কথাসাহিত্য ছোটগল্প বিশেষ সংখ্যা

রিমির গল্প | নাহিদা নাহিদ | ছোটগল্প | উৎসব ২০২৪

গল্প : নাহিদা নাহিদ আলোচনা : সায়মা ইসলাম

বর্তমান সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোর মাঝখানে এই ঘটনার আবেদন খুব সামান্য। গল্পটা রিমি নামক এক রমণীর। রিমির সঙ্গে একটা সেশন চলছে আমার। সপ্তাহে একদিন বসি। রিমি শুরু করে ওর বাড়িওয়ালা ভাবিকে দিয়ে। মধ্য-তিরিশের ওই রমণীর সঙ্গে রিমির সকাল বিকেলই দেখা হয়। অল্প-স্বল্প সময় নিয়ে সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়ায় তারা। নানান বিষয়ে কথা হয়। তিনি একাই বলেন, রিমি শুনে যায়।

রাত-বিরাতে ফেরেন একটু কেয়ারফুল থাকবেন আপা। আমার ছোটবোনের ননদের অ্যাকসিডেন্টের ঘটনাটা বলি, ফ্ল্যাটে একাই থাকত, ওর হাজব্যান্ড চাকরি করত মানিকগঞ্জ। গত ঈদে তাকে রেখে বৃদ্ধ মাকে দেখতে গিয়েছিল গ্রামের বাড়ি। দুই দিনের জন্যই গেলো। এরমধ্যেই ঘটনা!

‘কী হয়েছিল?’
‘বোঝেন নি? কেলেঙ্কারি ব্যাপার!’
‘অ।’
‘হ্যাঁ, সময় এখন খারাপ। তিন দিন হাসপাতালে ছিল। জীবনমরণ অবস্থা। ঘরের গহনা, ক্যাশ টাকা সব এক ধাক্কায় শেষ, তবুও মান সম্মানের ভয়ে পুলিশ কেস করেনি।’
‘বলেন কী!’
‘হ্যাঁ আপা, নিজের কানে শোনা, আমি তিন রাত ঘুমাই নাই। মোহাম্মদপুর এইখান থেকে খুব বেশি তো দূরের না।

ওই ভদ্রমহিলা নাকি দেখতে সুখী-সুখী চেহারার, তার পাতলা কাপড়ের ম্যাকসি নামক পোশাকের উপরের দুইটা হুক রিমি কখনো আটকাতে দেখেনি। তার সঙ্গে রিমি নানা জায়গায় যায়। একবার গিয়েছিল নিউমার্কেট। ফ্লাইওভারের ওপরে ব্রিজের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রিমি মুগ্ধ হয়ে দেখেছে মহিলার অসীম বস্তুপ্রিয় স্বভাব। কেনাকাটা করার সময় তার দরদামের কৌশল দেখে রিমি কিছু সময়ের জন্য ভুলেই গিয়েছিল এই পৃথিবী নামক গ্রহে এর চেয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থাকতে পারে। রিমিকে নিতে সেদিন বোগদাদী শওকতের আসার কথা ছিল। লোকটার আজিমপুরে কীসের যেন কাঁচামালের আড়ত আছে। রিমির সঙ্গে মাস ছয় হয় জুটেছে। লোকটা সম্পর্কে রিমির মনোভাব – ভাগ্যিস ছেলেপুলে নাই, না হয় এই বুড়োভামকে দেখে তারা দুঃস্বপ্ন দেখতো।

লোকটার কোনো বউই নাকি তার সঙ্গে মাস দু’য়েকের বেশি টেকে না। কী যে করে! যাক রিমির সঙ্গে তো আর বিয়েশাদির বালাই নাই। লোকটার কথা ভাবলেই রিমির জগৎ অসম্ভবরকম ঘোলাটে হয়ে যায়। তার গাড়ির ঠান্ডা বাতাসেও জাহান্নামের লু হাওয়া। এর চেয় বরং নিউমার্কেটের ওভারব্রিজের গরম রিমিকে বেশি স্বস্তি দেয়। আর তাছাড়া ওখানে তো আর সে একলা দাঁড়িয়ে থাকে না। আরও শত শত মানুষ । কারো কারো খুবই তাড়াহুড়া। ব্রিজটা কোনোমতে পার হয়ে আগাতে পারলেই গাউসিয়া, চাঁদনীচক, হকার্স; সম্মিলিত জনতার তেল-ঘামের লালায়িত মুখ। সস্তায় কেনাকাটার টাটকা সুখ।

ওখানে গেলে রিমির খোকন ভাইয়ের সঙ্গে জুতা কেনার ঘটনাটা মনে পড়ে। বেশ কিছুক্ষণ নস্টালজিক থাকে ওসব ভেবে। এরপর কী যেন হয়। ইদানীং রিমির ভাবনা একদিক থেকে শুরু হয়ে পদ্মা মেঘনা সোমেশ্বরী পার হয়ে কোথায় যেন চলে যায়। শেষে কোনো কূল-কিনারা না পেয়ে এক জায়গায়ই ঘুরপাক খায় সব। আপাতত থাকুক সেসব। যে সময়ের কথা সে বেশি বেশি ভাবে সে সময়টা বছর বিশ আগের, খালেদা জিয়ার আমল তখন। দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হয়েও এক বছর দুইমাস কোনো অ্যালোটেড রুম পায়নি। গণমেই থাকতো। মাঝে মাঝে যেতো ঢাকা। জাহাঙ্গীরনগর থেকে নিউমার্কেট সবুজ বাসে আসতে-যেতে লাগত এক টাকা। সন্ধ্যা ছয়টায় একটা টিউশনি করার সুবাদে অই বাসে চড়াটাও রিমির জন্য ছিল অনিয়মিত। অথচ গণরুমে যারা থাকত তাদের যে কতকিছু থাকতো কেনার মতো, নুন থেকে চুন সবই ঐ নিউমার্কেটের কোলে। রিমির মাঝে মাঝে মনে হতো সে যদি এই সবুজ বাসে করে একদিন লম্বা নদীটার ওইপারে চলে যেতে পারত। নেহায়েত লোকের মন্দ কথার ভয়ে দুইটা ঈদ ছাড়া বাড়ি যাওয়ার কথা বলতও না কেউ তাকে। বলেই বা কী লাভ সেই খোলা সদরঘাট দেখাদেখি, ঘরেও যা বাইরেও তা। যখনকার কথা বলে ও তখন রিমিদের নতুন নতুন পরীক্ষার ধরন শুরু হয়েছিল। যার একটার নাম ছিল প্রেজেন্টেশন। ভার্সিটির আর্টস ফ্যাকাল্টি বিশেষ করে সাহিত্য-ফাহিত্য আর ইতিহাসের জন্য এইগুলা ছিল বিরাট ফ্যাকড়া। সায়েন্সে দেখে আর্টসে কারিশমা ফলানোর বিড়ম্বনায় তারা চালের গুদামে আটকে পড়া ইঁদুরের মতো ছটফট করত, প্রেজেন্টেশন না বোঝার অযোগ্যতা নিয়ে এরা ওর-তার কাছে স্যার ম্যাডামদের নিন্দা করত। স্যারেরা কী চাইত তারা বুঝত না, তারা কি বোঝাত, স্যারেরা বুঝত না। সুন্দর শাড়ি-চুড়ি-মালার সঙ্গে একটু কাজল আর একটা বড় টিপ যদি দেয়া যায় এই-ই ছিল তখন তাদের চিন্তার সার। রিমির কাছে এইসব ইতংবিতং কপালের দোষ ছাড়া কিছু ভাবার অপশন ছিল না। এর ওর কাছে হাত পেতে নিদেনপক্ষে একটা সায়া কিংবা গলায় ব্যান্ড দেয়া ব্লাউজ নেওয়া গেলেও জুতা কেউ দিত না তাকে। আর দিবেই বা কেমন করে? হলে থাকা বেশিরভাগ মেয়েরই গামছা থেকে শুরু করে অন্তর্বাস সবই একপিস। বাড়ি ছেড়ে আসার পর রিমির যে কী দুর্গতি হয়েছিল সেসসময়; একথা বন্ধু-বান্ধবকেও বলার মতো অনুকূল পরিবেশ জোটেনি। কেউ খেতে বসলে পাশে গিয়ে বসা, কেউ রান্না চড়ালে পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ কেটে দেয়া। খুচরা ভাঙতি পয়সাগুলো রুমে ফিরে দুই-তিনবার গুণে দেখার সমষ্টিই ছিল তার ক্যাম্পাস জীবন। যেহেতু রিমির বাবা অকালে মরে গিয়ে দায় সেরেছেন এবং মাথার ওপর তার ভাই নামক কোনো মুরব্বি ছিল না তো কথা এই – নিজের চরকায় নিজে তেল দিতে না পারলে আগের দুই বোনের মতোই গণ্ডায় গণ্ডায় বাচ্চা বিয়ানো সাংসারিক লেবারশিপ তাবিজের মতো গলায় ঝুলে যাওয়ার সম্ভাবনা। এইসব দুর্দশায় রিমি ছিল প্রকৃতই আতঙ্কিত। আপন মনে পুড়তো সারাক্ষণ। পুড়তে পুড়তে অবস্থা এমন হয়েছে নিজেই নিজেকে গালি দিতো, ‘কী বালছালের জন্য পুড়তেছি আমি!’ সে যাই হোক, সেবার বাড়ি থেকে আসার পর আজমল স্যারের শ্রেণি উপস্থাপনা ছিল রিমির। স্যারের কোষ্ঠকাঠিন্যের আধিক্য এতটাই প্রবল যে তাকে কেন্দ্র করে অনেক মন্দছেলে মহলে নানাবিধ রসাত্মক মিথ চর্চিত ছিল। স্যারের ভয়ে সেবার রিমির বাড়ি থেকে ফিরে আসা খানিকটা এগিয়ে এসেছিল। আর এসেই-বা কী, ঈদের পর পর হলে কীসের পড়া, কীসের লেখা। কোরবানি যাওয়ার সুবাদে রুমে রুমে কেবল গরু-ছাগলের গল্প। কিচেন ভর্তি বাড়ি থেকে মাংস আনা হাঁড়ি-কড়াইয়ের ভিড়। রিমি লোকজনকে বোঝায় এইসব মাংস টানাটানি রিমির পোষায় না। গোসাইরহাট থেকে ঢাকা অনেক পথ। রিমির ছোট বোন ক্লাস নাইনে পড়ে হঠাৎ করেই সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে; মাংস নিয়ে ভাবার তার টাইম নাই। প্রদীপকেও সে এ কথাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে। অথচ ও বার বার বলে, “তোমার আম্মা কি পাঠাইছে দেও। অত জাত-পাতের বাছ-বিচার নাই আমার।’’ তো কী দেয় রিমি!

এসব গল্প রিমির মুখ থেকেই শোনা। রিমির জীবনে এত অল্প অল্প ঘটনা ছিল, এক গল্পই অনেকবার করে বলতে হয়েছে তাকে। সবিস্তারে বলতে হয়েছে, কিভাবে রিমি প্রদীপের সঙ্গে সম্পর্কে জড়াল, কিভাবে প্রদীপ তাকে বুঝাল প্রেমে একটু আধটু অমন হয়ই। এই একটু গা ঘেঁষাঘেঁষি, একটু চুমু খাওয়া, এসব। বলেছে কয়েকবার। এরপরও প্রদীপ ছিল আনাড়ি। একদিন প্রদীপ ওকে নিয়ে গিয়েছিল দোলন স্মৃতি গ্রন্থাগারে। এটা বামদের একটা ক্যামোফ্লেজ। রিমির ভাষ্যে – এরা দেখায় যে ওরা খুব বই পড়ে। কিন্তু ঘুরে-ফিরে ঐ এক শরতের পথের দাবি হাতে ধরিয়ে দেয়। রিমিকে প্রদীপ ভ্যানগার্ড বিক্রির কথাও বলেছিল । রিমি শোনে নি। বলেছে ‘ভাই, তোমাগো ভাবমারানো শ্রেণিসংগ্রাম তোমরাই কর, আমি ওসবে নাই। কোনোমতে টেনেটুনে পাঁচ-ছয়টা বছর, ব্যস।’ প্রদীপের কথায় মনে হলো, একবার ন্যাশনাল আর্কাইভে একটা অ্যাসাইমেন্টের প্রয়োজনে রিমিকে যেতে হয়েছিল আগারগাঁও। পুরো মিরপুর রোডের কোথাও তারা একটু ফাঁকা পায় নি, অনবরত একঘেয়ে স্বরে প্রদীপ নিন্দা করেছে কখনো আমেরিকা কখনো রাশিয়া আর কখনো চীনের। ভারতের কথা বলতে বলতে বেশ ক’বার গালিও দিয়েছিল। রিমিকে সে বুঝিয়েছে, ‘ভারত আমাদের ন্যাংটো করে শেষ পর্যন্ত নাকি চ-বর্গীয় শব্দটা করা বাকি রেখেছে। মাঝেমধ্যে একটু সুযোগ পেলেই এইদেশের জামা খুলে ছোট একটুখানি বুক টেপার অর্গাজম নেয়।’ এর মধ্যে জ্যাম পড়ে যাওয়ায় প্রদীপের নিন্দাবাক্যের তোড় আরও খানিকটা বেড়েছিল সেদিন। রিমির ঝিমঝিমে মাথায় সেসব ঢোকে নি। রিমি বুঝে পায় নি প্রদীপ এমন কেন, ওর ভেতরের ছটফটানি কেন প্রদীপ বোঝে না! পঙ্গু হাসপাতালের কাছে আসতেই রিমি উশখুশ করে। ঠোঁট চলে যায় সৌমিকের ঘাড়ের কাছে। যে অল্পবয়সী সৌমিকের চোখের ওপর আলো থাকার কথা, প্রেম থাকার কথা; উপর্যুপরি চীন, ভারত আর আমেরিকা বিদ্বেষে এমনি করে সেসব প্রেম উবে যেতো বাতাসে। পুরুষের ঘামের গন্ধের প্রভাববিস্তারী মোহে পুরোপুরি পর্যুদস্ত হয়ে রিমি হলরুমে ফিরতো একা, নিঃসঙ্গ। তবু এত কিছুর মাঝখানে রিমি চাইত প্রদীপ থাকুক পাশেই। অ্যাফেয়ার ব্যাপারটায় অভ্যস্ত হতেও তো কমফোর্ট জোন লাগে। যদিও রিমি বুঝত না অ্যাফেয়ার আসলে কী? মন না শরীর! ফয়জুন্নেসা হলের যে-মেয়েটা প্রায়ই তাদের কাছে ওর বন্ধুর গল্প করত, রিমি শুনেছে তাদের সম্পর্কটা ভেঙে গেছে। ওদের নির্দোষ সম্পর্ক নাকি গড়িয়েছিল কাঁঠালতলা অব্দি। ওরা চুমু খেয়েছিল কিনা জানা যায় নি। সেক্স ব্যাপারটা ওদের ভেতর নাকি জাগে নি কখনো। আসলে তাদের কথায় তারা এই শব্দটা ব্যবহারই করত না। আদর বলে পার পেত। তাদের এক বান্ধবী সময় সময় দুষ্টুমি করে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করলেও, ওকে সেক্সি বলার উৎসাহ ওদের পেট পর্যন্ত আসলে, মুখ পর্যন্ত গড়াত না। সেসময় তারা ছিল এমনই ইনোসেন্ট ।

মাঝে মাঝে রিমিকে নানা প্রয়োজনে ঢাকায় যেতে হতো। লেফটিস্ট প্রদীপের মধ্যে অত একটা কনজারভেটিভনেস ছিল না। তাছাড়া ছাত্রাবস্থায় রাজনীতি ফাজনীতির প্যারা অনেকেরই থাকে। তো গার্লফ্রেন্ডকে দেওয়ার সময় কই।

‘দেখি রিমি, তুমি একটু সরে বসো তো, এই ভিড়ে ঘেমে নেয়ে এ কী অবস্থা তোমার?’

ঢাকায় এলে রিকশা কিংবা সিএনজিতে এমনি আহ্লাদে খোকন ভাই রুমাল এগিয়ে রিমির নাকের নিচের ঘাম মুছে দিত। এভাবেই অবচেতনে প্রদীপকে ছাপিয়ে সময় সময় খোকন ভাই বাস্তব হয়ে উঠতো রিমির জীবনে। খোকন ভাই মানুষটা ভালো না, তবে আকর্ষণীয় নয় তাও বলা যায় না। কিছু কিছু মানুষকে দেখলেই মনে হয় এদের কোঁচরভরা ক্ষেতের বীজধান কিংবা ফার্মের মুরগি বিক্রির নগদ টাকা। এদের সৌন্দর্যেও কেমন জীবন্ত টাকার অশ্লীল গন্ধ। এরা পান খায়, জর্দা খায়, সেন্ট মাখে। তবু এদের ভালো লাগে৷ খোকন ভাইয়ের বাড়িও শরিয়তপুরে, বিয়ে করেছে নাখালপাড়া। রিমিও তাকে দেখলেই তার সঙ্গে উল্টামি করে বলে – এত জর্দা খান কেন? আপনার দাঁত লাল হয়ে আছে।
শুধু দাঁত, আমার সবই তো লাল, বলতে গেলে টকটকা। ছুঁইয়া দেখ এখনি গড়ায়া পড়বে।
রিমি ঝাঁজ দেখায়, ‘ঐদিকে তাকান আপনার চ্যালঢ্যালা নজরে শীত লাগে।’
‘শীত কেন খুকী গরম হওয়ার কথা!’
খোকন ভাই এই রকম করে একটু একটু করে নরম হয়ে উঠত। ওনার খরগোশের মতো খাড়া খাড়া কান আর ঘাড়ের উপর ছড়িয়ে থাকা চুপসানো চুল ইচ্ছে করেই এদিক সেদিক নাড়াত একটু, অনেকটা যেন পোষা বেড়ালের মতো। খোকন ভাইকে দেখলে রিমির বিস্মৃতপ্রায় শম্পার কথা মনে হত। মেয়েটা সুন্দর। কী যে তুলতুলে। ওকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল লোকাল এক ক্যাডার। শম্পার কথায় মনে হলো, একবার রিমি আর ওর রুমমেট স্টাডি-ট্যুরের বাস মিস করেছিল। রাত তখন দেড়টা, পেছনে রাতপ্রহরীদের ভয়াল বুটের আওয়াজ তাদের ভাবতে বাধ্য করেছিল, কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের ছিন্নভিন্ন শরীর পড়ে থাকবে স্ট্যাট-বিল্ডিংয়ের পাশের জঙ্গলে। তারপর আরও আরও… অনেক সময় পরে কেন রিমি শম্পার কথা ভেবেছিল তা আর মনে করতে পারে না। শুধু মনে পড়ে রেপ হওয়ার পর শম্পার মরদেহের ছবি পত্রিকায় দেখে দু রাত ঘুমুতে পারে নি রিমি।

শম্পার কথা থাক, রিমি বরং ঐ মেয়েটার কথাই বলতে চায়, যার কথা বলেছিল কিছুক্ষণ আগে, যার কাছে পলিগ্যামি ব্যাপারটা বড়ই অদ্ভুত আর ঘিনঘিনে । স্বামীর সঙ্গে পুতপবিত্র শোয়াশোয়ি তার প্যাশন। মেয়েটার ডিভোর্স হয়েছে শুনেছে। ঘটনা কিছুই না, স্বামীর পরকীয়া বড় ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে। যাই হোক, রিমির গল্পগুলো সবশেষে ঐ এক রুমমেট, বান্ধবী বা শম্পায় এসে আটকে যায়। কিন্তু এরপরও প্রদীপ তো থেকে যায় কোথাও না কোথাও। একবার তাদের হলে খুব বেড়ালের উৎপাত শুরু হয়েছিল। গণরুমের তিনটি মেয়ে আহত হয়। অথচ পত্রিকায় ছবি ছাপা হয় কেবল নায়লার। রিমি বেশ ঈর্ষা নিয়ে যখন মেডিক্যাল অফিসার কাওসার ভাইয়ের দ্বারস্থ হয় কাওসার ভাই তখন আলতো করে ছুঁতে ছুঁতে ওর অনেক দূর ছুঁয়ে ফেলেন। দুইপাশে ঝুলিয়ে দেয়া ওড়নার মাঝখানে ফর্সা কোমল বুক, অল্পের জন্য ক্লিভেজ দেখা না যাওয়ার আক্ষেপ তিনি ভুলে ছিলেন আঙুলের কারসাজিতে। বেড়াল নিয়ে সিরিয়াসনেস আপাতত তখন তাদের মধ্যে তরল হয়ে গিয়েছিল। কাওসার ভাইয়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে আরও কিছুদূর এগুনোর পর একসময় রিমিও টের পেতে শুরু করে, ওর ভেতরেও কী এক বিশ্রী পরিবর্তন। এ এক অনির্বাণ বিভীষণ। রিমির আশৈশবের শুচিতা প্রেমবোধ দারুণ এক বিভ্রান্তির বিড়ম্বনায় দুলতে দুলতে সে ভুলে যায় ওরা বন্ধুরা গল্পের ছলেও কখনো অশ্লীল কথা বলতো না। লজ্জা কাটাতে কাওসার ভাইকে নাকি সেদিন বলেছিল,
‘ভাইয়া, আমার কি এখন ভ্যাকসিন দেওয়া লাগবে? নাকি এমনি এমনি সেরে যাবে?’ তিনি বলেছিলেন, ‘দেখি কাল একবার দুপুরে আসো। সিচুয়েশানটা বুঝে নিই তারপর!”

এক গল্প এত এত বার করে বললেও কাওসার ভাইয়ের কথা বলতে গেলে ওর খুব ইতস্তত লাগে। একসময় তার এসব গল্প শোনানোর কেউ ছিল না। আসলে রিমির গল্পে খুব একটা ভিন্নতা আছে তা বলা যায় না। মূলত, সব মন্দ মানুষের গল্পই এক। বলতে গেলে সব গরিবের গল্পও এক। যতটা সম্ভব রেখেঢেকে সেসব গল্প রিমি মাঝে মাঝে প্রদীপকে বলত হলের অন্য কোনো মেয়ের নামে, যার সঙ্গে প্রদীপের আপাত কোনো পরিচয় নাই । কিন্তু কাউকে বলা যায় নি, কাওসার ভাই রিমির সঙ্গে রক্ষিতার মতো আচরণ করতো। তাকে মনে করতো ফুটপাতের একশো টাকার বেশ্যা। রিমিকে তার কাছ থেকে ইয়ার ফাইনালের ফি-এর টাকাটা প্রতিবার চোখ বন্ধ করে নিতেই হতো, শিট ফটোকপি করার টাকা নেওয়ার পর অন্ধকার ঘরে বসে ওর কেবলি মনে হতো, কয়টা সার্টিফিকেট নিতে মোট কয় টাকা লাগে, কয়শো পেইজ ফটোকপি লাগে, কয়টা টিউটোরিয়াল আর কয়টা ইয়ার ফাইনালে এমএ পাস জোটে? কখনো ভুলেভালে কাওসার ভাইকে তুমি বলে ফেললে, সে কী ভাবত রিমি তা জানে না। কিন্তু ওর মনে হতো, এরচেয়ে কাপড় খুলে খোলাবাজারে নেংটো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকাও ঢের ভালো। কাউকে ভুল করে নাকি প্রয়োজনে ভালোবাসার লজ্জা তাকে ভীষণভাবে মনে করিয়ে দিত – পৃথিবী এক দুষ্টগ্রহ, যেখানে সবই বিনিময় হয় মমতা, প্রেম, স্নেহ আর আদর, যাকে তারা সেক্স বলতে পারত না লজ্জায়। এক নিখুঁত পরাজিত মানুষের অসুখ নিয়ে রিমি পালাতে চাইত প্রদীপের কাছ থেকে। একথাও কাউকে বলা হয় নি কখনো, প্রদীপকে ভীষণভাবে ভালোবেসেও রিমি তড়িতাহত হতে পারে নি যতটা চমকিত হতো মধ্যদুপুরে কাওসার ভাইয়ের খসখসে হাতে প্যারাসিটামল লিখে দেওয়া প্রেসক্রিপশনে। সে বুঝতে পারত, ওর এত এত ছড়িয়ে থাকা প্রসারিত ডালপালার জীবন পরিচালনা করছে এক গরিবি জীবন। এখানে কোনো মানবতা নেই, নেই কোনো সম্পর্ক, আছে কেবল প্রয়োজন। দিনের পর দিন প্রদীপের সঙ্গে সময় কাটিয়েও অবশেষে তাকে ছাড়তে হয়েছে রিমির। কেন? ঐ সেই প্রয়োজনই। তার সঙ্গে শেষপর্যন্ত হয় নি রিমির, কী যেন নেই ওর। আসলে প্রদীপের জীবনও টানাপোড়েনের। প্রদীপ দিতে জানে না, নিতেও না। অথচ এই তো সিঁড়ির গোড়ায় যার সঙ্গে আলাপ তার স্বামীর সঙ্গেও সম্পর্ক যাকে বলে উত্তুঙ্গ ওরকম অবস্থা। কারণ একটাই, দু জন দু রকম। একবার ঐ মহিলাকে বলেছিল সে,
‘আপা আপনার এত এত নজরদারি এত এত সতর্কতা, সুখে আছেন তো দু জন? এই ধরেন আপনার স্বামী মানুষটা, ধরেন তার মনের অসুখ, ধরেন তার শরীরের অসুখ; আপনি তখন কী করেন। ম্যাক্সি পরে তাকেও কি জ্ঞান বিতরণ করেন? জানান দেন দেশের বর্তমান হালচাল।’

মহিলার উত্তরে স্বামী প্রবরটির চারিত্রিক স্বচ্ছতা আর তার নজরদারির প্রতি অন্ধবিশ্বাস দেখে করুণার চেয়েও শ্লেষবোধ হয়েছিল বেশি। এইসব জ্ঞানপাপীর কাছে নিজের গোপন অর্জন প্রকাশ করাটাও মূর্খতা! থাকুক এরা এমনই। এই ফাঁকে তাদের অর্থবান পুরুষেরা এই পুতুল পুতুল মাংসগুলোকে ভুলিয়ে তার হাড্ডি চর্মসার কণ্ঠায় লটকে থাকুক। রিমি চায় ভয়ঙ্কর হয়ে গ্রাস করতে সকল লোলুপ পুরুষের হৃৎপিণ্ড। সত্যি রিমি চায় এসব।

প্রদীপ রিমিকে ভালোবেসেছিল বলা যায়। পারলে সে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে হলেও রিমিকে সুখী করতে চেয়েছে। তাকে যদি কখনো রিমি জিজ্ঞেস করত, ‘ধরো আমার চোখ দুইটা নষ্ট হইলো তুমি দিবা একটা চোখ?’
প্রদীপ বলত, ‘তোমারেই দিয়া দিব পাখি, অনেস্টলি একটা না আমার দুইটাই তোমারে দিয়া দিব।’ এই অর্থহীন দেওয়া নেওয়ায় রিমির জীবন আটকে ছিল গোলকধাঁধায়। তৃপ্ত হতো না মন। মাস শেষে যখন সংসারের হিসাব মেলাতে বসত, ছোট দুইবোনের পড়ার খরচ, একজনের চিকিৎসা, মায়ের খালি খাই খাই চাই চাই স্বভাব – তখন কেন যেন চক্ষু-কর্ণ-নাসিকা উৎসর্গ করা সৎ পুরুষ ভালো লাগত না রিমির। ফিরেও তাকাতে মন চাইত না তার তেল-নুন মাপার ছ্যাঁচড়া সংসারে। ছয় মাসে সাড়ে ছয়শো টাকার শাড়ি তখন নিতান্তই গলার ফাঁস মনে হতো রিমির। কোটি কোটি স্বার্থপর মানুষের দেশে পৃথিবীর সামান্যতম প্রয়োজন না দেখে নিজেকে সুখী করতে চেয়ে অবশেষে রিমি ভুলেই গেলো কোনো এককালে সেও মানুষ ছিল, স্বচ্ছ জলের স্রোতোস্বিনীর মতো!

তার শোকতাপের জীবনের কোলাহল সব গিয়ে থামে এখন এক পথে, এক দুর্নিবার যাপনের নেশায়। আজ এখানে তো কাল ওখানে, কত রথি-মহারথী পায়ের তলায়। পরিপাটি ঘর, বালিশ তোষক, সুগন্ধী তেল, সব তার আজ বাড়তিই আছে। অথচ প্রথম টাকার আওয়াজে রিমি কতই না ভীত ছিল। সেই ভীতি-প্রীতির মোহের জগতে তাকে টেনেছিল খোকন ভাই। সেই যে এলাকার সেই বড়লোকের ছেলে খোকন ভাই – যার পান খাওয়ার প্রসঙ্গ মাঝে মাঝেই তোলে রিমি। রিমি জানতো এই শালা জাত মাদারচোদ। তবু খোকন ভাইকে তার ভালোই লাগতো। মেয়ে মানুষ দেখলে তার মেনি বেড়ালের মতো মিউ মিউ ডাক রিমির কাছে অপরাধ মনে হতো না একটুও। তবে খোকন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলেই শিরিন সুলতানা নামক এক মহিলার সঙ্গে এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ারের গল্প শুনতেই হতো তাকে। কী বিশ্রীরকম বেকুব খোকন ভাই। অল্প সময়ের জন্য হলেও তখন সে রিমিরই পুরুষ, ভাল্লাগে অন্য নারীর আসক্তি শুনতে! সেই অতি আধুনিকা নাকি অনেকের সঙ্গেই হিল্লি-দিল্লির হানিট্রিপে যায়। মহিলা ডিভোর্সী, তারও তো লাগে। একটা স্কুলে গান শেখায়। খোকন ভাই-ই হাসতে হাসতে রিমিকে বলেছে শিরিনকে পাড়ার সবজিওয়ালা ফলওয়ালারা কম দামে সবজি সাধে। দরজি বার বার মাপে ভুল করে। ছেলেপুলে গান ভুলে গিয়ে বার বার টয়লেটে যায়। স্কুলের দারোয়ান থেকে প্রিন্সিপাল সবাই ওর অসুখ-বিসুখের খবর নেয়। আসলে যার ঘরে এক স্বামী নাই তার পাশে দাঁড়ানোতো হাজার স্বামীর দায়িত্ব! খোকন ভাইয়ের কণ্ঠ কেমন পাতলা হয়ে উঠতো এসব বলতে বলতে। খলবল করে উঠতো স্থূল সুখের আমেজ। তো যেদিনের কথায় ছিল রিমি। ওই যেদিন নিউমার্কেটের সামনে ফুটপাথের খোলা দোকান থেকে জুতা কিনতে গিয়েছিল সে। রিমি তখন সবে সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী। আগের দিন অন্য ব্লকের মিশু নতুন কিনে আনা জুতা এনেছিল দেখাতে। ওর বয়ফ্রেন্ড নাকি ওকে গিফট করেছে। সপ্তাশ্চর্যের মতো এপেক্সের সেই দামী জুতা লেডিস হলে কম বাজেটে থাকা মেয়েগুলোর কাছে তাজমহল পাওয়ার মতোই। রিমির রুমমেট জুতা পায়ে গলিয়ে বলেছিল ‘জুতাগুলা মাখন রে। তুই একজোড়া নিবি রিমি? নে না প্লিজ, তোরওতো বয়ফ্রেন্ড আছে। আমি একদিন ধার নিব।

বাপরে বাপ পাঁচশো টাকা দামের জুতা!

বাবাকে নিয়ে রিমির মা যেদিন সদর হাসপাতালে ছুটাছুটি করছিল। সেদিনও নাকি ওর দাদার বাড়ির কেউ পাঁচশো টাকা নিয়ে আসেনি। মায়ের কাছ থেকে একথা পাঁচ হাজার পঞ্চান্নবার বা তার আগে পিছে আরও কয়েক সংখ্যায় শুনেছে রিমি। সেই ঘরের সংখ্যায় জুতা কিনতে রিমির পাঁচশোরও অধিক বার ভাবতে হয়। আর প্রদীপ কিনবে এপেক্সের জুতা! ওর কার্ল মার্কস, ফিডেল ক্যাস্ত্রো কিনতে দেবে? তবে রুমমেটের ঘ্যানঘ্যানানিতে একদিন ঠিকই এক-দেড়শোর দোকানে ভিড় জমিয়েছিল রিমি। সব রঙের শাড়ির সঙ্গে যেন মানায় ঐরকম একজোড়া বাছাই করে। এইসব খুচরা কাজ সারতে সারতে খোকন ভাই যখন এলেন, তখন বেলা সাড়ে তিনটা। গতরাতে ফোনে বলা ছিল জুতার দোকানে এসে খুঁজতে। খোকন ভাই আসায় রিমির একটু হালকা বোধ হয়। লোকটা পান খেলেও ধান বিক্রির ব্যবসা নাই এটা সত্য। টিকাটুলি জনতা ব্যাংক শাখার ম্যানেজার। খোকন ভাই টেনে-টুনে রিমির জুতার বেল্ট দেখেন, রং দেখেন। দরদাম শেষে রিমি যখন গরিবি পার্স বের করতে যায়, তখনই তিনি দেড়শো টাকায় কিনে নেন ওর সমস্ত অন্তরাত্মা। ফেরার পথে শোনা যায় অন্য ঘটনা। খোকন ভাইয়ের মেজ দুলাভাই যে নাকি রিমিকে চেনে, তাকে রিমির দেখতে যাওয়ার যৌক্তিকতা তিনি বোঝাতে থাকেন। যেহেতু তারা একই এলাকার তাই আত্মীয়তা এড়ানো যায় না। কিন্তু ঢাকা মেডিকেলের একশো এক নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি যাকে দেখল রিমি, তিনি খোকন ভাইয়ের খালাত বোনের শ্বশুর দিককার আত্মীয়। চেনেই না। লোকটার চোখেমুখে মৃত্যুদশা থেকে ফিরে আসার আনন্দ। তড়িঘড়ি করে চলে আসা যায় না আবার থাকাও যায় না। লোকটার পাশেই ফ্লোরে শুয়ে ছিল এক ছেলে। এক হাতে ক্যানোলা । রোড অ্যাক্সিডেন্টে মুখের ডান পাশ থেঁতলে গেছে। ওর সঙ্গে দুইজন ছেলে। সেবা শুশ্রূষা করার জন্য এসেও মাঝে মাঝে লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসছে রিমির কাচুমাচু অবস্থা দেখে। খোকন ভাই বলল, ‘আরে বাল এত উশখুশ করতাছ ক্যান, রোদটা একটু পড়ুক, আমি তোমারে ক্যাম্পাসে পৌঁছায়া দিব। ভার্সিটির বাস গেলে যাকগা।’ তার এই ঝাঁজের কথায় বাথরুমের অপরিষ্কার আয়নায় রিমি নিজেকে আবিষ্কার করে পুরাই আপসেট। ফেরার পথে ঢাকা টু সাভার সিএনজির তিনশো টাকা ভাড়া ওর কলিজায় ধুকপুকানি আরও এক ডিগ্রি বাড়িয়ে দেয়। কেউ কথা বলে না কারো সঙ্গে। চোখেমুখে অসীম অমানিশা নিয়ে রিমি মনে মনে খুব করে চায় বাইরেটা আরও অন্ধকার হোক, সিএনজিওয়ালা ব্যাকমিরর থেকে চোখ ফেরাক, খোকন ভাই যেন নিরাপদে ওর বুক পিঠ, নিতম্বে হাত রাখতে পারে।

‘‘ঘটনা কী, শক্ত হয়া আছ কেন?”

‘আপনের কয়টাকা খরচ হইল খোকন ভাই, দেড়শো প্লাস তিনশো, প্লাস মেডিক্যালে যাওয়ার রিকশা ভাড়া পঁয়ত্রিশ।

‘এইসব বেহুদা কথার কী দরকার? দেড়শো টাকার হিসাব ক্যান, জুতা তো তোমার গিফট।
রিমি বিব্রত হয়, ‘হ ভাই, আপনেরা পারেন। আপনের বউও তার কয়েকবার পরা জামা আমারে দিছিল, কইছিল নতুন জামা, পরে দেখি হাতায় রিফু। আসলে ভার্সিটিতে পড়লে অনেক জামা লাগে।’

খোকন ভাই আর কথা বাড়ায়নি। রিমিও নানান কারণে নিজেকে বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে মুক্ত করে খোকন ভাইয়ের হাতাহাতিতে মনোযোগ দেয়। প্রদীপ একবার ভারতকে গালি দিয়ে বলেছিল বন্ধু বন্ধু বলেও নাকি ওরা চান্স পাইলেই আমাদের চ-বর্গীয় খেল দেখায়, এইসব মনে করে রিমির হাসি পায়। চ-ব্যাপারটা খলখল করে বাজে মগজে। হায় প্রদীপ সে কখনো মাঝরাস্তায় অন্তর্বাস খুলতে চায় না, সিএনজির পর্দা টানে না। আড়াল পেলে সামান্য চুমু খেতেও তার কত অস্বস্তি! এখন রিমি কি তার বন্ধু রাষ্ট্র না শত্রু?

যাক প্রদীপ বৃত্তান্ত বা খোকন ভাই; এসব এখন অতীত। এই যে রিমি এখন সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে ভাবছে, এই যে এই মহিলার মতো, কবে তাকেও কোনো চোর ডাকাত হাত পা বেঁধে বিবস্ত্র বিশৃঙ্খল করে রেখে যাবে আর ম্যাক্সি পরা মহিলা এইরকম করেই অন্য কাউকে ফিসফিস করে বলবে, ‘দিনকাল ভালো না আপা আগেই বলেছিলাম। ডিভোর্সি মানুষ। তার ওপর মাথায় ছিট আছে। মাঝে মাঝে গাড়িওয়ালা লোকজন আসে। এদিক সেদিক যায়; এমন তো হবে আগেই জানতাম।’ তারপর একরাশ গোপন ঈর্ষার ঘিনঘিনে দির্ঘশ্বাস!

হ্যাঁ, এটাই রিমির বর্তমান। তবে সমস্যা হচ্ছে এই রিমি নামের মেয়েটা আমার কাছে আসে, নাকি আমিই যাই রিমির কাছে, এটা একটা বিভ্রান্তকর বিষয়। এই যে আমি এত এত গল্প শোনালাম, কীসের গল্প শুনালাম, কার গল্প শোনালাম তাও বিভ্রান্তকর। কিছুই ঠিক নাই। প্রদীপ সুইসাইড করার পর রিমি কিংবা আমার সব কিছু এলোমেলো। এখন আমাদের সকল আয়োজন শুধু মন্দের। আমরা সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়। পুরুষে যে দূরত্ব বা সখ্য তা আমাদের অসীম অপেক্ষায় দাঁড় করিয়েছে বহুবার বহুভাবে এমনই দণ্ডায়মান, উলঙ্গ। কেন আমাদের হয় নি কোথাও কিছু, কেন হয় না প্রেমময় সংসার – সে-গল্প বলার জন্য সেদিনও হয়তো এমন একটা সিঁড়ি লাগবে, ম্যাক্সি পরা ভাবি লাগবে অথবা ওভার ব্রিজে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজন লাগবে। থাকুক সেসব গল্প আপাতত।

ছোটগল্প : রিমির গল্প | গল্পকার : নাহিদা নাহিদ | আলোচক : সায়মা ইসলাম

গল্পটা রিমি নামক এক রমণীর। বর্তমান সময়ে বিশ্বে অথবা দেশের অভ্যন্তরেই এতসব জটিল গুরুত্বপূর্ণ আলোচিত ইস্যু আছে, যার মাঝে এরকম ঘটনার আবেদন খুব সামান্য।
শুরুতেই বোঝা যাবে গল্পটি রিমি নামের খুব সাধারণ এক নারীর গল্প, বা রিমির আড়ালে সেইসব নারীর গল্প, যাদেরকে পথে-ঘাটে বাসে-ট্রেনে, নিউমার্কেটের কোলাহলের মাঝে হরদম দেখা যায় বিশেষত্বহীন চেহারায়-পোশাকে। এরা জীবনের শুরুতে চোখে একটা নতুন সূর্যরশ্মি নিয়ে যাত্রা শুরু করে, কিন্তু গন্তব্যে পৌছানোর আগেই হোঁচট খেয়ে পড়ে, ভ্রান্তিতে অথবা বিভ্রান্তিতে এবং সন্ধ্যার আঁধারে পথ হারিয়ে ফেলে। এই নিয়নবাতির চোখ ধাঁধানো আলোর যুগে এরা হাতে নিবুনিবু সলতের হ্যারিকেন নিয়ে ছুটে চলতে চায় সভ্য সমাজের নাগরিক জীবনে বেঁচে থাকবার দুর্বার আশায়। তারপর স্বপ্নপূরণের পথে টিকে থাকতে গিয়ে অতি সাধারণ মেয়েটি একসময় ভুলে যায়, আর দশটা সাধারণ নারীর মতো বাঁচবার কথা ছিল না তার।

লেখকের ভাষায়, রিমি তার অন্য দু’টি বোনের মতো গণ্ডায় গণ্ডায় বাচ্চা বিয়ানো সাংসারিক লেবারশিপ তাবিজের মতো কোনো পুরুষের গলায ঝুলতে চায় না। চায় না বলেই সে নিজের তাগিদে পরিবার বা অজপাড়া গাঁয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে অদম্য স্পৃহা নিয়ে পৌঁছাতে পারে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নামক কাঙ্ক্ষিত সুন্দর সচ্ছল ভবিষ্যতের স্বপ্নযানে। সেখানে কোনো এক স্টেশনে খুব স্বভাবিকভাবেই রিমির পরিচয় হয় প্রদীপ নামক ছেলেটির সাথে, যাকে সে ভালোবাসে। প্রদীপকে ভীষণভাবে ভালোবেসে রিমি তড়িতাহত হতে চায়। নিছক নারী-স্বভাবের রিমি চায় প্রদীপ তাকে আগলে রাখুক প্রেমে-কামে-অর্থে-অনর্থে।

কিন্তু প্রদীপ, অল্পবয়সী ছেলেটি যার চোখের ওপর আলো থাকবার কথা, প্রেম থাকার কথা; উপর্যুপরি চীন, ভারত আর আমেরিকা বিদ্বেষে এসব সাধারণ প্রেম-ভালোবাসা উবে যায় বাতাসে। আর্থিক টানাপোড়েনে পোড়া রিমির কাছে প্রদীপের এই শ্রেণিসংগ্রাম নিছকই ভাবমারানো, অর্থহীন!

প্রদীপ, যে কিনা রিমির জীবনের প্রয়োজনে তার যে কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিতে সদা প্রস্তুত, কিন্তু লেখকের উলঙ্গ বাস্তব বয়ান হতাশ করে পাঠককে “এই নাই নাই চাই চাই জীবনে চক্ষু কর্ণ নাসিকা উৎসর্গ করা এই সৎ পুরুষগুলো ভালো লাগত না রিমির।তার ফিরেও তাকাতে মন চায় না তেল-নুন মাপার ছ্যাঁচড়া সংসার।” এইসব বস্তুগত বা অবস্তুগত টানাপোড়েনে খেই হারিয়ে ফেলে রিমি।

তাই, এমনি আহ্লাদে খোকন ভাই যখন নিজের রুমাল দিয়ে রিমির নাকের নিচের ঘাম মুছে দেয়, প্রদীপ তখন মূল্যহীন হয়ে ওঠে রিমির কাছে। সামান্য দেড়’শ টাকার একজোড়া জুতো বা টিউটোরিয়াল ফি’র বিনিময়ে রিমি সমর্পণ করে দেয় নিজের অন্তরাত্মা। অবচেতনে প্রদীপকে ছাপিয়ে খোকন বা মেডিকেল অফিসার কায়সার ভাই বাস্তব হয়ে ওঠে রিমির জীবনে। এক নিখুঁত পরাজিত মানুষের অসুখ নিয়ে রিমি পালাতে চায় প্রদীপের কাছ থেকে। কিন্তু এরপরও প্রদীপ তার গল্পে থেকে যায় কোথাও না কোথাও!

আরও কিছুদূর এগুনোর পর এক সময় রিমি টের পেতে শুরু করে, তার নিজের ভেতরে কী এক বিশ্রী পরিবর্তন, অনির্বান বিভীষণ। রিমির আশৈশবের শুচিতা প্রেমবোধ দারুণ এক বিভ্রান্তির বিড়ম্বনায় দুলতে দুলতে সে ভুলে যায় কোনো এককালে সেও মানুষ ছিল, স্বচ্ছ জলের স্রোতোস্বিনীর মতো! তবু এত কিছুর মাঝখানে রিমি চাইত প্রদীপ তার পাশেই থাকুক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই সাধারণ রিমি নামক মেয়েটি কী টিকে থাকতে পারে তার ভালোবাসা বা নিজস্ব কক্ষপথে। নাকি দুষ্টগ্রহের মতো ছিটকে পড়ে কোনো অন্ধকারচ্ছন্ন ছায়াপথে!

“রিমির জীবনে খুব অল্প সংখ্যক গল্প। তাই গল্পে দেখা যায় একই গল্প রিমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে, বান্ধবী শম্পা বা তার রুমমেটের গল্প বা অন্য কোনো নামে নিজেরই গল্প। যারা আসলে জানে না, তারা আসলে কী চেয়েছিল? গল্পের ভাষায় ‘আসলে এই সাধারণ রিমিদের গল্পগুলো প্রায় একই রকম। খুব একটা ভিন্নতা আছে তা বলা যায় না। মূলত, সব মন্দ মানুষের গল্পই এক। বলতে গেলে সব গরীবের গল্পও এক।”

এখানে গল্পের কথক, যার কাছে রিমি নিজের গল্প বলতে আসে, প্রায়ই নিজেই যায় রিমির কাছে। লেখকের গল্প বলার অসাধারণ নৈপুণ্য পাঠককে বিভ্রান্তিতে ফেলে দেয়, রিমি আসলে কার কাছে তার পুরোনো সাধারণ অস্তিত্বকে নগ্ন করে উল্টে-পাল্টে পুণঃপুণ নিরীক্ষণ করে। হয়ত বর্তমান বস্তুসুখে নিমজ্জিত রিমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আত্মবিশ্লেষণে মগ্ন হয় পুরোনো গরিব রিমির কাছে বা তারই মতো আরেকজন সাধারণ রিমির সামনে খুলে বসে তার অতি সাধারণ অসুন্দর অতীতের ডেবিট-ক্রেডিটের খেরোখাতা।

গল্পের শেষটায় এসে পাঠক হয়ত হতাশ হয় কাঙ্ক্ষিত কোনো চমক খুঁজে না পেয়ে। কিন্তু, এক সাধারণ রিমির নিজের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসবার আপ্রাণ প্রচেষ্টা ও টিকে থাকবার তুচ্ছ তুচ্ছ ঘটনাগুলোর নির্মোহ উলঙ্গ চিত্র পাঠককে মোহগ্রস্তের মতো টেনে নিয়ে যাবে গল্পের শেষ পর্যন্ত। গল্পের খাঁজে খাঁজে পাঠক হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকবে সাধারণের মাঝে লুকিয়ে থাকা অসাধারণ কোনো রিমিকে আবিষ্কারের আশায়।

গল্পকার নাহিদের গল্প বলবার মুন্সীয়ানা এখানেই। তিনি অত্যন্ত সহজ সাবলীল গল্পশৈলীতে অবলীলায় পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেন দৃশ্যত সাধারণ জীবনের স্বপ্ন-বাস্তবতার পরতে পরতে ঘাপটি মেরে থাকা অসাধারণ অসুন্দর নগ্নতার মাঝে। তখন হয়ত অবাক বিস্ময়ে পাঠক চোখ মেলে তার চারপাশে বিচরণ করতে থাকা সাধারণ রিমিদের নতুন দৃষ্টিতে দেখতে চায়। হয়ত সে দৃষ্টিতে খেলা করে গভীর মমতা, করুণা বা ঘৃণা।

এই গল্পের ন্যারেটিভ বা বর্ণনা এগিয়েছে কয়েকটি খণ্ড-ঘটনার মধ্য দিয়ে। এই ন্যারেটিভের যে বুনন, অর্থাৎ খণ্ড-ঘটনাগুলির এগিয়ে চলা তা আকর্ষণীয়। সেখানে অতীত-বর্তমানও মিশে গেছে।

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field