা এবং পাইকার কারবারির নাম কাশেম আলী। যার দোকানের পলিথিন ছাউনির নিচে টুলে বসে আপনি প্রায়দিন চা খান তার সাথে ঘণ্টা পর ঘণ্টা গল্প করেন। এইবার চিনতে পারছেন?
আমি চমকে উঠলাম। হ্যাঁ, কাশেম আলীকে আমি চিনি। সত্য যে মাঝে মাঝেই তার দোকানের পলিথিন ছাউনির নিচে বসে আমি বিক্রিবাট্টা দেখি, তার সাথে গল্প করি, চা সিগারেট খাই। কাশেম আলীকে আমি চিনি অথচ বলেছি, চিনি না। গোয়েন্দা সংস্থার লোক। না জানি কোন প্যাঁচে পড়ে যাই। আর কাশেম আলীর সাথে মাদক মামলার সম্পর্ক কী? আমার জিব্বায় পানি শূন্যতা অনুভব করলাম। কথা আটকে যাচ্ছে। তারপরও কোনোমতে বললাম,
হ্যাঁ, ওনাকে তো আমি চিনি। স্যরি, আপনি ঠিকই বলেছেন স্নায়বিক উত্তেজনায় তাকে মনে করতে পারি নাই। আসলে শুধু গোয়েন্দা বিভাগের না বাংলাদেশের কোনো পুলিশের সাথে আমার ইতিপূর্বে কখনোই কোনো মামলার তদন্তজনিত সাক্ষাত হয় নাই। মাদক মামলার ব্যাপরটা আমাকে একটু ক্লিয়ার করবেন প্লিজ। আমি দ্বিধায় আছি।
রাজীব সাহেবের মুখে এবার স্মিত হাসি দেখলাম। সিগারেটের শেষ অংশ সে অ্যাশট্রেতে রেখে বলল
আপনার দ্বিধায় থাকা স্বাভাবিক। বুঝতে পারছি আপনাকে মারাত্মক প্রেশারে ফেলে দিয়েছি। আর বেশি সময় নিবো না। ব্যাপারটা আপনাকে ক্লিয়ার করি। দেশের মধ্যে মাদকের, বিশেষ করে ইয়াবার যে মেইন স্পট আছে তার মধ্য এই এলাকা অন্যতম। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকার উপর নজর রাখছি অবশেষে আমরা জানতে বা আমাদের নেটে ধরা পড়ে যে কাশেম আলী সবজি বিক্রির আড়ালে একজন মাদক পাচারকারী। সে ট্রাকে করে মেইন শহরে যখন সবজি সরবরাহ করে, আসলে সেইগুলোর যেমন লাউ কুমড়ো কলা ইত্যাদির পেটের মধ্যে ভরে পাচার করে মাদক।
রাজীব সাহেবের কথায় আমি প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম। মনে হলো আমি স্বপ্নের মধ্য তার কথা শুনছি। আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এইটা কি করে সম্ভব। কোনো ভুল হচ্ছে নাতো? কাশেম আলীকে আমি জানি একজন ভালো মানুষের যে যে গুণ থাকতে হয় সেই গুণীজন হিসেবে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো সে একজন আর্দশবান বাবা। না না কাশেম আলী একজন মাদক ব্যবসায়ী হতে পারে না। আমি আনমনে বলে উঠলাম,
ইমপসিবল! কখনোই না। নেভার।
রাজীব সাহেব শব্দ করে হেসে বলল,
আপনি আপনার চিন্তা করেন! আমি আপনার কাছে এসেছি কেন কারণ অনুমান করছেন?
আমি সংবিৎ ফিরে পেলাম। তাই তো। আমি ম্রিয়মান স্বরে বললাম,
আপনি কি আমাকে সন্দেহ করছেন?
রাজীব সাহেব আরেকটি সিগারেট ধরিয়ে বললেন,
হ্যাঁ। সন্দেহ করেছি তো অবশ্যই। আপনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা একজন মাদক পাচারকারীর সাথে সময় কাটিয়েছেন, গল্প করেছেন। আপনাকে সন্দেহ করবো না?
আমি নিজের সমূহ বিপদের কথা মনে করে আমতা আমতা করে বললাম,
দেখুন ইয়াবা যে কোন ধরনের তা টেলিভিশন আর পত্রিকা ছাড়া নিজ চোখে আমি কোনোদিন দেখিনি। ইভেন, কাশেম আলী যে এবজন মাদক ব্যবসায়ী সেটাও কখনোই বুঝতে পারিনি।
রাজীব সাহেব সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে স্মিত হেসে বললেন,
নিজ চোখে দেখেননি সেটা আপনার জন্যই ভালো হয়েছে। হয়তো জানেন না গত তিনমাস ধরে আপনি আমাদের নজরবন্দি ছিলেন। আপনার প্রতিদিনের কর্মকাণ্ডের উপর আমাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিলো। আপনার অফিস, গ্রামের বাড়িতেও আমাদের সোর্স লাগানো ছিলো। সুখবর হলো, তিন মাসের অবজারভেশনে আপনার সাথে মাদক রিলেটেড কোনো ক্লু আমরা পাই নাই। এমনকি কাশেম আলীও আপনার সাথে মাদকের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে। সবকিছুর পরে আজ আপনার কাছে এসেছি একটা বিষয় ক্লিয়ার হতে। আপনার সাথে কাশেম আলীর কিসের এতো সখ্য ছিলো? সে তো আপনার পূর্ব পরিচিত ছিলো না। একজন মাদক ব্যবসায়ীর সাথে আপনি দীর্ঘক্ষণ কি এমন কথা বলতেন? আপনি কি কখনোই বুঝতে পারেন নাই সে আসলেই একজন দুর্জন, সমাজ ধ্বংসকারী খলনায়ক? দেখুন, আমি আশা করি আপনি সত্য কথা বলবেন। আমরা আপনাকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারতাম। তা না করে আপনার সম্মান রেখেছি। সুতরাং…
রাজীব সাহেবের কথা শুনে আমার বুক কেঁপে উঠল ঠিকই পরক্ষণে বুঝতে পারলাম আমার শরীরের সমস্ত শিরা-উপশিরা দিয়ে একটা শান্ত শীতল স্রোত বয়ে গেলো। আমার মনে হলো আমি একটি বদ্ধ ঘরে বন্দি ছিলাম, যে-ঘরে অক্সিজেন পযাপ্ত ছিলো না। শ্বাস নিতে আমার কষ্ট হচ্ছিল। হঠাৎ সেই ঘর আলো বাতাসে ভরে গেল। গত তিনমাস আমি গোয়েন্দাদের নজরবন্দি ছিলাম এমনকি আমার অফিস বাড়িও? আর আমি কিনা কিছুই বুঝতে পারি নাই। স্ট্রেঞ্জ! তবে, কাশেম আলী মাদক কারবারী দুর্জন বিষয়টা মানতে আমার আরো কিছুদিন সময় লাগবে। কাশেম আলীতে আমার একটা ভালো লাগার ঘোর লেগে আছে এবং এইটার ভিত্তি অনেক মজবুত বুঝতে পারলাম। সব শুনেও আমার তার প্রতি একটা মায়া কাজ করছে।
আপাতত স্বীয় মুক্তির আনন্দে সিগারেট ধরিয়ে বললাম,
কাশেম আলী সম্পর্কে আমি আপনাকে সত্যি কথাই বলবো। কিন্তু, আপনি বিশ্বাস করবেন?
অবশ্যই করবো। আর মিথ্যা বললেও তা বুঝতে পারবো।
আমি সিগারেটে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলতে লাগলাম,
কাশেম আলীর সাথে আমার প্রথম পরিচয় আজকের মতোই এক বৃষ্টিস্নাত দিনে। আশ্রয় নিয়েছিলাম তার পলিথিন ছাউনি দেওয়া দোকানে। প্রথমে ভদ্রতাবশত সে আমাকে একটি টুলে বসতে দিয়েছিল। আমিও সৌজন্যতাবশত তাকে ধন্যবাদ দিয়ে ব্যবসার খোঁজখবর নিলাম। বৃষ্টি শেষে টুল থেকে উঠেছি, এমন সময় স্কুল ড্রেস পড়ুয়া সাত-আট বছরের একটি মেয়ে কাশেম আলীর নিকটে এসে বলল, ‘বাবা স্কুলে যাচ্ছি।’ কাশেম আলী মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে স্কুল ড্রেস ঠিকঠাক করলেন, গামছা দিয়ে মুখটা মুছে দিলেন, পকেট থেকে চিরুনি বের করে মাথার চুল ঠিকঠাক করে শেষে হাতে টিফিনের জন্য দশ টাকা দিয়ে ক্লাসে দুষ্টমি না করাসহ আরো নানারকম হিত উপদেশ দিয়ে মেয়েকে বললেন আমার লক্ষ্ণী মা, এবার যাও।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো একজন বাবার নিষ্পাপ আদর আর ভালোবাসা ঠায় দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। আমি অধিক আবেগতাড়িত হয়েছিলাম এই জন্য যে, ততদিনে জেনেছিলাম আমার স্ত্রীর গর্ভের সন্তান মেয়ে। বিশ্বাস করুন রাজীব সাহেব, এমন দৃশ্য দুই তিন দিন দেখার পর, বিষয়টা আমার মনের কোণে গভীর এক রেখাপাত করল। এক সময় আমি নিজেকে কাশেম আলীর জায়গায় কল্পনা করতে লাগলাম। আমার কাশেম আলীর মতো একটি মেয়ে হবে, তাকে আমি চুল বেণী করে দিবো, মুখ মুছে দিবো, টিফিনের জন্য টাকা দিবো, নিজে স্কুলে দিয়ে নিয়ে আসবো এই রকম নানাবিধ সুখের এবং মমতাজড়ানো কল্পনা। এরপর থেকে এক অদৃশ্য শক্তি আমাকে কাশেম আলীর দোকানে বার বার টেনে নিয়ে যেতে লাগল। আমার সপ্তাহে তিনদিন সকালে আর তিনদিন বিকেলে ডিউটি । বিকেল ডিউটির দিনে সকালবেলা কাশেম আলীর দোকানে আমি না যেয়ে পারিই না। কাশেম আলী কিন্তু ব্যাপারটা জানেন না আবার প্রতিদিন যে ঐ দৃশ্য দেখি তাও না। তবে, যেদিন মেয়েটিকে না দেখি সেদিন আমার মনে এক অদৃশ্য কাতরতা ভর করত। আমি আহত মনে বসেই থাকতাম।
রাজীব সাহেব, কাশেম আলীর দোকানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকার মূল ঘটনা হচ্ছে এই। এখন ঘটনার বাইরে কিছু উপঘটনা থাকে, সেটা হচ্ছে কাশেম আলীর সাথে কথাবার্তা। যদিও তার সাথে কথাবার্তার চেয়ে আমি মৌনই থেকেছি বেশি। সবজির দোকান, বেচাবিক্রি করবে নাকি গল্পগুজব করবে? গল্পগুজব করার সময় তার কই? বিশ্বাস করুন, কাশেম আলীর সাথে এর বাইরে আর কোনো সম্পর্ক নাই। এবং আমার কখনোই মনে হয়নি সে মাদক ব্যবসায়ী। আমি সবসময় তাকে জ্ঞান করেছি একজন ভালো বাবা হিসেবে।
রাজীব সাহেব চোখ বুঝে আমার কথা শুনছিলেন। খেয়াল করলাম আমার মতো তার হাতের সিগারেটও নিঃশব্দে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তিনি চোখ খুললেন। মুখটা গম্ভীর। গলা খাকারি দিয়ে ধরা স্বরে বললেন,
আপনার গল্প আমি বিশ্বাস করলাম। কাশেম আলী একজন ভালো বাবা সেটা ঠিক। কিন্তু সে মাদক ব্যবসায়ী এ কথাও সত্য। বাবা সন্তানের ক্ষেত্রে ভালো কিন্তু কর্মপরিধিতে নীতিবর্জিত এমনটা অহরহ আমাদের দেশে। আর এজন্যই আমাদের দেশ দুর্নীতির দিক দিয়ে তলানিতে। আমি আশা করবো আপনি আপনার সন্তান এবং কর্মক্ষেত্র দুই জায়গায়ই ভালো হবেন। কাশেম আলীর মেয়ের মতো আপনার মেয়ে যেন দুভার্গ্যবতী না হয়। আপনার সাথে কাজ আমার আপাতত শেষ। বাইরে বৃষ্টিও এখন নেই। বিদায় নিবো। আপনার অনাগত সন্তানের জন্য শুভ কামনা রইল।
রাজীব সাহেব চলে গেলেন। বৃষ্টির অবিরাম বর্ষণ থেমে যাওয়ায় কদম ফুলের রেণুর মিষ্টি সুবাস জানালা দিয়ে হুর হুর ঢুকছে। তাতে মোহিত হতে পারলাম না। গোলা কদমফুলের গা থেকে চুইয়ে পড়া বৃষ্টির স্বচ্ছ জল মনে হলো কাশেম আলীর নিষ্পাপ মেয়ের বোবা কান্না। আমি নীরব নিথর হয়ে একটি ব্যথাতুর আবেগে ঘোরের মধ্য চলে গেলাম।
সেই ঘোরে কাশেম আলীর ছোট্ট মেয়ের সোনার প্রতিমার মতো মুখখানিকে মনে হলো আমার মেয়ের মুখ, মধুর স্বরে কুণ্ঠারহিত চিত্তে মেয়েটি বলছে, ‘বাবা, আমি স্কুলে যাচ্ছি, দশ টাকা দাও টিফিন খাবো.. .

আজাদ মণ্ডল
জন্মস্থান ফরিদপুর সদর, ফরিদপুর। পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : নিরালস্ব নিরাশ্রমে (২০১৭)। উপন্যাস : বিষয় ভ্রমণ শেষে (২০১৯)।

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field
    X