গদ্য

‘যে প্রেম মাঠে চরে, ঘাস খায়’| শিল্পী নাজনীন | গল্পপাঠ

Basic RGB

গল্প আমরা লিখি, গল্প আমরা পড়ি। কিন্তু অনেকসময় গল্পটি কেমন জানা হয় না। একসময় সেটি হারিয়ে যায়। কিন্তু তীরন্দাজ এভাবে কোনো গল্পকে আর হারিয়ে যেতে দিতে চায় না। আর সেই লক্ষ্যেই এই লেখাটি। রাবেয়া রব্বানীর ‘যে প্রেম মাঠে চরে, ঘাস খায়’ গল্পটি নিয়ে লিখেছেন শিল্পী নাজনীন। একটি গল্পের মধ্যে অনুস্যূত রক্ত-ক্লেদ-স্বেদ আমাদের স্নায়ুতে কীরকম কম্পন তোলে, সংবেদনশীল পাঠক নিশ্চয়ই সেটা অনুভব করতে পারেন। রাবেয়ার গল্পটি পড়ে সেই অনুভব ও ভাবনার কথাই বলবার জন্যে অনুরোধ করেছিলাম কৃতী গল্পকার শিল্পী নাজনীনকে। পড়ুন ছোট্ট কিন্তু তাৎপর্য়পূর্ণ লেখাটি। প্রতিটি সংখ্যাতেই আমাদের চেষ্টা থাকবে, প্রতিটি লেখা সম্পর্কে অভিজ্ঞ সৃষ্টিশীল পাঠকের মতামত প্রকাশের।
এই লেখাটি পড়বার আগে মূল গল্পটি নিচের লিংক থেকে পড়ে নিন

পড়লাম রায়েবা রব্বানীর গল্প ‘যে প্রেম মাঠে চড়ে, ঘাস খায়’। গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে লেখা গল্পটিতে বেশ চমক আছে। গল্পটি পাঠককে চমকে দেয়, ভাবায়। গল্পের চরিত্রগুলো নিজেদের মধ্যে যে বাক্যালাপ চালায় তাতে দেখা যায় তিনবন্ধু জয়া, ললিতা আর শম্পা প্রেমকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে চায়। ব্যাপারটা বেশ চমকপ্রদ মনে হয় পাঠকের কাছে। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ললিতা, যার কাছে প্রেম মূলত এক গরু, যে মাঠে চরে, ঘাস খায়। অন্যদিকে শম্পা চার্লস বুকোওস্কির উদ্ধৃতি দিয়ে বলে, প্রেম আসলে জাহান্নাম থেকে পালিয়ে আসা একটা কুকুর। কিন্তু জয়া বলে, ‘উঁহু, প্রেম একটা উড়ন্ত বট গাছ, শেকড় নেই শুধু ঝুড়ি নিয়ে উড়তে থাকে কিংবা মানি-প্লান্ট, ফুল ফল কিচ্ছু হয় না শুধু পাতার বাহাদুরি কিংবা ধরো, প্রেম আসলে কেবল একটা মস, মিহি আর দুর্বল।’ পরে তারা তিনজনই একমত হয় যে প্রেম আশলে একটি গরু!

গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ললিতা, যার কাছে প্রেম আদতে এক গরু। সে বলে, ‘প্রেম বীজের মতো বেঁচে থাকে একটা গোপন কবরে, লাল চপ্পলের মতো উলটো হয়ে পড়ে থাকে সেই কবরের পাশে, প্রেম ঘটে যাওয়ার পর থেকেই কবরে যাওয়া শুরু করে।’ তার এই ধারণার ওপর ভিত্তি করেই মূলত গল্পটি এগিয়ে যায় পরিণতির দিকে। গল্পে দেখা যায়, ললিতা তার দু’সন্তান, বর সুভাস আর ঘরের কাজে সাহায্যকারী বোয়ালীর মাকে নিয়ে আপাতসুখী একটি জীবনের খাঁজে আটকে আছে। কিন্তু এই আপাতসুখের আড়ালে আছে নানা হতাশা ও অপ্রাপ্তি যার কারণেই মূলত গল্পটির জন্ম এবং প্রেমের এমন অভিনব সংজ্ঞা খোঁজার প্রয়াস। গল্পে সাক্ষাৎ পাওয়া যায় ললিতার কল্পপ্রেমিক ইলিয়াদের, যে ললিতার বিপর্যস্ত সময়ে এসে হাজির হয় ললিতার পাশে, ললিতাকে আলিঙ্গন করে, চুমু খায়, তার সময়কে ভরে তোলে প্রেমের অমীয় বানীতে। ললিতা তাকে কল্পনা করে, একটি কবরে তাকে ইচ্ছেমতো শুইয়ে রাখে, ইচ্ছেমতো মাটি খুঁড়ে বের করে আনে এবং তার অবসন্ন, বিষণ্ণ সময়কে আনন্দময় করে তোলে। ললিতার এই যে কল্পনা, এটা মূলত মানবমনের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, মানুষ তার না পাওয়াকে নিয়ে হতাশ হয়, অপূর্ণতার বোধ তাকে ভারাক্রান্ত করে, আর তা থেকে উত্তরণের জন্য সে নেয় কল্পনার আশ্রয়। ললিতাকেও দেখা যায় তার শোয়ার ঘরের পাশের বাগানটিতে একটি কবরকে কল্পনা করতে, যার মধ্যে থাকা ইলিয়াদকে সে তুলে আনে তার অবসর মুহূর্তগুলোতে, তার সঙ্গে কাটায় একান্ত সময়। গল্পটি পড়তে গিয়ে প্রথমদিকে পাঠক বিভ্রা্ন্ত হয়, খেঁই হারিয়ে ফেলে, পরমুহূর্তে গল্পের ভেতরে প্রবেশ করে গল্পের মূল সুরটি আবিষ্কার করে চমকিত হয়, আন্দোলিত হয়। গল্পটি পাঠককে ভাবায়, নতুনতর আঙ্গিকে প্রেমকে সংজ্ঞায়িত করতে উদ্বুদ্ধ করে। গতানুগতিকতার বাইরে লেখা রূপকাশ্রিত গল্পটি পাঠকের ভালোলাগাকে ছুঁয়ে যায়।

যে প্রেম মাঠে চরে, ঘাস খায়, সেই প্রেম মূলত মানবজীবনের হতাশা ও অপ্রাপ্তি এবং মানবমনের স্বাভাবিক সুখটুকুকে সে খেয়ে যায় নিভৃতে। আর তাই গল্পে দেখা যায় বিভাসের বদলে যাওয়ার আভাসে ললিতা বিগত চৌদ্দদিন কবর খুঁড়ে তার প্রেমকে আর জাগায় না, এবং প্রার্থনা করে আগামী সাতদিনও যেন বিভাস এমনই প্রেমার্ত, সহনীয় থাকে তার প্রতি, তবেই সে কবর খুঁড়ে তার প্রেমকে জাগানোর অভ্যাস থেকে নিজেকে বিরত রাখতে সক্ষম হবে। গল্পটির বয়ানভঙ্গি ও ভাষা সহজ ও সাবলীল। ব্যবহৃত উপমাগুলোও দারুণ। খানিকটা পরাবাস্তবতার স্বাদে পরিবেশিত গল্পটি বোদ্ধা পাঠককে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হবে বলে মনে হয়।

শিল্পী নাজনীন

কথাসাহিত্যিক। জন্ম ১৪ জুলাই ১৯৮১, কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী থানায়। শৈশব, কৈশোর কেটেছে কুমারখালীর গোসাইডাঙ্গী গ্রামে। পড়াশোনা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। পেশা শিক্ষকতা। জাতীয় দৈনিক এবং দেশ-বিদেশের অনলাইন ম্যাগাজিনগুলোতে গল্প প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম উপন্যািস ‘ছিন্নডানার ফড়িঙ’ (২০১৬)। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : ‘আদম গন্দম ও অন্যাান্যদ’, ‘বিভ্রম’ এবং ‘মায়াফুল ও সাপের গল্প’। প্রকাশিত শিশুতোষ গ্রন্থ : ‘তোতন ও ফড়িঙরাজা’। দ্বিতীয় উপন্যাস ‘উলটপুরাণ’ প্রকাশিত হয়েছে ২০২৩ সালের বইমেলায়। ‘তীরন্দাজ’ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম সদস্য হিসেবে কাজ করছেন।

    Leave feedback about this

    • Rating

    PROS

    +
    Add Field

    CONS

    +
    Add Field