তীরন্দাজ Blog লেখালেখি আমার কবিতা | খালেদ হোসাইন | লেখালেখি
লেখালেখি

আমার কবিতা | খালেদ হোসাইন | লেখালেখি

নিজের কবিতা সম্পর্কে আলোচনা সহজ নয়। এ যেন কোনো প্রমাণ সাইজ আয়নার সামনে নিজেকে দাঁড় করিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ নিজেকে পর্যবেক্ষণ করা। এতেও সত্য ধরা পড়ে না, পড়তে পারে না। কারণ দর্পণে তো আমার ডান হাতটাতেই বাঁ-হাত বলে ভ্রম হয়।

মানবীয় চৈতন্যের মধ্যেই আসলে প্রকাশোন্মুখতা নিহিত। প্রকাশের তাড়না না থাকলে শিল্প সৃষ্টি হতো না। কিন্তু ব্যাপারটা নিশ্চয় অনন্যপ্রবণ নয়। মানবমনের আস্বাদন আকাঙ্ক্ষাও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এ কারণেই সৃষ্টি শিল্প হয়ে ওঠে। আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস মানবীয় স্বভাবেরই স্বাভাবিকতা। আর এর ধারাবাহিকতা বস্তুগত ও নির্বস্তুগত নানা আয়োজন, আলোড়ন, দ্বন্দ্ব। এবং উত্তরণ। ভাষাই মানুষের মহত্তম আবিষ্কার। আবিষ্কার কি? অন্তত মহত্তম সম্পদ। ভাষার মধ্য

দিয়েই মানুষ নিজেকে প্রকাশ করে। তার রাগ-ক্ষোভ-আকাঙ্ক্ষা-আনন্দ-আন্দোলন, তার ঘৃণা, তার ভালোবাসা। এই প্রক্রিয়ায়ই সৃষ্টি হয় কবিতা। যে-কোনো কবিতা। সুতরাং আমার কবিতাও। আমি কে? পূর্বপুরুষের জিনবাহী এবং উত্তরপুরুষের উৎস এক মানবসত্তা। সেই বিবেচনায় আমি সভ্যতার সারৎসার। কিন্তু আমার একটি ব্যক্তিগত জীবন আছে, যা আর কারো নয়। আমার অভিজ্ঞতা একান্তই আমার, আনন্দ-বেদনাও তাই। সেই অভিজ্ঞতা, সেই আনন্দ-বেদনা অভিব্যক্ত হয় আমার কবিতায়।

আমি সভ্যতার নির্যাস, কিন্তু আমিই একমাত্র নই। আমার সত্তার মধ্যে এক ধরনের পূর্ণতা থাকা সত্ত্বেও সভ্যতার বিবেচনায় আমি তাই খণ্ডিত। আমার চৈতন্যের প্রকাশও তাই পূর্ণায়ত নয়। কিন্তু এর জন্য আমি কুণ্ঠিত নই, লজ্জিত নই। আমার যতটুকু সামর্থ্য, আমি শুধু ততটুকুই উজাড় করে দিতে পারি, দিতে চেষ্টা করি, দিই এটাই আনন্দ। অনেক আলোচক দেখিয়েছেন আমার কবিতা মূলত প্রণয় ও প্রত্যাখ্যানের প্রণোদনা ও প্রদাহে উদ্বেল। আমিও লক্ষ করেছি, ব্যাপারটা তা-ই। নিজেকে জানার জন্য আমার আর কোনো প্রচেষ্টা নেই, শুধু আমার কবিতায় প্রতিফলিত আমার বিচূর্ণ অস্তিত্বকে মিলিয়ে আমি অনুভব করি, আমি এ-ই । সামাজিক জীবনযাপনের মধ্যে অনেক ভণ্ডামী থাকে। বিশ্বাস-উক্তি ও আচরণের মধ্যে অনেক পার্থক্য রচিত হয়ে যায়। কিন্তু চৈতন্যের মৌলতা নিষ্কলুষভাবে বিধৃত হয় কবিতায়। জীবনের অনেক গোপনীয়তা থাকে, অনেক লজ্জা, ভয় কবিতার দিকে তাকিয়ে দেখি তার মধ্যে সাহসী ও অলজ্জ অনুভূতি অবিকৃতভাবে জ্বলজ্বল করে। তা থেকেই আমি নিজেকে চিনে নিই ।

আমার কবিতার সাফল্য ব্যর্থতার খতিয়ান নিয়ে আমি ভাবি না। কিন্তু একথা বলা যায় যে, অন্তর্গত দুর্দমনীয় তাগিদ ছাড়া আমার কোনো কবিতা রচিত হয়নি। আমার অনেক কবিতাকেই অনেকে উল্টোভাবে বুঝেছেন, লক্ষ করেছি। আমি তাদের ধারণা পাল্টে দিতে চাইনি। দেরিদা পাঠের আগে থেকেই বুঝেছি, পাঠকমাত্রই স্বতন্ত্র অনুধাবন এবং ব্যাখ্যার অধিকার সংরক্ষণ করেন। সকল রচনার একজন মুনীদত্ত থাকে না, থাকার দরকার নেই, কবিতার ক্ষেত্রে তো নয়ই। তবে কবিতার সৃষ্টির অন্তরালবর্তী ইতিহাস প্রায়শই জটিল। রক্তক্ষরণে, আকাঙ্ক্ষায়, রহস্যময়তায়, মাধুর্যে। আমি যখন আমার কবিতা পড়ি, তখন সেই ইতিহাস সৃষ্টির তোরঙ্গ থেকে ন্যাপথলিনের গন্ধমাখা যে বাতাস বয়ে আনে, পাঠক তা কোনোদিনও পাবে না। পাবেই না।

একবার একটি মেয়ে আমার একটি কবিতা পড়ে খুব কেঁদেছিল। মেয়েটি তখন আমার প্রেমিকা, এখন আর মেয়েটি নেই, মহিলা। ভদ্রমহিলা এখন দুই সন্তানের জননী। তিনিও হয়তো অমুদ্রিত কবিতা থেকে কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে আমার অন্তর্গত সত্তার যা তার সত্যের পরিচয় পেতে চেয়েছিলেন। কতটুকু পেয়েছেন, তিনি জানেন। আমার কবিতার ডায়রিতে তার চোখের জল যে আলপনা অঙ্কন করেছে, তা অনপনেয় হয়ে আছে।

কবিতার প্রকৃতিই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু একবার একজন অধ্যাপক বন্ধু আমার কবিতার বইটি যে খুব ভালোভাবে পড়েছেন, তার প্রমাণ দিতে গিয়ে তিনি আমার কবিতার আকৃতিগত খর্বতার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন। তাঁর কাছেই জানলাম আমার দুটিমাত্র কবিতা দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় পদার্পণ করতে পেরেছে। ভয়াবহ নয়? আমি তাঁকে বলেছি দীর্ঘ দীর্ঘ কবিতা লিখতে। দীর্ঘ কবিতা পড়তে আমার ভালোই লাগে।

কোনো তত্ত্ব মাথায় নিয়ে কবিতা লিখিনি কোনোদিন। কবিতা লিখতে বসে পাণ্ডিত্যের পরিচয় দিতে চেয়েছি বলে মনে পড়ে না। কবিতাই লিখতে চেয়েছি, পাঠক-বিভ্রান্তিকর জটিলতার অন্ধকার রচনা করতে চাইনি। চাই না। ফলে আমার কবিতার মধ্যে প্রচলিত অর্থে এক ধরনের সরলতা লক্ষ করা যায়। ব্যাপারটা মজার। কারণ, এই সরলতা দৃষ্টি বিভ্রান্তিজনিত। অন্তত আমার কাছে। দেখি, কবিতার পরিচ্ছদকেই কবিতা ভেবে ভুল করছেন আলোচক। তাকে ঠেকাবে কে? এ থেকে আমার মনে হয়, কবিতার হৃদয়ের গভীরে সকলে যেতে পারে না। শিক্ষিত পাঠকদের কথা ভেবেই কথাটা বললাম।

আমার একজন মহিলা সহকর্মী, আমারও শিক্ষক ছিলেন, বললেন, ‘তোমার বইয়ের নাম ইলামিত্র ও অন্যান্য কবিতা। ইলামিত্র কে? বনলতা সেনের মতো কোনো কল্পিত নারী?’ সাহিত্যের এ শিক্ষককে আমি কী বলব? শুধু একটু হেসেছি। এই হাসির মতো সরল আমার কবিতা।

আমার কবিতার আত্মকেন্দ্রিকতা সম্পর্কে অনেকেই আলোকপাত করেছেন। তা ঠিক আছে। আমি আমার অভিজ্ঞতার বাইরে যেতে পারি না। অনেকেই বলেন, আমি ছন্দ-সচেতন। ঠিক। আমার একজন প্রিয় বন্ধু, কবি ও প্রাবন্ধিক একটি কবিতার ‘গদা’ শব্দটিকে মিলের প্রয়োজনেই ব্যবহার করেছেন বলে মন্তব্য করলেন। সম্পূর্ণ কবিতার পরিপ্রেক্ষিতে ভীমের শত্রু হিসেবেই যে শব্দটি এসেছে, তা তিনি ভাবতেও পারলেন না। কী করি?

“তোমার জন্য’ শিরোনামে আমার একটি কবিতা আছে। এই তুমি মাতৃগর্ভে সৃজ্যমান আমার প্রথম সন্তান। আলোচক প্রেমিকা ভেবে ভুল করলেন। এই অধিকার তো তার আছেই।

মানুষ যেহেতু প্রতি পলে অনুপলে বদলে যায়, তাই রচিত কবিতার উপর তার আর অধিকার থাকে কি-না তা-ও বিবেচ্য। পরিপার্শ্ব বদলের সঙ্গে সঙ্গে চেতনারও রূপান্তর ঘটে। ফলে বোধ-সোধ-বিশ্বাসের স্তরান্তর ঘটে। আগের বিবেচনা পরে লঘু হয়ে যায়। এমনকি বিপ্রতীপতাকেও আশ্বস্ত চিত্তে আত্মস্থ করতে পারে। সৃষ্টি হতে পারে দ্বন্দ্বের বিকাশের ধারাবাহিকতায় সবই গুরুত্বপূর্ণ, গুরুত্বপূর্ণ না-হোক, প্রয়োজনীয়-বলা যায়। তাই নিজ-অনুভূতির কাছে সৎ, এমন কবিকে অভিযুক্ত করা কঠিন। অনুভূতির কাছে সৎ না থেকে কি কবি হওয়া যায়? যায় না। তাই কোনো কবিই অভিযোগনীয় নয়।

একটা ব্যাপার থেকেই যায়; একটা ব্যাপার বললাম বটে, কিন্তু এর অন্তর্গত ডালপালা অসংখ্য। কবির কাছে কি পাঠকের প্রত্যাশা থাকতে নেই? কিংবা পাঠকের কাছে কবির? এসব নিয়ে পাণ্ডিত্যপূর্ণ অনেক প্রবন্ধ, অভিসন্দর্ভ গ্রন্থ রচিত হয়েছে। মতামতের বৈচিত্র্য বেড়েছে বৈ কমেনি । কমবেও না। আমার মনে হয়, পাঠক শেষ পর্যন্ত প্রত্যাশা করে, এমন প্রণোদনা, যা তাকে উজ্জীবিত করে জীবনে ও জৈবনিকতায়। আর কবির প্রত্যাশা পাঠকের চিত্তকে ছুঁয়ে যাওয়া। এটাই অনুমোদন। এটাই আশ্রয়। আগে অবশ্য কবিরা পাঠকের হৃদয় জুড়ে থাকতেন। তাকে আচ্ছন্ন করতেন। এখন কি সম্ভব? এখন যে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক রচনা করে ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া। এটা অন-লাইন ভালোবাসার কাল। জীবনানন্দের কবিতার কথাই ধরুন। ডট বেশি। এটা ডট কমের (com) যুগ যে!

তারপর আসে, কবিতার কায়া বা শৈলী নির্মাণে কবির দক্ষতা-ব্যর্থতা। উপমা, রূপক-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্প ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব নিয়ে গবেষক-পণ্ডিতরাই অবশ্য বেশি ভাবেন। সাধারণ পাঠক, প্রকৃত প্রস্তাবে যারা অসাধারণ পাঠক, তাঁরা কবিতার খণ্ডিত বিবেচনাকে মূল্যবান জ্ঞান করেন না। তারা পূর্ণায়ত অভিব্যক্তির স্বর্ণরেখা বুকে বয়ে নিয়ে যান। আমার কবিতা তাদেরই মুখাপেক্ষী। যত লেখা উচিৎ, আমি তত লেখি না, যত ছাপা হওয়া উচিৎ, তত ছাপা হয় না, যত বই থাকা উচিৎ তত বই নেই—এরকম কথাবার্তাকে কি অভিযোগ বলা ঠিক হবে? এগুলো সব সত্য। যারা এসব কথাবার্তা বলেন, তারা আমাকে ভালোবাসেন। এই ভালোবাসা আমি পেতাম না যদি কবিতা না লিখতাম। তাহলে কবিতামুদ্রার বিনিময়ে আমি দুর্লভ ভালোবাসা অর্জন করতে পেরেছি। এর চেয়ে বেশি কিছু কি আমি কবিতার কাছে চাইতে পারি? আমার কিছু কবিতা হারিয়ে গেছে। এ জীবনে আর তাদের মুখ দেখা হবে না। তাদের জন্য বড় মায়া হয়। হারিয়ে গেছে বলেই হয় তো এত প্রগাঢ় মমতা।

খালেদ হোসাইন : আশির দশকের কবি।

Exit mobile version