প্রায় আমাদের চোখের আড়ালে থাকা মেক্সিকোর প্রখ্যাত শিল্পী ফ্রিদা কাহলোর কিছু চিত্রশিল্পকে Frida Kahlo: The Complete Paintings শীর্ষক একটি বইতে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে নতুনভাবে জনসমক্ষে এসেছে। আবিষ্কৃত হয়েছে তাঁর শিল্পকর্মের কিছু সূত্র। এই আবিষ্কার নিঃসন্দেহে ফ্রিদার জীবন ও হারিয়ে যাওয়া বা স্বল্প পরিচিত কাজগুলি সম্পর্কে শিল্পবোদ্ধাদের নতুন অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করবে।
কে এই ফ্রিদা কাহলো?
ফ্রিদা সর্বকালের সবচেয়ে খ্যাতিমান মহিলা শিল্পী, এবং যার শিল্পকর্ম সর্বজন স্বীকৃত, শিল্পকলার ইতিহাসের অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়।
তার জনপ্রিয়তার অংশ হিসেবে পাওয়া যায় কাহলো টি-শার্ট, নোটবুক ও মগ, সর্বত্র। অধিকাংশ দর্শক কিছুটা দূরত্বে থেকে তার ভ্রূপল্লব ও ঐতিহ্যবাহী মেক্সিকান পোশাক, ফুলেল মাথার ব্যান্ড এবং লাল লিপস্টিকে রঞ্জিত ওষ্ঠ্যই দেখে আসছেন।
কাহলো সম্পর্কে সবসময় আসলে কৌতূহল দেখিয়ে আসছে মানুষ। এর প্রধান কারণ হলো কাহলোর নিজের আঁকা ছবি, যে-ছবিগুলোর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কাজই হলো সেল্ফ পোট্রেট বা আত্মপ্রতিকৃতি। যদিও তিনি ১৯৫৪ সালে মারা যান, তবু তাঁর কাজগুলোকে এখনও সবাই খুব তীক্ষ্ণভাবে লক্ষ করে। তাঁর পোট্রেট এবং সেইসব কাজের বিপুলতা, তাঁর নিজের শিল্পচর্চা আর নিজের জীবনের গল্পই সামনে চলে এসেছে। এরকম একটা বিষয়, যেমন তিনি দর্শকদের দিকে তাকিয়ে নিজেকে আঁকতেন, যা ছিল প্রত্যক্ষ, উগ্র, এবং খুব চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার।
কাহলো সমকালের নারীবাদী আখ্যানের মধ্য দিয়ে খুব দৃঢ়ভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন। তিনি দৃঢ় মনের এমন একজন স্বাধীন মহিলা ছিলেন, যিনি নিজেকে তাঁর শিল্পকর্মের বিষয় হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন এবং নারী হওয়ার জটিল, অগোছালো, এবং বেদনাদায়ক দিকগুলি অন্বেষণ করছিলেন।
তাঁর ছবিতে আঁকা নাটকীয়তা তাঁর জীবনের নাটকীয় উপাদানগুলিকেই তীব্রভাবে উপস্থাপন করে। গর্ভপাত, সন্তান ধারণে অক্ষমতা; শারীরিক যন্ত্রণা (১৮ বছর বয়সে তিনি ভয়াবহ দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন, এবং সারা জীবন শারীরিকভাবে ভুগছিলেন), তীব্র-গভীর প্রেম (মেক্সিকার শিল্পী দিয়েগো রিভেরার সাথে তাঁর উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল, সেইসাথে লিওন ট্রটস্কিসহ অন্য অনেক প্রেমিক, পুরুষ এবং মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল) এবং প্রচণ্ড ক্রোধ (রিভেরা, নিজের বোন তার সাথে বারবার প্রতারণা করেছিলেন) তাঁর শিল্পের বিষয়আশয় হয়ে উঠেছে।
কাহলো, শিল্প নিয়ে যাদের কারবার, তাদের কাছে আর্থিকভাবে ব্যবসাসফল বিষয় হয়ে উঠেছেন। গ্যালারিতে তাঁর ছবি প্রদর্শিত হলেই দর্শক পাওয়ার নিশ্চয়তা ছিল।
কিন্তু কাহলো বলতে শুধু এইসব নয়, তার শিল্পকর্ম কেবল তাঁর ব্যক্তিজীবনকে ঘিরে নয়, যদিও এতকিছু না বোঝার জন্যে দর্শককে ক্ষমা করা যেতেই পারে। তাঁর ব্যর্থতা, তার ভালোবাসা নিয়ে বই লেখা হয়েছে, তিনি সালমা হায়েক অভিনীত একটি হলিউডি সিনেমারও বিষয় হয়েছেন। বেশিরভাগ দর্শক কাহলোর শিল্পকর্মের চেয়ে তাঁর ব্যক্তিজীবন সম্পর্কেই জানতে বেশি আগ্রহ দেখায়।
কিন্তু তাঁর কাজ সম্পর্কে কজন লোক জানেন? অনেক শিল্প-সমালোচক ও শিল্প-ইতিহাসবিদের কাছে কাহলোর শিল্পের পরিবর্তে তাঁর প্রতি নিরলস মনোযোগ দেয়াটা ক্লান্তিকর হয়ে উঠেছিল। এই কথাগুলো মনে রেখেই লেখা হয়েছে ‘ফ্রিদা কাহলো: দ্য কমপ্লিট পেইন্টিংস’ বইটি। এটি প্রকাশ করেছে তাসচেন নামের পাশ্চাত্যের একটি প্রখ্যাত প্রকাশক। বইটিকে বলা যায় তাঁর পুরো শিল্পসম্ভারের অনন্য জরিপের বয়ান। মেক্সিকোর শিল্প-ইতিহাসবিদ লুইস-মার্টিন লোজানো, আন্দ্রেয়া কেটেনম্যান এবং মেরিনা ভাজকুয়েজ রামোস এই বইটি লিখেছেন। তাঁরা কাহলোর প্রতিটি কাজের সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ খুটিনাটি জানিয়েছেন। তাঁদের তথ্য অনুসারে কাহলোর আঁকা মোট ১৫২টি চিত্র পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছে অনেকগুলো হারিয়ে যাওয়া কাজ। শুধু ফটোগ্রাফি হিসেবে সেই কাজগুলি দেখার সুযোগ মেলে, মূল কাজগুলির কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
মেক্সিকো সিটি থেকে একটি ভিডিও কলে শিল্প-সমালোচক হলি উইলিয়ামস এই বইয়ের অন্যতম লেখক লোজানোর সাথে কথা বলার সময় জিজ্ঞেস করেছিলেন, সারা বিশ্বে তাঁর এত এত প্রদর্শনী হওয়া সত্ত্বেও কাহলোর কাজের বিস্তৃত পরিসংখ্যান নেই কেন?
প্রত্যুত্তরে তিনি জানান, “একজন শিল্প-ঐতিহাসিক হিসেবে কাহলোর প্রতি আমার প্রধান আগ্রহ মূলত তাঁর কাজের প্রতি। কিন্তু সত্যি বলতে কি, বেশিরভাগ মানুষ প্রদর্শনীতে আসে তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে। তাঁর ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে জানতে। তিনি কে, কী পোশাক পরতেন, কাদের সাথে শারীরিক সম্পর্ক ছিল, কারা তাঁর প্রেমিক – এইসব গল্প সম্পর্কেই দর্শকরা কৌতূহল দেখায়। স্বাভাবিক ভাবেই বিভিন্ন প্রদর্শনী এবং তাদের ক্যাটালগগুলি প্রায় একইধরনের বিষয়আশয় নিয়ে লেখা এবং একই ধরনের পেইন্টিং বা ছবি দেখতে চায় দর্শকেরা। নতুন কিছু তারা দেখতে পান না, জানতেও পারেন না। যারা কাহলোর প্রদর্শনীর আয়োজন করেন অথবা বই লেখেন, তাঁরা তাঁর শিল্পকর্মকে একপাশে সরিয়ে রেখে জীবন নিয়েই কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। আসলে কাহলোর ওপর কোনো বই বিক্রি হওয়ার অর্থ হলো কাহলোর ব্যক্তিজীবন বিক্রি হওয়া, তাঁর শিল্পকর্মের বৈশিষ্ট্য কেমন ছিল, সেসব কিছুই পাঠকের জানা হয় না। এটা খুব দুঃখজনক, নিঃসন্দেহে!
কিন্তু কেন কাহলো এভাবে পণ্য হয়ে গেলেন?
একটা জিনিস তো বোঝাই যায়, তাঁর ওপর আয়োজিত প্রদর্শনীগুলো, তাঁর ওপর লেখা বইগুলো তাঁর ব্যক্তিত্বের বাইরে যেতে পারেনি। এসব বইতে তাঁর শিল্পকর্ম নিয়ে তেমন কোনো কথা থাকে না। তখনই প্রশ্ন ওঠে, প্রদর্শনী বা বইয়ের তাহলে প্রয়োজনটা কি? এর জবাবে বলতেই হয়, কোনো প্রয়োজন নেই। এগুলা বেহুদা কর্ম।
উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে কাহলোর পেইন্টিংগুলিকে ভুল শিরোনামে, ভুল তারিখ দিয়ে অথবা নিম্নমানের রঙচঙে ফটোগ্রাফির মাধ্যমে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ফলে তাঁর ছবির যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হচ্ছে তাতে বিস্তর ভুল থেকে যাচ্ছে। দর্শকরা তাঁর পেইন্টিং দেখে বারবার বলে, “ওহ এই ছবিটা তাহলে আঁকা হয়েছে সে রিভেরাকে অনেক ভালবাসত সেই জন্যে। ওটা আঁকা হয়েছে কারণ তাঁর কোনো সন্তান ছিলো না। অথবা এই ছবিটা? হাসপাতালে ছিলেন বলে এঁকেছেন?” হ্যাঁ, কাহলোর কিছু কিছু ছবি সম্পর্কে এমনটা বলাই যায়। কিন্তু এর থেকেও বেশি আরও অনেক কিছু বলার আছে।
কত হারিয়ে যাওয়া ছবি
কাহলোর আঁকা ছবির সংখ্যা মাত্র ১৫২। একজন বিখ্যাত শিল্পীর ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা খুব বেশি বলা যাবে না। অবাক করা দিকটা হচ্ছে তাঁর সমস্ত ছবির পূর্বাপর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হয়নি। তাঁর এমন কিছু ভালো কাজ আছে যা নিয়ে একটা বাক্যও কখনো লেখা হয়নি, কেউ লেখেননি। শিল্প-ইতিহাসের দিক থেকে একে অনাকাঙ্ক্ষিত চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলাই বলা যায়।
তাঁর কাজের তাই একটি বিস্তৃত জরিপ হওয়া দরকার। এই প্রস্তাবটা করার অর্থ হলো, তাঁর হারিয়ে যাওয়া বা স্বল্প পরিচিত কাজগুলিকে একত্রিত করা। এর মধ্যে রয়েছে গত দুই দশক বা তারও বেশি সময় ধরে নিলামে আলোচিত এবং বিক্রি হওয়া চিত্রকর্মগুলি নিয়ে কথা বলা। মনে রাখতে হবে এসব ছবি রয়ে গেছে ব্যক্তিগত সংগ্রাহকদের কাছে। সেই সব ছবি দেখার সুযোগ আমাদের ঘটেনি। তাই সেই ছবিগুলো কেমন, তা অস্পষ্টই থেকে গেছে। স্পেনের শিল্প-সমালোচক লেখক লোজানো অবশ্য আশা করছেন, কাহলো সম্পর্কে আমাদের জানার পরিধি বিস্তৃত হবে। বিশেষ করে জানা দরকার বা ব্যাখ্যা করা দরকার – শিল্পী হিসেবে তিনি কে ছিলেন; নিজের কাজ সম্পর্কে তিনি কী ভাবতেন; শিল্পী হিসেবে তিনি কী অর্জন করতে চেয়েছিলেন আর তাঁর চিত্রকর্মগুলো কী অর্থ দেয় বা বোঝায়?
সামগ্রিকভাবে বললে, তাঁর প্রথম দিকের কাজগুলোকে আবার পর্যালোচনা করে দেখতে হবে। সেই সময়ে কাহলোকে নিয়ে তেমন একটা আগ্রহ দেখা যায়নি। কিন্তু তাঁর বাবা গিলার্মো একজন পেশাদার আলোকচিত্রী আর ফুলের সৌখিন স্টিল লাইভ চিত্রকর ছিলেন। তিনি কাহলোকে কতটা প্রভাবিত করেছিলেন সেটা দেখা দরকার।
কাহলো সারাজীবন ধরে বিস্ময়করভাবে প্রাণবন্ত জমকালো স্টিল লাইভ ছবি এঁকে গেছেন যা তাঁর সেল্ফ পোট্রেটের তুলনায় সাধারণ মানুষের কাছে কম পরিচিত, কম সংগৃহীত এবং কম আলোচিত।
লজানো এবং তার সহকর্মীদের মধ্যে উদ্ভিদের প্রতীকী অর্থ সম্পর্কে কাহলোর সারা জীবনের আগ্রহ দেখে তারা এমন নথি আবিষ্কার করেন যার মাধ্যমে এই শিল্পগুলোর গুরুত্ব সম্পর্কে তারা ধারণা লাভ করেছেন। কাহলো তার বাবার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছিলেন এবং এ নিয়ে তিনি তার সৎ বোন মার্গারিটার (আগের বিবাহ থেকে তার বাবার সন্তান) সঙ্গে চিঠি লিখে আলোচনা করেছিলেন।
লোজানো বলেন, “কাহলো এবং মার্গারিটার চিঠিগুলি “ফুল এবং ফল এবং ইডেন বাগানের প্রতীকী অর্থ দেয়, আমাদের দেহ একটি ফুলের মতো যা আমাদের যত্ন নিতে হবে কারণ এটি স্বর্গচ্যুত হয়েছিল।” আশ্চর্যজনক হলো, এ থেকে প্রমাণ মেলে যে স্থির জীবন এবং ফুলের এই বিষয়টি কাহলোর কাছে কতটা অর্থপূর্ণ ছিল।” তিনি ১৯৩৮ সালে একটি পেইন্টিং এর নতুন ব্যাখ্যা প্রদান করেন, যার নাম টুনাস, যা একটি ফলের পেকে যাওয়ার বিভিন্ন পর্যায়। তিনটি কাঁটাওয়ালা নাশপাতি -সবুজ, সরস, এবং রক্ত-লাল- যা শিল্পী হিসাবে তার পরিপক্বতা সম্পর্কে কাহলোর নিজস্বতা বোঝার প্রতিনিধিত্ব করে এবং একই সাথে প্রকাশ করে সম্ভাব্য ধর্মীয় প্রতীক।
সম্পূর্ণ বইটি শিল্প-জগতের বিকাশের সাথে সাথে কাহলোর বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পৃক্ততার গভীরতাও প্রকাশ করে। প্রচলিত ধারণার বিরুদ্ধে লড়াই করে তিনি ১৯২৮ সালে রিভেরার সাথে দেখা করে প্রভাবিত হয়েছিলেন,তার কাজটি স্বীকৃতি পেয়েছিলো, যা ছিলো নারীর ব্যথার সহজাত চিৎকার। । তার আঁকা ছবিগুলো প্রমাণ করে কাহলো গবেষণা করেছিলো শিল্প আন্দোলন, তরুণ মেক্সিকানদের আধুনিকতা, শ্রুতিকটুতা , শিল্পের ধারাবিষেশ এবং তারও পরবর্তীতে পরাবাস্তবতা নিয়ে।
লোজানো বলেন, “ফ্রিদা কাহলোর পেইন্টিংগুলি কেবল তার ব্যক্তিগত বিষয়গুলির ফলাফলই ছিলো না , বরং সে চারপাশ দেখেছিল কারা ছবি আঁকছে, কী প্রবণতা তাদের, কি আলোচনা চলছে।” তিনি ১৯২৭ এ অ্যাভান্ট-গার্ডে আঁকা তার প্রথম পদক্ষেপ এর দিকে ইঙ্গিত করেন – পাঁচো ভিলা এবং আদেলিতা, এবং হারিয়ে যাওয়া কাজ ইফ আদেলিতা, দুটোই বেশ ধারালো, তার আধুনিক রেখা এবং কোণ ব্যবহার করাই -প্রমাণ করে যে রিভেরার সাথে দেখা হবার পূর্বেই তার মেক্সিকান শিল্পের প্রতি আগ্রহ ছিল।
যে কেউ রেনেসাঁ ওল্ড মাস্টার্সের প্রতিও তার আগ্রহও দেখতে পারে, যা তিনি তার বাবার লাইব্রেরিতে প্রিন্ট হিসেবে আবিষ্কার করেছিলেন, প্রথমদিকের কাজ : ১৯২৮ এর পেইন্টিং, টু উইমেন (সালভাডোরা এবং হারমিনিয়ার প্রতিকৃতি), দুটি শ্যামল দাসী, পাতার পটভূমিতে চিত্রায়িত, যা রেনেসাঁর প্রতিকৃতি এবং ঐতিহ্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল, যেমনটা লিওনার্দো দা ভিঞ্চির রচনায় দেখা যায়। যে বছর এটি আঁকা হয়েছিল সে বছরই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। ১৯১৫ সালে বোস্টনের চারুকলা জাদুঘর দ্বারা এটি না কেনা পর্যন্ত এই কাজটির অবস্থান সকলের কাছে অজানা ছিল।
তিনি শুধুমাত্র ১৫২টি পেইন্টিং করেছেন, কিন্তু অনেক কাজ হারিয়ে গেছে। কিন্তু তারপরও, কাহলো তার জীবদ্দশায় খুব সফল ছিলেন না। তার এতগুলি শো, গ্যালারি এমনকি ডিলারদের মাধ্যমে এত ছবি বিক্রিও হতো না। বরং তার অনেকগুলি পেইন্টিং বিক্রি হয়েছিল সরাসরি শিল্পী, বন্ধু, পরিবারের পাশাপাশি চলচ্চিত্র তারকা এবং অন্যান্য গুণগ্রাহীদের কাছে, যাদের অধিকাংশই অন্য দেশের মানুষ। তার কাজের সংখ্যা কম থাকায়, কাজগুলি ঠিক ঠিক খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে ওঠে।
কিছু বিস্ময়কর পেইন্টিং, যা তিনি এঁকেছিলেন, এখনও পাওয়া যায়নি। হারানো প্রতিকৃতির সাদা- কালো ছবিগুলো দেখলে সম্ভবত সবচেয়ে বিজ্ঞ পণ্ডিত ছাড়া কারও কাছেই তা স্পষ্ট হবে না, যদিও কিছু বিস্ময়কর ছবির হদিশ মেলেনি। ১৯৩৮ সালের একটি হারিয়ে যাওয়া ছবি, গার্ল উইথ ডেথ মাস্ক-এ একটি ছোট মেয়ের ফাঁকা মাথার খুলির মুখোশ তিনি দেখিয়েছেন; যা খুব তীক্ষ্ণ, এবং আমরা জানি কাহলো গর্ভধারণ করতে অক্ষম ছিলেন। তার দুঃখকাতর এই পেইন্টিংটি তারই ইঙ্গিত বহন করছে। তার একটি মুর্যা্ল আছে যেখানে কাহলো একটি ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার ছবি একেছেন। ১৯৩৫ সালে রিভেরার সাথে তার বোনের সম্পর্ক আবিষ্কারের পর কয়েক বছর ধরে তিনি ব্যক্তিগত অশান্তির মধ্যে এই ছবিটি এঁকেছিলেন বলে জানা যায়। তার আরও দুটি সুপরিচিত চিত্রকর্ম হলো, প্যাশনেটলি ইন লাভ এবং আ ফু স্মল নিপস। এতে দেখা যায় এ মহিলা তার স্বামীর দ্বারা খুন হচ্ছে। বিমান দুর্ঘটনাটি খুব ঘনিষ্ঠভাবে একটি বাস্তব জীবনের সংবাদ প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে চিত্রায়িত ছিল।
কমিউনিস্ট কাহলো
কাহলো একজন কমিউনিস্ট ছিলেন, এবং সারা জীবন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই সময়ে তিনি প্রচুর শারীরিক কষ্টে ভুগছিলেন এবং অপারেশন করাতে হয়। তার হাঁটুর নীচের অংশ কেটে ফেলা হয়। কিন্তু কাহলো ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত ছবি আঁকা অব্যাহত রেখেছিলেন, শত অসুবিধা সত্তেও নতুন উদ্দেশ্য নিয়ে। তার জীবনীতে লেখক রাকুয়েল টিবোলের কাছে তিনি বলেছেন :
“আমি আমার চিত্রকর্ম নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন। যেকোনো কিছুর চেয়ে, এগুলোকে পরিবর্তন করার জন্য, এগুলোকে কাজে লাগানোর জন্য, এখন পর্যন্ত আমি যতটুকু এঁকেছি তা হল আমার নিজের বিশ্বস্ত প্রতিকৃতি। কিন্তু আমি কমিউনিস্ট] পার্টির সেবা করার জন্য আমার পেইন্টিং যা করতে পারে তা থেকে দূরে ছিলাম। আমাকে আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে লড়াই করতে হবে যাতে আমি সুস্থ হই এবং বিপ্লবকে সাহায্য করতে পারি। এখন আমার বেঁচে থাকার একমাত্র আসল কারণ এটাই।” এর ফলে ১৯৫২ সালে তিনি এঁকেছিলেন টু মাশরুম ক্লাউডস, যা পারমাণবিক যুদ্ধ সম্পর্কে কাহলোর দুঃস্বপ্নের প্রতিনিধিত্ব করে। তিনি শান্তির জন্য কাজ করেছেন। বিশ্ব শান্তি পরিষদের সমর্থনে মেক্সিকোর শিল্পীদের কাছ থেকে তিনি স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছিলেন, মেক্সিকান কমিটি অব পার্টিজানস ফর পিস গঠনে সহায়তা করাই ছিল তার লক্ষ্য।
তার দীর্ঘ জীবনে শান্তির প্রতীক হচ্ছে মেক্সিকোর একটি পতাকা। কাহলোর উদ্দেশ্য ছিল যে তার কাজটি তার জাতীয়তাবাদ এবং সাম্যবাদকে প্রকাশ করবে। তবে অস্বস্তিকরভাবে তার শেষ চিত্রকর্মগুলোতে স্ট্যালিনের প্রেম চিত্রায়িত হয়েছিল, তার রাজনীতি আরও জঙ্গি হয়ে উঠেছিল।
সম্ভবত তার সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের করা পেইন্টিং হচ্ছে একটি আত্মপ্রতিকৃতি : ফ্রিডা ইন ফ্লেমস (সেলফ-পোর্ট্রেট ইনসাইড এ সানফ্লাওয়ার)। এটি চরম যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি জাগায়, যা একটি পুরু রঙিন ইম্পাস্টোতে আঁকা; তার মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে, কাহলো এটিতে ছুরি দিয়ে আঘাত করে ছিঁড়ে ফেলেন। তখন তিনি তার কাজ করার অক্ষমতায় হতাশ হয়ে পড়েছিলেন, সম্ভবত স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে তার মৃত্যু খুব কাছাকাছি।”এটি একটি দুর্দান্ত চিত্র, বলেছেন চিত্রসমালোচক লোজানো : “নান্দনিকতার দিক থেকে এটি খুব আকর্ষণীয় একটি ছবি। যখন আপনার শরীর আর কাজ করছে না, যখন আপনার মস্তিষ্ক আপনি যা আঁকতে চান, ফুটিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট নয়, তখন আগে আঁকা ছবি পুনর্নির্মাণ করাই ভালো।
আমাদের কাছে এটি এমন একটি চিত্রকর্ম যা অসম্পূর্ণ, কিন্তু অবশ্যই সুন্দর, মসৃণ তল থেকে এক পৃথিবী দূরে। কাহলোর আরও বিখ্যাত আত্মপ্রতিকৃতিগুলোর প্রতি বিশদ মনোযোগ থাকা সত্ত্বেও এটি একটি বিস্ময়করভাবে শক্তিশালী কাজ, যা পরিচিত হওয়ার যোগ্য। একজন শিল্পীর মধ্যে এমন একটি বিষয় খুঁজে পাই, যা তার নিজের ইমেজ তৈরি করার পক্ষে চূড়ান্ত সৃজনশীল কাজ। এমনকি নিজেকে বিলুপ্ত করার ক্ষেত্রেও, কাহলো তার কাজকে আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। তার সমস্ত শিল্পকর্মই যন্ত্রণা ও ব্যক্তিগত বিষাদ থেকে উত্থিত। মহান শিল্পী হিসেবে তার মহিমা এখানেই।
Leave feedback about this