তীরন্দাজ Blog বিশ্বসাহিত্য মিলান কুন্ডেরার সঙ্গে ফিলিপ রথ | বঙ্গানুবাদ আসিফ মাহমুদ
বিশ্বসাহিত্য সাক্ষাৎকার

মিলান কুন্ডেরার সঙ্গে ফিলিপ রথ | বঙ্গানুবাদ আসিফ মাহমুদ

প্রখ্যাত মার্কিন ঔপন্যাসিক ফিলিপ রথ এবং চেক ঔপন্যাসিক মিলান কুন্ডেরার মধ্যে দুবার কথোপকথন হয়েছিল। এই কথোপকথটি তার একটি। রথ কুন্ডেরার Book of Laughter and Forgetting বইটির অনূদিত পাণ্ডুলিপি পড়ার পরে প্রথম কথোপকথনটি হয়। কুন্ডেরা তখন লন্ডনে এসেছিলেন। অন্যটি ঘটে তাঁর প্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের সময়। তখন কুন্ডেরা সস্ত্রীক বসবাস করছিলেন ফ্রান্সের প্যারিতে। শিক্ষকতা করতেন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কথোপকথনের সময় কুন্ডেরা মাঝেমধ্যে ফরাসি ভাষা ব্যবহার করেছেন। কিন্তু বেশিরভাগ সময় তিনি চেক ভাষায় কথা বলেছেন, এবং তাঁর স্ত্রী ভেরা তাঁর কথাগুলো দোভাষী হিসেবে অনুবাদ করে দিয়েছেন।

>> ফিলিপ রথ : আপনি কি মনে করেন খুব দ্রুত আমাদের পৃথিবী ধ্বংস হতে চলেছে?
> মিলান কুন্ডেরা : এটা নির্ভর করছে ‘দ্রুত’ ব্যাপারটাকে আপনি কী অর্থে ব্যবহার করবেন তার উপর। ধরা যাক, এই দ্রুত বলতে বোঝাচ্ছি ‘কাল’ বা ‘পরশু’। পৃথিবী ধ্বংস হতে চলছে এই ধারণাটি অতি প্রাচীন।

>> তাহলে আমাদের চিন্তার কিছু নেই?
> বলা যায়, মানুষের মনে যখন এ ব্যাপারে যুগ যুগ ধরে একটা ভয় সঞ্চারিত হয়ে আছে, তার মানে এর কোনো একটা অর্থ আছে।

>> যাই হোক, আমার মনে হয় এই চিন্তাটাই আপনার সাম্প্রতিক বইয়ের গল্পগুলির মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে।
> কেউ যদি আমাকে বালকের মতো বলে, একদিন দেখবে তোমার দেশটা পৃথিবী থেকে অন্তর্হিত হয়ে গেছে, আমি সেটাকে পাগলামি বলেই মনে করব। এটা আমি কখনো কল্পনাই করতে পারি না। মানুষ জানে যে সে মরণশীল, কিন্তু সে এটা ধরে নেয় তার দেশের একটা অবিনশ্বর সত্তা আছে। কিন্তু ১৯৬৮ সালে রুশ আক্রমণের পর চেকদের মনে একটা ধারণা জন্মেছিল যে তাদের দেশ ইউরোপ থেকে মুছে যেতে পারে, যেমন গত পাঁচ দশক ধরে ৪০ মিলিয়ন ইউক্রেনীয় সমস্ত পৃথিবীর অগোচরে দুনিয়া থেকে মুছে যাচ্ছে। অথবা লিথুয়ানিয়ানদের মতো। আপনি কি জানেন সপ্তদশ শতাব্দীতে লিথুয়ানিয়া এক শক্তিশালী ইউরোপীয় দেশ ছিল? আজ রুশরা তাদের এক অর্ধলুপ্ত আদিবাসী হিসেবে সংরক্ষিত করে রেখেছে। তাদের দর্শকদের কাছ থেকে দূরে রাখা হয় যাতে তাদের খবর বাইরে না যায়। আমার দেশের ভবিষ্যৎ কী, আমি জানি না। এটা নিশ্চিত যে রুশেরা সবরকম চেষ্টা করবে তাদের সভ্যতার সঙ্গে একে মিশিয়ে ফেলতে। তারা সফল হবে কিনা তা অনিশ্চিত, কিন্তু সম্ভাবনা অবশ্যই আছে। এই সম্ভাবনা যে বর্তমান, এই উপলব্ধিই একজনের জীবন সম্পর্কে ধারণা বদলে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। এখন তো আমার মনে হয় ইউরোপও একইভাবে ভঙ্গুর ও মরণশীল।

>> এটা ছাড়াও কি পশ্চিম ও পূর্ব ইউরোপের ভাগ্যের মধ্যে মূলগত পার্থক্য নেই?
> প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী পূর্ব ইউরোপ হল রাশিয়া, যার শিকড় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে প্রোথিত। বোহেমিয়া, পোল্যান্ড বা হাঙ্গেরি অস্ট্রিয়ার মতোই কখনোই পূর্ব ইউরোপের অংশ ছিল না। শুরু থেকেই তারা পশ্চিম ইউরোপের নবজাগরণ, ধর্মবিপ্লব ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করেছে যার মূল শিকড়িত হয়ে আছে এই অঞ্চলেই। এখানেই আধুনিক সভ্যতা তার সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্যগুলি খুঁজে পেয়েছে। যেমন মনস্তত্ত্ব, বস্তুবাদ, ডোডেকাফোনি, বর্তুকের সঙ্গীত, কাফকা এবং মুসিলের রচনার সৌন্দর্য। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে রাশিয়ার দ্বারা মধ্য ইউরোপের (বা তার বেশিরভাগ অংশের) ধ্বংসের পর পাশ্চাত্য সংস্কৃতি তার মূলটি হারিয়ে ফেলে। এটাই এই শতাব্দীর পাশ্চাত্য ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। একে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না যে মধ্য ইউরোপের ধ্বংসের মধ্য দিয়েই সমগ্র ইউরোপের ধ্বংসের শুরু।

>> প্রাহা বসন্ত (Parague Spring)-এর সময় আপনার উপন্যাস The Joke এবং গল্পসংকলন Laughable Loves-এর প্রায় দেড় লাখ কপি প্রকাশিত হয়েছিল। রুশ আক্রমণের পর আপনি চলচ্চিত্র অ্যাডেমিতে শিক্ষকতা থেকে অপসারিত হন এবং আপনার সমস্ত বই গ্রন্থাগার থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। সাত বছর পরে আপনি সন্ত্রীক কিছু বই ও জামাকাপড় নিয়ে ফ্রান্সে চলে আসেন এবং আপনিই সেখানকার সবচেয়ে বহুলপঠিত বিদেশি লেখক বলে পরিগণিত হলেন। একজন প্রবাসী হিসেবে আপনার কেমন লাগে?
> একজন লেখকের পক্ষে অনেক দেশে বাস করা হল আশীর্বাদস্বরূপ। বিভিন্ন দিক থেকে দেখলে তবেই পৃথিবীকে বুঝতে পারা যায়। আমার সাম্প্রতিকতম গ্রন্থ ফ্রান্সে প্রকাশিত হয়েছে এক বিশেষ পটভূমিতে। যে ঘটনাগুলি প্রাহায় ঘটছে সেগুলি পশ্চিম ইউরোপীয় দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে এবং যেগুলি ফ্রান্সে ঘটছে সেগুলি প্রাহার দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে। একদিকে আমার দেশ, যেখানে মাত্র অর্ধশতাব্দীর মধ্যে গণতন্ত্র, ফ্যাশিজম বিপ্লব, স্তালিনীয় সন্ত্রাস ও স্তালিনবাদের বিনাশ, জার্মান এবং রুশ দখলদারিত্ব, গণ-দেশান্তরকরণ, নিজের দেশে পশ্চিমের মৃত্যু – সবই দেখেছে। দেশটি তাই ইতিহাসের গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে এবং পৃথিবীর দিকে গভীর সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। অন্যদিকে বহু শতাব্দী ধরে ফ্রান্স, যে দেশটি পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু ছিল, তা ঐতিহাসিক ঘটনার অভাববোধে ভুগছে। এ কারণেই সে মূলগত আদর্শবাদের মাধ্যমে বিপ্লব ঘটাচ্ছে। এটি নিজের ভালো কাজ সম্বন্ধে একধরনের অবান্তর প্রত্যাশা যা কখনো ঘটেনি ও ঘটবেও না।

>> আপনি কি ফ্রান্সে একজন বিদেশি হিসেবে বাস করছেন? আপনি সাংস্কৃতিকভাবে এখানে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন?
> আমি ভীষণভাবে ফরাসি সংস্কৃতির অনুরাগী এবং আমি এর কাছে কৃতজ্ঞ। র্যা বেলেই আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখক। এবং আমি দিদেরোর জাক দে ফ্যাতালিস্তে এবং লরেন্স স্টার্নেরও ভক্ত। এগুলি উপন্যাসের আকারে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গবেষণা। তাদের গবেষণাগুলি হাসি ও আনন্দে ভরা, যা এখন ফরাসি সাহিত্য থেকে অন্তর্হিত আর যার অভাবে শিল্প তার বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে। স্টার্ন ও দিদেরো উপন্যাসকে খেলা হিসেবে গণ্য করতেন। তাঁরা উপন্যাসের হাস্যরসকে আবিষ্কার করেন। যখন আমি এরকম প্রাজ্ঞ মতামত শুনি যে উপন্যাস তার সম্ভাবনা হারিয়ে ফেলেছে – বস্তুত সেটা নয়, এ সম্পর্কে আমার বিপরীত ধারণাই হয়। ইতিহাসের বিবর্তনে উপন্যাস তার অনেক সম্ভাবনা হারিয়ে ফেলেছে। যেমন দিদেরো ও স্টার্নের লেখা থেকে উপন্যাসের উন্নততর হবার যে সম্ভাবনা ছিল, তা কোনো যোগ্য উত্তরসূরী পায়নি।

>> আপনার সাম্প্রতিকতম গ্রন্থটিকে উপন্যাস বলা যায় না। যদিও আপনি এখানে উল্লেখ করেছেন যে এটি একটি উপন্যাস। এতে বৈচিত্র্য অনেক বেশি। তাহলে এটাকে কি উপন্যাস বলা যাবে?
> নান্দনিক বিচারে এটি একটি উপন্যাস, কিন্তু আমি এই ধারণাটি কারও উপর আরোপ করতে চাই না। একটি উপন্যাসের মধ্যে স্বাধীনতার নানান অনুষঙ্গ লুকিয়ে থাকে। বাঁধাধরা কোনো ছক বা আকারকে উপন্যাসের মূল সুর বলে মনে করলে ভুল হবে।

>> কিন্তু কিছু নিশ্চয়ই এই স্বাধীনতাকে খর্ব করে, এবং একটি উপন্যাসকে উপন্যাস করে তোলে?
> উপন্যাস একটি লম্বা গদ্য। এটি আবিষ্কৃত চরিত্রের উপর নির্ভরশীল। এর একমাত্র সীমাবদ্ধতা সিনথেটিক কথার মাধ্যমে একজন ঔপন্যাসিক তাঁর বিষয়টিকে সমস্ত দিক থেকে ধরবার যে চেষ্টা করে থাকেন, সেটাই বোঝানো হয়েছে। একটি উপন্যাসের সিনথেটিক পাওয়ার হলো তার ব্যঙ্গাত্মক দিকটি। উপন্যাস আত্মজীবনীমূলক রচনা, ঐতিহাসিক তথ্য বা কল্পনাধর্মী আখ্যান – সব কিছুকে এক জায়গায় নিয়ে আসে। ঠিক বহুস্বরিক সংগীতের (polyphonic music)-এর মতো। একটি গ্রন্থের প্রয়োজনীয়তার উৎপত্তি তার মূল প্রতিপাদ্য বা থিম থেকে, বিষয়বস্তু থেকে নয়। আমার সাম্প্রতিক গ্রন্থে সেরকম দুটো মূল প্রতিপাদ্য বা থিম আছে। হাস্যরসও ভুলে যাওয়া যায়।

>> হাস্যরস চিরকালই আপনার প্রিয় বস্তু। আপনার গ্রন্থে ব্যঙ্গ বা হিউমারের মাধ্যমে হাস্যরস পরিবেশিত হয়। আপনার চরিত্রগুলি তখনই দুঃখকাতরতা অনুভব করে যখন তারা এমন জগতের সম্মুখীন হয় যেখানে তারা তাদের সেন্স অব হিউমারকে হারিয়ে ফেলে।
>> আমি স্তালিনীয় সন্ত্রাসের সময় হাস্যরসের গুরুত্ব বুঝতে পারি। আমি একজন স্তালিন নয় এমন ব্যক্তিকে চিনতে পারি, যাকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই – তার হাস্যরসের জন্যে। হাস্যরসের ক্ষমতা একধরনের বিশ্বাসযোগ্য স্বীকৃতি। সেই সময় থেকেই আমি হাস্যরস-বর্জিত জগৎকে ভয় পেতে থাকি।

>> আপনার সাম্প্রতিক গ্রন্থে অন্য একটি বিষয় আলোচিত হয়েছে। একটি ছোটো অনুচ্ছেদে আপনি দেবতার হাসির সঙ্গে শয়তানের হাসির তুলনা করেছেন। শয়তান হাসে কারণ ঈশ্বরের পৃথিবী তার কাছে অর্থহীন মনে হয় এবং দেবতা হাসেন কারণ ঈশ্বরের পৃথিবী তাঁর কাছে অর্থপূর্ণ মনে হয়।
> মানুষ এই হাস্যরসের মাধ্যমেই দু-ধরনের মানসিক ভাবকে প্রকাশ করে। কখনো মাথার টুপি হয়তো কোনো কবরের উপর পড়ে যায় এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া তার অর্থ হারিয়ে ফেলে ও হাস্যরসের জন্ম হয়। প্রেমিক-প্রেমিকা মাঠের মধ্যে দিয়ে ছুটে যায় হাসতে হাসতে। তার মধ্যে হয়তো কোনো কৌতুক বা রস নেই, এটি সেই দেবতাদের হাসির মতো। তাদের অস্তিত্বের আনন্দ থেকে উদ্ভূত। দু-ধরনের হাস্যরসই জীবনবোধ থেকে আসে। মানুষের জীবনবোধ দু-ধরনের, একদিকে গোঁড়ামি, অন্য দিকে সেই সংশয়। যখন তারা তাদের গোঁড়ামির জন্য সবকিছুকে বলি দিতে প্রস্তুত অথবা সেই মনোভাব যার জন্য তার কাছে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াও হাস্যকর বলে মনে হয়, বা যৌনতাকেও হাস্যকর মনে হয়।

>> যাকে আপনি এখন দেবতার হাসি বলছেন, তাকে আপনি জীবনের লিরিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি বলে আপনার আগের রচনায় অভিহিত করেছিলেন। আপনার একটি গ্রন্থে আপনি স্তালিনীয় সন্ত্রাসের যুগকে ফেঁসে যাওয়া মানুষ আর কবিদের যুগ বলেছেন।
> সম্পূর্ণতা শুধুমাত্র নরক নয়, স্বর্গের স্বপ্নও বটে। পৃথিবীর সেই পুরাতন নাটক যেখানে সকলে পরস্পরকে বিশ্বাস করবে, কারও কাছে কিছু গোপন করবে না। আঁদ্রে ব্রেতও এই স্বর্গের কথা বলেছিলেন যখন তিনি একটি কাচের ঘরে থাকতে চেয়েছিলেন। যদি ওই সব বস্তু, যা আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে আছে তাকে এক্সপ্লয়েট না করত, তাহলে এত মানুষ এতে আকৃষ্ট হত না, বিশেষত তার অস্তিত্বের শুরুতে। যখন স্বর্গের স্বপ্ন সত্য হতে শুরু করে তখন অনেক ক্ষেত্রে মানুষ তার পথ রুদ্ধ করে দেয়। তাই এই স্বর্গের স্রষ্টার ইডেনের পাশে একটি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প তৈরি করা উচিত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ক্যাম্পটি বড়ো হতে থাকে আর স্বর্গ হতে থাকে ছোট।

>> আপনার বইতে ফরাসি কবি এদুয়ার্দ এই বন্দীশালা ও স্বৰ্গকে অতিক্রম করে গেছে। এই ইতিহাসটা কি প্রামাণিক?
> যুদ্ধের পর পল এলুয়ার তার পরাবাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করেছিলেন ও কবিতার স্বার্বভৌমত্বের মূল প্রবক্তা হয়ে উঠেছিলেন। তিনি ভ্রাতৃত্ব, শান্তি, ন্যায়বিচার ইত্যাদির জয়গান গেয়েছিলেন। তিনি ভেদাভেদের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন। আনন্দ ও সারলোর জয়গান করেছিলেন। ১৯৫০ সালে যখন এই স্বর্গের প্রবক্তারা এলুয়ারের প্রাহার বন্ধু জালভিস কালান্দ্রাকে মৃত্যুদণ্ড দিল, এলুয়ার তাঁর অতুচ্চ আদর্শের জন্য বন্ধুর প্রতি আনুগত্যের বিষয়টি ভুলে গিয়েছিলেন ও তাঁর মৃত্যুদণ্ডকে সমর্থন করেছিলেন। তিনি গান গাইছিলেন যখন বন্ধুর ফাঁসি হয়। এবং শুধু কবি নয়, সমগ্র স্তালিনীয় সন্ত্রাসের যুগটি ছিল এক বিকারের যুগ। এটি মানুষ ভুলে গেলেও এই বিকারের কথা ভোলেনি। মানুষ বলতে চায় যে বিপ্লব সুন্দর। কিন্তু তার মধ্যে যে সন্ত্রাস লুকিয়ে থাকে, সেটাই অশুভ। কিন্তু এটি সত্য নয়। শুভের মধ্যেই অশুভ লুকিয়ে থাকে, স্বর্গের মধ্যেই নরকের অস্তিত্ব। যদি আমরা নরককে বুঝতে চাই, তবে আমাদের স্বর্গকে বুঝতে হবে, যা থেকে সে উদ্ভূত। বন্দিশিবিরকে ত্যাগ করা সহজ, কিন্তু সামগ্রিকভাবে কবিত্বশক্তি যার পরিণতিমাত্র, তাকে ত্যাগ করা কঠিন। এখন মানুষ বন্দিত্বকে স্বীকার করে না। তারা সঙ্গীতের মতোই সামগ্রিক কবিত্বের দ্বারা সম্মোহিত হতে চায়।

>> আপনার গদ্যের বিশেষত্ব ব্যক্তিগত ও সমষ্টির সংঘাত, কিন্তু সেই অর্থে নয় যে, ব্যক্তিগত কাহিনি রাজনৈতিক পটভূমিতে রচিত। বরঞ্চ আপনি বলতে চেয়েছেন, রাজনৈতিক ঘটনাবলী ব্যক্তিজীবনের ঘটনার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়, তাই বলা যায় আপনার রচনা রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বের বিশ্লেষণ।
> মানুষের অধিবিদ্যা ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে একই। এই বইয়ের আর একটি বিষয়কে ধরা যাক। ‘বিস্মৃতি’—এটি মানুষের একটি বহুল প্রচলিত সমস্যা। মৃত্যু হল এক ধরনের আত্মবিস্মৃতি কিন্তু এই ‘আত্ম’ বলতে কী বোঝায়? তাই মৃত্যু সম্বন্ধে আমাদের এই ভীতির কারণ এই বিস্মৃতি যা আমাদের জীবনের মধ্যে নিহিত। আমার নায়িকার এটাই সমস্যা। সে তার মৃত স্বামীর স্মৃতি আঁকড়ে ধরতে চায়। কিন্তু বিস্মৃতি রাজনীতিরও একটি সমস্যা। যখন কোনো বৃহৎ শক্তি কোনো ক্ষুদ্র দেশের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে চায়, তখন সে তার পরিকল্পিত বিস্মৃতির নীতিটি গ্রহণ করে, যা এখন বোহেমিয়ায় ঘটছে। সমকালীন চেক সাহিত্য গত ১২ বছরে প্রকাশিত হয়নি। দুশো চেক লেখককে চিহ্নিত করা হয়েছে, কাফকাসহ এবং ১৪৫ জন চেক ঐতিহাসিককে বহিষ্কার করা হয়েছে। ইতিহাস নতুন করে লেখা হয়েছে, সৌধ ধ্বংস হয়েছে। যে জাতি তার অতীতকে ভুলে যায়, সে নিজেকে ভুলে যায়। তাই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আমাদের এই দৈনন্দিন জীবনের ভুলে যাওয়াকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। রাজনীতি ব্যক্তিগত জীবনকে প্রকাশ করে, ব্যক্তিগত জীবন রাজনীতিকে প্রকাশ করে।

>> আপনার বইয়ের ষষ্ঠ অংশে মূল নায়িকা তামিনা একটি দ্বীপে আসে যেখানে শুধু শিশুরা থাকে। শেষে তারা তাকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়। এটি কি স্বপ্ন, না রূপকথা, না রূপক?
> রূপক। অর্থাৎ এ হলো সেই গল্প যা লেখক তৈরি করেন, কোনো একটি বিষয়কে উপস্থাপিত করার জন্য। এটি আমার কাছে একেবারেই অপরিচিত। যে-কোনো ঘটনা, সে কাল্পনিকই হোক বা বাস্তব, এমন হওয়া উচিত, যাতে পাঠক তার বলিষ্ঠতা বা কবিত্বশক্তির দ্বারা প্রভাবিত হয়। আমি বরাবরই এর দ্বারা তাড়িত হয়েছি, এবং একসময় আমি স্বপ্নে দেখতাম যে এক ব্যক্তি শিশুদের পৃথিবীতে চলে এসেছে, যেখান থেকে সে পালাতে পারে না। তখন শৈশব, যা আমাদের অতি প্রিয় বস্তু, তা যেন ভীতিপ্রদ হয়ে ওঠে। জালের মতো। এটি রূপক নয়। বহুস্বর (Polyphony), যেখানে অনেক গল্প পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। বইটির মূল ঘটনা সামগ্রিকতা, যেটি মানুষকে স্মৃতি থেকে বঞ্চিত করে এবং তাদের একটি শিশুরাজ্যে পৌঁছে দেয়। আমাদের বর্তমান প্রযুক্তির যুগে এটাই ঘটে, যেখানে আছে অবিশ্বাস ও অতীতকে অবজ্ঞা করার মতো বিষয়আশয়। একটি শিশুকেন্দ্রিক সমাজে একজন মস্তিষ্কসম্পন্ন মানুষ। ঠিক তামিনা যেমন শিশুদের দ্বীপে অনুভব করেছিল, সেরকমই অনুভব করে।

>> আপনার প্রতিটি উপন্যাসই, বিশেষত আপনার সাম্প্রতিক গ্রন্থের সব অংশই যৌন-ঘটনার মাধ্যমে শেষ হয়েছে। এমনকি মা নামের পরিচ্ছেদটিও একটি ত্রিমুখী যৌনক্রিয়ার মাধ্যমে শেষ হয়েছে। ঔপন্যাসিক হিসেবে যৌনক্রিয়া সম্বন্ধে আপনার কি মত?
> আজকের যুগে যখন যৌনতা কোনো নিষিদ্ধ বস্তু নয়, তখন তার বর্ণনা বা স্বীকারোক্তির ব্যাপারটি খুবই বৈচিত্র্যহীন একটা ব্যাপার, তা সত্ত্বেও জর্জ বাতালিকের George Batalic-র কিছু রচনা আমাকে প্রভাবিত করেছে। হয়তো সেগুলো কাব্যিক (lyrical) নয়, কিন্তু দার্শনিক, এই কারণে। আপনি ঠিকই বলেছেন, আমার অধিকাংশ রচনাই যৌনতার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। আমার মনে হয় শারীরিক সম্পর্ক মানুষের চরিত্রের অনেক দিককে ফুটিয়ে তোলে। তামিনার সঙ্গে উগো শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়, কিন্তু তামিনা তার মৃত স্বামীর সঙ্গে হারানো মুহূর্তগুলো ভাববার চেষ্টা করে। এই যৌনদৃশ্যেই গল্পের সমস্ত মূল ভাব প্রকাশিত হয়েছে ও তার গভীরতম সত্যটি এখানে নিহিত।

>> শেষ, অর্থাৎ সপ্তম অংশটিতে শুধুমাত্র যৌনতার কথাই বলা হয়েছে। এই অংশটি দিয়ে বইটি শেষ না হয়ে ষষ্ঠ অংশে যে তামিনার মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে তা দিয়ে শেষ হল না কেন?
> তামিনার মৃত্যু রূপকার্থে দেবদূতদের হাসির মধ্যে ঘটে। শেষাংশে সেই বিপরীতার্থক হাস্যরস পাওয়া যায় যখন কোনো বস্তু তার অর্থ হারিয়ে ফেলে। এখানে একটি কাল্পনিক দেখা বর্তমান, যার অপরদিকে সবকিছুই অর্থহীন ও হাস্যকর। মানুষ নিজেকে প্রশ্ন করে। সকালে ঘুম থেকে ওঠা, কাজে যাওয়া। কোনো কিছুর জন্য চেষ্টা করা, বা শুধুমাত্র জন্মসূত্রে একটি রাষ্ট্রের অন্তর্গত হওয়া, এগুলি কি অর্থহীন নয়? যারা সীমান্তের কাছাকাছি থাকে তারা অন্য দিকের বাসিন্দা হিসেবে নিজেদের দেখতে পায়। এই সীমারেখাটি মানুষের জীবনের সর্বত্র বিদ্যমান। এমনকি যেটি সবচেয়ে প্রাচীন ও জৈবিক – যৌনতাও। এবং যেহেতু এটি জীবনের গভীরতম অংশ, তাই যৌনতা সম্পর্কিত প্রশ্ন গভীরতম প্রশ্ন। তাই আমার বুক অব ভ্যারিয়েশন যৌনতার মাধ্যমে শেষ হয়েছে।

>> তাহলে কি আপনি নিরাশার চরমে পৌঁছে গেছেন?
> আমি ‘আশা’ এবং ‘নিরাশা’ শব্দগুলিতে ক্লান্ত। উপন্যাস কোনকিছুই ঘোষণা করে না, শুধু প্রশ্ন করে ও উত্তর খোঁজে। আমি জানি না আমার দেশ ধ্বংস হবে কিনা এবং আমার চরিত্রগুলি ঠিক কিনা। আমি গল্প বলি, পরস্পরকে মুখোমুখি করি, এবং এর মাধ্যমে প্রশ্ন করি। মানুষের সব কিছুতে প্রশ্ন করা বোকামি। যখন ডন কিহোটো পৃথিবীতে বেরোলেন, পৃথিবীটা তাঁর কাছে এক রহস্য বলে মনে হল। এই প্রথম ইউরোপীয় উপন্যাস থেকে পরবর্তী উপন্যাসগুলি সৃষ্টি হলো। একজন ঔপন্যাসিক পাঠককে, পৃথিবীকে, একটি প্রশ্ন হিসেবে ভাবতে শেখায়। এই ভাবনায় এক ধরনের পাণ্ডিত্য ও সহিষ্ণুতা আছে। যেখানে সবকিছু নিশ্চিত। সেই জগতে উপন্যাস মৃত। এই সম্পূর্ণ জগৎ, যার ভিত্তি মার্কস, ইসলাম বা অন্যকিছু – একটি উত্তরের জগৎ, প্রশ্নের নয়। এখানে উপন্যাসের স্থান নেই। যাই হোক, আমার মনে হয় এখন মানুষ বোঝার চাইতে বিচার করতে বেশি পছন্দ করে, প্রশ্ন করা থেকে বেশি উত্তর দিতে চায়। এই নিশ্চয়তার জগতে উপন্যাস তার অর্থ হারিয়েছে।

Exit mobile version