“সিনেমায় নীতিকথার পরিবর্তে আসল সমস্যাটা কী, পারস্পরিক বোঝাপড়ার সেই গল্পটি বলা উচিত”
এটি অনেক আগের একটি সাক্ষাৎকার, কিন্তু এখনও প্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে তাঁর চলচ্চিত্র বুঝতে সাহায্য করবে সাক্ষাৎকারটি। দুকের চলচ্চিত্র যাঁরা পছন্দ করেন, তাঁদের জন্যে এটি একটি অবশ্যপাঠ্য সাক্ষাৎকার বলে আমরা মনে করি।
দক্ষিণ কোরিয়ার চলচ্চিত্র পরিচালক কিম কি দুক এই সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি কোনো বিতর্ক সৃষ্টি করতে চাননি, কিন্তু তাঁর সিনেমাগুলো নিয়ে প্রায়ই বিতর্ক উঠেছে। ২০১৯ সালে তিনি যখন বসফরাস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণ করার জন্যে ইস্তাম্বুল গিয়েছিলেন তখন তাঁর সঙ্গে কথা বলেন চলচ্চিত্র সমালোচক এলিফ বেরেকেটলি। বেরেকেটলির সুযোগ হয়েছিল দুকের চলচ্চিত্র শৈলী ও অন্যান্য নানা প্রসঙ্গে কথা বলার। সাক্ষাতকারটি পরে ১লা নভেম্বর ২০১৯ সালে টিআরটি ওয়ার্ল্ডে প্রচার করা হয়।
এলিফ বেরেকেটলি : আজকে আপনাকে আমাদের অনুষ্ঠানে পেয়ে আমরা খুবই আনন্দিত। আমাদের সাথে যোগ দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। তাহলে শুরু করি। ভার্চুয়াল জগৎ কিংবা মিডিয়া, যেখানেই দেখি আপনার সিনেমা নিয়ে নানান সমালোচনা চোখে পড়ে। আপনাকে একজন বিতর্কিত পরিচালক, বিতর্কিত চলচ্চিত্র নির্মাতা মনে করা হয়। আমার মনে হয় আপনি আসলেই মাঝেমাঝে বিতর্কিত বিষয় বাছাই করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তাই হয়তো আপনাকে সবাই আসলে এরকমই ধরে নিয়েছে কিংবা আপনি কি মনে করেন একজন নির্মাতার ভূমিকা হচ্ছে বিতর্কিত হওয়া এবং সময় সময়ে সে-বিতর্ক সৃষ্টি করবে?
কিম কি দুক : ধন্যবাদ, আমি জানি যারা আমার সিনেমা দেখে তাদের ভিন্ন ধারণা থাকতে পারে। আমি কিন্তু কখনোই কোন উদ্দেশ্য নিয়ে বা ইচ্ছাকৃতভাবে এ জাতীয় তর্ক-বিতর্ক তৈরি করার জন্য কিছু করি না। অপাপ ইচ্ছে নিয়ে আমি আমার ভাবনাকে সিনেমাতে রূপ দিই। কিন্তু এটা স্বাভাবিক, আমার অনুরাগী ও বিরাগীদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব আছে। আমার উদ্দেশ্য কিন্তু এটা নয়, তবে সিনেমা দর্শকদের মাঝে সেসব ভাবনা বিপরীত অনুভূতিও তৈরি করতে পারে। সিনেমা শেষ হওয়ার পর দর্শক আর সমালোচকদের মাঝে যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, আমি মনে করি এটা একটা ভালো বিষয়।
এলিফ বেরেকেটলি : আমার মনে হয় আপনার সিনেমায় সাদা-কালো, আলো-অন্ধকার তথা আলো-ছায়া, সুখ-দুঃখ এবং আশার সহাবস্থান সম্পর্কে একটা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। এদিক থেকে আপনি কি মনে করেন এখন সারা বিশ্ব যেভাবে ভুগছে, সেখানে পরিচালক হওয়াটা কঠিন? আমি জানি না, পৃথিবীতে উগ্রবাদীদের উত্থানে আমরা এখন যে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ করছি, আপনি কি মনে করেন একজন চলচ্চিত্র নির্মাতার জন্য এটা ভাল সময়?
কিম কি দুক : অবশ্যই, এখন বিভিন্ন ধরনের সিনেমা হয়। এটা হতে পারে মানবতাবাদী, রম্য বা রাজনৈতিক সিনেমা। আমি মনে করি, যুদ্ধে সন্ত্রাসী আক্রমণ এবং দেশগুলোর মধ্যে যে দ্বন্দ্ব তাতে ক্ষমতার মতো বিষয়গুলো রয়েছে। অতি সম্প্রতি আমার নির্মিত সিনেমাগুলোর মধ্যে একটি ছিল “নেট”। এই সিনেমাটা দক্ষিণ কোরিয়া ও উত্তর কোরিয়ার দ্বন্দ্ব নিয়ে নির্মিত। তবে এটা কোন পক্ষ সঠিক বা ভুল তা বিচার করার জন্য নির্মিত হয়নি। আমি মনে করি, “সিনেমায় নীতিকথার পরিবর্তে আসল সমস্যাটা কী, পারস্পরিক বোঝাপড়ার সেই গল্পটি বলা উচিত।” এক্ষেত্রে আমি সাদা বা কালোর চেয়ে উদার হওয়াটাকে সম্মান করি। আমি বিষয়গুলোকে ধূসর দিক থেকে দেখতে এবং উপেক্ষা বা সন্ধি করতে পছন্দ করি।
এলিফ বেরেকেটলি : কিছুটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন,আমার খুব জানার ইচ্ছে, আপনি প্রচুর সিনেমা দেখেন কিনা? কারণ আমি এমন অনেক পরিচালককে চিনি যারা বেশি সিনেমা না দেখাটাকে গর্বের বলে মনে করেন এবং তারা নিজেদের সিনেমাখোর বলে পরিচয় দেন না। কারণ তারা হয়তো বিশ্বাস করেন যে, অনুশাসনে নিমগ্ন হওয়া খুব বুদ্ধিমানের কাজ। আপনিও কি এমনটা মনে করেন?
কিম কি দুক : আমি সিনেমা বানানো শুরু করেছি প্রায় ২৫ বছর হয়ে গেল। প্রথম সিনেমা বানানোর আগে আমার খুব বেশি সিনেমা দেখার সুযোগ ছিল না। আমার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না, সিনেমা সম্পর্কে তেমন কিছু জানতামও না। কিন্তু যখন ধারাবাহিকভাবে সিনেমা বানাচ্ছি তখন আমি ভাবতে শুরু করি অন্যান্য পরিচালকদের সিনেমাগুলো কেমন হয়? আমার প্রথম সিনেমা বানানোর পাঁচ-ছয় বছর পর আমি অন্য পরিচালকদের পুরনো সিনেমাগুলো দেখি। বিশেষ করে যে সিনেমাগুলো দর্শকদের মাস্টার পিস বলে মনে হয়েছে। তাছাড়া আমি আমার সমসাময়িক পরিচালকের ভালো সিনেমাগুলোও দেখি। এটা আমার নিজের সিনেমাকেও প্রভাবিত করেছে।
এলিফ বেরেকেটলি : আপনি কি দক্ষিণ কোরিয়ার সিনেমার গতানুগতিক ধারা, নাকি নবজাগরণের সাথে যুক্ত?
কিম কি দুক : বলতে পারেন এ বিষয়ে আমি বহুবার ভেবেছি। আমি দক্ষিণ কোরিয়ায় জন্মেছি এবং সেখানেই সিনেমা নির্মাণ করছি। তবে আমাকে দক্ষিণ কোরিয়ার চলচ্চিত্র পরিচালক বলার চেয়ে বরং একজন চলচ্চিত্র পরিচালক বলাই ভালো। কারণ আমার চলচ্চিত্রগুলি অনেক দেশে মুক্তি পায়, তাই আমি কেবল একজন চলচ্চিত্র পরিচালক।
এলিফ বেরেকেটলি : তবে অনেক নির্মাতা আছেন যারা তাদের ধরন, দেশ অথবা তাদের জাতীয়তা দিয়ে পরিচিত। তাই আপনি কি কখনো কখনো বহিরাগত হওয়ার কথা বলে গর্ব করবেন?
কিম কি দুক : আমি অবশ্য এভাবে চিন্তা করি না। আমি অবশ্যই দক্ষিণ কোরিয়ায় জন্মেছিলাম। কিন্তু আমি যেহেতু মানুষের দ্বন্দ্ব ও সমস্যা নিয়ে প্রচুর সিনেমা বানাই, তাই আমি সত্যিই ভাবি না আমার সিনেমাগুলো কেবলমাত্র কোরিয়ায় নির্মিত হয়েছিল বলেই এগুলোকে দক্ষিণ কোরীয় চলচ্চিত্র বলা উচিত। যেহেতু এখন বিশ্বব্যাপী আমাদের সকলের কাছে অনেক তথ্য রয়েছে। আমি মনে করি, আমি এমন একজন পরিচালক যে বিশ্বচলচ্চিত্র নির্মাণ করে চলেছে। সম্প্রতি আমি একটি সিনেমা বানিয়েছি যার নাম “হিউম্যান স্পেস টাইম এন্ড হিউম্যান”। সিনেমাটি এই উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছিল। সিনেমার বিষয় এমন একটি সমস্যা নিয়ে যা এখন সারা পৃথিবীকে ভোগাচ্ছে। এই সমস্যা শুধুমাত্র কোনো দেশের নয়, সমগ্র মানবজাতির। যেমনটি আপনি বলেছেন এটি একটি প্রতিবাদী ধারার চলচ্চিত্র। কেউ বলেছে এটা স্বাভাবিক, কেউ কেউ বলেছিল নিখাদ সুন্দর।
এলিফ বেরেকেটলি : কথা হচ্ছিল সর্বজনীনতা নিয়ে, আপনি কি মার্বেলের মতো সুপারহিরো সিনেমা দেখেন?
কিম কি দুক : আমি একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হলেও আমার কিন্তু একটি প্রোডাকশন কোম্পানি রয়েছে। পরিচালক হলেও একজন প্রোডিউসার হিসেবে আমি সবসময়ই চাই হলভর্তি দর্শক বড় পর্দায় সিনেমা দেখুক। আমার মনে হয় দর্শক কিসে আগ্রহী এই তথ্যটা সংগ্রহ করাটা জরুরি। এজন্যই আমি মার্বেলের মতো অনেক আমেরিকান ও ইউরোপীয় বাণিজ্যিক ঘরানার সিনেমা দেখেছি। একজন নির্মাতা হিসেবে আমার মনে হয় চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে নিজের পছন্দ অপছন্দকে গুরুত্ব না দিয়ে অবশ্যই সিনেমাগুলো দেখা উচিত।
এলিফ বেরেকেটলি : কিন্তু সম্প্রতি সরসিস ও ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা এই ধরনের সিনেমা প্রত্যাখ্যান করেছেন। এমনকি সরসিস এও বলেছেন যে, এগুলো আসলে কোন সিনেমাই নয়। আপনার মতামত কি? আপনি কি মনে করেন এধরনের সুপারহিরো ঘরানার সিনেমা কোন সিনেমার পর্যায়ে পড়ে?
কিম কি দুক : কোন সিনেমা পরিচালকের সিনেমা সম্পর্কে আমি কখনোই যুক্তি-তর্কে যেতে চাই না। যেহেতু পৃথিবীর সব কিছুর বাজার আছে, তেমনি সিনেমারও একটা বাজার গড়ে ওঠা দরকার। সেই বাজারে যদি এ ধরনের সিনেমার চাহিদা থাকে, তাহলে আমি বলব এসব সিনেমা বানানোটা একেবারে স্বাভাবিক ব্যাপার। মার্বেল সিনেমার হিরো হোক, বা সে অন্য যে কোনো সিনেমার হিরো হোক, তারা শিশু বা জনসাধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ এসব সিনেমা দেখে আনন্দ পায়, এ কারণেই আমি এসব সিনেমা ভাল বা খারাপ কোনটাই বলতে পারি না। অন্য দিকে, মানুষ আমার সিনেমা দেখে ভালো খারাপ যা-ই মন্তব্য করুক, আমি সেসব মন্তব্যকে সম্মানের চোখে দেখি। আমি গত পঁচিশ বছর ধরে সিনেমা বানাচ্ছি। প্রতিবছর একটি করে সিনেমা বানানো আমার স্বপ্ন, সেটি স্ক্রিনে দেখানো হোক বা না হোক। চলচ্চিত্র কর্মীদেরও অন্যান্য কর্মীর মতন কাজের মধ্যে থাকতে হয়। অধিকন্তু প্রতিবছর একটি করে সিনেমা বানানো আমার লক্ষ্য। সিনেমা বানানো আর চিত্রনাট্য লেখা আমাকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দেয়। আরো আনন্দ পাই এই ভেবে যে, সেই সিনেমা পৃথিবীর কোথাও কেউ না কেউ দেখছে।
এলিফ বেরেকেটলি : আপনাকে আমাদের অনুষ্ঠানে পাওয়া একটা দারুণ ব্যাপার ছিল। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমাদের মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।
কিম কি দুক : আমি এই চলচ্চিত্র উৎসবে আসতে পেরে অনেক খুশি। আশা করি তুরস্কের এই উৎসব দিন দিন আরও জনপ্রিয় হবে এবং দর্শকরা এখানে প্রদর্শিত চলচ্চিত্রগুলি দেখবে।
Leave feedback about this