নোবেল পুরস্কারধন্য মার্কিন কবি লুইজ গ্লিক প্রয়াত হলেন ১৩ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে। তাঁর জন্ম হয়েছিল নিউ ইয়র্ক সিটিতে ১৯৪৩ সালের ২২ এপ্রিল। বেড়ে ওঠা লং আইল্যান্ডে এবং পড়াশোনা জর্জ হিউলেট হাই স্কুল, সারা লরেন্স কলেজ ও কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে। মানুষ ও কবি হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ়চেতা। শৈশবে এনোরেক্সিয়া নার্ভোসা রোগে (শারীরিকভাবে শুকিয়ে যাওয়া) আক্রান্ত হন কিন্তু চিকিৎসা ও কঠিন সংকল্পে তাঁর রোগমুক্তি ঘটে। তাঁকে ভগ্নিবিয়োগ ও বিবাহবিচ্ছেদের তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। তাঁর কবিতায় পরিব্যাপ্ত ব্যক্তিজীবনের বিষণ্ণ ছায়া। বেদনাবিধূর উচ্চারণে মর্মরিত তাঁর কবিতার পঙক্তিমালা। তাঁর কবিতা পাঠ করলে মনে বেজে ওঠে বিষাদের সুর। সুদীর্ঘ গৌরবোজ্জ্বল সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতস্বরূপ তিনি ২০২০ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। নোবেল ছাড়াও তিনি পেয়েছেন পুলিৎজার প্রাইজ, ন্যাশনাল হিউম্যানিটিজ মেডাল, ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড, ন্যাশনাল বুক ক্রিটিক্স সার্কেল অ্যাওয়ার্ড ও বলিনজেন অ্যাওয়ার্ড। ২০০৩-২০০৪ এ দুবছর তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পোয়েট লরিয়েট ছিলেন। অনেক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গ্লিক কবিতার শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি অধ্যাপনা করেছেন ইয়েল ও স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে। তাঁর কবিতার বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফার্স্টবর্ন (১৯৬৮), দ্য হাউস অব মার্শল্যান্ড (১৯৭৫), ডিসেন্ডিং ফিগার (১৯৮০), দ্য ট্রায়াম্ফ অব একিলেস (১৯৮৫), আরারাত (১৯৯০), দ্য ওয়াইন্ড আইরিস (১৯৯২), মেডোল্যান্ডস (১৯৯৭), ভিটা নোভা (১৯৯৯), দ্য সেভেন এজেস (২০০১), আভের্নো (২০০৬), এ ভিলেজ লাইফ (২০০৯), ফেইথফুল এন্ড ভার্চুয়াস নাইট (২০১৪)।
গ্লিকের কবিতায় ঘুরেফিরে আসে প্রকৃতি, প্রেম, বিষণ্ণতা, একাকীত্ব, মৃত্যু, আশাভঙ্গ ইত্যাদি। তাঁর কবিতা সচরাচর লিরিক্যাল, হ্রস্বায়তনিক ও সৌকর্যময়। এখানে তাঁর পাঁচটি কবিতার অনুবাদ উপস্থাপিত হলো।
ক্রোটন-অন-হাডসনে ডিসেম্বরের শুরুতে
(Early December In Croton-On-Hudson)
তীর্যক সূর্য
বরফে শীর্ণ হাডসন
আমি শুনি হাড়ের মড়মড়
পাথরকুচির খটখট
ফ্যাকাসে তুষার লোমের মতো
নদীর সঙ্গে বাঁধা, স্থির
গত বছর আমরা যাচ্ছিলাম
বড়দিনের উপহার দিতে
টায়ার ফেটে গেল
মৃত নালার ওপর পাইন গাছগুলো
ঝড়ে জবুথবু, ছালবাকলহীন
আমি তোমাকেই চাই।
বৃক্ষনিবাস
(The Tree House)
বালতি ঝোলে জীর্ণ শিকলে
গোলাকার কুয়া কাদামাটিতে ঘেরা
নলখাগড়ায় ছাওয়া হরিণদ্বীপ
তুষারে ঢাকা অম্লগোলকের মধ্যে
বেরিফল কুড়ানো
সারাদিন ধরে দেখি
সাগরে দ্বীপের ভেঙে পড়া
অনেক আগের কথা
সব বিলীন হয়ে গেছে
জেটিরা চলে গেছে ব্যক্তিগত পথে
অথবা ডুবে গেছে, স্রোতে
কিছুই বাকি নেই
এই জানালার পথে
মায়ের সালাদে ডুবন্ত পুদিনা
চোখে ভাসে আমাদের বাগান, পামগাছ
হাজারো পাখির মেলা
অযতনে পুদিনা গাছ উঠেছে বেড়ে
গাছেরা, আমার ঘর খুলে দাও
শিশু দাঁড়িয়ে আছে।
প্রস্থান
(Departure)
বাবা দাঁড়িয়ে আছেন রেলের প্ল্যাটফর্মে
তার চোখ অশ্রুতে ছলছল
জানালায় সেই মুখ উজ্জ্বল
যেন কতো আগের দেখা মুখ
ভুলে যাওয়া সেই মুখ
চোখে চোখ পড়তেই
বাবা মুখ ঘুরিয়ে নেন ছায়ার দিকে
মন দেন বইপড়ায়
তখনো খাদের মধ্যে ট্রেনখানি
ছাইয়ের নিশ্বাসে অপেক্ষমান।
আগুন
(The Fire)
আমরা যখন একসঙ্গে থাকতাম
তখন তুমি মারা গেলে কিছুই চাইতাম না
আজ মৃত বলে তোমাকে ভাবছি, এই ভাল।
প্রায়শ, প্রাক-বসন্তে শীত-শীত সন্ধ্যায়
কচি পাতার সঙ্গে
বিভীষিকাগুলো পৃথিবীতে ঢুকে পড়ে
আমি পাইন ও আপেল কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালি
বারবার জ্বলে, নিভে যায়
রাত নেমে এলে
আমরা পরস্পরকে স্পষ্ট দেখতে পাই
দিনের বেলায় আমরা তৃপ্ত
আগের মতো
লম্বা ঘাসে
বনের সবুজ জানালায়, ছায়ায়।
তখন তুমি বলো না
চলে যাও
কারণ মৃতেরা একা থাকতে পছন্দ করে না।
দেবদারু
(Elms)
সারাদিন ধরে চেষ্টা করেছি
প্রয়োজন ও আকাঙ্ক্ষার পার্থক্য বুঝতে
এখন অন্ধকারে অনুভব করছি
কেবল তিক্ত বিষণ্ণতা
আমাদের জন্য
ভবন নির্মাণকারী ও বনকর্মীদের জন্য
একদৃষ্টে দেবদারু গাছগুলো দেখছি
দেখেছি স্থির গাছেরা কিভাবে কুঁকড়ে যায়
যন্ত্রণায় কাতরায়
এবং বুঝেছি
এদের কোনো আকার নেই
আছে কেবল দুমড়ানো-মোচড়ানো অবয়ব।
বিনয় বর্মণ
পেশায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর সৃজনশীলতায় কবি, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক।