কথাসাহিত্য ছোটগল্প বিশেষ সংখ্যা

গ্র্যাফিত্তি রিপু | ফেরদৌস সাজেদীন | ছোটগল্প | উৎসব সংখ্যা ১৪৩০

সজীবের সকাল হয় সকাল সকাল। এত সকালে তার বিছানা ছাড়তে হবে এর কোন কারণ নেই। আর পাঁচজনের মত তার কোন কাজ নেই; তার অফিস নেই, স্কুল নেই। সে কিছুই করে না। কিছুই করে না তবুও বাড়ির আর সবাই ঘুমিয়ে থাকলেও, সে উঠে পড়ে। উঠতেই হয়, কারণ, তার চোখে ঘুম নেই। নেই কী, সে কখনই ঘুমায় না। ঘুম কী জিনিস সে জানে না। তন্দ্রা? পাতলা ঘুম? তাও না। জীবনভর সে জেগে আছে। জেগে আছে মানে জেগে থাকতে হয়। তন্দ্রা আর জাগরণের মধ্যবর্তী কোন অবস্থা? হবে হয়ত। এই নিয়ে তার কোন চিন্তা-ভাবনা নেই, অভিযোগও নেই। মনের উপর কোন-ই চাপ নেই। দিনের পর দিন।
আজও জানালার পর্দা সরিয়ে সজীব দেখে রোজকার মত ঝাপসা জগত। ফিকে অন্ধকার আলোর দিকে যেতে নিশপিশ করছে। আলো ততটুকুই, ল্যাম্পপোস্ট যততুকু আলো দিচ্ছে। তার জানালা বরাবর হিলসাইড অ্যাভিনিউর দোকানগুলোর ঝাঁপ টানা। মার্চের প্রাক সকাল ঝিমুচ্ছে। কেবল হঠাৎ হঠাৎ বাতাস ছাড়া। দমকা বাতাস। নিউইয়র্কের মার্চের বাতাসের মর্জি অভদ্র ও দম্ভের পর্যায়ে পড়ে। দাপাদাপি বাতাসের সঙ্গে শীতের প্রকোপ। তার পিতা অতীত দিনের গল্পে এই প্রসঙ্গটি অনিবার্য ভাবে আনেন। বাংলাদেশ থেকে তিনি তিরিশ বছর আগে মার্চ মাসেই আসেন। তার মাকে বছর পাঁচেক পরে পিতা নিয়ে আসেন। বিয়ের সময় তার মা’র বয়স ছিল ষোল। তার পিতা যখন এদেশে আসেন পকেটে তখন তাঁর পনের ডলার, স্যামসনাইট সুটকেসে কিছু কাপড় চোপর, ব্যস। তার পিতা মার্চে জেএফকেতে প্যান এম টার্মিনালের রুফটপ পার্কিংলটে তাঁর বন্ধুর একুশ বছরের পুরানো ডজ ডার্ট গাড়িতে উঠার সময় বাতাসের এলোপাথাড়ি চড় থাপ্পড়ে যারপরনাই নাজেহাল হয়েছিলেন, এই গল্পটি বেশ সরস করে বলে যোগ করেন, মার্চ মাসে বাংলাদেশের বাতাস বড় ততা, আর এইহানে বাতাসে শইল কাঁফে। এতগুলো বছর পরেও তার পিতার শীতের বিরুদ্ধে সীমাহীন নালিশ। শীতের আগেই তিনি কুঁকড়ে যান। তিনি এখন অবসর জীবন যাপন করছেন। কিছুদিন আগে কর্মস্থলের এলিভেটরে ঢুকতে গিয়ে ফ্লোর আর এলিভেটরের মধ্যেকার অসমতল স্থানে একটি বড়সড় হোঁচট খান। ডান পায়ের বুড়ো আঙুল বেশ ভালই থেঁতলে যায়। হাঁটুতেও আঘাত পান। হসপিটালে অর্থপেডিক সার্জনের সহায়তায় আরোগ্য লাভ করলেও তিনি আর কাজে ফিরে যাননি। কোম্পানির কাছে বিরাট অংকের ক্ষতিপুরণ দাবি করে বসেছেন। এখন ডলারের অপেক্ষা। আয় নেই, এই নিয়ে তাঁর মাথাব্যথাও নেই। কিন্তু সংসার চলছে। কেমন করে, তা অজ্ঞাত।
একটুপরেই তাঁর কাশির শব্দ পাবে সজীব। খুক খুক করতে করতেই তিনি বাথরুমে যাবেন। গোসল করবেন। কাজকর্ম নেই, তবু এত সকালে প্রায় প্রত্যহ গোসল পিতার মিস হয় না। তারপর তিনি হাঁটাপথের মসজিদে যাবেন। কাঁপতে কাঁপতে, ঠক ঠক করে। মসজিদ থেকে এসে তার মাকে বলবেন, শীতে মইরা গেছিগা, একটু ছা দেও। তিরিশ বছর আমেরিকায় বসবাস, গাড়ি চালাননি কোনদিন; চালাবেন কেমন করে, জীবনে তিনি ড্রাইভিং লাইসেন্সই করেননি। তিরিশ বছর আগে তাঁর পকেটে ছিল পনের ডলার; তার দৃঢ় বিশ্বাস, এত বছর পরেও পনের থেকে তিনি বেশিদূর এগুতে পারেন নি। সজীবের কোন অভিযোগ নেই। সে তার পিতার জীবন থেকে যোজন দূরত্বে বাস করে। তার পিতার পৃথিবী চলে গুনে গুনে গুন টেনে, আর তার পৃথিবী? দিবানিশি দুরন্ত, আকাশ ছোঁবে, পাতাল ছোঁবে।
তার চব্বিশ বছরের জীবনেও কিছুই নেই। তার পকেট শূন্য, কিন্তু সে নিঃস্ব নয়। সে তার পিতার মত বিড়বিড় করে না। সারাজীবন একটি মানুষ, যার বয়স মাত্র পঞ্চান্ন, তিনি একরৈখিক চলন বলন ও জীবন যাপনের বাইরে না গিয়ে একটিমাত্র কাজে সন্তুষ্ট থেকে, গার্মেন্টস শিপিং কোম্পানির ফোরম্যান, সেই কাজ থেকে বিদায় নিয়ে, বাকি জীবনের শ্বাস-প্রশ্বাসের আয়োজন করে, ঘরে, কিছুই না করে জীবন-যাপন করছেন, এর আরেকটি নজীর তার আর জানা নাই।
সজীবের স্নায়ু-ই তার নিয়ন্ত্রক; তার মনন-স্রোতে সম্মুখ আছে, কোন ধস নেই। সে তার পিতার কাছে সকাল বিকাল চিরকাল এক বিটকেল সন্তান হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু এতে সে বিড়ম্বিত নয়। তার মা শুধু কাঁদেন। তার মাথায় শিশুকে আদর করার মত হাত বুলান। মুখ দেখে বলেন, সজীব বাবা, খাবি, আয়। সে বলে, আমার ক্ষিদে নেই। আসলেই নেই। তার ক্ষিদে পায় না। খেলে খেল না খেলে নাই। খাওয়ার প্রয়োজন বা গুরুত্ব কোনটাই তার জীবনে নেই।
সজীব সাত সকালের জানালা খুলে দেয়। তার নগ্ন শরীরে বাতাস ঝাপটা দিয়ে জড়িয়ে যায়। তার বিনিদ্র শরীর-মন বশ পায়। সে এক নীরোগ-সবল-শিহরণকে তার শরীরের ভেতর যথেচ্ছাচারী হচ্ছে অনুভব করে। সে নিঃশব্দে মুখর হয়। সেই মুখর মুহূর্তে তার ভেতর একটা চাওয়া রোষ নিয়ে বিদ্রোহী হয়। সে জানালার ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যেতে চায়। তীব্র-দুরন্ত হাওয়াকে জড়িয়ে ধরে সে আকাশ ফুঁড়ে উঠে যেতে চায়। ঠিক সেই মুহূর্তে পাশের ঘরে খুক খুক কাশির শব্দ শোনে। পায়ের আওয়াজ পায়, তার পিতা বাথরুমে ঢুকেছেন। তার মা তাঁর আজীবনের পিঠের ব্যথার নিভৃত জীবন – তিক্ততায় নিয়ন্ত্রিত হওয়ার চেষ্টা করছেন। এই চিত্রটি সে নিয়ত অনুভব করে। সে তখন কাঁদে। তার বুকের ভেতর প্রার্থনার মত কান্না প্রলাপী হয়, সে কান্না কখনই দৃশ্যমান হয় না।
আজ তার পিতা মসজিদে যাবার জন্য বের হওয়ার আগেই সে দৌড়ে রাস্তায় নামে। সে তাঁর সামনে পারতপক্ষে পড়ে না। তাদের মধ্যে কথাও হয় না। সে এইরকম দৌড়ে রাস্তায় নেমে আসে প্রতিদিন। ঝড়, বৃষ্টি, স্নো, কিছুই তাকে আটকে রাখতে পারে না। প্রকৃতি যখন রুষ্ট হয়, তার চিত্তপ্রকম্প তখন বৃদ্ধি পায়। তার অন্তর্গত কামনা-বাসনা তীব্র হয়। সজীব তখন অদম্যের দাস হয়। সেই ছোটকাল থেকেই, বুদ্ধির উন্মেষের পর থেকেই। কখনও কখনও তার মা’র মুখোমুখি হলে, সেই দৌড়ে যাবার মুহূর্তটায়, মা জিজ্ঞেস করেন, নাস্তা খাবি আয়, স্কুলে যাবি।
সে দৌড়ে তিনতলার সিঁড়ির ধাপে পা ফেলতে ফেলতে চীৎকার করে বলে, না, আমি স্কুলে যাব না।
খাবি না?
না।
দাঁড়া সজীব।
মা সজীবের পকেটে একটি বিশ ডলারের নোট গুঁজে দেন। সে নোটটি ফিরিয়ে দিতে উদ্যোগী হয়। বলে, আমার লাগবে না মা। মা বলেন, এই একটি কথা অন্তত রাখ। সজীব মা’র কথা রাখে।
ব্যস। তাঁর কণ্ঠস্বর সারাদিনের জন্য অন্তর্হিত হয়। এলোমেলোভাবে এই করে করে সজীব টুয়েল্ভ গ্রেডের পরে আর স্কুলে যায়নি। ড্রপ আউট, আজ ছ’ বছর হল। সজীবের পাকাপোক্ত ধারণা, স্কুলে বন্দি হয় বোকারা, যারা অসহায় তারা, দিশেহারা মানুষেরা। তার মাথা ভাজা না, জন্ম থেকেই সে উন্মেষ ভারাক্রান্ত; তার মগজের কোষে কোষে নিরবধি জ্ঞান-যন্ত্রণা বাড়ে, কেবলই বাড়ে; উপচে পড়ে। সে নিয়ত সেই যন্ত্রণা সামলে সামলে এই চব্বিশ বছরে পৌঁছেছে। বাড়তি শিক্ষা তার পক্ষে নেয়া অসম্ভব। তাই স্কুলের এই বন্দি সময়টা পুরাপুরি নষ্ট সময়, সজীব এই বিবেচনা করে। পৃথিবী যেখানে খোলা, মানুষ সেখানে কেমন করে বন্দি হয়! এটা অর্থহীন। সজীব অ্যাবসলিউটলি তাই মনে করে। সে প্রাজ্ঞ, সে সর্বজ্ঞাত। তার বারো বছরের স্কুলগমন একটা বড়সড় ওয়েস্ট। এটা সজীবের দম্ভ নয়, এটা তার বুৎপত্তিগত যাত্রাপথের পরম উপলব্ধি।
সজীবের ড্রপআউট নিয়ে তার পিতাকে সে কোন উচ্চবাচ্য করতে দেখেনি। সজীবের ধারণা তার এই সিদ্ধান্তে তিনি অন্তরে অন্তরে বিশেষ আরাম বোধ করেছেন। তার জন্যে তার পিতার অতিরিক্ত কোন খরচ হবে না, স্কুলের ফি থেকে তাঁর মুক্তি, সজীবের পিতা বেঁচে গিয়েছেন। এমন নির্জীব, চতুর, নির্মম, বিবেকহীন মানুষ আর একজন আছে বলে সজীবের সন্দেহ হয়। তিনি গর্জন করেন না কখনই, কিন্তু আশ্চর্য এক কৌশলে তিনি গর্জন-উত্তর-নষ্ট-প্রবাহ সৃষ্টি করেন, সজীব অবাক হয়। তাঁর কণ্ঠস্বর বরাবর নিস্তেজ, কিন্তু চারপাশ তাঁর এই নিস্তেজ গলাতেই কেমন করে উপদ্রুত অঞ্চলের ভেংচি কাটে, সজীবের বোধে আসে না।
সজীব স্পষ্ট অনুভব করে, তার মা তাঁর পিঠের ব্যথায় যে একটু ককিয়ে উঠবেন তার প্রকাশ থেকে কী নিদারুণ কষ্টেই না বিরত থাকতে চেষ্টা করেন। তার পিতার পিশাচ ঠান্ডা-নিগৃহের কাছে মা নতজানু থাকেন। তার মা এত নিরীহ, সজীব ভেবে পায় না, কেন!
সজীব হিলসাইড অ্যাভিনিউ ধরে কুইন্স বুলেভার্ডের দিকে হাঁটছে। বাংলাদেশি হালাল গ্রোসারি ও সুপারমার্কেটগুলি ছাড়া আর সব দোকানের ঝাঁপটানা। কিছু গাড়ি রাস্তায় নেমে এসেছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই ঝাঁক বেঁধে ছুটবে। ফুটপাত ফাঁকা। কে বলবে, ঘন্টা দুয়েক পরেই রাস্তার দুপাশের হাঁটাপথে হাট বসতে শুরু করবে। সজীবের পিতা এই বাংলা-হাটের নিয়মিত সদস্য। এখন কাজ নেই, তাই আরও মজে গেছেন হাটে। সর-ভাসা চা, সিগারেট, মুখ-গহ্বরে সুপারি-খয়ের-চূন-জর্দা-চমনবাহার ঠাসা পানের খিলির চূর্ণন আর দাঁতের পাটি খোলা গাল-গল্প। এইসব গাল-গল্পে ‘কাউলা’ শব্দটা অনিবার্যভাবে আসবেই। গপ-সপের একটি নমুনা সজীব দেয় – আগে এই অঞ্চলে ‘কাউলা’রা গিজ গিজ করত, এখন তো নাই বললেই চলে; একই লাল রক্তের মানুষ একজন আরেকজনকে ‘কাউলা’, ‘কালা’ বলে কী বজ্জাত – আনন্দ আহরণ করে সজীব বোঝে না। এসব ছাড়া তার অবশ্য ভালোই লাগে দেখতে এই লোকারণ্য। মানুষ আনন্দ করছে, এরা সময়ের দাস না, এর চাইতে মানুষের আর বড় কী চাওয়ার আছে তার জীবনের কাছে? মানুষের মুখে হাসি দেখতে ভালো লাগলেও, সজীবের নিজের ভালো লাগার ক্ষেত্র বিস্তৃত। বিস্তৃত বলেই তার দখলে সময় বরাবরই নিষ্পিষ্ট থাকে। সারা শহর তাকে ডাকে। বিশেষ করে ম্যানহাটান। ডাউন,আপ, ইস্ট, ওয়েস্ট করে করে তার সারাদিন কেটে যায়। শহরটি সজীবের বড় প্রিয়। তার প্রাণ শহরের অলি গলিতে মিশে আছে। কত কী দেখার আছে, সর্বত্র কত কত ডাক! ম্যানহাটানের সো হো’র গ্র্যাফিটি সরিসৃপের মত এগোয় মিডটাউনের ঝলমল অঞ্চলে; সে দেখে, ইটের টুকরো যেমন বালকের পথচলার খেলা হয়ে পায়ের ঠোকায় সরে সরে সামনে যায়, তেমনি খেলায় খেলায়, সময়ের বিবর্তনে গড়ে উঠে কিকিং কালচার; ডাউনটাউন-কালচারের রূপরসগন্ধ উপনীত হয় মিডটাউন বা আপটাউনে, বা ভাইস ভারসা। এইসব কলরব ছেড়ে সে বাড়ি ফিরতে চায়না। এও সজীব ভেবেছে, সে চিরদিনের জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। পৃথিবীর পথে বেরিয়ে পড়ে। পারে না। তার তখন মা’র মুখটি ভাসে, তার হৃদয় কাঁদে, সে তাই ঘরে ফিরে আসে। এত সুন্দর তার মা, তরুণীর মত ছিপছিপে, এমন মায়াভরা মুখ, তুল্য করে আরেকটি এমন মুখ সজীব আর দেখেনি। পবিত্রতার চুমকি দিয়ে মোড়া তার মায়ের শরীর। তারপরেও সে কোন্ এক অভাগা – কৌশলে মায়ের মুখের লুকানো দুঃখ, কষ্ট, বেদনার প্রস্রবণ দেখে, সে বোঝে না। তার মায়ের বিয়ে হয়েছিল ষোল বছর বয়সে। মাত্র বালিকা থেকে কিশোরী হয়েছেন, বিয়ে হয়ে গেল? বিয়ে হয়েছে, তা-ও তার পিতার সঙ্গে? যার বয়স তার মায়ের বয়সের চেয়ে পনের বছরের বেশি! মায়ের বয়সের সমান ফারাক! কী করে পারলেন পিতা! সজীব কেবলই তার প্রশ্ন ও বিস্ময়ের অতল দেখে।
সজীব রোজকার রাস্তায় তার পথে হাঁটতে থাকে। সে বাতাস কেটে দৌড়ে যায়। কুইন্স বুলেভার্ড গাড়িতে সয়লাব। রাশ আওয়ার। তার চেনা শহরের চেনা ছবি। হাঁটতে হাঁটতে সজীব অনুভব করে সে পৃথিবী পরিভ্রমণ করছে। এও অনুভব করে যে, যতই সে হাঁটে, ততই সে শক্তি অর্জন করে। সে কখনই পরিশ্রান্ত হয় না, উলটো, সে চার্জড্ হয়। সজীব ফুটপাতের সকল মানুষের ভাষা বোঝে। কেবল বোঝেনা তার পিতার ভাষা। মানুষের ভাষা বোঝা যায়, পিতার ভাষা? তাঁর ভাষার ব্যুহ ভেদ করা দুরূহ। তার মা এখন কী করছেন সজীব জানে। মসজিদ ফেরতা স্বামীর জন্য ব্রেকফাস্ট তৈরি করছেন। পিতার কোন নড়চড় নেই। তিনি প্লাস্টিকে মোড়া লাল সোফা-চেয়ারে পা তুলে আসন পেতে বসে আছেন। তিনি টিভি দেখেন না, কিছুই পড়েন না। কিন্তু সময় তাঁর বয়ে যায়। কেমন করে? সজীব জানে না। কফি টেবিলে মা রুটি, সবজি, ডিম আর চা দিয়েছেন। তার মার সঙ্গে পিতার কোন বাক্যালাপ নেই। মা কিচেনে ফিরে যাচ্ছেন, পিতা মুখ খুলে বলছেন, বরাবরের নিস্তেজ প্যাচপ্যাচে গলায়, রুডি ত অক্করে পুইড়া গ্যাছে।
আরেকটা আইনা দেই। মা পিতার মুখের দিকে না তাকিয়েই উত্তর দেন।
থাউক, ছলব। ঠান্ডা গলায় তার পিতা ঘরময় বিসুভিয়াসের লাভা ছড়িয়ে দেন। সজীবের পিতা তার মা’র উপর কারণে-অকারণে প্রতি পদে পদে রুষ্ট আচরণ করেন, মানসিক অত্যাচার করেন, তাঁর আবিষ্কৃত এক অভাবিত কৌশলে, নিষ্ঠুর শীতল ছোবলে। কেন? তিনি কি বিকারগ্রস্থ? সজীব কত কী জানে, এর উত্তর জানে না। তার মা সব সহ্য করেন। সজীব কত কত দিন প্রার্থনার মত জানতে চেয়েছে, কেন মা , কেন?
সজীব হাঁটছে আর ভাবছে, আজো সনোমা নিশ্চয়ই এখনও ঘুমিয়ে আছে। সে পৌঁছুতে পৌঁছুতে সনোমা জেগে উঠবে। তার এই যাত্রাপথে সে দেখে নিচ্ছে মানুষের গোষ্ঠীবদ্ধতার অপরূপ স্বরূপ। খণ্ডে খণ্ডে উন্মোচিত হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন দেশ, তার মানুষ ও সংস্কৃতির বৈচিত্র। নিউইয়র্কের কুইন্সের মত এমন ভিন্ন ভিন্ন জাতির বসতি দুনিয়ার আর কোথাও আছে কি? আইরিশ, জার্মান, ইটালিয়ান, কোরিয়ান, চাইনিজ, রুমানিয়ান, রাশিয়ান, কলম্বিয়ান, পোর্টোরিকান, ব্রাজিলিয়ান, গায়ানিজ, জ্যামাইকান, কেনিয়ান ইন্ডিয়ান, বাংলাদেশি, পাকিস্তানি, নেপালি, সব, সব। কুইন্স যেন ভুবনডাঙার চিত্রিত এক লোকালয়; সজীব হাঁটে, আর দেখে; লাফ দিয়ে দিয়ে সে যেন এক ল্যান্ড থেকে আরেক ল্যান্ডে ল্যান্ড করে নাবিকের মত। কুইন্স বুলেভার্ড নিউইয়র্কের কুইন্স কাউন্টির বুক চিড়ে ইস্ট রিভারের কুইন্সবরো ব্রিজে তুলে দেয়। সজীব ব্রডওয়েতে এসে আজকাল ডানে মোড় নেয়। একটু ডিটোর। ব্রডওয়ে টানা গিয়ে পরে নর্দার্ন বুলেভার্ডে, তারপর বাঁয়ে গেলেই আবার কুইন্স বুলেভার্ড। এই ডিটোরটি সে নেয় সনোমার জন্যে। সনোমাকে দেখে তারপর তার দিনের শুরু হয়।
কয়েকমাস আগে আকস্মিকভাবে ওর সঙ্গে সজীবের পরিচয়। সজীব জ্যাকসন হাইটসের পাশ দিয়ে ব্রডওয়ে ধরে এগুচ্ছে; ব্রুকলীন-কুইন্স এক্সপ্রেসওয়ে যেখানটায় ব্রডওয়ের নিচ দিয়ে চলে যায়, ঠিক তার উপর ডান পাশে ব্রিজের কোনায় ত্রিভুজমত খালি জায়গায় প্লাস্টিকের টেবিল ক্লথ ও কার্ডবোর্ডের টুকরো দিয়ে বানানো একটি আস্তানা দেখে। হোমলেসদের আশ্রয়স্থল। নিউইয়র্ক শহরের যত্রতত্র, বিশেষ করে ঘনবসতিপুর্ণ জায়গায় এসব চোখে পড়ে। সেদিন সে দেখে একটি তরুণী রাস্তার পাশেই ফুটপাতের গার্বেজ ক্যানের ভেতরে হাতড়িয়ে কিছু খুঁজছে। সজীব অনুমান করে, খাবার-টাবার হবে। সে সাঁতপাচ না ভেবে, খানিকটা কৌতূহলের বশে গার্বেজ ক্যানের ভেতর উঁকি দেয়। দেখে কিছু আবর্জনা উলটে পালটে মেয়েটি কিছু খুঁজছে। সজীব জিজ্ঞেস করে, কি খুঁজছো, খাবার?
হ্যাঁ। তোমার কি? দূর হও। মেয়েটি ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলল।
সজীব দূর হয়ে যাবার আগে বলল, কোথাও যেও না, আমি আসছি। সে প্যান্টের পকেটে হাত গলিয়ে বিশ ডলারের নোট স্পর্শ করে।
‘কাবাবিশ’ রেস্টুরেন্টটি নিকটেই। কয়েকটি কাবাব আর রুটি নিয়ে মেয়েটির কাছে ফিরে যায়। গিয়ে দেখে সে তার কার্ডবোর্ড ঘেরা আস্তানায় বসে আছে। গোগ্রাসে মেয়েটি খাবার শেষ করে। তারপর থেকে প্রায়-ই সজীব যায়। কথা হয়।
তোমার নাম কি? সজীব প্রশ্ন করে।
সনোমা।
সুন্দর নাম। সাহস নিয়ে সজীব জিজ্ঞেস করে, এখানে থাকছ কেন? সনোমা কিছু মনে করল না। সে চুপ করে রইল। সেদিন আর কিছু বলল না। সজীবের আগ্রহ বেড়ে গেল ওর প্রতি। ওকে দেখে এবং আলাপ করে সে বুঝতে পারল, মেয়েটি একদম পথের না, পড়াশোনা আছে। সম্বলহীন ঘরের না। কয়েকদিন পরে সজীব যা জানতে পারে, তার জন্যে সে প্রস্তুত ছিল না। সজীবকে বলল,
আমি যখন তের, তখন আমার বাবা মারা যান। আমার মা আরেকটি বিয়ে করেন।
তোমার বয়স এখন কত? কিছু মনে করো না বয়স জানতে চাইলাম বলে।
না, মনে করিনি। বাড়ি ছাড়ার পর তুমিইতো আমাকে প্রথম সাহায্য করেছ। তুমি আমার বন্ধুর মত।
মত না, বন্ধু। সজীব বলে।
এই ওয়ার্ল্ডে আমার কেউ নেই। সনোমা’র গলা ভেঙে গেল।
বললে না? তোমার বয়স কত?
আমার বয়স এখন সতের।
সতের? রাস্তায়, এখানে?
আমার উপায় ছিল না। সনোমা ডুকরে উঠে।
সে সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলল না। সজীবও ভাঙা মন নিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মায়াভরা, নিষ্পাপ মলিন মুখ, অবিন্যস্ত চুল। সনোমা মুখ খুলল, আমার বাড়ি নিউ মেক্সিকোর অলবাকারকিতে। থেমে বলে, আমার স্টেপ ফাদার, আবার থামে, তার চোখের পানি ধারাসম্ভবা; ফর্সা-তামাটে মুখে ক্রোধ ফণা তুলছে, বলে, সে একটা জানোয়ার, শুয়োর, আমাকে আমাকে, আমার মা’র আড়ালে, আবার থামে; এবার কান্নায় ভেঙে পড়ল, বলে, আমি ওর হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে যাই। সজীব সনোমাকে কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। এসব ঘটনা সে শোনে, পড়ে, টিভিতে দেখে, কিন্তু বাস্তবে কারো জীবনে এটা ঘটেছে এবং সেই-ই তাকে নিজের মুখে বলছে, সে বাকরহিত হল। একটা বাচ্চা মেয়েকে, তার স্টেপ ফাদার! পৃথিবীতে অবিশ্বাসের আর কিছু রইল না। সেদিন সজীব অনেকক্ষণ ছিল তার সাথে। তারপর থেকে সে সনোমার কাছে রোজ আসে, কিছুক্ষণ ওর সঙ্গে কথা বলে, কখনও পকেটে পয়সা থাকলে, কিছু খাবারের ব্যাবস্থা করে দিয়ে তার জীবনভরের অন্তরের শহরে আনন্দের পাখি হয়।
আজ সনোমার জন্যে ‘কাবাবিশ’ থেকে একটি শিক কাবাব আর একটি নান নিয়ে সাঁইত্রিশ নম্বর অ্যাভিনিউ পার হয়ে সনোমার কার্ডবোর্ড ঘেরা আস্তানার দিকে সজীব এগিয়ে যায়। কাছে গিয়ে সে দেখে সনোমা শুয়ে আছে। পরক্ষণেই তার চোখে পড়ে, সনোমার খোলা পিঠে আঁচড়ে আঁচড়ে রক্তের দাগ। নখের! সজীব তার শরীরে ধাক্কা দেয়, ডাকে, সনোমা, সনোমা! সনোমা কিছু বলতে পারল না। সে ব্যথায় ককিয়ে উঠছে। তার শরীরের কাপড় ছেঁড়া, লণ্ডভণ্ড, মুখে কামড়ের ক্ষত। কোন চণ্ডাল সনোমার শরীরে প্রবিষ্ট-খেলায় মেতে উঠেছিল? সজীব পাগল প্রায়। কী করে, কী করে; সে সনোমাকে দুই হাতে কোলে তুলে নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে এল্মহার্স্ট হসপিটালের দিকে ছুটে যায়। ইমার্জেন্সিতে রেখে সে রাস্তায় ফিরে আসে। সে বুলেটবেগে তার বাসার দিকে ছোটে। শা শা করে কুইন্স বুলেভার্ডে বাতাস কেটে কেটে সে পাগল প্রায়, সে স্পষ্ট শুনছে, তার মা’র রোজ রাত্রের গোঙানির শব্দ! তার পিতার গোসলের শব্দ! নিপীড়িত মা তার!
সজীব বাসার দরোজায় ধাক্কা দেয়। কেউ খোলার আগেই দরোজায় পা দিয়ে প্রচণ্ড জোড়ে লাথি দেয়। দরোজার কপাট হিঞ্জ থেকে আলগা হয়ে যায়। সে দেখে, তার পিতা তার শখের লাল সোফায় বসে আছে। শব্দ পেয়ে তার মা ছুটে আসেন। ততক্ষণে সজীব তার পিতার গলা দুহাতে প্রচণ্ড শক্তিতে চেপে ধরে। মুহূর্তেই তার পিতার জিহ্বা প্রায় সবটা ঝুলে পড়ে। চোখ গোল হয়ে বেরিয়ে পড়ছে। তার মা পেছন থেকে সজীবকে তাঁর শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে স্বামীর গলা থেকে সজীবের হাত ছাড়াতে বৃথা চেষ্টা করছেন।
পিতাকে ফেলে রেখে সজীব এক ঝটকায় তার মাকে দুহাতে কোলে তুলে নেয়। তারপর ঘরের ছাদ ফুঁড়ে ঊর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত হয়।

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field
    X