কথাসাহিত্য ছোটগল্প

শিল্পী নাজনীন | উল্টোরথ | ছোটগল্প

আমি এখন আমার, একান্তই আমার। আজ থেকে শুরু আমার একান্ত অভিসার।

পড়তে ৬ মিনিট লাগবে

আকাশে আধখাওয়া চাঁদ। মিহি জোছনার রূপালি হাসি ফিকে হয়ে এসেছে অনেকটাই। রাতভর একা অপেক্ষায় থাকার ক্লান্তি নিয়ে ম্লানমুখে ফিরে যাওয়ার আয়োজনে রাত্রি গুটিয়ে নিচ্ছে অন্ধকারের পাতলা চাদর। দূরে, একটা হুতোম প্যাঁচা কেঁদে উঠল হুট করে, একটা কানাকূয়ো কুব কুব ডেকেই নীরব হয়ে গেল আবার। ঠিক তখন, জীবন আমার থেকে পাশ ফিরে শু’ল। না-কি আমিই জীবনকে পাশ কাটিয়ে ঘুরে শুলাম মৃত্যুর দিকে? হবে। অমনই কিছু একটা হবে হয়ত। কিন্তু আমার খারাপ লাগছে না। দারুণ স্ফূর্তিতে শূন্যে ভাসছি বরং। ভারহীন এই জীবন কী যে তীব্র আনন্দে অভিভূত করে দিচ্ছে আমায়! আহ! মুক্তি! মুক্তির তীব্র আনন্দ বিবশ করে দিচ্ছে আমায়, করে দিচ্ছে মোহমুগ্ধ।
ঘরটার দিকে নজর গেল হঠাৎ। এলোমেলো বিছানা-বালিশ, মেঝেতে ডাঁই করে রাখা, মাথার কাছে মাটির শানকিতে ছাই দেয়া, তাতে দলা দলা কফ-থুতু জমাট শুকিয়ে গেছে কখন, তার ওপরে মাছিদের মিছিল চলছে চক্রাকারে। যেন জীবনকে জাগিয়ে রাখতে তারা তুমুল আন্দোলনে নেমেছে হঠাৎ। এবং বিছানায়, বহুদিন, বহুদিন পর সটান পা ছড়িয়ে শুয়ে আছি আমি। আমিই? হাহাহা। না। আমার খোলস। অথচ এই খোলসটাকেই আমি বলে জেনেছি এতকাল! ওই খোলসটা আমি নই তাহলে! তাহলে আমিটা কে আসলে? এই যে ভরশূন্য আমি ভাসছি হাওয়ায়, উড়ছি শূন্যে, এই-ই তাহলে ‘আমি’? বেশ। নতুন এই ‘আমিত্বে’র বোধটুকু দারুণ উপভোগ্য লাগছে এই মুহূর্তে।
কিন্তু হঠাৎ পাওয়া এই ভরশূন্যতার বোধে খানিকটা দিশেহারাও লাগছে আমার, খানিকটা উদ্ভ্রান্ত। এখন কী করব আমি? কোথায় যাব? দ্বিধা ক্ষণকাল আগলে দাঁড়ায় পথ। পরক্ষণেই ঝেড়ে ফেলি তাকে, ফুৎকারে উড়িয়ে দিই হাওয়ায়। আহ। শান্তি। অপার শান্তি। কতদিন আটকে ছিলাম আমি এই গুমোট ঘরের প্রায়ান্ধকার ঘেরাটোপে, বিছানা ছেড়ে উঠতে পারিনি আমি কতকাল! আহা। প্যারালাইজড এই জীবন আমাকে কত কী যে শিখিয়েছে অবশেষে! চিনিয়েছে মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কতসব কপট মুখ! আজ কোনো আবরণ নেই আর, নেই সামান্যতম আড়ালের অনুষ্ঠানিকতাও। পাশের ঘরে যাব একবার? ভাবি। উচিত হবে কি? না, থাক। বিচ্ছিন্নতা যেখানে স্পষ্ট, বিভেদ যেখানে চুড়ান্ত, সেখানে বাড়তি কৌতূহল অভব্যতা শুধু নয়, অদরকারিও। পাশের ঘরে মাজহার ঘুমুচ্ছে। পাশে তার দারুণ সুন্দর, অতি আধুনিক বউ নীল। তাদের প্রাইভেসি নষ্ট করা একদমই অনুচিত আমার, ভীষণই অশোভন তাদের একান্ত অন্তরঙ্গতায় উঁকি দেয়া। কিন্তু মুশকিল হল, আমি ইচ্ছে করলেই নিজের জায়গায় থেকেও সব দেখতে পাচ্ছি এখন, সে যতই দূরের হোক কিংবা হোক কারো একান্ত গোপন। তবু মাজহার আর নীলের অন্তরঙ্গতায় উঁকি দিতে আমার ইচ্ছে করে না, রুচিও হয় না। যা আমার ছিল, ছিল একান্তই আপনার, তা অন্যের হতে দেয়ার, দেখার, যে অসহ্য যন্ত্রণা,তাতে তিলে তিলে দগ্ধ হওয়ার যে বিভৎসতা, আমার চেয়ে বেশি সেটা কে জানে জগতে আর! আমি তাই মাজহার আর নীলের বেডরুমে ভুলেও ঢুকতে চাইনি কোনোদিন, এখনো চাই না। আমার ভাবনা থেকে তাই তাদের সব অন্তরঙ্গতা নাকে লেগে থাকা সর্দির মতো ঝেড়ে ফেলি মুহূর্তেই। বরং উঁকি দিই জাহিনের ঘরে। কেমন হাত-পা ছড়িয়ে ছোট বাচ্চাদের মতো ঘুমুচ্ছে ছেলেটা। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে বনবন, খোলা জানালা দিয়ে ভোরের আভাস মুখ গলিয়ে দিয়েছে অনেকটাই, ঝিরঝিরে একটু হাওয়াও আসছে সেদিক দিয়ে জাহিনের মুখে, তবু চিকচিক করছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মুখে অদ্ভুত সারল্য ছড়িয়ে আছে তার। জীবন তার সবটুকু মায়া জাহিনের মুখে উগড়ে দিয়ে তাকে আঁকড়ে আছে নিবিড় করে।
দূরে, কানাকূয়োটা আবার কুব কুব করে ডেকে উঠল কোথাও। কয়েকটা পাখির ডানা ঝাপটানিতে জীবন আড়মোড়া ভেঙে পৃথিবীকে তুমুল প্রেমে জাগিয়ে তোলার আয়োজনে নেমে পড়ল আবার। শুধু আমার সঙ্গেই সব আত্মীয়তা ঘুচে গেছে তার। মিটে গেছে সব লেনদেন। এখন মৃত্যু আমার সহোদর, আত্মার আত্মীয়। নিজের বহুকালের পুরোনো, জীর্ণ ঘরটায় উড়ে উড়ে, ঘুরে ঘুরে আমি অপেক্ষা করি পৃথিবীর তুমুল জেগে ওঠার, জীবনের নাট্যমঞ্চ নিপুণ সব কুশীলবে জমে ওঠার।
পাশের ঘরে খুট করে একটা শব্দ হল। মাজহার দরজা খুলল, প্রতি ভোরে ঘুম ভেঙে সে ছাদে যায় এ সময়, ছাদের গাছগুলোতে জল দেয়, আগাছা পরিষ্কার করে, একান্ত কিছু সময় কাটায়। নীল দেরিতে ওঠে। ভোরের দিকে তার ঘুম গাঢ় হয় আরও, এ সময় তাকে জাগানো নিষেধ। সিঁড়িতে মাজহারের পায়ের শব্দ বাজছে। মৃত্যুর কী আলাদা কোনো গন্ধ থাকে? কোনো শব্দ? থাকে সম্ভবত। মাজহার পায়নি। পাওয়ার কথাও নয়। তার কাছে আমি ঢের আগেই মৃত। ঢের আগেই তার পৃথিবী থেকে মুছে গেছি আমি। তাই সম্ভবত নতুন করে আমার মৃত্যুর গন্ধ বা শব্দ বিচলিত করেনি তাকে। সে অন্যদিনের মতোই ধীর, শান্ত পায়ে একটা একটা করে সিঁড়ি ভেঙে ছাদে উঠে গেছে। আজ মে মাসের এক তারিখ। সারা ছাদ জুড়ে আছে আমার লাগানো হরেক ফুল আর ফলের গাছে। ফুল ভালোবাসতাম ভীষণ। নাম না জানা কত যে ফুল আমি যোগাড় করেছিলাম খেয়ে না খেয়ে! অফিস থেকে ফিরে যতটা সময় মিলত, পুরোটুকু ঢেলে দিতাম এই ছাদবাগানটার পেছনে, জাহিন আর মাজহারের পেছনে। মে ফ্লাওয়ারটায় ফুল ফুটেছে আজ। মাজহার সস্নেহে মে ফ্লাওয়ারটার গায়ে আলতো আদর বুলাচ্ছে। সে-ও ফুল ভালোবাসে। লোকটা পাঁড় প্রেমিক ছিল এককালে। প্রতি রাতে বেশ্যাবাড়ি থেকে মাতাল হয়ে ফেরার পথে সে ফুল নিয়ে আসত বাসায়। ছড়িয়ে দিত বিছানায়।
আমার মৃত্যু আর মে ফ্লাওয়ারটার ফুল হয়ে হেসে ওঠার মধ্যে কি যোগসূত্র আছে কোনো? না কি পুরোটাই কাকতাল? ভাবনাটা মাথাচাড়া দেয়ার আগেই কলবেল বেজে উঠল তারস্বরে। রমা এল। প্রতিভোরে আসে সে, আমার ঘরে ঢোকে সবার আগে, আমাকে সাফ-সুতরো করে তবে সে অন্য কাজে হাত দেয়। মাজহার নোংরা পছন্দ করে না। নীল আরও। যদিও আমার ঘরে নীল ঢোকে না কখনো। প্রয়োজন পড়ে না। এ বাড়িতে নীলের বউ হয়ে আসাটা নিতান্তই দৈব দুর্ঘটনা। মাজহার কী করে নীলকে রাজি করাল কে জানে! জীবন ভারি অদ্ভুত। কখন যে কার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, কার দিকে বাড়ায় তার উচ্ছলতার হাত, সেটাও অনিশ্চিত খুব। নইলে মাজহারকে নিয়ে আমার তো দিব্যি চলছিল দিন! তার বেশ্যাবাড়ি যাওয়া, গলা পর্যন্ত মদ গিলে মাতলামি করা নিয়ে আপত্তি প্রথম দিকে করেছিলাম বৈকি। মাজহার তাতে বদলায়নি। কিছু মানুষ থাকে, কোনো কিছুতেই যারা বদলায় না, পাল্টায় না কোনো পরিস্থিতিতেই। মাজহার তেমনই একজন। তার রক্তে আছে বহুগামীতার আদিম নেশা, পূর্বপুরুষের জমিদারি এখন নেই কিন্তু জমিদারির বনেদিয়ানাটুকু ধরে রাখার চেষ্টাটুকু এখনো ষোলোআনা আছে তার। হাহাহা। বেশ্যাবাড়ি যাওয়া আর মদ খাওয়াটাও কি তবে বনেদিয়ানার অংশ? মাজহারকে জিগ্যেস করা হয়নি কোনোদিন। জিগ্যেস করলে সে কী জবাব দিত কে জানে! আমি শেষপর্যন্ত তবু মেনেই নিয়েছিলাম মাজহারের সকল স্বেচ্ছাচারিতা, সব অনাচার। মোটামাইনের সরকারি চাকরি, নিজের নিরাপত্তার শতভাগ নিশ্চয়তা সত্বেও মাজহারকে আমি ছেড়ে যাইনি। আসলে পরিবারের সবার অমতে মাজহারের হাত ধরে ঘর ছাড়া আমি নতুন করে লড়াই শুরুর সাহস করতে পারিনি আর। বাপের বাড়ির সাথে আমার সব সম্পর্ক চুকে গেছিল মাজহারকে বিয়ের মধ্য দিয়ে। মাজহারকে বিয়ের মধ্য দিয়ে যে যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল, তাতে অল্পদিনেই গো-হারা হেরে যাওয়া আমার আর সাহস ছিল না নতুন কোনো যুদ্ধে নামার। তাই প্রতিবাদে কাজ না হওয়ায় পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে শিখিয়েছিলাম নিজেকে। তবু শরৎবাবুর সেই হিংসুটে বিধাতার মতো ভাগ্য ভীষণ ভ্রুকুটি করে মুখ ফিরিয়ে নিল আমার দিক থেকে। বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ করেই এক রাতে ঘুমের ঘোরে স্ট্রোক হয়ে গেল আমার। জাহিনের তখন চার চলছে, সে তখন অন্য ঘরে তার দাদির কাছে নিশ্চিন্তে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমুচ্ছে, মাজহার তখনো ফেরেনি তার নিত্যরাতের অভিসার সেরে। সে যখন ফিরল, তখন মাঝরাত্তির। কে একজন দরজা খুলে দিল, আমি শুয়ে শুয়েই শব্দ পেলাম। আমার জিব তখন আড়ষ্ট, কথা বলার শক্তি নেই, সারা শরীর অসাড়। কণ্ঠ দিয়ে গোঁ গোঁ একটা ভোঁতা আওয়াজ আমার বেরল বটে, কিন্তু মাথার ওপর পুরোদমে ঘুরতে থাকা পাখার আওয়াজ সেটাকে কারো কান পর্যন্ত পোঁছতে দিল না শেষ অবদি। প্রতিরাত্তিরের মতো সে রাত্তিরেও ফুল নিয়ে বাড়ি ফিরল আমার তুমুল প্রেমিক বর মাজহার। ছড়িয়ে দিল বিছানায়, আমার গায়ের ওপর। টান দিয়ে খুলে ফেলল নিজের ফিনফিনে পাতলা, সাদা পাঞ্জাবি, পাজামা, আরো সব পোশাক-আশাক। তারপর ধপাস করে বিছানায় পড়েই নাক ডাকাতে আরম্ভ করল সজোরে। আমাকে সে আবিষ্কার করল পরদিন, অতি ভোরে, যখন পূবাকাশের সূর্য তার লাজুক মুখটা সবে একটুখানি বের করেছে রাতের কালো ঘোমটা সরিয়ে। তখন আর জ্ঞান নেই আমার, মৃতবৎ পড়ে আছি খাটের একপাশে। তড়িঘড়ি অ্যাম্বুলেন্স ডেকে সেই সকালেই আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করাল মাজহার। সেই যে মাজহারের ঘর থেকে বেরোলাম আমি, আর ও ঘরে ঢোকা হয়নি আমার কোনোদিন। বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে, বহুবিধ চেষ্টার পর ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছিল, জানিয়ে দিয়েছিল যে, আমার সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে শূন্য। অগত্যা বাসায় ফিরিয়ে এনে মাজহার তার পাশের ঘরে আমাকে থাকতে দিয়েছিল দয়া করে। তাতেও আপত্তি ছিল না আমার, আদতে আপত্তি করার ক্ষমতা আর ছিলও না। শুধু চোখ আর কান দুটো সচল ছিল, আর ছিল আমিত্বের বোধ। বাকি সব জড়, মৃত। মৃত্য তবু পাশে এসে বসেনি তখনও আমার। আজ বসল এসে, জীবন আমার থেকে যখন পাশ ফিরে শু’ল, ঠিক তখন।
প্রথম স্ট্রোকের মাসতিনেক পরেই আবার বাড়াবাড়ি অবস্থা হয়েছিল আমার। বাধ্য হয়ে মাজহার আবার আমাকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল হাসপাতালে। ডাক্তার হাল ছেড়ে দিয়ে তখন বলেছিল, আর বেশি দেরি নেই। বড়জোর মাস ছয়েক।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত অত দেরি সহ্য হয়নি মাজহারের। আমার মৃত্যুর অপেক্ষায় থেকে নিজের নশ্বর জীবনের মহার্ঘ্য সময়টুকু নষ্ট করার বোকামি সে করেনি আর। তার কাছে জীবন মানেই উপভোগের ডালা, তা থেকে নিংড়ে নেয়া সম্ভাব্য সবটুকু আনন্দ, সুখ, সম্ভোগ। মাসখানেক পরের কোনো এক মাঝরাত্তিরে নীলকে নিয়ে মাজহার হাজির হল এ বাড়িতে। প্রায় বাপের বয়সী লোকটার হাত ধরে নীলের মতো শিক্ষিত, সুন্দরী একটা মেয়ে কেন যে এ বাড়ির বউ হওয়ার অভিশাপ কুড়াতে গেল, কে জানে! জড়বৎ পাশের ঘরে পড়ে থেকে আমি সব শুনলাম, সব দেখলাম। জাহিন তার ছোটমার ছবি কী যে উচ্ছ্বাস নিয়ে দেখাল আমাকে! আহা। শিশুর সারল্য। ভারি অপার্থিব। ভারি উপভোগ্য। তবু কেন যে জল এসেছিল সেদিন আমার চোখে! কেন যে দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে উঠেছিল সেদিন আমার এই গুমোট, ঘুপচি ঘরটার বাতাস। সে বাতাস হালকা হয়নি আর কোনোদিন। আরও ভারী, আরো গুমোট হয়ে উঠেছিল বরং দিনে দিনে। শুধু মনে হয়েছিল, নিয়মিত বেশ্যাবাড়ি যাওয়া মাজহারের বিয়েটা কি এতই জরুরি ছিল তখন? অন্তত আমার মৃত্যু পর্যন্ত কি অপেক্ষা করতে পারত না সে? যত মিথ্যেই হোক, তবু আমাকে ভালোবাসার কথা বলেই তো একদিন এই বাড়ির চৌকাঠ ডিঙিয়ে আমাকে ঘরে তুলেছিল সে! সেটুকু তো মিথ্যে ছিল না একদম। পরক্ষণেই মনে হয়েছিল, মাজহার মানুষ। আর মানুষ, সব পারে। সব। জীবন দিয়ে একথা আমি বুঝেছি প্রতিদিন, তিলে তিলে, একটু একটু করে। তবু মাজহারের প্রতি রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা, কিছুই নেই আমার। নিজের প্রতি ছিল বরং। ঘৃণা ছিল নিজের প্রতি। ছিল বমনোদ্রেককারী সীমাহীন বিতৃষ্ণা। এখন, এই মুহূর্ত থেকে সেটুকুও নেই আর। আমার তিলতিল করে গড়া সংসারে, আমার একটু একটু করে তৈরি করা ভালোবাসার সীমানায় দখল নিয়েছে কোথাকার কোন এক নীল নামের হাঁটুর বয়সী মেয়ে, এমনকি তাতেও আর কোনো কষ্ট নেই আমার, নেই সামান্য দুঃখবোধ। মানুষ তো। মানুষের প্রতি কোষে কোষে ছড়িয়ে থাকে স্বার্থের দানা, প্রতি অণু-পরমাণুতে মিশে থাকে ক্ষুদ্রতার পরিপুষ্ট বীজ। আমি মানুষ হয়ে যদি ক্ষমা করতে না পারি স্বজাতির এই জন্মগত ত্রুটি, তবে কে আর ক্ষমা করতে পারবে তাকে!
রমা প্রতিদিনের মতোই ঘরে ঢুকল আমার। বেডপ্যান পাল্টাবে বলে এগিয়ে এল আমার দিকে নিত্যকার অভ্যাসবশে। তারপরই চিৎকার সে তারস্বরে করে উঠল আচমকা। সারা বাড়ি চমকে জেগে উঠল রমার চিৎকারে। সদ্য ফোটা মে ফ্লাওয়ারে আরেক দফা জল ঢেলে, তার মিষ্টি গোলাপি শরীরে স্নেহের অতি কোমল পরশ বুলিয়ে মাজহার সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল ধীরে-সুস্থে। কোনো তাড়া নেই, কোনো উদ্বেগ নেই তার। আমি ঢের আগেই তার কাছে মৃত, নতুন করে আমাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার অভিনয়ের ক্লেশ নিতে সে অপারগ সম্ভবত। অবশ্য অভিনয়ের কোনো প্রয়োজনও নেই তার। সামাজিকতা, লৌকিকতা এসব বড় বাহুল্য তার কাছে, অদরকারি ভীষণ। জাহিন কাঁদছে। ছোট্ট সোনাটা আমার। কাঁদুক। পৃথিবীতে কান্নার চেয়ে নিভৃত কোনো সহচর নেই, যে মানুষকে সত্যিকার অর্থে কোনো যন্ত্রণা থেকে সামান্য হলেও মুক্তি দিতে পারে, দিতে পারে নির্বানের স্বস্তি। সেই একান্ত সহচরকে চিনতে শিখুক আমার জাহিন। সারাবাড়িতে মৃত্যু তার ভ্যাপসা, ভারী গন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে। গুমোট একটা বাতাস ভাসছে চারদিকে। এ বাড়ির সবাই অপেক্ষায় ছিল, আমার মৃত্যুতে সে অপেক্ষার অবসান হল আজ, সবার চোখে-মুখেই শোকের হালকা পর্দা চিরে উঁকি দিচ্ছে স্বস্তির দারুণ একচিলতে আলো। নীলের আর মাজহারের মুখে ঝুলছে স্বস্তির চিকচিকে ঝালর। আমার বাপের বাড়ির লোকজনকেও খবর দেয়া হয়েছে, তারাও এসে পড়েছে ঝটপট। জীবিত আমার মুখ দেখবে না বলে পণ করেছিল যারা, তার আজ এসেছে আমার হাড্ডিচর্মসার মৃত মুখটা দেখতে। জীবন। অদ্ভুত তার হিসেব-নিকেশ, আশ্চর্য তার বিচার-বিবেচনা। আমার মৃত্যুতে আজ তারা কাঁদছে। অথচ রাগে, ক্ষোভে, অভিমানে তারা এতদিন খোঁজ পর্যন্ত নেয়নি আমার, কীভাবে বেঁচে আছি, দেখতে আসেনি কোনোদিন কেউ। অথচ কত অর্থহীন এইসব অনুভূতিগুলো, কত অকিঞ্চিৎকর জীবনের এইসব ভালোবাসাবাসি, ঘর বাঁধা, সামাজিকতা, আরো আরো সব এমানতরো রেওয়াজ-রীতি, সেটা আমার চেয়ে ভালো এই মুহূর্তে কে জানে আর! মাজহার সম্ভবত জানে, তাই সে সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে, সব অনুভূতিকে পায়ে মাড়িয়ে উপভোগ করে জীবন! জীবন নামক খেলাঘরটাকে সে তাই ইচ্ছেমত সাজায় আর ভাঙে। কিন্তু মানুষের মধ্যে থাকা মানবিকবোধটুকুও কি অমনই ঠুনকো, তুচ্ছ, অর্থহীন? অমনই অকিঞ্চিৎকর? তাহলে জাহিনের চোখের জল কেন স্পর্শ করে উপস্থিত সবাইকেই! তাহলে কি সবই আপেক্ষিক? সময়ের সাথে সাথে বদলে যায় সবকিছুর সংজ্ঞা আর ধরন? ভাবনাটা গাঢ় হওয়ার আগেই শোরগোল শোনা যায়। আমি হাওয়ায় উড়ি, বাতাসে ভাসি। সারাবাড়ি ভরশূন্য ঘুরি। কত স্মৃতি। কত কথা। এ বাড়ির প্রতি কোণায়, প্রতি ইটে, ছাদে, ছড়িয়ে আছে কত একান্ত মুহূর্ত আমার। বহুদিন পর সেসব দেখি। স্মৃতির পাতা উল্টোই, নুড়ি কুড়োই, হাওয়ায় উড়োই।
আমার নিরুত্তাপ, ‘আমি’হীন শরীরটা তখনো পরে থাকে লাশবাহী ফ্রিজার ভ্যানে। আমার কোনো এক স্বজন বহুদূর থেকে ছুটে আসছে শেষবারের মতো আমার মুখটা একবার দেখতে। আমার মুখ! শব্দ দুটি খুব হাস্যকর আর অলীক মনে হয় এই মুহূর্তে। মানুষ কি আদৌ কারো মুখ দেখতে পায় কোনোদিন? আমিই কি কোনোদিন দেখতে পেয়েছি আমার মুখ? মানুষ যা দেখে তা আদতে মুখোশ। কৌতুককর এক খোলস বৈ-তো নয়। মুখোশকেই মুখ ভেবে ভুল করে সে জীবনভর। আয়নায় নিজের মুখ যদি দেখতে পেত মানুষ, তবে তাদের অধিকাংশই বমি করত নির্ঘাত।
বাড়িটার প্রতি একটা মায়া জন্মে গেছিল অজান্তে, কোনো একসময়। এখন নেই আর। জাহিন। আমার জাহিন। মায়া। তাকেও কাটিয়ে উঠেছি বৈকি। নইলে জীবন কি আর পাশ ফিরে শোয়! আমার জন্য একজীবনে বরাদ্দকৃত শরীরটা ত্যাগ করে আমি চলে যাচ্ছি মৃত্যুকে ভালোবেসে, মাজহারেরা আমার সেই শরীরটাকে লৌকিকতা শেষে নিয়ে যাচ্ছে শেষ গন্তব্যের দিকে।
ফ্রিজার ভ্যানের বিল নিয়ে মৃদু কথা কাটাকাটিও করে মাজহার, দেখে ভারি হাসি পায় আমার। মাজহার টাকা বাঁচাতে চাইছে। মানুষ বড় অর্বাচীন প্রাণী। দেখেও শেখে না, বুঝেও বোঝে না। এই যে আমি, ব্যাংকে স্বপার্জিত প্রায় পঞ্চাশ লক্ষাধিক টাকা রেখে ছুটি নিলাম জীবন থেকে, কিংবা জীবনই ছুটি দিল আমাকে সবরকম যন্ত্রণা থেকে, সেটা দেখেও কেন মাজহার বোঝে না, শেষ পর্যন্ত সবই পড়ে থাকে অচল পয়সার মতো, বাতিল মুদ্রার মতো সব ফেলে রেখেই শূন্যহাতে ফিরতে হয় একদিন গন্তব্যে, সবাইকেই? সম্ভবত মানুষের স্বভাবই এমন। সব জেনেও জীবনকে আঁকড়ে ধরে সে তুমুল প্রেমে, জড়িয়ে ধরে গভীর আবেগে। ভুলে যায়, জীবন আদতে এক কপট প্রেমিক, ভণ্ড প্রতারক। সব প্রেম তুমুল উপেক্ষায় ফেলে রেখে যে মুহূর্তেই ভালোবাসার মানুষটাকে ত্যাগ করে যায় নিতান্তই অপরিচিতের মতো। যেন সে মানুষটার প্রণয়ে জড়ায়নি কোনোদিন, ভালোবেসে তাকে বুকে টানেনি কোনোকালে। সব ভুল। বিভ্রম। মায়া।
জাহিন কাঁদছে। কাঁদুক। জীবনের প্রেমে মোহাচ্ছন্ন জাহিন মৃত্যুকে শোক জেনে কাঁদছে এখন। মৃত্যুর চেয়ে আপনার কিছু নাই, একদিন বুঝবে সে-ও। ভরশূন্য এই আমি যেমন জেনেছি আজ। মৃত্যুর ডানায় এখন আমার অনন্ত ভ্রমণ। আমি এখন আমার, একান্তই আমার। আজ থেকে শুরু আমার একান্ত অভিসার।

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field