উপন্যাস কথাসাহিত্য বিশ্বসাহিত্য

হাওয়ার্ড ফাস্ট | মুক্তির পথ (পর্ব ৮) | ভাষান্তর : মোবাশ্বেরা খানম বুশরা | উপন্যাস

পড়তে ৫ মিনিট লাগবে

পর্ব ৮

ওরা গোলাঘরের সেই দিকটায় ছিল যেটা অ্যালেনবি স্কুলবাড়ি হিসেবে ব্যবহার করছে। ওর ডেস্ক ছিল পশুদের খাবার রাখার বাক্সটা। ঘাস রাখার খোলা জায়গার চওড়া ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে উপচে পড়েছে। সস্তা কিছু কাগজ স্তূপ করে রাখা। ধার করা চারকোলের কাঠি, কেমন একটা বাচ্চা বাচ্চা গন্ধ যেটা গিডিয়ন ঠিক বলে বোঝাতে পারবে না। যদিও বাচ্চারা চলে গেছে তবু খিদে আর চাওয়া জায়গাটাকে ছেয়ে আছে। একটা ক্লাশের সময় গিডিয়ন ছিল আর বুড়ো মানুষটার অবিশ্বাস্য ধৈর্য দেখে অবাক হয়েছে। ও তখন বলেছে, ‘ওরা পশুদের মতো।’

‘অবশ্যই, তুমি আর কি আশা কর? কিন্তু ওরা শিখছে।’ ওদের শেখার ইচ্ছেটা বোঝা যায় স্পষ্ট। আর অ্যালেনবিও ধৈর্যশীল ভাল শিক্ষক।
‘কেন?’ গিডিয়ন ওকে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল। ও তো কখনো এমন কথা যেটা জেফের সাথে বলতে চায়, এভাবে বলবে ভাবে নি।
‘সেটা বলা শক্ত। হয়ত এজন্যে যে ও আগুনের মতো। তুমি কি জানো গিডিয়ন ওর মনের ভেতরে কি হচ্ছে?’
অপ্রস্তুত হয়ে গিডিয়ন উত্তর দিল, ‘না।’
‘ও কিন্তু এখনই লিখতে ও পড়তে পারে। ও একটা স্পঞ্জের মতো, সব কিছু শুষে নেয়। পুরো পৃথিবীটাকে ও নিজের ভেতরে শুষে নিতে চাচ্ছে। আর সেটা এত তাড়াতাড়ি যে আমার ভয় হয়। ও জানে ও কি করতে চায়, ও ডাক্তার হতে চায় গিডিয়ন।’
‘তুমি কিভাবে জানলে?’
‘আমাকে ও বলেছে।’
‘আমাকে তো কখনো বলে নি,’ গিডিয়ন বলল।
‘তুমি কি কখনো জিজ্ঞেস করেছ?’
গিডিয়ন মাথা নাড়ল, অ্যালেনবি বলে চলল, ‘তুমি কি কখনো নিজের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছ কোনো কিছু? চার্লস্টনের পথে হেঁটে যাওয়া লোকটিকে মনে পড়ে? তুমি আর সেই মানুষটি নেই, কিন্তু সে তো খুব বেশি দিন হয় নি? তুমি কি কখনো নিজেকে জিজ্ঞেস করেছ কি হচ্ছে তোমার? কি হচ্ছে আমাদের সবার, যে পৃথিবীটাতে আমরা বাস করছি তার? যখন তুমি সম্মেলনে বসে পরিবর্তনগুলোর পরিকল্পনা করেছ কখনো কি মনে হয়েছে এই পরিবর্তনটা প্রসবব্যাথার মতো হবে?’
‘জেফের ব্যাপারটা কি?’ গিডিয়ন আস্তে আস্তে বলল।
‘ওর ব্যাপারটা কি? ও তোমার ছেলে। ওকে যদি ঐ জলাভূমিতে নিয়ে যাও দিনে এক ডলার করে আয় করবে বলে, আমি বলছি না সেটা ভুল হবে। কিন্তু আমাদেরকে তো শুরু করতে হবে। এখানে কোনো স্কুল নেই এখনো, তবে ও উত্তরের কোনো স্কুলে যেতে পারে। ওখানে ম্যাসাচুসেটসে স্কুল আছে। ওরা কালো ছেলেদের নেবে, পড়াবে, শেখাবে ওকে।’
‘বুঝতে পারছি না কিভাবে,’ উদভ্রান্তের মতো বলল গিডিয়ন।
‘চার্লস্টনে তোমার বন্ধু আছে। সেই কারডোজো বলতে পারে।’
‘ওকে কেবল পাঠিয়ে দিলেই হবে?’ গিডিয়ন বলল।
জেফ মেয়েটিকে পাইনের বনে নিয়ে গেল, অনেক কিছু সম্পর্কে ওকে বলল, ছোট বড় অনেক জিনিসের কথা যা ওকে ঘিরে আছে। ‘এখানে একটা ব্যাং লাফিয়ে লাফিয়ে তোমার পায়ের ওপর দিয়ে চলে গেল।’ অস্তগামী সূর্যের কথা বলল, ‘একটা পুরোনো গোলাপ যেন ডালের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে।’ তবে বাতাসটাকে সে নিজেই অনুভব করতে পারত, ‘কারো হাতের মতো,’ বলল জেফকে। প্রথম দিকে পুরো শরীর জুড়ে একটা ভয় ওকে জড়িয়ে রাখত। আর যেন একটা দৈবের মতো, ভেতর থেকে কেন কিভাবে জানতে পেরে জেফ আস্তে আস্তে সেটা ভেঙে দিয়েছে। একটা গভীর অন্ধকার গুহায় বাস করত সে, যেখানে কোনো রং কোনো আলো ছিল না। এই অন্ধ মেয়েটি, যাকে জেফ মনে করছিল পৃথিবীর সুন্দরতম প্রাণী, সে যেন ভয় না পায় তাই তেমন কোনো কিচ্ছু ও করে নি, কোনো কথা কোনো পা ফেলা। ও তাকে ঝোঁপের দিকে নিয়ে যেত, চেষ্টা করত যেন ঝোঁপের ফুলগুলোকে ও অনুভব করতে পারে, সেগুলোর ওপরের মসৃণতাকে, ঘাসের ছোঁয়াকে, একবার একটা বুনো স্ট্রবেরি ফল ওর হাতে চটকে দিয়েছিল।
অ্যালেনবি ওখানকার লোকেদের ঠিক করে দেয়া একটা ঝুপড়ির ভেতরে থাকত। জেফ গেলে ও কিছু মনে করত না। যখন ঘরের কাজ থাকত না তখন ও মেয়েটিকে বই থেকে পড়ে শোনাত। একবছর আগে মারা যাওয়া বুড়ো সেক্সটন চাচার কাছ থেকে ও অনেক গল্প শুনেছিল। জলাভূমির গল্প, পাখি আর পশুদের গল্প, যারা নিজেরা কথা বলতে পারে, আশ্চর্য অদ্ভুত জীবন যাদের। সেসব গল্পও ও অ্যালেন জোনসকে বলত। র্যা শেল বুঝতে পেরেছিল মেয়েটার জন্যে ওর ভালবাসাকে, ওর মন কেমন করা কোমলতাকে যেন তাই গিডিয়নের মতোই। তাই মার্কাস যখনি জেফকে ঠাট্টা করত কনুই দিয়ে জোরে জোরে ওকে মারত র্যা শেল। তবু খুব মন খারাপ হতো, এলেন তো একটা অন্ধ মেয়ে! অন্ধ মেয়েকে তো সব সময়েই দেখশোনা করতে হবে, অন্ধ মেয়ে পুরুষ মানুষের বোঝা, যেভাবেই তুমি দেখনা কেন। আর জেফ তো এখনি অত বড় হয়ে গেছে যে বয়সে গিডিয়ন ওকে বিয়ে করেছিল। পুরুষের একজন নারীকে দরকার হয়, নারীরও পুরুষকে। কিন্তু একেবারে সমান সমান, যেন একটি স্কেলের দুটো ভাগ দুদিকে টানা।
অ্যালেনবি ওকে বলেছিল, ‘এটা ভালই হবে র্যা শেল দেখো।’

বনের পথ ধরে আধ মাইল গেলে যেখানে দক্ষিণের মাঠটা শেষ হয়েছে, সেখানে একটা জায়গা আছে যেটা আস্তে আস্তে চলে গেছে সামনে, পড়ে আছে খোলা, গাছের কাটা গুঁড়িতেভর্তি রোদে তেতে ওঠে। শকুনগুলো সেখানে আসত, পচে যাওয়া গুঁড়িগুলোর ওপরে বসে থাকত, একজন আরেক জনকে মাথা নাড়াত, আর পেঁচিয়ে থাকা বাগানের সাপগুলো রোদ পোহাত। সেখানে অ্যালেনকে নিয়ে যেত জেফ। গরম বালুর মধ্যে ওরা বসে রইত একটি পড়ে যাওয়া গাছে হেলান দিয়ে। আশ্চর্যরকম একা ওরা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা জেফ বসে থাকতে পারত আর শব্দ দিয়ে জগত তৈরি করত, যে মেয়েটি দেখতে পায় না তার জন্য। বাতাসে মেঘ আকাশ বেয়ে ভেসে যাচ্ছে, একটা ব্লুজে পাখি উড়ে যাচ্ছে, আর ওর নিজের স্বপ্নের ভেতর দিয়ে ও মেয়েটার জন্যে ছবি তৈরি করে দিচ্ছে।

আস্তে আস্তে খুব ধীরে ধীরে মেয়েটির ভেতরে কিছু ঘটতে লাগল। এর একটি দিক ছিল উষ্ণ বন্ধুত্বপূর্ণ সমাজের ভেতরে থাকা, সারাদিন লোকেদের গলা শুনতে পাওয়া, একটু দূরে বাচ্চাদের হাসির শব্দ, লোকেদের একজনের সাথে আরেক জনের কথা বলা। এইসব কিছুরই একটি অংশ ছিল জেফ, যে ওকে একবার বলেছে, ‘আমি তোমাকে খুব মিষ্টি করে ভালবাসি অ্যালেন।’ আরেকবার যখন জেফ ওকে ভালবাসায় জড়িয়ে ধরেছে ও বলেছিল, ‘প্লীজ জেফ আমাকে ব্যথা দিও না।’ তখন জেফ বুঝতে শুরু করেছিল এই মেয়েটির জন্যে জীবন কি ছিল, কি হয়েছে। এটা খুব অদ্ভুত আর বিশেষ কিছু। ওকে জানতে হবে, কিন্তু প্রশ্ন করার মতো তো কেউ নেই। ওর বয়েসী অন্য ছেলেরা তখন খাড়ির পাশে ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে মেয়েদের স্নান করা দেখে, ওদেরকে তাড়া করে, নাগালে পেলে ঘাসের ওপরে পেড়ে ফেলে।

‘তুমি কি করবে?’ অ্যালেন একবার ওকে জিজ্ঞেস করেছিল।
‘আমার মনে হয় যা করতে চাই আমি তাই করব।’
‘কিন্তু সেটা কি?’
‘তোমার বাবার মতো,’ ও বলল। জেফই প্রথম লোক যে অ্যালেনের সাথে ওর বাবার ব্যাপারে কথা বলতে পেরেছে।
‘ডাক্তার হবে?’ ও বলল, ‘হ্যাঁ তাই,’ জেফ উত্তর দিল। জেফের ভাবনাগুলো ছবি এঁকে যাচ্ছিল। এই গাঁয়ের ভেতরে ‘ডাক্তার’ মানে একজন হুইস্কি খাওয়া, বাজে, তামাকের রসে ভেজা দাড়িওলা লোক। একবার যখন একজন মহিলা মারা যাচ্ছিল, ও লোকেদের বলতে শুনেছিল ডাক্তারদের সম্পর্কে আজে বাজে অর্থহীন কথাবার্তা। ও ভেবেছিল এটা নিয়ে গিডিয়নের সাথে কথা বলবে। ওর বাবা তো জানবে, তারপরও ও এসব নিয়ে গিডিয়নের সাথে কথা বলতে পারে নি যদিও বাবাকে ও পূজা করত। ও এ্যালেনবিকেই জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ডাক্তার ঠিক কি করে?’
‘যে লোক অন্যদেরকে সুস্থ করে তোলে।’
‘সত্যিই তাই?’ এক বুড়ো গরিব মহিলা যে কিনা মাইল কয় দূরে বনের ধারে থাকত, একধরনের তন্তরমন্তর করত, জাদু দেখাত সেসব বেচে খেত। ওগুলোর মত?’ ও জানতে চাইল।
‘না ওগুলো নয়। এটা বিজ্ঞান থেকে হয়, কি জন্যে মানুষ অসুস্থ হয় তা জেনে, সেই জ্ঞান দিয়ে সুস্থ করতে হয়।’
‘মানুষ কেন অসুস্থ হয়?’
তো শুরুটা এইভাবে হল। আজ এখন অ্যালেনকে হাতে ধরে নিয়ে পাইনের বনের কাছে আসতে আসতে ও বলল, ‘ওরা আমাকে পাঠিয়ে দিচ্ছে।’
‘পাঠিয়ে দিচ্ছে? কোথায়?’
‘মনে হয় উত্তরে পড়াশোনা করতে, ডাক্তার হতে।’
এটা অবিশ্বাস্য; অ্যালেন কেমন অনুনয় করে বলল ও যখন থাকবে না তখন কে থাকবে? জেফ যেন বুঝতে পারল কিভাবে অন্ধকার নেমে আসছে। যেন এই চিন্তা ওর মাথায় আগে আসেই নি। ‘আমি তোমাকে ভালবাসি, তোমাকেই ভালবাসি, শুধু তোমাকে।’
‘কিন্তু তুমি তো চলে যেতে চাও।’
‘আমি চলে যেতে চাই,’ ও খুব দুঃখ নিয়ে বলল, ‘কিন্তু একদিন ফিরে আসব, আমি ফিরে আসব, নিশ্চয়ই ফিরে আসব। প্রতিজ্ঞা করছি ফিরে আসব।’
কারডোজোর কাছ থেকে উত্তর পাওয়ার পরেই কেবল গিডিয়ন র্যা শেলকে বলল। কারডোজো বলেছে হ্যাঁ, এমন ব্যবস্থা করা যাবে। জেফকে চার্লস্টনে ওর কাছে যেতে হবে। ও উত্তরে ওর বন্ধু ফ্রেডারিক ডগলাস ও আরো ক’জন বন্ধুকে লিখবে। একবারের জন্যে পঁচিশ ডলার দিলেই যথেষ্ট। কারডোজো জেফকে সমুদ্রপথে বোস্টন যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে। এবারে গিডিয়ন র্যা শেলকে বলল।
‘বোস্টন কত দূর?’
‘আমার মনে হয় হাজার মাইলের মতো’, গিডিয়ন বলল, ‘কিন্তু তুমি কি বুঝতে পারছ র্যা শেল এর মানে কি? আমাদের একটা বাচ্চা, একটা বাচ্চা যে দাসের ঘরে জন্মেছিল, বোস্টন যাচ্ছে ডাক্তারি পড়তে।’
র্যা শেল মাথা নাড়ল।
‘তোমার কি মনে হয় না যে আমি ওকে আমার সাথে রাখতে চেয়েছিলাম?’ গিডিয়ন জানতে চাইল।
আবারো র্যা শেল মাথা নাড়ল। গিডিয়ন ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘দেখ সোনা ছোট্ট সোনা, তুমি অনেক গর্বিত হবে ছেলের জন্যে, ভীষণ ভীষণ গর্বিত। দেখবে কেমন লম্বা দৃপ্ত পা ফেলে ও হাঁটছে।’

(চলবে)

পূর্ববর্তী (পর্ব ৭) লিংক

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field