শালুক লিটল ম্যাগাজিনটি প্রকাশিত হচ্ছে গত ২৬ বছর ধরে। ২৬ বছরে প্রকাশিত হয়েছে ২৪টি সংখ্যা। ২০২৩-এ এসে শালুক বাংলাদেশের সাহিত্যজগৎকে চমকে দিল আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবের আয়োজন করে। সে উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন চারজন কবি ও লেখক – দুজন বাংলাদেশের, একজন নেপালের, একজন ভারতের। এ উৎসবে ভিসা জটিলতায় পুরস্কার গ্রহণ করার জন্য আসতে পারেননি ভারতের কথাসাহিত্যিক কিন্নর রায়। সেই অসমাপ্ত অংশটুকু সমাপ্ত করতে বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনি। তাকে ঘিরে এবং পুরস্কারপ্রাপ্ত দুজন বাংলাদেশী কবি জিললুর রহমান ও কথাসাহিত্যিক ইমতিয়ার শামীমকে নিয়ে গত ৩১ মে’র শেষ বিকেলে পাঠক সমাবেশের কাটাবন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হলো এক চমৎকার সাহিত্য-আড্ডা।
শালুক সম্পাদক কবি ওবায়েদ আকাশ পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-লেখকদের সমুখের অনুচ্চ মঞ্চে পেতে রাখা কমলারঙের সোফায় বসার আহবান জানালেন। কলকাতা থেকে আসা দুই অতিথি কবি অশোক দে ও কবি পলাশ বর্মনও আসন গ্রহণ করলেন। এ অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা করলেন তিনজন। সম্পাদক ওবায়েদ আকাশ তো ছিলেনই, তিনিই মূখ্য, আর ছিলেন শালুকের দুই সহযোগী সম্পাদক কবি মাহফুজ আল হোসাইন ও কবি ভাগ্যধন বড়ুয়া।
প্রথমেই কিছু বলবার জন্য ডাক পড়লো কবি ভাগ্যধন বড়ুয়ার যিনি কবি জিললুর রহমানের ঘনিষ্ঠ। তাদের আরেকটি মিল হলো তারা দুজনেই চট্টগ্রামের সন্তান, দুজনেই চিকিৎসক, এবং একই মেডিকেল কলেজের ছাত্র। জিললুর রহমান যখন চতুর্থ বর্ষের ছাত্র, ভাগ্যধন বড়ুয়া তখন প্রথম বর্ষে। সিনিয়রের প্রতি তার আকর্ষণ কবিতার সূত্রে আর চকবাজারের একটি রেস্টুরেন্টে আড্ডার কারণে। এ দু’কবির ওই পর্বটি আমার স্বচক্ষে দেখা। তখন আমি কর্মসূত্রে চট্টগ্রামের বাসিন্দা আর আড্ডা দিতে যাই সবুজ হোটেলে। ভাগ্যধন দেখল জিললুর রহমান সকাল-সন্ধ্যা সবুজ হোটেলে আড্ডা দিলেও পরীক্ষার রেজাল্ট করেন চমৎকার! ১৯৯৫ সালের ওই বছরটিতে লিরিক গোষ্ঠীর চার কবি এজাজ ইউসুফী, আহমেদ রায়হান, হাবীব আহসান ও জিললুর রহমানের চারটি কাব্য একত্রে ‘চতুর্ভেদ’ নাম নিয়ে ঢালী আল মামুনের আঁকা প্রচ্ছদে ঝকঝকে হয়ে বেরুয় এবং সাড়া ফেলে। ‘লিরিক’ হলো বাংলাদেশে উত্তরাধুনিকতার প্রথম প্রবক্তা লিটল ম্যাগাজিন। জিললুর রহমান এই ঘরানার কবি।
উত্তরাধুনিকতার মতবাদ বা যে কোনো মতবাদই কবিতার কোনো ক্ষতি করছে কিনা ওবায়েদ আকাশের এমন জিজ্ঞাসায় জিললুর রহমান বললেন, জীবের বৈশিষ্ট্য হলো পরিবর্তন, সুক্ষ্ম পরিবর্তনগুলো চোখে পড়ে না, গুণগত পরিবর্তনগুলো চোখে পড়ে। উত্তরাধুনিকতা একটি চেতনা, বীক্ষা বা দর্শন। আধুনিক বা অধুনা সর্বদাই গতিশীল। উত্তরাধুনিকতা নতুন আলো দেখায়। এটি আসলে একটি নব্য মার্ক্সবাদী দর্শন।
কিন্নর রায়কে প্রশ্ন করার জন্য ওবায়েদ আকাশ মঞ্চে ডাকলেন কবি শামীম রেজাকে। কিছুটা লাজুক স্বভাবের এই কবির কাছ থেকে কিন্নর রায়ের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠার ইতিবৃত্ত আমরা জানতে পারলাম। ২০০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের ছয়জন লেখক, কথাসাহিত্যিক তারা সকলেই, একজনও কবি নন, বাংলাদেশে এসেছিলেন। এরা হলেন সাধন চট্টোপাধ্যায়, ভগীরথ মিশ্র, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, আফসার আহমেদ, তপন বন্দোপাধ্যায় ও কিন্নর রায়। সেই থেকে শামীম রেজা এই লেখকদের সাথে পরিচিত যে পরিচয় ক্রমশ ঘনিষ্ঠতায় রূপলাভ করেছে।
স্পষ্টভাষী বা ঠোঁটকাটা বলে নাম কিংবা দুর্নাম আছে কথাসাহিত্যিক কিন্নর রায়ের। তরুণ বয়সে তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন নকশালবাড়ি আন্দোলনে, চেতনায় এখনো ধারণ করেন বাম মতাদর্শ, তার ব্যক্তিত্বে রয়েছে মাথা-না-নোয়ানো এবং সত্য কথা বলার সাহস। তিনি বললেন, নিজের সঙ্গে বোঝাপড়াটা সবচেয়ে জরুরি, প্রতিদিন নিজের মুখোমুখি হয়ে নিজেকেই জিজ্ঞেস করতে হবে- আমি দালাল কিনা, আমি আত্মবিক্রিত কিনা? আজীবন প্রতিষ্ঠানবিরোধী এই বিপ্লবী ঘৃণা করেন আপোষকামীতা ও সুযোগসন্ধানী মনোভাব। তিনি বললেন, কোনো প্রকৃত কবি বা লেখক রাষ্ট্রযন্ত্রের পক্ষে গিয়ে দাঁড়াতে পারে না। দাঁড়ালে সে আর কবি বা লেখক থাকে না, হয়ে যায় দালাল।
নকশাল আন্দোলনে যোগ দিয়ে কিন্নর রায় পাঁচ বছর জেল খেটেছেন, পুলিশের হাতে ধরা পড়া এড়াতে ফেরারী ছিলেন বহুবার, মৃত্যুর খুব নিকট থেকে বেরিয়ে এসেছেন- তার জীবনপঞ্জি এমনি অনেক বিপদঠাসা, রোমহষর্ক ঘটনায় পূর্ণ। অসীমসাহসী মানুষটি তার জীবনের, যা তৎকালীন কলকাতার রাজনৈতিক চিত্র তুলে ধরে, শ্রোতাদের সাথে শেয়ার করলেন। সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের বিরল অভিজ্ঞতাগুলো তিনি সন্নিবেশিত করেন উপন্যাস ও ছোটগল্পে।
কথাসাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত ইমতিয়ার শামীম একজন নিভৃতচারী, বিনয়ী মানুষ। তার সম্পর্কে উচ্চারিত ওবায়েদ আকাশের প্রশংসাধর্মী বিশেষণগুলো তাকে আনন্দিত করার চেয়ে হয়তো বিব্রতই করল বেশি। তিনি শুরু করলেন কিছুটা অপ্রতিভভাবে, কিন্তু সময় যতই গড়াল তার আলোচনা ততই বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করল আর হয়ে উঠল আকর্ষণীয়। তিনি কথা বলেন শান্তস্বরে। বল্লেন, তবু ভালো অজানা কথা বলতে হবে, গোপন কথা নয়।
কথাসাহিত্যিক কাজী রাফির অভিমত হলো ইদানিং উপন্যাসসমূহ প্রতিবেদনধর্মী হয়ে যাচ্ছে, সেগুলো তথ্যভারাক্রান্ত। আগে পাঠক জানত পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন হলো সত্য আর ফিকশন হলো কল্পনা বা মিথ্যা। এখন হয়েছে উল্টো। পত্রিকা মিথ্যা ছাপায় আর যেটুকু সত্য বলা সম্ভব তা বলে ফিকশন। ইমতিয়ার শামীম বললেন, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস নিজেই বলেছেন সাংবাদিক ছিলেন বলেই তিনি বড়ো লেখক হতে পেরেছেন। তিনি বাস্তবের প্রতিবেদনকে জাদুবাস্তবতার ফিকশন বানাতেন। বাকস্বাধীনতা প্রসঙ্গে শামীম বললেন, যা বলতে চাই তা বলতে পারি না, ৯৯ ভাগ সময়েই ব্যর্থ হই। যে অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে আমরা যাই না, সে বিষয় নিয়ে লেখা কঠিন। ট্রমার মধ্য দিয়ে না গেলে প্রকৃত লেখা হয় না। অনেক লেখক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে স্টোরি বেছে নেন, এর সাথে আরও কিছু যোগ করেন। কিন্তু লেখা তো উপলব্ধির ব্যাপার। তিনি উপন্যাসে চরিত্র সৃষ্টির উপর জোর দিলেন। বললেন চরিত্র সৃষ্টি হয় না, কেননা আমরা চরিত্রগুলোর জীবনযাপন করি না। তিনি বললেন কোথায় থামতে হবে সেটাই মুন্সীয়ানা, কেননা লেখা প্রায়শই মাত্রা ছাড়া হয়ে উঠতে চায়।
কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদারের এক জিজ্ঞাসা ছিল একদা বাসদ থেকে ডাকসু নির্বাচন করা ইমতিয়ার শামীম এখনো মার্ক্সবাদে বিশ্বাস করেন কিনা, কারণ বহুকাল তার জীবনাচরণে ও ভূমিকায় মার্ক্সবাদের প্রভাব দেখা যায়নি। এর জবাবে ইমতিয়ার শামীম একটি বিখ্যাত উদ্বৃতি টানলেন, “If you’re not a communist at the age of 20, you haven’t got a heart. If you are still a communist at the age of 30, you haven’t got a brain.” বেশিরভাগ মার্ক্সবাদী মনে হয় এই কথা মেনে চলেছেন, ইমতিয়ার শামীমও ব্যতিক্রম নন। ইমতিয়ার শামীম বললেন মার্ক্সবাদী দর্শনই শ্রেষ্ঠ দর্শন, এর বিকল্প দাঁড়ায়নি। পলাশ বর্মনের এই প্রথম বাংলাদেশে আসা। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস দেখে তার মনে হয়েছে বিশ্বভারতী নিয়ে রবীন্দ্রনাথের যে কল্পনা ছিল এটা যেন তাই।
শালুক কী মানদণ্ডের ভিত্তিতে বা কোন নীতিমালা অনুসরণ করে পুরস্কার দেয় – জাকির তালুকদারের এমনি একটি প্রশ্নের ব্যাখ্যা দিতে মঞ্চে এলেন মাহফুজ আল হোসাইন। তিনি বললেন, শালুক যেসব মানদণ্ডের ভিত্তিতে পুরস্কার দেয় তা হলো সাহিত্যকর্ম হবে ব্যতিক্রমী, শিল্পসমৃদ্ধ, মৌলিক ও প্রভাবসঞ্চারী। জনপ্রিয়তা, প্রতিষ্ঠা, বইয়ের সংখ্যা, পুরস্কারপ্রাপ্তি বিবেচনা করা হয় না। অধুনাবাদ সম্পর্কে তিনি বললেন, এটা কেনো মতবাদ, ইজম বা সাহিত্য তত্ত্ব নয়। এটা এখনো নিরীক্ষার মধ্যে রয়েছে।
কথাসাহিত্যিক মোহিত কামাল সম্প্রতি কলকাতায় তার সম্পাদিত পত্রিকা ‘শব্দঘর’-এর ব্যানারে একটি সাহিত্য সভার আয়োজন করেছিলেন। সেখানে জড়ো হয়েছিলেন কলকাতার ২৫ জন গুরুত্বপূর্ণ লেখক। তিনি বললেন, সীমান্তহীন উৎসব হোক দু’বাংলায়। তিনি শালুকের প্রতি তার মুগ্ধতা প্রকাশ করলেন। আনেয়ারা সৈয়দ হক বললেন, মোহিত কামাল একজন মনোচিকিৎসক, সে রোগিদের কাছে নেতিবাচক কথাই বেশি শোনে। তাই তার কথা ইতিবাচক। অতঃপর তার উক্তি, আমিও একজন মনোচিকিৎসক।’ তিনি বললেন, ‘যত সাহিত্যই করি না কেন, সত্য কথা বলতে পারি না।’ তিনি একটি মূল্যবান কথা বললেন। মানুষ যখন আদিম ও নগ্ন ছিল তখনই সে অবিকৃত সত্যের ধারক ছিল। যখন থেকে সে পোষাক পরতে শুরু করল তখন থেকে তার লুকোছাপা, আড়াল ও মুখোশ পরা। বললেন, ‘Life is full of pretentions’। সভ্যতার শুরু হয়েছে মিথ্যে দিয়ে।
শালুকের এ অনুষ্ঠানে তিনি এসেছেন কবি শামীম আজাদকে খুঁজতে। সে সময়ে মঞ্চে এসে তার পাশে বসেছিলেন শামীম রেজা। শামীম আজাদকে ষাটের দশকের কবি বলায় নাটকীয় ভঙ্গিতে বললেন, আমি সত্তরের। তার প্রথম কাব্য প্রকাশিত হয় আশির দশকে। তাই মজা করে বললেন, ‘ভাই রে, আমি আশির দশকের।’ কবি ওবায়েদ আকাশ বললেন, শামীম আজাদকে এমনকি দ্বিতীয় দশকের কবি বলেও চালিয়ে দেওয়া যায়।
অনুষ্ঠানের সময় ফুরিয়ে আসছিল। ওবায়েদ আকাশ বিভিন্নজনকে সংক্ষিপ্ত আকারে প্রতিক্রিয়া প্রকাশের জন্য ডাকছিলেন। নির্ধারণ করে দেওয়া সময় ছিল এক মিনিট করে, কিন্তু লাজুকরা ব্যতীত কেউই এক মিনিটে কথা শেষ করছিলেন না। আমারও ডাক পড়লে আমি আমার সাম্প্রতিক লেখালেখি ভ্রমণকাহিনী, যাপিত জীবনের গদ্য, সাহিত্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিয়ে লেখার কথা বললাম। এগুলো প্রতিবেদনধর্মী হলেও আমি যেহেতু মূলত কবি, আমার লেখা সাংবাদিকদের মতো নীরস হয় না, কবিত্বময় হয়ে ওঠে। আমি প্রচুর লেখি আর লিখি ডিটেইলসে। এখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমার কদর বেড়ে গেছে, কেননা আয়োজকরা জানে কামরুল হাসান গেলে একটা প্রতিবেদন তৈরি হবে। অবশ্য আমাকে অনেক শুভানুধ্যায়ী বলেন, আমি সময় নষ্ট করছি, আমার ফিকশন লেখা উচিত। এখন ননফিকশন লেখছি কেননা এই লেখাটা আমার ভালো লাগছে।
অনুষ্ঠানের শেষ বক্তা ছিলেন কবি ও প্রাবন্ধিক মাসুদুজ্জামান। তিনি ওবায়দ আকাশ ও শালুকের প্রশংসা করে বললেন শালুক আর লিটল নেই, এটি হয়ে উঠেছে এক মহীরুহ। জীবনানন্দ দাশ, শহীদ কাদরী, আবুল হাসান, সিকদার আমিনুল হক – যে-কবিদেরকে আমরা আধুনিকতার আইকন বলে মনে করি, শালুক তাঁদের নিয়ে ঢাউস সংখ্যা বের করেছে। জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে শালুকের কাজ অসামান্য। মাসুদুজ্জামান শালুক আয়োজিত আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবের প্রশংসা করে বললেন, একমাত্র শালুকের পক্ষেই এ কাজটি করা সম্ভব ছিল। শালুক তা করে দেখালও। নব্বই দশকের কবিতার নেতৃত্ব দিচ্ছে ওবায়েদ আকাশ মাসুদুজ্জামানের এ কথার মৃদু প্রতিবাদ করে ওবায়েদ আকাশ বললেন, ‘আমি মিছিলে থাকতে চাই।
একটি আন্তর্জাতিক বড় সাহিত্য সম্মিলন, এরপর তারই ধারাবাহিকতায় এই প্রাণবন্ত আয়োজন নিঃসন্দেহে অনেক দিন মনে থাকবে উপস্থিত কবি, লেখক ও পাঠকদের।
Leave feedback about this