কবি চতুষ্টয়
উইলিয়াম হাইনেসেন
(ফারো দ্বীপপুঞ্জ, ডেনমার্ক – ১৯০০-১৯৯১)
>> প্রেত
এমনই হয়েছে এক শব্দহীন গোধূলিবেলায়,
যে, তোমার আশেপাশে সবকিছুই ঠাণ্ডা ও আজগুবি,
চেয়ারে আরাম নাই, হিবাচিতে নিবেছে আগুন,
খাবারে কাদার তথা কাঁইয়ের আর ছাতার বিস্বাদ;
তুমি আলো চাইলে—কিন্তু মোমেরাও তলানিতে সব;
সারাটা আলমারি হাতড়ে পেলে না পরার মতো জামা
মথ এবং মাকড়শার-জালে ভরা কিছু ন্যাকড়া-ছাড়া;
দেয়ালের আয়নাটায় দেখা গেল কেবলই কুয়াশা,
সেই ভুসো-ধূসরিমা, উড়ছিল যা ঘরের ভিতর।
তারপর বেরুলে তুমি; গিয়ে পড়লে হেমন্ত-হাওয়ায়,
যেখানে আঁধারে বইছে শব্দহীন ধূলি আর বীজ।
(William Heinesen, Spectre)
>> রাজহাঁস-ছাড়া লীডা১
হিমানী ও রোদমাখা বসন্তের দিনে
কাই নিয়েলসেন২-এর ভাস্কর্য দেখে
এই বসন্ত-শীতল পার্বত্য প্রভাতে
এর উঁচু আকাশ আর নীল গিরিশ্রেণি
আর এর চকমকানো আয়নার মোজেইক-ভরা
সুদূর, প্রশস্ত জলীয় মেঝেয়—
এই চোখধাঁধানো আর হুহুঙ্কৃত দৃশ্যটির ঠিক মাঝখানে :
তার একাকিনী দেহবল্লরী
ন্যাড়া পাথরখণ্ডগুলির ভিতরে তিরতির কাঁপছে
টানটান শুয়ে থেকে শ্যাওলা-বিছানায়।
উদ্ভ্রান্ত চোখগুলি জ্বলছে
চুলের ছায়ার নীচে,
দোটানায় গাল-দু’টি লাল—
উজ্জ্বল তরুণ নাসারন্ধ্রগুলি উঠছে ফুলে-ফুলে—
মুখ জুড়ে ফুটে উঠছে উৎকণ্ঠিত হাসি, গোপন।
সে আবার টের পায় শ্যাওলা আর পাথর থেকে
পৃথিবী আর আকাশ আর আর-সবখান থেকে
এইসব দুর্দমনীয় দমকা,
উদ্দাম আর অযৌক্তিক
তবু অনিবার্য আর অপ্রমেয় ঐশী অভিলাষ,
এইসব খিঁচুনি—জঠরে ও ধড়ে আর প্রতি-হাত-পায়ে,
অন্তঃস্থ হৃৎপিণ্ডে এই ভয়াল কম্পন।
একেবারে সাদাচোখে সে দ্যাখে আবার
স্ফটিকের দানাগুলি ঝিকমিক করছে ধূসর গ্র্যানিটে
আর হাওয়ায় ঝলসে উঠছে ধাতব দ্যুতিমা
পরিযায়ী বালিহাঁসগুলির ডানার আভায়।
তারপর আবার তার গা গোলায়—
জানে না সে পরের মুহূর্তটি
জীবন নাকি মৃত্যু,
কিন্তু সে আঁচ করে ক্রমবর্ধমান ভীতি আর উন্মত্ত উল্লাসে
যে এক অজানা কামনার গর্জায়মান অনিরুদ্ধতা
হাসিল ক’রে নিয়ে নিচ্ছে তাকে।
(William Heinesen, Leda Without the Swan)
১ গ্রিক উপকথায়, স্পার্টার রানি লীডার রূপে মুগ্ধ হয়ে দেবরাজ জিয়ুস একটা রাজহাঁসের রূপ ধ’রে তাঁকে ভোগ করেন। কোনো-কোনো উপকথায় বলা হয়, যে, এই সম্ভোগের পর লীডা দু’টি ডিম প্রসব করেন, যার একটির থেকে হেলেন (পরবর্তী সময়ে স্পার্টার রাজা মেনিলাউসের রানি এবং ট্রয়-যুদ্ধের উপলক্ষ) ও পোলাক্স, এবং আরেকটির থেকে ক্লাইটেমনেস্ট্রা (মাইসিনির রাজা অ্যাগামেমননের রানি—অ্যাগামেমনন মেনিলাউসের ভাই, এবং ট্রয়-যুদ্ধের প্রধান নেতা) ও ক্যাস্টর জন্ম নেয়। এই কবিতাটির সঙ্গে ডব্লু বি ইয়েটস-এর লীডা অ্যান্ড দ্য সোয়ান কবিতাটি মিলিয়ে পড়তে পারেন পাঠক। সুবিধার্থে আমার করা ইয়েটস-এর কবিতাটির তরজমা নীচে দিয়ে দিলাম। সু.অ.গো.।
লীডা আর রাজহাঁস
ডব্লিউ বি ইয়েটস
এক সহসা আঘাত : রাজকীয় ডানার পাখসাট
ট’লে-ওঠা মেয়েটির ’পরে, তার ঊরুতে আদর
করে দু’টি কালো ঠ্যাং, জাঁতা দিয়ে ধরেছে ও-ঠোঁট
মেয়েটার গ্রীবা, তার বুকটা চেপে বুকের ভিতর।
কীভাবে পারবে-বা ঠেলে ফেলতে ঐ ভয়ার্ত আঙুল
শিথিল ঊরুর থেকে ও-ঐশ্বর্য, পালকে যা ছাওয়া?
কিংবা সে-কি জানবে, ঐ সাদা-মাঝে নির্জিত আমূল,
যেথা সে শয়ান, কোথা ধুকপুকোয় ও’ অদ্ভুত হিয়া?
জঘনের শিহরন ত্বরান্বিত করে ভগ্ন সেই
নগরপ্রাকার, জ্বলন্ত মিনার, প্রাসাদের ছাদ,
সাথে আগামেম্ননের মৌত।
এরকম অধ্যুষিত,
বাতাসের পাশব রক্তের দ্বারা তুমুল দূষিত,
পেরেছে সে নিতে ‘তার’ ক্ষমতার সাথে ধী অগাধ
উদাসীন চঞ্চু-দু’টি তাকে ফেলে দেওয়ার আগেই?
২ কাই নিয়েলসেন (১৮৮২-১৯২৪), ড্যানিশ ভাস্কর। বিখ্যাত ভাস্কর্য মর্মর-বালিকা, এবং লীডা ও রাজহাঁস (যার উল্লেখ এ-কবিতায়)।
এডিট স্যোডেরগ্রান
(ফিনল্যান্ড – ১৮৯২-১৯২৩)
>> নিচ্যের সমাধিতে
পাকা-শিকারিটা আজকে মৃত…
আমি তার কবরেরে ঢেকে দিই ফুলের ঝালরে…
ঠাণ্ডা পাথরেরে আমি চুমু খাই, বলি :
সুখের চোখের জলে ভেজা, দ্যাখো, এ তোমার প্রথম সন্তান।
ঠাট্টাহাসি হেসে বসি তোমার কবরে
যেন গালে চড়— তোমার স্বপ্নের চেয়ে চারু।
হে অদ্ভুত পিতঃ!
তোমার ছেলেমেয়েরা করবে না তোমার মাথা হেঁট।
তারা আসছে সারা দুনিয়ার থেকে, দৈবী কদমে,
চোখ কচলে বলছে: এটা কোথায় এলাম?
না, সত্যিই… হ্যাঁ, এটাই মোকাম আমার,
এই ভগ্নদশা গোরে, আমার পিতার…
দেবতামণ্ডলি— কোরো নজরদারি জায়গার ’পরে।
(Edith Södergran, At Nietzsche’s Grave)
>> শাহি বাগিচা
আমরা সবাই হাঘর বাউণ্ডুলে
আর আমরা ভাই-বোন।
বস্তা-পিঠে চলি আদুল-গায়ে,
কিন্তু আমাদের তুলনায় শাহ্জাদাদের কীইবা আছে ধন?
হাওয়ায় নিত্যি উড়ে আসে কতই কিমতি চিজ,
সোনার দরেও হয় না তাদের মূল্য নিরূপণ।
বয়স যত বাড়ে আমাদের
ততই পষ্টাপষ্টি বুঝি আমরা-যে ভাই-বোন।
সৃষ্টিকে-তো আমাদের আর কিছুই দেওয়ার নাই,
আমরা তাকে দিয়েছিলাম আত্মা— সবেধন।
আমার যদি থাকত নিজের এক শাহি বাগিচা
করতাম আমার ভাই-বোনদের সেথায় নিমন্ত্রণ।
প্রতিজনাই ফিরত একটা জবর তোফা-হাতে।
বেঘরেরা করত একটা গোত্রের পত্তন।
আমরা বেড়া তুলে দিতাম বাগানের চৌধারে
বাইরের সব ধমক যাতে ঢুকে প’ড়ে না করে গর্জন।
আমাদের ঐ নীরব বাগিচায়
পৃথিবীকে আমরা দিতাম নোতুন এক জীবন।
(Edith Södergran, The Great Garden)
মাথিয়াস য়োহান্নেসসেন
(আইসল্যান্ড – ১৯৩০-)
>> বিদেশবার্তf
(সংক্ষিপ্ত)
১
এবং পৃথিবী আজও এক
নির্জন বিরানা
এবং আঁধার ঝুলে থাকে
সমুদ্রের ’পরে।
এবং ঈশ্বর বলিলেন :
আলো হোক।
এখন বলে না কিছু কেউ।
জ্বালানি সঙ্কট :
মীনরাশি, ক্যাম্বাইসিজ১ লভে
জ্যোতিশ্চক্র, বোতাম-বিবরে।
২
এ-কি স্বপ্ন নাকি এ বাস্তব
এই ওয়াটারগেট২ :
সেটাই কেবল
কেউই জানে না।
এরা খেদিয়েছে শেষে লড়াকু নিক্সনকে৩
হোয়াইট হাউস থেকে:
যে করেছে নাজেহাল জ্যোতিষী ডিক্সনকে৪।
৩
নিকোসিয়া আর ফামাগুস্তার৪ সীমান্তে
ম্লেচ্ছ তুর্কিদের সাথে
সাধু জর্জের৫
তুমুল যুদ্ধের
একমাত্র ফসল
শুধু এই
বিশ্বখ্যাত পেরিক্লিজ৬ আর ক্লেরিডিজ৭
অন্ত্যমিলে মেলে।
৪
কারাগারে হাইলি সেলাসি৮
আদ্দিস আবাবায়,
সবাইকেই মেরে ফেলতে চেয়েছে এ-লোক।
এবং সেখানে আছে আরেক আবিসিনিয়া
যে তোমায় ল’বে না জিনিয়া :
সিংহের খাঁচায়, আর দেশের শাসক
আরেক হায়েনা।
স্যালি,
কে ছিল এ’ হাইলি সেলাসি,
স্যালি?
(Matthias Johannessen, News from Abroad (In Short))
১ পারস্য সম্রাট্। মহান্ সাইরাস-এর পুত্র। ইজিপ্ট আক্রমণ করেছিলেন। মেম্ফিস নগরের বহু দেবালয় ধ্বংস বা অপবিত্র করেছিলেন। সেসময় সূর্য (অশুভ) মীনরাশিতে অবস্থান করছিল।
২ মার্কিন প্রেজিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন-এর কুখ্যাত ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি, যার দরুন তাঁকে বাধ্যতামূলকভাবে পদত্যাগ করতে হয়।
৩ জীন ডিক্সন (১৯০৪-১৯৯৭), প্রখ্যাতা মার্কিন ভবিষ্যদ্বক্ত্রী। প্রেজিডেন্ট কেনেডির হত্যাকাণ্ডের আগাম খবর তিনি দিয়েছিলেন শোনা যায়। তবে তাঁর বহু ভবিষ্যদ্বাণীই ফলে নি (যেমন ১৯৫৮-তে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার ঘোষণা)।
৪ নিকোসিয়া আর ফামাগুস্তা সাইপ্রাস-এর দু’টি প্রধান শহর ও বন্দর।
৫ সাধু জর্জ, খ্রিস্টিয় সন্তপুরুষ। গ্রেট ব্রিটেনের অভিভাবক, “বীর” সন্ত। তাঁর জীবনের অধিকাংশ কাহিনিই লোককল্পনামূলক। এখানে সাধু জর্জ সম্ভবত: গ্রেট ব্রিটেন বোঝাতে।
৬ পেরিক্লিজ (৪৯৫-৪২৯ খ্রি.পূ.) প্রাচীন অ্যাথেন্স-এর এক বরেণ্য জননেতা। অ্যাথেনিয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা।
৭ গ্লাফকস ক্লেরিডিজ (জ. ১৯১৯) সাইপ্রাসের ভূতপূর্ব প্রেজিডেন্ট।
৮ হাইলি সেলাসি (১৮৯২-১৯৭৫) ১৯৩০ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত ইথিয়োপিয়ার (প্রাচীন আবিসিনিয়ার) সম্রাট্। এই রাজবংশ দাবি করত তারা প্যালেস্টাইনের রাজা সলোমন আর তাঁর প্রণয়িনী, শীবার রানির বংশধর। ১৯৭৪-এ এক সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি ক্ষমতাচ্যুত ও বন্দি হন। ১৯৭৫-এ সরকার তাঁর মৃত্যু ঘোষণা করে (এর সত্যতা নিয়েও বিস্তর বিতর্ক ছিল)। রাস্তাফারি আন্দোলনের সমর্থকদের কাছে সেলাসি একজন অবতার-রূপে পরিগণিত হতেন।
>> যুদ্ধ আর শান্তি
‘কিন্তু চাষারা — চাষারা কীভাবে মরে?’— লিও টলস্টয়
আর এই সুদীর্ঘ রুশ শীতকাল, চিন্তার অতল-অব্দি সাদা
তুষারের আচ্ছাদন, যতদূর চোখ যায় শীতকাল, আর
ঘায়েল জন্তুর মতো দূরের সুশ্রূষা-খোঁজা তোমার কদম,
তোমার পরিখা-কাটা জীব-রক্তপথ, এ-যে আজও
জলে ভরে তোমার দু’চোখ, চিঠি, অথবা ডায়েরি,
আহা রে নিস্তার নাই এই আত্মনিমগ্ন ল্যান্ডস্কেপে,
এখনও বেজায় দূরে ডেরাখানি, তুহিন-তটস্থ দুনিয়াটা
আহত নির্জীব, এই সাদা ম্লান তুষারের তলে
একটা ঢিবি সে কেবল, এবং তোমার পথরেখা
সুদূরে মিলায় ধুধু খোলা-প’ড়ে-থাকা
তেপান্তরে; আমরা আজও উঁকি মারি ঐ
ধ্রুব শব্দ, অজর চিন্তায়, আর তুষার গলছে না
যদিও বসন্ত দ্বারে, নবকিশলয়ের আঘ্রাণ
তোমাকে অনুসরণ করছে এই আবাদায় যেখানে জমিন
শৃগালের মতো রক্ষা করে তার বুনো নির্জনতা
মরা-ছানাগুলি বালিহাঁসের ডানার হেফাজতে
রেখে দিয়ে, তোমরা দু’জনে-তো তবু যুঝে যাচ্ছ, পর্বত পেরোনো
অধিক সময়সাধ্য হ’য়ে পড়ছে, অখণ্ড স্মরণ
আমাদের ছদ্মবেশী সন্দেহে— এবং তবু আসছে
বসন্ত, তুষার গলছে, পাখি-সব করে রব সবুজ পাতায়,
মলয় হাওয়ায় দোলে, মেঠাইয়ের নাও
মানুষের হাতের তালুর মতো বড়।
উবে যায় যত পদক্ষেপ
রক্তাক্ত একাকী
মাটির ভিতরে
সাদা এক সীমাহীন তেপান্তরে, আমাদের মনে
খোলে এটি উল্টো এক ফুলের মতন যেটি তার
বর্ণিল পাপড়ির চোখ মেলেছে সূর্যের দিকে, বসন্তের দিকে,
নদী-সহ ডুবে যাও তুমি আমাদের চেতনায়,
ঈশ্বর বা নারী নয়, কিন্তু শুধু তুমি
এক যৌথ পর্যটনে আমাদের বসন্ত-সুনীল
অন্তরে, হারাও তুমি পাখিদের লক্ষ্যহীন গুঞ্জনের সাথে,
ফুলের, জলের সাথে; পাতায় মর্মর, তেপান্তর
নেচে যায় ভেঙে-পড়া ঢেউয়েদের সাথে, কী-নোতুন
কোনো আধিদৈবিক অধ্যাস নয়, কষ্ট বা মৃত্যুর
অগভীর প্রতীক্ষাও নয়— একটা তার,
একটা ধুন, আর শোনো, গাইছে খোলামাঠ, পর্বতেরা
প’রে নেয় ঝোপের, পাতার জামা, হাঁটো হাল্কা পায়ে
আবাদার পথ বেয়ে যতদূরতক
চোখ যায়, হেঁটে যাও পৃথিবীর ভিতর, হারিয়ে
নিজেকে পাখির আর পানির যুগল-গানে; আমাদের মন
ভ’রে আছে ঘ্রাণে, শ্যামলিমার সৌগন্ধে, যে-সৌরভ
তোমার কথায়, তোমরা দু’জনে চলেছ একটা ঢাকনি-খোলা বসন্তের তীর্থে
একা-একা, অবশেষে, লিও ও সোনিয়া১— কারো অতীব-উৎসুক
চক্ষুঃ, কিংবা ঝলকানো ছুরির ফলা, পাপ, স্বার্থ, দেব আর মানব
এড়িয়ে। কেবল তোমরা ঘরে আসো— আখেরে, শিকার-করা পাখিদের মতো
বাসা বাঁধো আমাদের চিন্তায় পালক-
-মোড়ানো আশায়: শুদ্ধ ও অপাপবিদ্ধ,
অজঙ্গম সময়ের নির্বিকার নীরবতা-মাঝে
শান্তি কিংবা যুদ্ধহীন, পরিশেষে থিতু
আমাদের সুগভীর চেতনায়, নব-উদ্বোধন— আর, তুমি
এযাবৎ অজানিত তারে-তারে স্বয়ং সনাটা,
এ-বাড়ির আওয়াজ, এখনও, আর সদাসর্বদাই
ভেক-ধরা দুর্গবৎ বাড়িতে-বাড়িতে; একটা নিরুদ্বেগ এপ্রিলের দিন;
একটা সে পালক-ঢাকা উড়ুউড়ু দিন; দ্যাখো, ঐ-যে সে ওড়ে
ঘরে ফিরতে, ইয়াস্নায়া পল্যানায়২, অথচ ওদিকে
তুমি চ’লে গেছ; শুধু প’ড়ে আছে বাড়িখানা, ফাঁকা,
মনের বিজনতম তেপান্তরে, উজাড় ঝিনুক
মৎস্য-মুক্তা-হীন।
(Matthias Johannessen, War and Peace)
১ লিও টলস্টয়ের স্ত্রীর নাম ছিল সোনিয়া। তাঁর বিখ্যাততম উপন্যাস যুদ্ধ ও শান্তি-র নায়িকারও নাম সোনিয়া।
২ ইয়াস্নায়া পল্যানা ছিল টলস্টয়ের জন্মস্থান। তিনি এখানকার জমিদারের ঘরে জন্মেছিলেন, এবং এখানে আজীবন বাস ক’রে মারাও গিয়েছিলেন।
টারয়েই ভেসস
(নরওয়ে – ১৮৯৭-১৯৭০)
>> সোনালি বালি
ঝোরাটা জমির বুকে চ’লে যায় ছুটে
বুকের জমিতে ছোটে পাথরে বালুতে
এঁকেবেঁকে চ’লে যায় মাটিতে হৃদয়ে
উজানে ভাটিতে সবই বদলে দিয়ে-দিয়ে
সোঁত তার ঘাই মারে জালের দেয়ালে
তবু দোঁহে ব’য়ে যায় জলের খেয়ালে
সোঁতেরা যদিও বাধা পায় নানা খাদে
প্রেমের বদ্বীপে তারা দৌড়ায় অবাধে
যে-যে পাথরের ফাঁক গ’লে তারা চলে
তাদের তলার সোনা ধুয়ে নেয় জলে
এভাবেই হয় এক সোনালি সূচনা:
সোনার হৃদয় আর হৃদয়ের সোনা।
(Tarjei Vesaas, Golden Sand)
>> গুমসুম দুলহান
আমার সব বসন্তের সুগন্ধ
মৌলি হ’য়ে ঝোলে আমার চুলে,
এই-কি সব?
কী-যে যৎসামান্য, কী ফুড়ুৎ-উড়ে-যাওয়া—
ভাষার অতীত আমার বসন্তেরা
গোপন কামনা আর
কত এষণায় রাঙা।
আজকে রাতে, হায়, আমার রাতে,
কাঁপছে বাতিগুলি নাচের তালে-তালে—
দাঁড়িয়ে আছি আমি এখানে, চোখগুলি
দিচ্ছে চাউনি— দেখছে আমার সব,
খালি থরোথরো আতঙ্কটুকু-ছাড়া।
কী-যে দ্রুত কী-যে শ্লথ হ’য়ে যায় পা।
আমার মৌলি— মৌলি আমার
বোঝা হ’য়ে যায় মাথার উপর।
(Tarjei Vesaas, The Quiet Bride)
Leave feedback about this