এক তরুণ ভবঘুরে যুবক, একদিন এক রাতে, এক নদীর ধারে নিজের বুকে রিভলবার চালালেন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো সেই যুবককে। আর তার পকেট হাতড়ে পাওয়া গেল এক টুকরো কাগজ, যাতে তার নাম লেখা—আলেক্সই পেশকভ। নীচে লেখা, “I lay the blame of my death on the German poet HEINE, who invented a toothache of the heart…”
রোগী কিন্তু মরলেন না। সেরে উঠলেন। সেরে উঠে গল্প লিখলেন। গল্পের নাম দিলেন, “মাকারচুদ্রা” আর গল্পের তলায় নিজের নাম লিখলেন — ‘ম্যাক্সিম গোর্কি’ । এর অর্থ ‘চরম তিক্ত’। তারপর থেকে অনবরত লিখেই চললেন গোর্কি।
গোর্কি সাধারণত গল্প লিখেছেন সাধারণ মানুষদের নিয়ে। আর পৃথিবীতে তাঁর ভক্তের সংখ্যাও অগণিত। নিচের রচনাটি ১৯২৫ সালে মিস্টার মর্টিয়ার রচিত Histoire generale der litteratures etr angere-এর ভূমিকা হিসেবে লিখেছেন গোর্কি। এখানে বঙ্গানুবাদ দেয়া হলো।
বই | ম্যাক্সিম গোর্কি
তুমি আমাকে এ বইয়ের ভূমিকা লিখে দিতে বলেছ। আমি ভূমিকা লিখিয়ে নই। কিন্তু তাই বলে এমন একটা সুযোগ ছেড়ে দিতেও আমি অনিচ্ছুক। তাই এ সুযোগে বই সম্পর্কে আমার সাধারণ ধারণা কী তা-ই বলবো।
আমার ভিতর যা কিছু ভাল, সে সব বইয়ের দান। সে জন্যে বইয়ের কাছে আমি ঋণী। আমার যৌবনে আমি অনুভব করেছি, আর্ট বা শিল্প মানুষের থেকেও মহৎ। বই আমি ভালবাসি। প্রত্যেকটি বই আমার কাছে এক আশ্চর্য জিনিস। আর তার লেখকরা আমার কাছে যাদুকর।
যখন ছাপাখানা থেকে কোনো লেখকের সদ্য ছাপা বই আমার হাতে আসে (লেখক যেন কোন বীর; আর এ বীরের জয়যাত্রায় সাহায্য করছে আরেক বীর, মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করে), তখন আমার মনে হয় কোনো কিছু জীবন্ত যা কথা বলতে পারে, আমার ভিতর প্রবেশ করছে। এ যেন এক নতুন টেস্টামেন্ট, যা একজন লোক লিখেছে এমন একজন সম্পর্কে, যে নাকি রহস্যময় আর ভালোবাসার যোগ্য। তাঁর (লেখকের) শ্রম আর কল্পনা সৃষ্টি করেছে এই পৃথিবীর যা কিছু সুন্দর। যা কিছু মহৎ।
বই সারাজীবন আমাকে পথ দেখিয়েছে। তারা সব সময়, এমন এক নতুন কিছু সম্পর্কে আমায় বলেছে, যা আমি আগে অন্য কোনো মানুষের মধ্যে দেখিনি। পুরো বইটাতে একটা না একটা বাক্য খুঁজে পাওয়া যাবেই যা তোমাকে মানুষের অতি কাছে নিয়ে আসবে।
নাক্ষত্রিক জগতের সৌন্দর্য, পৃথিবীর যান্ত্রিকতা – এসবের কথা যতই বাগ্মিতার সাথে বলা হোক না কেন, তা আমার মনকে নাড়া দেবে না বা আমার মনে কোনো উৎসাহ জাগাবে না, কিন্তু অসাধারণ কল্পনাশক্তির অধিকারী ক্যামিল ফ্লামারিয়নের মৃত্যুতে আমি গভীর দুঃখ পেয়েছি।
পৃথিবীর যা কিছু সুন্দর তার বর্ণনা দিয়েছে মানুষ। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে সে তার লেখায় মাঝে মাঝে বেদনার সৃষ্টি করেছে এবং এ বেদনা উজ্জ্বলভাবে বর্ণিত, হয়েছে বোদলেয়ার বা দস্তইয়েফ্স্কির লেখায়। কিন্তু এখানেও আমি দেখি জীবনের যা কিছু ঘৃণিত আর বৈচিত্রহীন তা উপশম আর সুশোভিত করার এক প্রচেষ্টা। সুন্দর হলো সে জিনিস যা মানুষ নিজের হৃদয়ের গভীর থেকে সৃষ্টি করে।
আমাদের উপস্থিতি সব সময় সবখানে বেদনাদায়ক। আর এ বেদনাকে লেখক রূপান্তরিত করেছে ট্র্যাজেডিতে। এর চেয়ে বিস্ময়কর আর কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। তাই পুশকিনের কবিতার বইতে আর ফ্লবেয়ারের উপরাসে আমি খুঁজে পাই সৌন্দর্য আর সত্য; যা পাইনা তারাদের ঝিকিমিকিতে, সাগরের শব্দে আর প্রকৃতির নিস্তব্ধতায়।
অতি তুচ্ছ এক মানুষকে নিয়ে কবি-লেখকেরা সৃষ্টি করে এক অপূর্ব চরিত্র, যা অমর।
আমি যে পৃথিবীতে বাস করি তা হ্যামলেট, ওথেলো আর রোমিওর পৃথিবী, ডেভিড কপারফিল্ড, মিঃ ডোম্বে, ব্রাদার কারামাজোভ, মাদাম বোভারী, ম্যানন ল্যাসকাউট আর আনাকারেনিনার পৃথিবী। এ পৃথিবী ডন কিহোটো আর জুয়ানের।
আমরা যে পৃথিবীতে বাস করি, সে পৃথিবীতে মানুষকে চিনতে হলে বই পড়তে হবে। ফ্লবেয়ারের Un Coer Simple আমার কাছে গসপেলের মতো পবিত্র। ‘ওডেসি’ আমাকে যেমন মুগ্ধ করে, নুট হামসুনের ‘গ্রোথ অব সয়েল’’ও আমাকে তেমনি মুগ্ধ করে।
আমি নিশ্চিত যে, আমার পৌত্ররা নিশ্চয়ই রোঁমা রোলার ‘জাঁ ক্রিস্তফ’ পড়বে এবং বুঝবে লেখকের হৃদয়ের মহত্ব, মানবজাতির প্রতি তার অপরিসীম দরদ।
মানুষ ছাড়া আর কিছু সম্পর্কে জানার আগ্রহ আমার নেই আর এ সম্পর্কে জানতে হলে দরকার বইয়ের মতো মহৎ পথপ্রদর্শক। আমার মনে সেসব বিনীত বীরদের জন্যে গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে যারা এ পৃথিবীর সমস্ত কিছু সুন্দর আর মহৎ সৃষ্টি করেছেন।
Leave feedback about this