নানান টানাপোড়েন, সম্পাদনা এবং মাজাঘষার পর `অ্যা মুভেবল ফিস্ট’ নামে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের প্যারিসের স্মৃতিকথা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর তিন বছর পর, ১৯৬৪ সালে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, প্রকাশকের কাছে বইটির পাণ্ডুলিপি হেমিংওয়ে পাঠিয়েছিলেন ১৯৬০ সালে। তবে ১৯৬১ সালে অসুস্থাবস্থায় স্ক্রিবনারকে একটা চিঠি লিখে বইটি প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতে বলেছিলেন হেমিংওয়ে, কিন্তু তাঁর চতুর্থ স্ত্রী মেরি চিঠিটা না পাঠিয়ে সরিয়ে রেখেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। প্যারিসে বসবাসকারী তাঁর সঙ্গে পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন সাহিত্যব্যক্তিত্ব সম্পর্কে মূল্যায়ন ও বিরূপ মন্তব্যের কারণে তাঁর বিরুদ্ধে মামলার আশঙ্কা ছাড়াও বইটি প্রকাশের ব্যাপারে হেমিংওয়ের দ্বিধার আরেকটি কারণ ছিল এটিকে যথাযথ সম্পাদনা ও পরিমার্জনার মাধ্যমে আরো গ্রহণযোগ্য করার জন্য সময় নেওয়া।
বইটির কাজ শুরু করার পটভূমি সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা এই যে স্পেনে অসুস্থ হয়ে পড়লে প্যারিসে ফিরে এসে বহুপরিচিত আস্তানা রিৎজ হোটেলে উঠেছিলেন হেমিংওয়ে, সেটা ১৯৫৬ সালের কথা। সেবারের অবস্থানকালে হোটেলের বেসমেন্টের মালখানায় রক্ষিত তোরঙ্গ থেকে আবিষ্কৃত হয় তিরিশ বছর আগের লেখালেখি এবং ডায়েরি-নোটগুলো। পুরনো এই ডায়েরি থেকেই তিনি পেয়ে যান একটা স্মৃতিকথা লেখার বহু উপাদান।
পরবর্তী সময়ে বইটি নিয়ে বহুবিধ সমালোচনা এবং বিতর্কের বিষয়বস্তুর মধ্যে একটি ছিল রিৎজ হোটেলে খুঁজে পাওয়া বাক্সের ভেতর দীর্ঘ তিরিশ বছরের পুরনো দলিলপত্রের বিষয়টির বিশ্বাসযোগ্যতা। কেউ কেউ মনে করেন পুরনো নোট এবং অন্যান্য কাগজপত্র আচমকা পেয়ে যাওয়ার বিষয়টি হেমিংওয়ে কিংবা অন্যদের বানানো গল্প। তাঁদের মতে, এটি বিশ্বাস করা কঠিন যে রিৎজ হোটেলের কর্মকর্তারা মনে করিয়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত তিরিশ বছরের মধ্যে একবারও ট্রাংকটার কথা মনে পড়েনি হেমিংওয়ের (ক্যাথেরিন ই উইট, হেমিংওয়ে’জ অ্যা মুভেবল ফিস্ট: মাস্কড থীমস ইন দ্য কনটেক্সট অভ হিজ লাইফ (২০১৫)। এবিষয়ে মেরি এবং হোচনারের সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের বক্তব্য এই ধারণাকে আরো দৃঢ়তা দান করে।
হেমিংওয়ে গবেষকদের মধ্যে কেউ কেউ রিৎজ হোটেলে ত্রিশ বছর আগে রেখে যাওয়া স্যুটকেস খুঁজে পাওয়া এবং সেগুলোর ভেতর পাওয়া মালমশলা দিয়েই যে স্মৃতিকথাটি লেখা হয়েছে, সেটা বিশ্বাসযোগ্য মনে করেননি। তাঁরা বিভিন্ন জনের কাছে লেখা হেমিংওয়ের চিঠিপত্র, পলিনকে বিয়ে করার পর প্যারিস ছেড়ে তাঁদের ফ্লোরিডার কি ওয়েস্টে চলে আসার সময় বিশ্লেষণ – এসব বিবেচনায় ঘোরতর সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে রিৎজ হোটেলের মালখানায় আবিষ্কৃত দুটো ট্রাংকের গল্প পুরোপুরি সত্য নয়।
তেমনই একজন জ্যাকুলিন তেভেরনির কোবাঁ। তিনি প্রশ্ন করেছেন এসব ট্রাংক কি আসলেই ছিল এবং যদি থেকে থাকে, তাহলে সেগুলো কখন সেই হোটেলে জমা রাখা হয়েছিল, ওগুলোর ভেতর কী কী কাগজপত্র ছিল এবং স্মৃতিকথাটি লেখার জন্য সেসব কাগজপত্রের কতখানি ব্যবহার করা হয়েছিল? (জ্যাকুলিন কোবাঁ, দ্য মিস্ট্রি অভ দ্য রিৎজ হোটেল পেপারস, কলেজ লিটারেচার; ওয়েস্ট চেস্টার, খণ্ড ৭, হেমন্ত ১৯৮০)।
বইটির প্রথম সংস্করণের প্রকাশ এবং সেটির সম্পাদনার ব্যাপারে চার্লস স্ক্রিবনারের একটা ভাষ্য পাওয়া যায় তাঁর বইতে। তিনি লেখেন,
[হেমিংওয়ের] মৃত্যুর পরপরই আমাদের ভবনে মেরির জন্য একটা অফিস বানিয়ে দিয়েছিলাম যাতে তিনি হেমিংওয়ের বিভিন্নি জিনিস এবং কাগজপত্রগুলো ঘেঁটে দেখতে পারেন। সেটা ছিল এক তুষারধসের মতো, কারণ, তিনি [হেমিংওয়ে] ছিলেন [কাগজপত্রের] পাকা সংরক্ষক। কিউবায় পড়ে থাকা সেইসব কাগজপত্র ছিল পোকামাকড়ে ভরা। আমাদের পুরো ভবন জুড়ে কিউবান পতঙ্গ কিংবা অন্য কোনো ছারপোকার উপদ্রব শুরু হবে কি না সে বিষয়ে কিঞ্চিৎ আশঙ্কা ছিল আমার, তবে বাস্তবে সেরকম কিছু ঘটেনি। তাঁর মরণোত্তর প্রথম যে বইটি আমরা প্রকাশ করি, যেটির বিষয়ে তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগে আমার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, সেটি হচ্ছে প্যারিসের স্মৃতিলেখগুলো, ‘অ্যা মুভেবল ফিস্ট’। বইটি ব্যাপক সাফল্য পেয়েছিল, তবে সেটি দেখার জন্য বেঁচে ছিলেন না তিনি। মেরির সঙ্গে লেখাগুলো সম্পাদনা করি আমরা, কারণ কখনো কখনো তিনি বারবার একই কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন। যেমন, আড়কাটি মাছ সম্পর্কে লেখাটিতে আমি এবং হ্যারি ব্রাগ বুঝতে পারি যে সহ্যাতীত বাহুল্যগুলো বাদ দেওয়া উচিত, এবং সেগুলো বাদ দিয়ে দিই। হেমিংওয়ের জীবনীকার কার্লোস বেকার এজন্য ভর্ৎসনা করেছিলেন আমাকে। তাঁর মতে, লেখক যেভাবেই তাঁর লেখা রেখে যান না কেন, সেগুলো কাটাছেঁড়া করা অনৈতিক (চার্লস স্ক্রিবনার, ইন দ্য কম্প্যানি অভ রাইটার্স: অ্যা লাইফ ইন পাবলিশিং, চার্লস স্ক্রিবনারস সন্স, ১৯৯০)।
হেমিংওয়ে যখন প্যারিস স্মৃতি নিয়ে কাজ করছিলেন ততদিনে তাঁর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের যথেষ্ট অবনতি ঘটেছে, দিনের পর দিন অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি নিয়ে বসে থেকেছেন, কিন্তু কিছুই লিখতে পারছিলেন না। মানসিক এই অবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ফিদেল কাস্ত্রোর আমলে পরিবর্তিত কিউবাতে তাঁর বাড়িটি এবং প্রিয় বোট ‘পিলার’ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার বেদনা। মেরি তাঁকে প্রবোধ দিয়ে বলতেন যে চাইলেই তাঁরা প্যারিস কিংবা ভেনিসে একটা অ্যাপার্টমেন্ট কিনে নিতে পারেন, একটা বোটও কিনতে পারেন, যাতে নৌভ্রমণ করা কিংবা মাছ ধরা যায়। কিন্তু হেমিংওয়ের মানসিক অবসাদ আর কাটেনি। এসময় প্রায়ই তিনি আত্মহননের কথা বলতেন। তাঁকে কখনো দেখা যেত তাঁর বন্দুকের সংগ্রহ থেকে কোনো একটা তুলে নিয়ে জানালা দিয়ে দূরের পাহাড়ের দিকে অনিশ্চিত তাকিয়ে আছেন।
হোচনার জানান, জীবনের মূল যে বিষয়টি হেমিংওয়েকে তাড়িত করত, সেটি হচ্ছে তাঁর লেখালেখি। ‘অ্যা মুভেবল ফিস্ট’ লেখার কাজ শেষ করার অক্ষমতা তাঁর লেখক জীবনের সমাপ্তি বলে বুঝতে পারেন তিনি। লেখালেখির এই অক্ষমতাকে মোকাবেলা করতে পারছিলেন না কিছুতেই। হোচনারের সঙ্গে কথোপকথনের এক পর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, “…আমি লিখতে পারি, এই বোধ যতদিন আমার ভেতরে থাকবে ততদিন আমি একদিন এক বছর এমনকি দশ বছর না লিখলেও কিছু আসে যায় না। কিন্তু সেই বোধ ছাড়া কিংবা সেটা সম্পর্কে অনিশ্চয়তা নিয়ে একদিন থাকাকেও মনে হবে অনন্তকাল।’’ (অ্যারন ই হোচনার, পাপা হেমিংওয়ে: অ্যা পারসোনাল মেময়ার্স।)
রিৎজ হোটেলে ট্রাংক পাওয়া কিংবা সেগুলোর ভেতর কী ছিল, সেসব তাঁর প্যারিস স্মৃতি লেখার কাজে কতখানি কাজে লেগেছে এসব প্রশ্ন, সন্দেহ ও বিতর্কের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন হেমিংওয়ের পৌত্র শন হেমিংওয়ে। কেনেডি লাইব্রেরির এক আলোচনা অনুষ্ঠানে দর্শকদের উপস্থিতিতে তিনি জানান, রিৎজে পাওয়া ‘পাণ্ডুলিপি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা একজন গবেষকও বিশ্বাস করতে চান না যে ওসব ট্রাংকের অস্তিত্ব আদৌ ছিল কি না। আমার মনে হয়, ছিল।”
বইটি সম্পর্কে এতসব বিতর্ক আবার উসকে ওঠে যখন প্রথম প্রকাশের পঁয়তাল্লিশ বছর পর ‘পুনঃস্থাপিত সংস্করণ’ নামে একটি পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে। এই সংস্করণটি সম্পাদনা করেন শন হেমিংওয়ে। প্রথম সংস্করণে মোট লেখা ছিল বিশটি, (১) প্লাশ সাঁ মিশেলের ক্যাফেটি, (২) মিস স্টাইনের পাঠদান, (৩) পরাজিত প্রজন্ম, (৪) শেকসপিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি, (৫) স্যেনের মানুষেরা, (৬) মেকি বসন্ত, (৭) একটি পেশার সমাপ্তি, (৮) খিদের শৃঙ্খলা, (৯) ফোর্ড ম্যাডক্স ফোর্ড এবং শয়তানের চেলা, (১০) এক নতুন মতের জন্ম, (১১) পাসিনের সঙ্গে, (১২) এজরা পাউন্ডের সৎসংঘ, (১৩) এক আজব সমাপ্তি, (১৪) মৃত্যুচিহ্নবাহী লোকটি, (১৫) ইভান শিপম্যানের সঙ্গে, (১৬) শয়তানের চর, (১৭) স্কট ফিটজেরাল্ড, (১৮) স্বার্থপর বাজপাখি এবং (১৯) মাপজোকের ব্যাপার এবং (২০) অনিঃশেষ প্যারিস।
নতুন সংস্করণে ওপরের বিশটি থেকে ‘এক নতুন মতের জন্ম’ এবং ‘এজরা পাউন্ডের সৎসংঘ’ শিরোনামের দুটো লেখাকে স্থানচ্যুত এবং ‘অনিঃশেষ প্যারিস’ নামের লেখাটিকে সম্পূর্ণ বাতিল করে তার জায়গায় যুক্ত করা হয় ‘এজরা পাউন্ড ও শুঁয়োপোকা’ নামের একটি লেখা। স্থানচ্যুত লেখা দুটো সন্নিবিষ্ট হয় ‘প্যারিসের বাড়তি চিত্র’ নামে সৃষ্ট দ্বিতীয় অংশে, ‘পুনঃস্থাপিত সংস্করণ’-এ যেটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘প্রথম ভাগ : প্যারিসের বাড়তি চিত্র।’ ফলে নতুন সংস্করণের পূর্ণাঙ্গ সূচি দাঁড়ায় এরকম : (১) প্লাশ সাঁ মিশেলের ক্যাফেটি, (২) মিস স্টাইনের পাঠদান, (৩) শেকসপিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি, (৪) স্যেনের মানুষেরা, (৫) মেকি বসন্ত, (৬) একটি পেশার সমাপ্তি, (৭) পরাজিত প্রজন্ম, (৮) খিদের শৃঙ্খলা, (৯) ফোর্ড ম্যাডক্স ফোর্ড এবং শয়তানের চেলা, (১০) পাসিনের সঙ্গে, (১১) এজরা পাউন্ড ও শুঁয়োপোকা (১২) এক আজব সমাপ্তি, (১৩) মৃত্যুচিহ্নবাহী লোকটি, (১৪) ইভান শিপম্যানের সঙ্গে, (১৫) শয়তানের চর, (১৬) শ্যোনসের শীতকাল (১৭) স্কট ফিটজেরাল্ড, (১৮) স্বার্থপর বাজপাখি, (১৯) মাপজোকের ব্যাপার।
প্রথম ভাগ : প্যারিসের বাড়তি চিত্র : (২০) এক নতুন মতের জন্ম, (২১) এজরা পাউন্ডের সৎসংঘ, (২২) প্রথম পুরুষে লেখা বিষয়ে, (২৩) গোপন আনন্দ, (২৪) এক আজব মুষ্টিযুদ্ধ ক্লাব, (২৫) মিথ্যের কটু গন্ধ, (২৬) শ্রীমান বাম্বির শিক্ষাদীক্ষা, (২৭) স্কট ও তাঁর প্যারিসীয় গাড়িচালক, (২৮) আড়কাটি মাছ ও পয়সাওয়ালারা, (২৯) শূন্য ও কেবলই শূন্যতা।
দ্বিতীয় ভাগ : খণ্ডিতাংশ।
ওপরে উদ্ধৃত প্রথম সংস্করণ এবং পুনঃস্থাপিত সংস্করণের সূচির মধ্যেকার পার্থক্যগুলো থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, এই পরবর্তী সংস্করণটি হেমিংওয়ের পাণ্ডুলিপির মূলানুগ প্রকাশনা, সেই অর্থে এটিকে শন হেমিংওয়ের সম্পাদনা না বলে বরং অসম্পাদিত বললেই বোধকরি যথার্থ হয়। প্রকৃত অর্থে সম্পাদিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ ছিল প্রথমটি, যেটি মেরি নিজের সুবিধামাফিক পরিবর্তন, সংযোজন ও বিয়োজন করেছিলেন, যে কারণে মেরিকে যথেষ্ট সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। পুনঃস্থাপিত সংস্করণে অধ্যায়গুলোর ক্রম পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে, ফিরিয়ে আনা হয়েছে প্রথম সংস্করণের কিছু বাদ দেওয়া বিষয়, সংযোজন করা হয়েছে ইতস্তত লিখে রাখা পুনরাবৃত্তি করা এলোমেলো বিভিন্ন মন্তব্য।
প্রথম প্রকাশিত হওয়ার পর বইটির সম্পাদনা এবং উৎস নিয়ে যেমন বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল, ‘পুনঃস্থাপিত সংস্করণ’ বলে অভিহিত মূলানুগ সংস্করণটি প্রকাশ হওয়ার পরও বিশ্লেষকদের কেউ কেউ এটির বিষয়ে বিশেষ উৎসাহ দেখাননি, কারণ প্রায় অর্ধযুগ ধরে যে বইটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত ও পাঠকমহলে পরিচিত, নতুন একটি সংস্করণ তার তুলনায় কতখানি সাড়া জাগাতে পারবে, সে বিষয়ে তাঁদের সংশয় ছিল। নতুনটির তুলনায় পরিমার্জিত প্রথম সংস্করণটিকেই অধিকতর গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করেছেন অনেকেই। দুই সংস্করণের পার্থক্য এবং অন্যান্য বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্কের বিষয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ ছিল কম, তাদের কাছে পুরনো পরিচিত সংস্করণটিই বেশি পরিচিত ছিল। তাঁরা জানতেন প্রথম সংস্করণের সম্পাদক মেরি ও দ্বিতীয় চার্লস স্ক্রিবনার দুজনই হেমিংওয়ের খুব কাছের লোক ছিলেন বলে তাঁকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছিলেন, সম্পাদনার প্রয়োজনে আলোচনাও করতে পেরেছিলেন তাঁর সঙ্গে। নতুন সংস্করণের সম্পাদক শন হেমিংওয়ের সে সুযোগ ছিল না।
অথচ মরণোত্তর প্রকাশনা হিসেবে লেখকের সম্পাদিত মূল পাণ্ডুলিপি অনুসরণ করে প্রকাশিত সংস্করণটি স্বভাবতই পাঠকের আগ্রহের বিষয়ে পরিনত হওয়া উচিত। উপরন্তু নতুন মূলানুগ সংস্করণটির বাড়তি অধ্যায়, পাণ্ডুলিপিতে হেমিংওয়ের সহস্তে করা সংশোধিত কিছু পৃষ্ঠার সংযোজিত ছবি এবং হেমিংওয়ের বিচ্ছিন্ন নোট ও মন্তব্য গবেষকদের জন্য হয়ে উঠতে পারে নতুন উৎস।
বইটির প্রথম সংস্করণে পলিনের নামোল্লেখ না করে হ্যাডলির সঙ্গে নিজের দাম্পত্য জীবনে পলিনের অনুপ্রবেশ সম্পর্কে যে বিরূপ ধারণা দিয়েছেন হেমিংওয়ে কিংবা মেরির সম্পাদনায় যেরকম বিরূপতা উঠে এসেছে, নতুন সংস্করণের সেই অংশগুলোতে পলিনের বিষয়ে হেমিংওয়ের মূল ভাষ্য পুনঃস্থাপিত হয়েছে। সঙ্গতভাবেই ধারণা করা যায় আর্নেস্টের পৌত্র শন হেমিংওয়ে তাঁর ঠাকুরমা সম্পর্কে অপ্রিয় ভাষ্যগুলোকে বর্জন করেছেন কিংবা তাঁর ঠাকুরদার মূল ভাষ্য এমনভাবে ফিরিয়ে এনেছেন, যাতে তাঁর পিতামহীকে খল নায়িকা বলে মনে না হয়। অথচ প্রথম সংস্করণে পলিন সম্পর্কে এরকম ধারণাই পাঠক পেয়ে এসেছেন এত বছর ধরে। তার পরও পিতার রেখে যাওয়া পাণ্ডুলিপিতে তাঁর মা সম্পর্কে আরও কোনো তথ্য পাওয়া যায় কি না, সেটা দেখতে আগ্রহী ছিলেন বলেই প্যাট্রিক একটি নতুন সংস্করণের ব্যাপারে ভ্রাতুষ্পুত্র শন হেমিংওয়েকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি বুঝতে পারেন যে মূল সংস্করণে তাঁর মায়ের সম্পর্কে যা লেখা হয়েছিল, সেটা ভয়াবহরকম খারাপ। নতুন সংস্করণে পাঠকরা বুঝতে পারবেন, তাঁর বাবা দ্বিতীয় স্ত্রী পলিনকে নিয়ে সুখী ছিলেন। তাঁর ভাষায় ‘আত্ম-সমর্থকের চেয়ে তিনি ছিলেন অনেক বেশি মানবিক।’ (মটোকো রিচ, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, জুন ২৭, ২০০৯)
বইটির পুনঃস্থাপিত সংস্করণ সম্পর্কে শন হেমিংওয়ে বলেন, ‘এটা ঠিক, নতুন সংস্করণে পলিন সত্যিকারভাবে উঠে আসেননি। আমার কাকা প্যাট্রিকের মা হচ্ছেন পলিন, আর আমার দাদী। তাই আমরা খুব আগ্রহী ছিলাম, যদি তাঁর সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য পাওয়া যায়, কারণ বইটিতে প্রায় আসেননি তিনি। কিন্তু দেখা যায় বইটিতে তাঁর সম্পর্কে এমন কিছু নেই। …কিছু চমৎকার অংশ আছে তাঁদের বিয়েতে কীভাবে অবিশ্বাস্য সুখ এসেছিল, কীভাবে সেটা ছিল শুরু, শেষ নয়। শেষ অধ্যায়টি নতুনভাবে লিখতে গিয়ে মেরি সেসব বাদ দিয়েছিলেন। প্রথম সংস্করণে তিনি এটা আরও খারাপভাবে এনেছিলেন…। আপনি যদি কোনো অধ্যায় ঢোকাতে চান, আপনার উচিত যেভাবে সেটা লেখা হয়েছিল সেভাবেই রাখা…” (শন হেমিংওয়ে, জন এফ কেনেডি প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরি অ্যান্ড মিউজিয়াম, সেপ্টেম্বের ২০, ২০০৯)।
নতুন পরিমার্জিত সংস্করণটি প্রকাশিত হওয়ার পর মেরির সম্পাদনার মান ও উদ্দেশ্য নিয়ে একটি সঙ্গত প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে। আমরা জানি, পলিনের সঙ্গে মেরির সুসম্পর্ক ছিল, কারণ, প্রথমোক্তজনের সঙ্গে বিচ্ছেদের জন্য মেরি কোনোভাবেই দায়ী ছিলেন না। এই বিচ্ছেদের মূল কারণ ছিলেন হেমিংওয়ের তৃতীয় স্ত্রী মার্থা গেলহর্ন। মেরি যখন লেখকের চতুর্থ স্ত্রী হয়ে আসেন, তাঁর সঙ্গে পলিনের সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়, নিয়মিত যোগাযোগ ছিল তাঁদের মধ্যে, এমনকি স্বামীর সঙ্গে পলিনের কী ওয়েস্টের বাড়িতে আতিথ্যও গ্রহণ করেছিলেন তিনি। তার পরও পলিনকে প্রথম স্ত্রী হ্যাডলির সঙ্গে বিচ্ছেদের মূল নায়িকা হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য মেরির সম্পাদকীয় প্রয়াসের কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। পুনঃস্থাপিত সংস্করণে ‘আড়কাটি মাছ ও পয়সাওয়ালারা’ শিরোনামে যে নতুন একটি অধ্যায় যুক্ত হয়েছে সেখানে হেমিংওয়ে লিখেছিলেন,
বন্ধুর সঙ্গে প্রতারণা করা একটি মেয়ের জন্য একটা জঘন্য ব্যাপার, কিন্তু সেটা ছিল আমারই দোষ ও অন্ধ আবেগ যা আমাকে আটকায়নি। ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িয়ে এবং প্রেমে পড়ে সকল দায় নিজের ওপর গ্রহণ করেছিলাম আমি, বেঁচে ছিলাম অনুশোচনা নিয়ে। যতদিন পর্যন্ত না আমার স্ত্রী এমন একজনকে বিয়ে করে, যিনি আমার চেয়ে ভালো, যাঁর মতো কখনোই ছিলাম না এবং কখনো হতেও পারব না, এবং যতদিন না জেনেছি যে সে সুখী হয়েছে, ততদিন বিবেকের এই দংশন দিন রাত্রির কখনোই ছেড়ে যায়নি আমাকে।
মেরির সম্পাদিত সংস্করণে পলিনকে বিরূপভাবে চিত্রিত করা হলেও সৎমা মেরির ওপর কোনো দোষ চাপাননি প্যাট্রিক। তিনি বরং বলেন, সে সময়ের পরিস্থিতিতে চমৎকার একটি কাজ করেছেন তিনি। তাঁর ধারণা, পলিনের সঙ্গে কোনো কারণে মেরির মনোমালিন্য হয়েছিল কিংবা হ্যাডলিকে তোষামোদ করতে চেয়েছিলেন তিনি, কারণ, হ্যাডলির কাছে মিরোর একটা পেইন্টিং ছিল, সেটা ফিরে পেতে চাইছিলেন মেরি (মটোকো রিচ, প্রাগুক্ত)। এখানে উল্লেখ করা দরকার, হ্যাডলির ৩৪তম জন্মদিনে তাঁর পছন্দের একটা পেইন্টিং – স্প্যানিশ শিল্পী হুয়ান মিরোর ‘দ্য ফার্ম’ কিনে দিয়েছিলেন হেমিংওয়ে। বিচ্ছেদের পর থেকে পেইন্টিংটি হ্যাডলির অধিকারেই ছিল।
আমাদের স্মরণে রাখতে হবে পলিনকে ত্যাগ করে মার্থাকে বিয়ে করেছিলেন হেমিংওয়ে। তারপর মার্থার সঙ্গে অপেক্ষাকৃত স্বল্প সময়ের দাম্পত্যের শেষে হেমিংওয়ের জীবনে আসেন মেরি। এরকম পরিস্থিতিতে মার্থার প্রতিই সবচেয়ে বেশি বিদ্বেষ থাকার কথা পলিনের, মেরির প্রতিও হয়তো থাকতে পারে, কিন্তু দেখা গেছে উল্টো পলিনের প্রতি মেরির মনোভাব ছিল বিরূপ, অন্ততপক্ষে তাঁর সম্পাদিত বইতে পলিনের ভূমিকা সেরকমই মনে হয়েছে। তাই মেরির সম্পাদনায় ‘অ্যা মুভেবল ফিস্ট’-এর প্রথম সংস্করণে কিছু সংযোজন ও বিয়োজনের কারণ সবসময়ই রহস্যাবৃত থাকবে। পলিনের বিষয় বাদ দিলেও আরো কিছু বিয়োজন ছিল প্রশ্নবহ। যেমন, প্রথম সংস্করণে ‘স্কট ফিটজেরাল্ড’ শিরোনামের অধ্যায়টির শুরুতে এপিগ্রাফে হেমিংওয়ের যে মন্তব্যটি ব্যবহার করা হয় সেটি ছিল এরকম :
তাঁর মেধা ছিল প্রজাপতির পাখার ওপর রেণু দিয়ে তোলা নকশার মতো প্রাকৃতিক। এটা কখন আঁকা কিংবা নষ্ট করে ফেলা হয়েছে, সেটা প্রজাপতি যেরকম জানে, কখনো তিনি তার চেয়ে ভালো বুঝতে পারতেন না। পরে তিনি তাঁর ক্ষতিগ্রস্ত পাখনা আর ওগুলোর গঠন বিষয়ে সচেতন হন এবং ভাবতে শেখেন। তখন আর উড়তে পারতেন না তিনি, কারণ, তিরোহিত হয়েছে তাঁর ওড়ার ইচ্ছে, তখন কেবল স্মরণ করতে পারতেন, ওগুলো যখন অনায়াস ছিল সেসব কথা।
নতুন সংস্করণে সংযোজিত পাণ্ডুলিপির পাতা থেকে দেখা যায় মূল ভাষ্যে ওপরের উদ্ধৃতির শেষ বাক্যটি টাইপ করা ছিল বটে, কিন্তু হেমিংওয়ে সেটি কেটে নিচের বাক্যটি লিখে দিয়েছিলেন নিজহাতে :
তিনি আবার উড়ছিলেন এবং জীবনের ভালো সময়ে না হলেও তাঁর লেখালেখির একটা ভালো সময়ের পরপরই তাঁর দেখা পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।
নিজের একসময়ের বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের সম্পর্কে এমন বহু নেতিবাচক লেখা থাকলেও মুভেবল ফিস্ট বইটির নতুন সংস্করণে হেমিংওয়ের সংশোধিত ও মূল অংশ যুক্ত করা হয়েছে পলিন সম্পর্কিত লেখাতে, যাতে তাঁকে আরো ইতিবাচক হিসেবে দেখানো যায়। যুক্ত করা হয়েছে স্কট ফিটজেরাল্ডকে নিয়ে লেখাটিতে তাঁর বিষয়ে করা ইতিবাচক একটি বাক্যও।
স্কট সম্পর্কে হেমিংওয়ের নমনীয় মনোভাব কিংবা পলিনের বিষয়ে তাঁর সহানুভূতিশীল মন্তব্যগুলো প্রথম সংস্করণে এড়িয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে অধ্যাপক গেরি ব্রেনার মনে করেন, হেমিংওয়ের শেষ জীবনে মেরির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিরঙ্কুশ ছিল না। তাঁর আশঙ্কা ছিল, হেমিংওয়ে তাঁকে ত্যাগ করবেন আগের নিয়মে। বিভিন্ন আচার আচরণে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে স্ত্রীকে আর সহ্য করতে পারছেন না তিনি। তাই সম্পাদনার কাজটি তিনি এমনভাবে করেছিলেন যাতে হেমিংওয়েকে অনেক বেশি প্রতিহিংসাপরায়ণ বলে মনে হয়। (স্টিভ পল, নিউ কোক ভার্সাস ওল্ড কোক: দ্য ডিবেট ওভার অ্যা মুভেবল ফিস্ট: দ্য রেস্টোরড এডিশন, দ্য হেমিংওয়ে রিভিউ, খণ্ড ২৯, সংখ্যা ১)
বইটি সম্পাদনার ক্ষেত্রে মেরির এরকম মনোভাব সত্যিই ছিল কি না, সে বিতর্কে না গেলেও হেমিংওয়ের জীবদ্দশায় মেরির দাম্পত্য জীবন খুব যে সুখের ছিল না, সেটি সঠিক। স্বামীর মাতাল অবস্থায় বহুবার বিভিন্নভাবে অপমানজনক আচরণের শিকার হয়েছিলেন তিনি। কখনো সেনাশিবিরের মনোরঞ্জনকারী নারী (ক্যাম্প ফলোয়ার), কখনো ‘মড়াখেকো’ বলে মেরির ওপর নিজের রাগ ঝেড়েছেন হেমিংওয়ে। একবার বলেছিলেন যে মেরির চেহারা দুষ্ট ও নিপীড়ক স্প্যানিশ যাজক ‘তোরকে মাদা’র মতো। এরকম সময়ে বাগানের লিচুগাছটার নিচে বসে নীরবে অশ্রুপাত করা ছাড়া আর কিছু করার থাকত না মেরির।
প্রথম সংস্করণে যে ভূমিকাটি হেমিংওয়ের বলে যুক্ত করা হয়েছিল, নতুন সংস্করণে সেটি পুরোপুরি বাদ দিয়ে দেওয়ার কারণে স্পষ্ট যে এটি প্রকৃতপক্ষে হেমিংওয়ের লেখা ছিল না। ধারণা করা যায়, হেমিংওয়ের বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন বাক্য ও নোটের টুকরো অংশ মিলিয়ে ভূমিকা নামের এই লেখাটি তৈরি করেছিলেন মেরি। মূল পাণ্ডুলিপিতে না থাকলেও জোড়াতালি দিয়ে তৈরি করা লেখাটি ভূমিকা নামে যুক্ত করা হয়েছিল। ভূমিকা নাম দিয়ে প্রথম সংস্করণে এটি যুক্ত করার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ ছিল না বলে মনে হলেও তখনকার বাস্তবতায় এজাতীয় একটি বইতে একটা মুখবন্ধের হয়তো দরকার ছিল।
এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে হেমিংওয়ের প্যারিস স্মৃতিকথাটির মূল পাণ্ডুলিপির সঙ্গে বইটির প্রথম সংস্করণের গরমিল বিষয়ে অনুসন্ধানকারী প্রথম সারির গবেষকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন গেরি ব্রেনার। হেমিংওয়ে সংগ্রহশালার সংরক্ষক জো অগাস্ট হিল তাঁকে এ বিষয়ে প্রথম ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, তাঁদের কাছে রক্ষিত হেমিংওয়ের নথিপত্রের অনেক বিষয়ের সঙ্গে মেরির সম্পাদিত সংস্করণের পুরোপুরি মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। অবশেষে যখন কেনেডি লাইব্রেরিতে হেমিংওয়ে সংগ্রহশালা উন্মুক্ত করা হয়, তখন এই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়। শন হেমিংওয়ে নিজেও বলেছেন, বইটির কোনো সংস্করণই লেখকের মূল লেখা নয়। প্রথম সংস্করণটি বহুভাবে মূল ভাষ্যের প্রতি অনুগত ছিল, কিন্তু সেটিকে সম্পূর্ণ বলে উপস্থাপন করা হলেও সেটি আসলে চূড়ান্ত ছিল না। ব্রেনার লেখেন, মেরি যেভাবে বইটির পাণ্ডুলিপিতে কাটাছেঁড়া করেছেন, সেরকম পরিবর্তন তাঁর স্বামী করতে চাইতেন না।
বইটির নতুন সংস্করণের বিষয়ে সবচেয়ে বেশি আপত্তি তুলেছেন আর্নেস্টের বন্ধু ও জীবনীকার অ্যারন হোচনার। তাঁর দাবী অনুযায়ী বইটির সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন হেমিংওয়ে। হোচনার যখন কিউবা থেকে নিউ ইয়র্ক ফিরে যাচ্ছিলেন, তখন স্ক্রিবনার্সের প্রেসিডেন্ট চার্লস স্ক্রিবনার জুনিয়রকে দেওয়ার জন্য হেমিংওয়ে তাঁর হাত দিয়ে প্যারিস স্মৃতির পূর্ণাঙ্গ পাণ্ডুলিপিটি পাঠিয়েছিলেন বলে দাবী করেছেন তিনি। এমনকি মায়ো ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায়ও হেমিংওয়ে বইটির বিষয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ছিলেন বলে জানিয়েছেন হোচনার, কারণ ওটাতে একটা সমাপ্তিসূচক অধ্যায় থাকা দরকার ছিল, সেটা দেওয়া হয়নি। নতুন সংস্করণের সম্পাদক হেমিংওয়ের পৌত্র শন হেমিংওয়ে সম্পর্কে কিছুটা ব্যঙ্গ করে হোচনার লেখেন, ‘নাতিটি বইটির শেষ অধ্যায়ের কয়েকটা অংশ সরিয়ে তার জায়গায় হেমিংওয়ের অন্য লেখা ঢুকিয়ে দিয়েছেন, যেগুলোতে তিনি মনে করেন তাঁর ঠাকুরমাকে আরো বেশি সহানুভূতির আলোকে চিত্রিত করা হয়েছে। আরো দশটি অধ্যায়, যেগুলো নাতির অসন্তোষ জাগ্রত করেছে, সেগুলোকে একটা সংযোজনীতে নির্বাসিত করা হয়েছে, যার ফলে, নাতিটির মতে “বইটির আরো যথার্থ একটা বিবরণ তৈরি করা গেছে যা আমার ঠাকুরদা প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন।” (অ্যারন ই হোচনার, ডোন্ট টাচ ‘অ্যা মুভেবল ফিস্ট,’ নিউ ইয়র্ক টাইমস, জুলাই ১৯, ২০০৯)
হোচনার আরো জানান, মেরি তাঁর স্বামীর সম্পত্তির বিষয় নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন বলে বইটিতে তাঁর সম্পৃক্ততা কমই ছিল। হোচনার দাবি করেন, কিউবা থেকে ফেরার পথে যে পাণ্ডুলিপিটি তিনি বিমানে বসে পড়েছিলেন, সেটাই বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি আরো জানান, মেরি কোনো বাড়তি অধ্যায় তৈরি করেননি।
তার পর তাঁর সবচেয়ে মারাত্মক যুক্তিটা দিয়ে তিনি লেখেন, ‘একজন গ্রন্থকার হিসেবে এই ‘পুনঃস্থাপিত সংস্করণে’ স্ক্রিবনারের জড়িত হওয়ার বিষয়টা নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন। পুনঃসৃষ্টির এই নজির স্থাপনের পর, ধরা যাক, স্কট ফিটজেরাল্ডের কোনো বংশধর এসে যদি দাবি করেন যে ‘অ্যা মুভেবল ফিস্ট’ থেকে ফিটজেরাল্ডের পুরুষাঙ্গের আকার নিয়ে লেখা অধ্যায়টা বাদ দিতে হবে, কিংবা ফোর্ড ম্যাডক্স ফোর্ডের নাতি যদি দাবি করেন যে তাঁর পূর্বপুরুষের শরীরের দুর্গন্ধ বিষয়ক অংশটা বাদ দিতে হবে – তাহলে কী করবেন স্ক্রিবনার?’ (অ্যারন ই হোচনার, প্রাগুক্ত)।
হোচনার আরো লেখেন, লেখকরা যেসব বই বিশ্বাস করে তাদের কাছে আমানত হিসেবে রেখে দেয়, স্ক্রিবনারসহ সকল প্রকাশকই হয়ে ওঠে সেগুলোর জিম্মাদার। উত্তরাধিকারী হয়ে কেউ লেখকের স্বত্বের দাবিদার হতে পারেন, কিন্তু সে বই সংশোধন বা পরিবর্তন করার অধিকার অর্জন করেন না।
তাঁর মাধ্যমে পাণ্ডুলিপি পাঠানো এবং প্লেনে বসে সেটি পড়েছেন বলে হোচনারের দাবির বিষয়ে একটি ব্যাপার অমীমাংসিত রয়ে যায়, তাঁর মাধ্যমে প্রকাশকের কাছে পাণ্ডুলিপি পাঠানো হয়ে থাকলে, মেরির সম্পাদনায় বইটি প্রকাশিত হতে হেমিংওয়ের মৃত্যুর পর তিন বছর সময় লাগল কেন? কিংবা মেরির সম্পাদনার প্রয়োজনই বা পড়ল কেন? মেরি এবং হোচনারের বক্তব্যের মধ্যে বিস্তর ফারাক আমরা দেখেছি রিৎজ হোটেলের বাক্স-রহস্য বিষয়ে, সুতরাং পাণ্ডুলিপি উদ্ধার নিয়ে হোচনার কিংবা মেরির দাবি কতখানি সত্য, সে সংশয় থেকেই যায়। তবে মেরির সম্পাদনায় তিন বছর পর বইটি বের হওয়ার কারণ সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। আত্মহত্যার তিন মাস আগে হেমিংওয়ে স্ক্রিবনারের কাছে একটা চিঠি লিখেছিলেন বলে জানা যায়, যেখানে তিনি লিখেছিলেন, যে পাণ্ডুলিপিটা তিনি হোচনারের হাতে পাঠিয়েছিলেন, সেটিতে তাঁর প্রথম দুই স্ত্রী এবং ফিটজেরাল্ডের প্রতি অবিচার করা হয়েছে। বইটির কোনো সমাপ্তিও টানা হয়নি। সুতরাং সেই পাণ্ডুলিপি অনুসারে বইটি আপাতত প্রকাশ করতে চাইছেন না তিনি। এই চিঠিখানিই মেরি স্ক্রিবনারের কাছে না পাঠিয়ে সরিয়ে রেখেছিলেন বলে ধারণা করা হয়।
সৃষ্টিকর্ম অসমাপ্ত অবস্থায় রেখে লেখকের মৃত্যুর নজির এটাই প্রথম নয়। সমরেশ বসু দশ বছরের পরিশ্রমে লিখেছিলেন রামকিঙ্কর বেজের জীবনভিত্তিক উপন্যাস ‘দেখি নাই ফিরে’। ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা হওয়ার সময় তিনি মারা যান। পরবর্তী সময় অসমাপ্ত অবস্থাতেই প্রকাশিত হয় উপন্যাসটি। বিকল্প কাউকে দিয়ে শেষ করানোর চেষ্টা করা হয়নি। শরৎচন্দ্রের ‘শেষের পরিচয়’ উপন্যাসটিও অসমাপ্ত রেখে মারা গিয়েছিলেন তিনি। একই পরিণতি ঘটেছিল শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘আলো নেই’ উপন্যাসের ক্ষেত্রে। এটিও দুই খণ্ডের একটি অসমাপ্ত উপন্যাস। বইটির ভূমিকায় কিন্নর রায় লিখেছেন, ‘শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় যেভাবে ‘আলো নেই’ শেষ করতে চেয়েছিলেন, সেভাবে এই উপন্যাস খুব স্বাভাবিকভাবেই শেষ হয়নি। …অনেক লেখা লেখকের মৃত্যুর পর অন্য কোনো কথাশিল্পী শেষ করেন। …কিন্তু ‘আলো নেই’ এমন একটি রচনা, লেখকের কল্পনামতো শেষ করতে পারা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। …শ্যামলবাবু শারীরিকভাবে সুস্থ থেকে যদি ‘আলো নেই’ শেষ করতেন, তাহলে নিশ্চয়ই অন্যরকম হতো। …বাকিটা নয় বিনির্মাণ করবেন পাঠক (শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, আলো নেই, দ্বিতীয় খণ্ড, দে’জ পাবলিশিং, এপ্রিল ২০০২)।
‘দ্য অরিজিনাল অভ লরা’ নামে নবোকভের যে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল, সেটির ব্যাপারে তিনি তাঁর স্ত্রী ভেরা এবং পুত্র দিমিত্রিকে বলে গিয়েছিলেন, বইটি শেষ করার আগে যদি তিনি মারা যান, তাহলে যাতে অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপিটা পুড়িয়ে ফেলা হয়। ১৯৭৭ সালে সত্যিই বইটি অসমাপ্ত রেখে মারা গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পিতার নির্দেশ অমান্য করে তাঁর মৃত্যুর বত্রিশ বছর পর বইটি শেষ করে প্রকাশ করেছিলেন দিমিত্রি। এই কাজের জন্য সাহিত্য সমালোচকদের ব্যাপক আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিল দিমিত্রিকে। কাফকা তাঁর বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে অনুরোধ করেছিলেন মৃত্যুর পর তাঁর অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপিগুলো যেন পুড়িয়ে ফেলা হয়। তাঁর বন্ধুটি যদি সেদিন তাঁর অনুরোধ রক্ষা করতেন, তাহলে ‘দ্য ট্রায়াল’ কিংবা ‘দ্য ক্যাসেল’ নামের কাফকার কোনো উপন্যাস পড়ার সুযোগ হতো না পাঠকের। মিখাইল বুলগাকভের ‘দ্য মাস্টার অ্যান্ড মার্গারিটা’ শেষ করেছিলেন তাঁর স্ত্রী এলেনা বুলগাকোভা। উপন্যাসটি ১৯২৮ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে লেখা হলেও এটি প্যারিস থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে।
নবোকভকে বাদ দিলে অন্য কারো অসমাপ্ত রচনা শেষ করে প্রকাশনা নিয়ে এত সমালোচনা হয়নি, যা হেমিংওয়ের প্যারিস স্মৃতি নিয়ে ঘটেছে। তার কারণ, পাঠকসমাজ যে বইটি হেমিংওয়ের নিজের হাতের কাজ বলে এতদিন জেনে এসেছে, দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর পর তাঁর পৌত্রের সম্পাদনায় বইটির পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হলে পাঠক ও বিশ্লেষক মহলের কৌতূহল এবং ইতিবাচক ও নেতিবাচক নানাবিধ সমালোচনার শিকার হতে হয় সেটিকে। একথা অনস্বীকার্য যে বইটির প্রথম সংস্করণে হেমিংওয়ের ঘর ভাঙার জন্য পলিনকে যেভাবে দায়ী করা হয়েছে, তিনি হয়তো তেমন খলনায়িকা ছিলেন না। হেমিংওয়ের নোট ও অন্যান্য কাগজপত্র উন্মুক্ত হওয়ার পর প্রকাশ পায় যে এই গৃহদাহের দায় তিনি নিজের ওপর টেনে নিয়েছিলেন। তাই প্যাট্রিক তাঁর মায়ের এবং শন হেমিংওয়ে ঠাকুরমার ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের জন্য পুনঃস্থাপিত সংস্করণটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এই সংস্করণের সমালোচনাকারীরা মনে করেন, এই কাজটি অন্যভাবেও করা যেত, তার জন্য প্রথম সংস্করণটিকে বিকৃত করার প্রয়োজন ছিল না। এমনকি প্রথম সংস্করণের ভাষ্য পরিবর্তন না করে অগ্রন্থিত লেখাগুলোকে নিয়ে আরেকটি বইও প্রকাশ করা যেত। প্রকাশক স্ক্রিবনারের ওপরও এক হাত নিয়েছেন কিছু সমালোচক। নতুন সংস্করণের পাশাপাশি প্রথমটিও বাজারে চালু থাকবে, প্রকাশকের এমন সিদ্ধান্তের ফলে পাঠক কোনটি কিনবে বা পড়বে, সেটা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে যাবে। কেউ কেউ দুটো সংস্করণই কিনবে, ফলে প্রকাশক বাণিজ্যিকভাবেও লাভবান হবে।
‘অ্যা মুভেবল ফিস্ট’-এর ‘পুনঃস্থাপিত সংস্করণ’ নিয়ে গবেষক ও সমালোচকমহলের নানামুখী প্রতিক্রিয়া থাকলেও, মেরি সম্পাদিত প্রথম সংস্করণে অগ্রন্থিত অধ্যায়গুলো পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত করে শন হেমিংওয়ে বহুবর্ণিল জীবনের অধিকারী আর্নেস্ট হেমিংওয়ের প্রতি আগ্রহী পাঠকের কৌতূহল পুনঃজাগ্রত করতে পেরেছেন, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। শন তাঁর ঠাকুরমার ভাবমূর্তি কতখানি উদ্ধার করতে পেরেছেন কিংবা আদৌ পেরেছেন কি না, সে বিচারের ভার পাঠকদের ওপর ছেড়ে দেওয়া যায়। এই সংস্করণটি প্রকাশের সঙ্গে প্রকাশক স্ক্রিবনার্সের ব্যবসায়িক স্বার্থ জড়িত, একথা যেমন সত্য, হেমিংওয়ের মতো লেখকের মূল পাণ্ডুলিপির প্রায় অর্ধাংশ বাদ দিয়ে, একটা স্মৃতিগ্রন্থ প্রকাশ করাও ছিল সত্য গোপন করার একটা প্রয়াস। ‘পুনঃস্থাপিত সংস্করণ’টি হেমিংওয়ের নিজস্ব মনোভাব ও অভিজ্ঞতার অবিকৃত ও অবিকল দলিল হিসেবে যেভাবে টিকে থাকবে, তেমনই বিভিন্ন লেখক-শিল্পী সম্পর্কে হেমিংওয়ের বিরূপ মন্তব্য এবং স্মৃতিচারণও পাঠকের ভেতর এই সাহিত্য ব্যক্তিত্বের বিষয়ে মিশ্র অনুভূতি ও প্রবলতর হবে এবং পরিবর্তন ঘটবে তাঁর ভাবমূর্তির।
Leave feedback about this