সেই সব দিন
মাঝে মাঝে ইদানীং অনেক আগে চলে যাওয়া দিনগুলি মনে পড়ে। বিশেষ কোনও কারণে কি? না, এমনিতেই। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলির কথা। আমি যে ঢাকা বিশ্বব্যিালয়ের কথা বলছি তার ঠিকানা তো আজকের নয়, অনেক অনেক বছর আগেকার কথা। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৪৭ সালে ভর্তি হয়েছিলাম ভিন্ন আংশিক দালানে। আমার বিষয় ছিল ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স। সেই ক্লাশে আমার সহপাঠী ছিলেন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সৈয়দ মোহাম্মদ আলী, এবং সাবের রেজা করিম। বাকি ক’জনের কথা বিস্মৃতির তিমিরে লুপ্ত হয়েছে।
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী তো তুখোড় ছাত্র ছিলেনই, তদুপরি ছিলেন কবিচিত্তের অধিকারী। ১৯৫০ সালের গোড়ার কথা, মাঝে মাঝে আমাদের ক’জনের অর্থাৎ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সৈয়দ মোহাম্মদ আলী, সাবের রেজা করিম, এবং আমাকেসহ আরও দু’তিন জন, ইউনিভার্সিটির চৌহদ্দিতেই অবস্থিত জলাশয়ের তীরে গাছতলায় একটি আড্ডা জমিয়ে তুলত অবসরকালে। সেই আসরে প্রায়শই সদ্য-লেখা পড়া হতো কারও কারও। এই আসরে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করতেন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী; তিনিই আবৃত্তি করে শোনাতেন সবেমাত্র স্বরচিত কবিতাবলি। তার এই কবিতাপাঠ আমাদের মুগ্ধ করত। আমিও কখনও-সখনও অনুরুদ্ধ হয়ে অত্যন্ত সঙ্কোচের সঙ্গে সদ্য-লেখা কবিতা পাঠ করতাম। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর কবিতা আগে থেকেই কলকাতা থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘মোহাম্মদী’ এবং সম্ভবত মাসিক ‘সওগাত’-এও প্রকাশিত হতো। তাই ওর মর্যাদা সেই আসরে অন্যরকম ছিল এবং সেটাই স্বাভাবিক। আমার কবিতা পাঠে ছিল কিছু সঙ্কোচ এবং দ্বিধা। তবে কোনও মতে পাঠ সেরে উঠতে পারতাম। সীমিত শ্রোতৃবর্গ খুব একটা বিরক্তি কিংবা অবহেলা প্রকাশ করতেন না।
সৈয়দ মোহাম্মদ আলী তো আমাদের কবিতা তখন থেকেই খুব পছন্দ করতেন। তিনি অতি তরুণ হওয়া সত্ত্বেও সেকালেই ইংরেজি দৈনিক ‘পাকিস্তান অবজারভার’-এ একজন সাংস্কৃতিক রিপোর্টার-এর দায়িত্ব পালন করতেন। তার কলামে আমার সম্পর্কে কিছু মন্তব্য এবং আমার একটি কবিতার কিছু অংশের অনুবাদ প্রকাশ করেন। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী সম্পর্কে প্রশংসা তো ছিলই, তবে আমার কবিতা সম্পর্কে তার প্রশংসাপূর্ণ আলোচনা পাঠ করে আমি, সত্যি বলতে কি বিস্মিত হয়েছিলাম। লুকাব না, আমার সহপাঠীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলাম সেদিনই। তিনি যা বললেন, তাতে যেন হলো, এই প্রশংসার পুরোটাই আমার প্রাপ্য, আমাকে খুশি করার জন্যে তিনি কোনও বাক্যই ব্যবহার করেননি।
অনেক বছর পর সৈয়দ মোহাম্মদ আলী কোনও কোনও বিদেশী পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করে দেশে ফিরে এলেন স্বাধীনতার কিছু পরে। ঢাকায় এসে তিনি ‘ডেইলি নিউজ’-এর সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। একদিন সৈয়দ মোহাম্মদ আলীর টেলিফোন পেলাম। তিনি বললেন, ‘ডেইলি নিউজ’ আমার একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশ করতে আগ্রহী, আমি অনুগ্রহ করে তার অফিসে এলে তিনি খুশি এবং বাধিত হবেন। আমি রাজি হয়ে গেলাম। দৈনিক ‘ডেইলি নিউজ’-এর পুরো একটি পাতা জুড়ে প্রকাশিত হল সেই সাক্ষাৎকার। সৈয়দ মোহাম্মদ আলী এবং তার একজন সহকর্মী-দু’জন মিলে আমার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। সাক্ষাৎকারটি, জানতে পেরেছিলাম, অনেক পাঠকের প্রশংসা অর্জন করেছিল। এই প্রশংসার অনেকটাই প্রাপ্য আমার প্রয়াত সহপাঠী ও বন্ধুর। আজও তার কথা স্মৃতিতে ভেসে উঠলে ক্ষণিকের জন্যে হলেও হু হু হাওয়া বয়ে যায় মনে।
সঞ্জয় ভট্টাচার্যের মাসিক পত্রিকা ‘পূর্বাশা’
পঞ্চাশের দশকের ঊষাকালের আভা ফুটতে শুরু করেছে মাত্র, এমন সময় আমার কয়েকটি কবিতা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা শহরের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। কিছুদিন পর কলকাতার ‘পূর্বাশা’ পত্রিকাতেও আমি একজন প্রতিশ্রুতিশীল কবি হিসেবে স্বীকৃতি পেলাম। পর পর আমার কয়েকটি কবিতা ছাপা হলো। একবার আমার একটি কবিতা দিয়ে ‘পূর্বাশা’ শুরুই করা হলো। এটি ছিল আমার জন্যে বিরল সম্মান। এই বনেদি মাসিক পত্রিকা ‘পূর্বাশা’র সম্পাদক ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, এবং প্রাবন্ধিক সঞ্জয় ভট্টাচার্য। তাঁর সঙ্গে কখনও আমার দেখা হয়নি। শুধু চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ বজায় ছিল। তাঁর সঙ্গে দেখা না হওয়ার খেদ এখনও আমাকে বিষাদগ্রস্ত করে তোলে।
বুদ্ধদেব বসুর ত্রৈমাসিক ‘কবিতা’
আমি যে কালের কথা বলছি, সেকালে কবি এবং প্রাবন্ধিক কায়সুল, ছিলেন রংপুরের বাসিন্দা। এই সাহিত্যপ্রেমী মানুষটির ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল সঞ্জয় ভট্টাচার্য এবং পশ্চিমবঙ্গের বেশ ক’জন সাহিত্যিকের সঙ্গে। ‘পূর্বাশা’য় আমার কবিতা পড়ে বিস্মিত হয়েছিলেন তিনি। পূর্ব পাকিস্তান-এর শামসুর রাহমান এবং সঞ্জয় ভট্টাচার্যের পত্রিকায় যার কবিতা প্রকাশিত হচ্ছে তিনি যে একই ব্যক্তি, এটি তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। তাই নিজের সন্দেহ ভঞ্জনের উদ্দেশ্যে কায়সুল হক সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কাছে জানতে চাইলেন একটি পত্রের মারফত। ‘পূর্বাশা’র সম্পাদক তাকে জবাবে জানালেন যে, ওরা একই ব্যক্তি। তারপরই আমি পেলাম কায়সুল হকের প্রথম চিঠি। কিছু পরে আমাদের নিবিড় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। বলতে দ্বিধা নেই, তিনি আমার দু’তিনজন প্রকৃত বন্ধুর একজন। পরে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করার জন্যে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় আসার পর তিনি আমাকে বাঙালি পাঠক পাঠিকাদের তুমুল নাড়িয়ে দেয়া সব্যসাচী লেখক বুদ্ধদেব বসুর ত্রৈমাসিক ‘কবিতা’ পত্রিকায় কবিতা পাঠানোর তাগিদ দিলেন। সত্যি বলতে কী, বন্ধুর এই লোভনীয় তাগিদ সত্ত্বেও বুদ্ধদেব বসুর দরবারে কবিতা পেশ করার সাহস মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে নি। নিজেকে সংযত রাখলাম, পাছে আমার সাধের পঙক্তিমালা সম্পাদকের টেবিল-সংলগ্ন বাজে কাগজের ঝুড়িতে না নিক্ষিপ্ত হয়।
কিছুদিন পর আমি ‘রুপালি স্নান’ শিরোনামে একটি কবিতা রচনা করি। সেটি দাখিল করি ঢাকার এক সাহিত্য সম্পাদকের টেবিলে। একদিন পর আমার ডাক এল ‘সংবাদ’-এর সম্পাদক জনাব খায়রুল কবিরের কাছ থেকে। যথাসময়ে তার কামরায় প্রবেশের অনুমতি চাইলাম। তিনি হাসিমুখে আমাকে প্রবেশের অনুমতি দিলেন। আমাকে বসার জন্যে একটি চেয়ার দেখিয়ে দিলেন। অন্য একটি চেয়ারে বসে ছিলেন কবি ও সাংবাদিক আবদুল গনি হাজারী। খায়রুল কবির আমার দিকে এগিয়ে দিলেন ‘রুপালি স্নান’-এর পাণ্ডুলিপি। কবিতার কয়েকটি শব্দ লাল কালিতে গোলাকার চিহ্নে দাগানো। সম্পাদকের বক্তব্যের সারমর্ম হলো, আমি যদি দাগানো শব্দগুলো পরিবর্তন করে দিই তাহলে সেটি ছাপানো যাবে, নচেৎ নয়। আমি সবিনয়ে অসম্মতি জানিয়ে কবিতাটি ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিলাম। তারপর অনুমতি সহকারে সম্পাদকের কামরা থেকে বেরিয়ে এলাম। বাসায় ফিরে কবিতাটি কপি করে বুদ্ধদেব বসুর ২০২ রাসবিহারী এভিনিউর ‘কবিতা ভবনে’ পাঠালাম তাঁর বিবেচনার জন্যে। তিনি তখন কলকাতায় ছিলেন না; কিছু কালের জন্যে মহীশূরে অবস্থান করছিলেন বিশেষ দায়িত্ব পালনের জন্যে। বুদ্ধদের সেখান থেকেই চিঠি লিখে আমাকে জানালেন যে, চলতি সংখ্যা ছাপা হয়ে গেছে প্রায়, ‘রুপালি স্নান’ পরবর্তী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে। একটি শব্দ তিনি পড়তে পারেন নি, সেটি কী হবে লিখে কবি নরেশ গুহকে জানাতে বললেন। শব্দটি ছিল ‘যেশাস’। আমি তক্ষুনি শব্দটি স্পষ্টাক্ষরে লিখে একটি চিঠিতে নরেশ গুহকে জানিয়ে দিলাম। কিছুদিন পর চিঠির মাধ্যমে নরেশ গুহ এবং আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, যা আজ অব্দি বজায় আছে। বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় সেই সংখ্যার ছাপা প্রায় শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও পত্রিকাটির রীতি ভঙ্গ করে ‘রুপালি স্নান’ শেষ পাতায় ছাপা হয়। ব্যাপারটি খানিকটা দৃষ্টিকটু হলেও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। আমি পুরো ঘটনা কায়সুল হককে চিঠি লিখে জানাই। এরপর আমার অনেক কবিতা প্রকাশিত হয় বুদ্ধদেব বসুর পত্রিকায়। আমার দু’টি কবিতা ‘মনে মনে’ এবং ‘তার শয্যার পাশে’ দিয়ে বুদ্ধদেব শুরু করেন পরবর্তী সংখ্যা।
বলতে ভালো লাগছে, আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’-র অধিকাংশ কবিতাই ‘কবিতা’য় প্রকাশিত হয়েছিল। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের কোনও কবিরই এত বেশি কবিতা সেই পত্রিকায় ছাপা হয়নি। আবু সয়ীদ আইয়ুব তাঁর সম্পাদিত ‘পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা’ গ্রন্থে ‘মনে মনে’ এবং ‘তার শয্যার পাশে’ কবিতা দু’টি সঙ্কলিত করেছিলেন।
“অধুনা’ এবং ‘অমিত্রাক্ষর’
‘অধুনা’ একটি মাসিক সাহিত্যপত্র। না, এই ছোট পত্রিকা আর এখন প্রকাশিত হচ্ছে না অনেক বছর ধরে। পত্রিকাটি যারা প্রকাশ করেছিলেন, তারা সবাই ছিলেন তরুণ। শারীরিক ভাবে তরুণ না হলেও মানসিকভাবে আমি যে তরুণ ছিলাম সেকথা তরুণরা স্বীকার করতেন বলেই আমাকে ওরা মাসিক বেতন-সহকারে সম্পাদকের পদটির জন্যে নির্বাচন করেছিলেন। আমি সবিনয়ে নিবেদন করছি, অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল পত্রিকাটি। বেশ সুনামও অর্জন করতে পেরেছিল ‘অধুনা’। অনেক তরুণ লেখকের প্রিয় সাহিত্যপত্র হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, বলা যেতে পারে। অনেকেই আমাদের পত্রিকায় লেখার জন্যে উৎসাহিত হয়েছিলেন। আমার সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্যে অনেকেই এগিয়ে এসেছিলেন। আমি তাদের উৎসাহ এবং নিষ্ঠায় অনুপ্রাণিত হয়ে বহু কষ্ট করে দীর্ঘ সম্পাদকীয় রচনা করতাম রাত জেগে। সহকর্মীদের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে একাধিক সংখ্যায় কবিতাও লিখেছি।
কিন্তু কয়েক মাস পর যারা অর্থ সংগ্রহ করতেন পত্রিকাটির জন্যে, তাদের মূলধন দু’দিকে জ্বলতে থাকা মোমবাতির মতোই হুট করে খতম হয়ে গেল। তারা অধুনা’কে নিঃশ্বাস নিতে দিতে বাধ্য হলেন।
তবে দেখে ভালো লাগে, ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে কোনও কোনও জায়গায় এখন বেশ কিছু ছোটপত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। আমরা পড়ার সুযোগ পাচ্ছি কিছু শক্তিশালী, তরুণ এবং প্রতিশ্রুতিশীল লেখকের লেখা। সম্প্রতি ‘অমিত্রাক্ষর’ নামে একটি ছোট পত্রিকার জন্ম হয়েছে। ইতিমধ্যে এর দু’টি সংখ্যা প্রকাশনার আলো দেখেছে। এই পত্রিকার সম্পাদক আমিনুর রহমান সুলতান দৃষ্টিভঙ্গিতে আধুনিক তো বটেই, তার বিবেচনা সুস্থ এবং সুদূরপ্রসারী। তিনি প্রবীণ লেখকদের পরিহার করে পাশ কাটিয়ে চলেন না, নইলে আমার মতো একজন লেখকের, যার চুল শাদা, শরীর নড়বড়ে, তার কাছে কোনও লেখা চাইতেন না। তিনি লেখার বিষয় নির্ধারণ করেননি আমার জন্যে, শুধু একটি গদ্য রচনা চেয়েছেন আমার কাছে, বিষয়ের দড়ি বেঁধে দেননি আমার বিবেচনায়।