“আমার দেশের চেয়ে ভালো দেশ, আমার দেশের চেয়ে সুন্দর দেশ পৃথিবীতে নেই।”
সাহিত্যের অনেক শাখায় কাজ করলেও নাটককেই কেন বেশি গুরুত্ব দেন?
এটা খুবই দুর্বল শাখা ছিল। আমার কাছে মনে হয়েছে মুনীর চৌধুরী স্যাররা যখন জীবিত, বাংলা নাটক যথার্থ বিশ্বমানের জায়গায় পৌঁছায়নি—বিষয় দৈন্যের কারণে এবং শিল্পকুশলতার অভাবে, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের পরে। সেজন্য মুক্তিযুদ্ধের পরে আমার কাছে মনে হয়েছে নাটককে শক্তিশালী করতে হবে। নাটককে শক্তিশালী করলে আমাদের সংস্কৃতি শক্তিশালী হবে।
আপনার নির্দেশনায় ইংরেজি নাটক শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’ মঞ্চে এসেছে, এ সম্পর্কে কিছু বলুন?
আমি প্রায় ২৫ বছর ধরে প্রথমে বাংলা বিভাগ, পরে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে ‘ম্যাকবেথ’ পড়াচ্ছি। আমার মনে হলো আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জন্য ইংরেজি ভাষাটা শিক্ষার্থীদের আয়ত্তে থাকা উচিত। ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে ‘ম্যাকবেথ’ করালাম যাতে করে ইংরেজি ভাষার অন্যতম স্থপতি শেক্সপিয়রের ভাষার সঙ্গে তাদের পরিচয় ঘটে এবং ইংরেজি সম্পর্কে উৎসাহ জাগে।
ঢাকার দর্শকরা কবে নাগাদ ইংরেজি ‘ম্যাকবেথ’ দেখতে পাবে?
‘ম্যাকবেথে’র রেগুলার শোতে আসতে হলে আমাকে আরো ভালো প্রস্তুতি নিতে হবে। পরীক্ষামূলক প্রদর্শনীতে উচ্চমানের দর্শক উপস্থিত ছিল এবং প্রত্যেকেই এটি এনজয় করেছে। নাটকের ক্ষেত্রে ভাষা কোনো প্রতিবন্ধকতা নয়, যদি নাটকের দৃশ্যায়নটা সুন্দরভাবে ঘটে। ‘ম্যাকবেথে’র দুর্বোধ্য ইংরেজি—সেটিও দর্শকের সঙ্গে কম্যুনিকেট করেছে শুধু অঙ্গভঙ্গি, দৃশ্যায়ন ও অভিনয় রীতির মাধ্যমে। এর নিয়মিত মঞ্চায়নে আমি আশাবাদী।
পেশাদারি থিয়েটার সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?
পেশাদারি থিয়েটার বাঙালিদের ভাগ্যে খুব ভালো থিয়েটারের জন্ম দেয়নি। পঞ্চদশ থেকে ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকার, যেমন ইবসেন, শেক্সপিয়র কিংবা স্ট্রিন্ডবার্গ সবাই পেশাদারি মঞ্চ থেকেই উঠে এসেছেন। কিন্তু বাংলা পেশাদারি মঞ্চে শিশির ভাদুড়ীর মতো বড় অভিনেতা জন্মালেও ভালো নাট্যকার জন্মায়নি। অপেশাদার মঞ্চ থেকে রবীন্দ্রনাথ এসেছেন। পেশাদারি মঞ্চ নয় বলেই তার পক্ষে করা সম্ভব হয়েছিল ডাকঘর বা রক্তকরবীর মতো নাটক লেখা।
পেশাদারি থিয়েটার হলে ভালো, কিন্তু আমাদের দেশে পেশাদারি থিয়েটার ক্বচিৎ খুব ভালো নাটকের জন্ম দেবে। আমি মনে করি পেশাদারি থিয়েটার হলে মহৎ প্রণোদনা নাটকে থাকবে না। দর্শক ভেড়ানোর জন্য খুব সস্তা সস্তা নাটক আসবে। পেশাদারি মঞ্চে অর্থ ব্যয়ের কথা বিবেচনা করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ কিংবা আমার লেখা কীত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল বা হাত হদাই কখনোই মঞ্চস্থ হবে না। এজন্য আমি পেশাদারি মঞ্চের পক্ষে কথা বলব না।
এদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তৃণমূল পর্যায়ে (স্কুল/কলেজ) কীভাবে নাটচর্চা সম্ভব?
এ ব্যাপারে কলেজগুলো এগিয়ে আসতে পারে। যারা ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে কলেজগুলোতে থিয়েটার পাঠ্য করবে, তারা নিশ্চিতই ছেলেমেয়েদের একটা ভালো ভবিষ্যৎ গড়ে দিতে পারবে। কারণ, বহু জ্ঞানের সংমিশ্রণে এই থিয়েটারটা তৈরি হচ্ছে। একদিকে যন্ত্রকৌশলের বিষয়, অন্যদিকে আছে থিয়েটারের কলাকানুনের বিষয়। পাশাপাশি নিজেকে প্রকাশ করার কৌশল তো আছেই। নাটক যে কলেজে পাঠ্য হবে সে কলেজ অনেক বেশি এগিয়ে যাবে অন্য কলেজের চেয়ে। দেশে পশ্চাৎপদ শিক্ষাব্যবস্থার জন্যই হয়তো প্রাতিষ্ঠানিক থিয়েটার চর্চার মাহাত্ম্যটা কেউ বুঝতে পারছেন না। এ ব্যাপারে সরকার সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে।
উন্নয়ন থিয়েটার বা পপুলার থিয়েটার সম্বন্ধে বলুন?
উন্নয়ন থিয়েটারকে থিয়েটার ভাবাটাই অত্যন্ত ভুল কাজ হবে। উন্নয়ন থিয়েটার যোগাযোগের একটা মাধ্যম, বিশুদ্ধ শিল্প নয়। উন্নয়ন থিয়েটারের শিল্পমূল্য আজ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে আমি জানি না। তবে সামাজিক মূল্যবোধ তৈরিতে খানিকটা সহায়তা করছে বলে মনে করি। আমি গ্রাম থিয়েটারকে কখনো অর্থনৈতিক বা উন্নয়নের জন্য ব্যবহার করিনি। আমি চেয়েছি মানসিক ভূমি তৈরি করতে। সেটা কোনো ইস্যুভিত্তিক নয়।
আপনি নাটক রচনার পাশাপাশি গান লিখছেন এবং সুর করছেন। কবে নাগাদ দর্শক-শ্রোতারা আপনার গান শুনতে পাবে?
না, আমি ঠিক ওইভাবে সুরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করিনি। তবে আমার মনে হচ্ছে এবার শীতকালে আমার সুরগুলো প্রকাশ করব। যদি আমি সুস্থ এবং সবল থাকি।
এদেশের টিভি চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে আপনার অভিমত?
চ্যানেলগুলোকে আরো বেশি সিরিয়াস হতে হবে। চ্যানেলগুলোর টেকনিক্যাল সাইডকে সিরিয়াসলি নেয়া উচিত। নাটক নির্বাচনে কিছু সস্তা বিনোদনমূলক নাটক থাকবে কিন্তু তার পাশাপাশি স্টার মুভিজের মতো কিছু জীবনঘনিষ্ঠ নাটক সিরিয়ালের প্রয়োজন আছে। প্রেমের অবিরল উপস্থাপনা প্রত্যেকটি নাটককে ম্লান বা পাণ্ডুর একটা কালকে উপস্থাপন করে। জীবনের প্রধান প্রবণতা তো প্রেম নয়। জীবনের আরো অনেক অনুষঙ্গ আছে। চ্যানেলে নাটকগুলো দেখলে মনে হয় ওটাই যেন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে—যুবক-যুবতীদের সম্পর্ক। আরেকটি অশনিসংকেত হলো, প্রতিবেশী দেশের সিরিয়ালগুলোর খুব বাজে প্রভাব পড়ছে আমাদের দেশের নাটকগুলোতে।
এনটিভিতে প্রচারিত আপনার লেখা জনপ্রিয় নাটক ‘রঙের মানুষ’ ও অন্যান্য নাটক প্রসঙ্গে কিছু বলুন?
‘স্পর্শের বাইরেও’ বেশ জনপ্রিয় আমার কাছে মনে হয়েছে। ‘রঙের মানুষে’র জনপ্রিয়তা আরো হতো যদি এটা সৎ জায়গায় দাঁড়াতে পারত। সৎ জায়গা বলতে বলছি—যেভাবে আমি শুরু করেছিলাম যে পরিকল্পনায়, সেভাবে শেষ হয়নি। কারণ ভার্চুয়ালি কুড়ি পর্বের পরে আমি আর লিখিনি নাটকটি। এটি দর্শকনন্দিত হলেও আমার সেসব লেখার অন্তর্গত নয়, যেমন—’গ্রন্থিকগণ কহে’, ‘রক্তের আঙ্গুরলতা’, ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’ বা ‘লালমাটি কালো ধোঁয়া’—এরকম নয়। নাটকের মতো নাটকের জায়গায় দাঁড়ায়নি। তো এই একটি ব্যর্থতা আছে ‘রঙের মানুষে’।
দেশে নতুন টিভি চ্যানেল আসছে এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
বাণিজ্যভিত্তিক যে কোনো ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক দায়টা খুব জরুরি হয়ে দেখা দেয় না যদি না এর পেছনে একটা সাংস্কৃতিক পরিকল্পনা থাকে। সাংস্কৃতিক পরিকল্পনা বলতে আমি বুঝাচ্ছি, আমাদের দেশে টিভি অনেক আগেই এসেছিল। এটা প্রতিবেশী দেশের চেয়ে অনেক অ্যাডভান্সড হওয়ার কথা ছিল। টেকনোলজিতে, মানে, কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি। অনেক চ্যানেল আসা একদিকে যেমন অত্যন্ত আনন্দের ব্যাপার তেমনি আমি শঙ্কিত যে আমাদের দেশে কতটা নতুন মুখ এবং নতুন প্রতিভার সন্ধান করতে পারবে নতুন ধ্যান-ধারণা, উপস্থাপন করতে পারবে তাই নিয়ে। হুবহু পাশ্চাত্য অনুকরণ বা হিন্দি ফিল্মের অনুকরণের মধ্য দিয়ে আমাদের স্বকীয়তা বিসর্জিত হোক এটা আমি চাই না। তবে চ্যানেলগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বা হচ্ছে। আমি আশা করি, নিজ নিজ মাটি ও সংস্কৃতির প্রতি, মানুষের প্রতি, নিজ মানচিত্রের দিকে সে মনোযোগী হবে বেশি।
১৮ আগস্ট আপনি ৫৭তম বর্ষে পা রাখছেন। জন্মদিনে আপনার উপলব্ধি কী?
জীবন ক্রমেই মৃত্যুর দিকে হামাগুড়ি দিচ্ছে এবং হয়তো আমার রচনা আরো উজ্জ্বল হবে—এ আশা করছি।
সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ সম্পর্কে আপনার ভাবনার কথা বলুন।
এক কথায় বলব, আমার দেশের চেয়ে ভালো দেশ, আমার দেশের চেয়ে সুন্দর দেশ পৃথিবীতে নেই।
উৎস : আমার দেশ, ১৬ জানুয়ারি ২০০৮